fbpx

নভেম্বর ২, ২০২৪

ডায়বেটিস, এর জটিলতা ও প্রতিকার

অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ফলে অর্থাৎ দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্নীক অবস্থার সামঞ্জস্যতা নষ্ট হওয়ার জন্য মানবদেহে রোগব্যাধি দেখা দেয়। শিশুকাল থেকেই রোগব্যাধি সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা থাকে না। উপরন্তু সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া নানা প্রকার ভ্রান্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের মনে নানা ধরণের যুক্তিহীন ধারণার জন্ম হয়। তাছাড়াও আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাতেও রোগব্যাধি ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক, সহজ ও আধুনিক ধারণার অনুশীলনের সুযোগ নেই। এসব কারণে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং আজন্ম লালিত সংস্কার ও ভ্রান্ত তথ্যের সাথে মনের মধ্যে বিরোধ বাঁধে। সুতরাং অনেক সময় আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা বোধ করেন অনেকেই। এর ফলস্রুতিই আমাদের রোগব্যাধি অনেক জটিল আকার ধারণ করে। তখন স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যায় এবং অনেক বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই রকমই একটি জটিল রোগ হল ডায়াবেটিস। এটি একটি সারাজীবনের রোগ। এই রোগে প্রতিবছর বহুলোক দৈহিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছেন, পরিবার হচ্ছে ধ্বংস আর সেই সাথে সমাজের অগ্রযাত্রা হচ্ছে ব্যাহত, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৮ কোটি লোকের ডায়াবেটিস আছে। আর এর শতকরা ৮০ ভাগ লোক বাস করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন (আইডিএফ)-এর পরিসংখ্যান মতে ২০০৪ সনে ডায়াবেটিসে মারা গেছে ৩৪ লক্ষ মানুষ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২০৩০ সনে মৃত্যুর ৭ম কারণ হবে ডায়াবেটিস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ২০০০ সনে ছিল ৩২ লক্ষের মতো আর ২০৩০ সালে তা দাঁড়াবে ১ কোটি ১৪ লক্ষের উপরে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে এবং সেই সাথে বাংলাদেশেও। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানিরা দেখেছেন যে, বেশি ওজন, শরীরচর্চার অভাব, দ্রুত নগরায়ন, অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, অলস জীবন-যাপন ও শিশু বয়সে খেলাধুলা না করা হলো এই রোগের মূল কারণ। অতএব ডায়াবেটিস কী ও কেমন, এত লক্ষণ ও সমস্যা কী এবং এর নিয়ন্ত্রণ কিভাবে করতে হবে, আমাদের তা জানা একান্ত প্রয়োজন। ডায়াবেটিস একটি বিপাকীয় অনিয়মজনিত ব্যাধি। সাধারণত আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি তার শর্করা জাতীয় অংশ পরিপাকের পরে সিংহভাগ গ্লুকোজ হিসাবে রক্তে প্রবেশ করে। আর দেহ কোষগুলো প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদনের জন্য গ্লুকোজ গ্রহণ করে। অধিকাংশ দেহকোষই এই গ্লুকোজ গ্রহণের জন্য ইনসুলিন নামক এক প্রকার হরমোনের উপর নির্ভরশীল। আর ডায়াবেটিস হল ইনসুলিনের সমস্যাজনিত একটি রোগ। ইনসুলিন কম বা অকার্যকর হওয়ার জন্য কোষে গ্লুকোজের ঘাটতি এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই সামগ্রিক অবস্থাই হচ্ছে ডায়াবেটিস মেলাইটাস। সাধারণত অভুক্ত অবস্থায় রক্তেত প্লাজমায় প্রতি লিটারে ৬.৭ মিলিমোল বা তার বেশি অথবা পূর্ণ বয়ষ্ক ব্যক্তিকে অভুক্ত অবস্থায় ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ানোর ২ ঘন্টা পর প্রতি লিটারে ১১.১ মিলিমোল বা তার বেশি হলে, তাকে ডায়াবেটিস রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডায়াবেটিস হলে যে সকল উপসর্গ দেখা দেয়।সেগুলো হলো:

  • খুব বেশি পিপাসা লাগা
  • ঘন ঘন প্রসাব হওয়া
  • বেশি ক্ষুধা পাওয়া
  • ক্লান্তি ও দুর্বলতা বোধ করা
  • ওজন কমে যাওয়া
  • ক্ষত শুকাতে বিলম্ব হওয়া
  • চোখে কম দেখা
  • খোস-পাঁচড়া, ফোড়া প্রভৃতি চর্মরোগ দেখা দেয়া

যে কেউ যে কোন বয়সে যে কোন সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে উল্লিখিত শ্রেণির লোকের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

  • যাদের বংশে, যেমন বাবা-মা বা রক্ত সম্পর্কিত নিকট আত্নীয়ের ডায়াবেটিস আছে
  • যাদের ওজন অনেক বেশি
  • যারা ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের কোনো কাজ করেন না
  • বহুদিন ধরে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করছেন এমন ব্যক্তি
  • যার বহুমূত্র পূর্ব শর্করা আধিক্য রয়েছে এমন ব্যক্তি

ডায়াবেটিস বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এখানে প্রধান তিন ধরনের ডায়াবেটিসের কথা বলা হলো।

১। ধরন ১ (টাইপ ২)
২। ধরন ২ (টাইপ ২)
৩। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস

ধরন ১: যে সকল ডায়াবেটিস রোগীর শরীরে ইনসুলিন একবারেই তৈরি হয় না, তারাই এই শ্রেণিভুক্ত। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিনই নিয়ম মেনে ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। সাধারণত ত্রিশ বছরের কম বয়সে এই রোগ ধরা পড়ে। অনেক সময় জন্মের সাথে সাথেই এই রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগীরা সাধারণত কৃশকায় হয়ে থাকে এবং এদের প্রসাবে এসিটোন থাকতে পারে। আমাদের দেশে ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগীর সংখ্যা খুবই কম। এদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পারিবারিক ইতিহাস থাকে না।

ধরন ২: এ সকল ডায়াবেটিস রোগীর শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয়, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয় অথবা নিজের শরীরের উৎপাদিত ইনসুলিনের কর্মক্ষতা কম বা নেই। ধরন ২ ডায়াবেটিস রোগীদের বয়স সাধারণত ত্রিশ বছরের উপরে হয়ে থাকে এবং অধিকাংশ সময় এই সকল রোগী স্থূলকায় হয়ে থাকে। এই ধরনের রোগের লক্ষণগুলো তেমন প্রকটভাবে দেখা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও ব্যায়ামের সাহায্য ছাড়া এদের চিকিৎসা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

গর্ভাকালীন ডায়াবেটিস: কোন কোন মহিলার সন্তান ধারনের সময় ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। আবার প্রসবের পর ডায়াবেটিস থাকে না। এই প্রকার জটিলতাকে গর্ভাকালীন ডায়াবেটিস বলা হয়। গর্ভবতী মহিলাদের ডায়াবেটিস হলে গর্ভবতী ভ্রুণ, প্রসূতি ও সদ্য-প্রসূত শিশু সকলের জন্যই বিপজ্জনক হতে পারে। বিপদ এড়াবার জন্য গর্ভকালীন অবস্থায় ডায়াবেটিসের প্রয়োজনে ইনসুলিনের মাধ্যমে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখা আবশ্যক। এদের প্রসব হাসপাতালে করানো বাঞ্ছনীয়। শুধু তাই নয়। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস থাকলে বা অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগজনিত জটিলতা দেখা দেয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে দীর্ঘস্থায়ীভাবে রক্তে শর্করার পরিমাণ ঊর্ধ্বমুখী থাকে বলে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত প্রবাহের বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং পর্যাপ্ত পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহে অসঙ্গতি হয়, তাছাড়াও স্নায়ুর কার্যক্রমের ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। ডায়াবেটিস হলে প্রায় সব স্থানই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অর্থাৎ ডায়াবেটিস রোগে যে সকল রোগজনিত জটিলতা দেখা যায় সেগুলো হলো :

১। চোখের রোগ|
২। বৃক্ক বা কিডনি রোগ
৩। স্নায়ু রোগ
৪। হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীর জটিলতা
৫। ত্বকের সমস্যা
৬। পায়ের বিভিন্ন ক্ষত
৭। অস্থি ও অস্থি সংযোগস্থলে ইত্যাদি

অতএব ডায়াবেটিস এবং এর রোগজনিত জটিলতা প্রতিরোধ করার জন্য  প্রত্যেক রোগীর প্রথমে প্রয়োজন  ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা। এছাড়াও প্রয়োজন পরিমিত সুষম খাবার গ্রহণ।  অর্থাৎ পরিমিতভাবে ভাত, রুটি,  মাছ, মাংস, ডিম,  দুধের  পাশাপাশি প্রচুর পরিমানে শাকসবজি,  মৌসুমি ফল -ফুলের তালিকায় প্রাধান্য দেওয়া। প্রতিদিন পরিশ্রম করা, নিয়মিত হাটা,চর্বিযুক্ত খাবার ও ‘ফাস্ট ফুড’ পরিহার করা এবং ডাক্তারের পরামর্শ মতো ঔষধ ও ইনসুলিন ব্যবহার করা।

এখনও যাদের ডায়াবেটিস হয়নি তাদের জন্য  প্রয়োজন দেহের ওজন  স্বাভাবিক রাখা  এবং আর যদি বেশি  ওজন হয় সেক্ষেত্রে ৫%-১০% ওজন কমিয়ে ফেলা। এছাড়াও প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট  হাটা যা ডায়াবেটিস  হওয়ার সম্ভাবনাকে বহুলাংশে কমিয়ে দেয়।

ডায়াবেটিস সম্পর্কে একটি সাধারণ অথচ মোটামুটি বিস্তারিত তথ্য সাধারণ মানুষেমানুষের বোধগম্যতার মতো করে তুলে  ধরার একটা  প্রচেষ্টা নেওয়া  হলো এখানে। যদি কেউ  এই লেখা থেকে রোগ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি জেনে সেভাবে নিজের কিংবা অন্যের রোগ সম্পর্কে সচেতন হন, তবেই এই লেখা সার্থক হবে। 

সিনিয়র রিসার্চ অফিসার | এপিডেমিওলজি এন্ড বায়োস্ট্যাটিস্টিক্স বিভাগ, বারডেম।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী
পরিসংখ্যান বিভাগ,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সেশন: ১৯৮৭-৮৮