জুন ১৮, ২০২৫

বলি – বই পড়ো

মানুষের মানবীয় গুনাবলীর বিকাশ ও চর্চা বই পড়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে, এ ছাড়া বই পড়ে কি হয় এ প্রশ্নের হাজারো জবাব রয়েছে। ছেলে বেলায় পড়েছিলাম একটি ইংরেজি ছড়া যার অর্থটা আজও মনে পড়ে – যত তুমি পড়ো তত তুমি জানো, যত তুমি জানো তত তুমি চৌকস হও, যত চৌকস হও তত দৃপ্ত হয় তোমার কন্ঠস্বর, আর তখন তোমার মন কথা বলে কিংবা পছন্দ করতে শেখে। জ্ঞানী মানুষের যে কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয় না। তাই জ্ঞান অর্জন করতে হলে বই-ই পড়তে হবে।

     দেশ, জাতি, সংস্কৃতি,সময় যে কোনো কিছু সম্পর্কে জানতে চাইলে বই-ই প্রধান মাধ্যম। বই পড়লে মানুষের নিজের মেধা বিকশিত হয়, তাই জাতির মেধা মজবুত হয় এবং জাতি মেধা ও মননে বিশ্বে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে। সেজন্য বই পড়তে হবে।

     বই আমরা কিনে পড়তে পারি বা লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়তে পারি।  বইয়ের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ সকল পরিবারে কিছু না কিছু থাকে, এর প্রসার যতটা করা উচিত ছিলো সময়ের বিবর্তনে ততটা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। তাই বলতে চাই যত রকমের লাইব্রেরি আছে আমরা তার মধ্যে সুবিধাজনক অবস্থানের কোনো লাইব্রেরির সদস্য হতে পারি এবং সেখানে গিয়ে অথবা সেখান থেকে বই এনে পড়তে পারি। এ রকম কয়েকটি লাইব্রেরির তথ্য দিয়ে বই পড়তে সহযোগিতা করার জন্য আমার এ ক্ষুণ্ণ প্রয়াস।

জাতীয় আর্কাইভস্ ও গ্রন্থাগার : বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগার হিসেবে এটির যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পর থেকেই। এখানে ১৯৬১ সাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য সকল দৈনিক, সাপ্তাহিক, আঞ্চলিক, বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা সংরক্ষিত আছে এবং থাকে। এ ছাড়া চিনা, জাপানি, ফার্সি, আরবি, উর্দু, হিন্দি ও কোরিয়ান ভাষার সাময়িকী ও জার্নাল রয়েছে। ষাটের দশকে পাকিস্তান জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৬৭ সালে ঢাকায় এর প্রাদেশিক সংগ্রহশালা খোলা হয়- এটিই পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। গ্রন্থাগারটি জাতীয় আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার  নামে পরিচিত। শুরুতে তিনটি পাঠকক্ষ পাঠকদের জন্য ব্যবহার করা হতো। একটি বাংলা, একটি ইংরেজি এবং সংবাদপত্রের জন্য একটি পাঠকক্ষ দিয়েই পাঠক সেবা শুরু করে এ গ্রন্থাগারটি।

      সমসাময়িক বিষয় ছাড়াও এখানে রয়েছে কিছু পুরানো ও দুর্লভ প্রকাশনা। রাজনীতি,  অর্থনীতি, পরিবেশ, কৃষি, চিকিৎসা, প্রকৌশল, মানবউন্নয়ন, শিল্পকলা, দর্শন, ধর্ম, ভাষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে অনেক প্রকাশনা রয়েছে জাতীয় গ্রন্থাগারে। এতে সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে গ্রন্থাগারটি। শুক্র ও শনিবারসহ অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকে।

কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার, ঢাকা: ঢাকার শাহবাগ এলাকায় জাতীয় জাদুঘরের পাশে এ গ্রন্থাগারটি অবস্থিত। এখানে পুরানো পত্রিকা সংরক্ষণ করা হয়। ১০,০৪০টি বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গ্রন্থাগারটি তার যাত্রা শুরু করে। ১৯৭৭ সালে বর্তমান অবস্থানে নতুন ভবনে এটি স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭৮ সালের ৬ জানুয়ারি নতুন ভবনে এই গ্রন্থাগারটির উদ্বোধন করা হয়। মূল গ্রন্থাগারটির সাথে একটি শিশু কিশোর গ্রন্থাগারও রয়েছে। মূল গ্রন্থাগারটি বেগম সুফিয়া কামাল জাতীয় গ্রন্থাগার নামে পরিচিত। এটি শুক্রবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সকাল ৮.০০টা থেকে রাত ৮.০০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। যেকোনো পাঠক এখানে যেতে পারে। এখান থেকে বই ধার নিয়েও পড়া যায়। গ্রন্থাগারটির ঠিকানা: ৩, লিয়াকত এভিনিউ, শাহবাগ, ঢাকা-১০০০। ফোন: ৮৫০০৮১৯, ওয়েবসাইট : http://www.centralpubliclibrarydhaka.org

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র: বইয়ের কদর বিশ্বজুড়ে, কিন্তু মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট আর স্যাটেলাইট বিনোদনের কারণে বর্তমান প্রজন্ম সাহিত্য সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। তবে আলোকিত মানুষ হতে হলে বই পড়তে হবে। – এ ধ্যান ধারণা থেকেই পাঠাগার কার্যক্রম শুরু এবং এর কালজয়ী স্লোগান “আলোকিত মানুষ চাই”। এ স্লোগানকে সামনে রেখে সম্মানিত অধ্যাপক জনাব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেবের উদ্যোগে ১৯৭৭ সালে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আলোকিত মানুষ পেতে হলে বই পড়ানোর চেয়ে ভালো কোনো উপায় নেই। এখানে সপ্তাহের বিভিন্ন দিন বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে মানুষের মেধা ও মনন বিকাশের উদ্দেশ্যে।  সপ্তাহের কোনো কোনো দিন হয়ে থাকে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। কোনো দিন সমকালীন বিষয়ের আলোচনা সভা হয়। এছাড়াও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একটি ভ্রাম্যমান পাঠাগার প্রকল্প আছে। এ প্রকল্পের অধীনে গাড়ি দিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন বই প্রেরণের কাজ করে থাকে এ সংগঠনটি। নির্দিষ্ট ফি এর মাধ্যমে সদস্য হলে নির্দিষ্ট দিনে বই নিয়ে পড়া যায়। সপ্তাহান্তে বই ফেরত দিয়ে আবার বই নেওয়া যায়। এদের মূল কার্যালয় ঢাকার বাংলামটর এলাকায়। দেশজুড়ে এর শাখা রয়েছে। ঠিকানা: ১৪, বাংলামটর, ঢাকা। ফোন: ৯৬৬০৮১২।

বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট লাইব্রেরি: সংক্ষেপে এই লাইব্রেরি পি আই বি নামে পরিচিত। এটি বিশেষ ধরনের একটি লাইব্রেরি। ১৯৭৬ সাল থেকে এর যাত্রা শুরু। এতে দুটি শাখা আছে – নিউজ পেপার আর্কাইভস্ এবং বই শাখা । সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট বই সহ অন্যান্য বিষয়ে প্রচুর বই এই লাইব্রেরির বই শাখায় আছে। দেশি বিদেশি ২৭টি পত্রিকা নিউজ পেপার আর্কাইভসে রাখা হয়। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ খবর ও প্রবন্ধের ওপর বিষয়ভিত্তিক ক্লিপিং ও সংরক্ষণ করা হয়। এ লাইব্রেরি সবার জন্য উন্মুক্ত। লাইব্রেরী এর ঠিকানা: ১৪, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, ঢাকা-১০০০। ফোন: ৯৬৬০৮১২, ওয়েবসাইট: http://www.bskbd.org/demo/index.php

বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি: বৃটিশ কাউন্সিল তার যাত্রা শুরু করে ১৯৩৪ সালে। ২২০ টি অফিসের মাধ্যমে বিশ্বের ১১০ টিরও বেশি দেশে এটি সেবা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে যতগুলি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি আছে তার মধ্যে বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি অন্যতম। ইংরেজি বই পড়া বা ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে লাইব্রেরির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ইংরেজি ভাষার ১২ হাজারেরও বেশি বই রয়েছে এখানে। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, ভাষা ইত্যাদি সম্বন্ধে বিভিন্ন ধরনের বইসহ বিভিন্ন জার্নাল পাওয়া যায় – এ লাইব্রেরিতে। বিভিন্ন ধরনের পত্র পত্রিকা, সিডি, ডিভিডি, অডিও সিডি এখানে পাওয়া যায়। আরও আছে সাইবার সেন্টার। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে এর সদস্য হওয়া যায়। যারা

সদস্য হন তারা বই এবং অন্যান্য জিনিস বাসায় নিতে পারেন। বৃটিশ কাউন্সিল শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এবং শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে । লাইব্রেরির ঠিকানা: ৫, ফুলার রোড, ঢাকা-১০০০। ফোন: ৮৬১৮৯০৫। ওয়েবসাইট: http://www.british.council.org/bangladesh

এশিয়াটিক সোসাইটি লাইব্রেরি: এক সঙ্গে ৯০ থেকে ১০০ জন পাঠক একত্রে বই পড়তে পারে এ রকম আয়োজন  নিয়ে পুরানো ঢাকায় এর অবস্থান। ১৫ থেকে ২০ হাজার বইয়ের সম্ভার নিয়ে এ লাইব্রেরি পাঠক সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও গবেষকদের প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করার উল্লেখযোগ্য উৎস হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় দৈনিক ও জার্নাল মিলে ৫০টি পত্রিকা রাখা হয় এখানে। সদস্য হওয়ার পদ্ধতি অন্যান্য লাইব্রেরি থেকে একটু আলাদা। এ লাইব্রেরিতে সদস্য হতে হলে প্রত্যেকের কমপক্ষে স্বরচিত দুইটি প্রকাশনা থাকতে হবে। সপ্তাহে প্রতিদিনই খোলা থাকে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকে। লাইব্রেরির ঠিকানা: নিমতলী ৫ নম্বর পুরান সেক্রেটারিয়েট রোড। (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের পাশে, আনন্দবাজার সংলগ্ন), ওয়েবসাইটঃ http://www.asiaticsociety.org.bd

আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ: এই লাইব্রেরি ঢাকার ধানমন্ডি, ২৬ নং মিরপুর রোডে অবস্থিত। এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫৯ সালে। এখানে যে সমস্ত বই আছে তার অধিকাংশই ফরাসি ভাষায় লেখা। বাংলা ও ইংরেজি ভাষার বই ও আছে এখানে। ফ্রান্সের ২৭টি ম্যাগাজিন, ৪টি জার্নাল, একশতেরও বেশি চলচ্চিত্র, আন্তর্জাতিক ও ফরাসি সঙ্গীত মিলিয়ে এখানে রয়েছে ৬০০ অ্যালবাম। ছয় হাজারের বেশি বই আছে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ-এ। বার্ষিক দুই হাজার টাকা দিয়ে এখানকার সদস্য হওয়া যায়। প্রতি বছর ছয় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ফ্রান্স ভাষা শিখে, আড়াই হাজারের বেশি মানুষ এখানকার ওয়ার্কশপে ও প্রদর্শনীতে আসে। এই লাইব্রেরি রবিবার বন্ধ থাকে। ঢাকাতে এই লাইব্রেরির তিনটি শাখা আছে। ফরাসি ভাষা শিক্ষা এবং এই ভাষার বই পড়ার ক্ষেত্রে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ এর ভূমিকা অন্যতম। লাইব্রেরিটির ফোনঃ ৯৬৭৫২৪৯ ও ওয়েবসাইট: http://www.afdhaka.org

উপরোল্লিখিত লাইব্রেরিগুলো ছাড়াও আরো কিছু লাইব্রেরি রয়েছে। যেমন, নীলক্ষেত ‘বেনবেইস’ অফিসে একটি লাইব্রেরি আছে। সেখানে বিভিন্ন তথ্যমূলক বই পাওয়া যায় পড়ার জন্য। যে কোন লাইব্রেরির সদস্য হয়ে বই পড়া যায় – এছাড়া ঢাকার কোন কোন এলাকা বই পড়ি হিসেবে পরিচিত। আছে যেখান থেকে বই কেনা যায়। এর মধ্যে চারুকলা ফুটপাত, কলাবাগান এবং সোবহানবাগ বই বাজার, জ্ঞানকোষ, বই বিচিত্রা, বিচিত্রা লাইব্রেরী, আজিজ সুপার মার্কেট, নীলক্ষেত, নিউ মার্কেটের একটা অংশ, বাংলা বাজার ইত্যাদি। কিছু কিছু বই পাড়া বিলুপ্তির পথে। কিছু কিছু বই পাড়া বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে যেমন স্টেডিয়াম মার্কেট ম্যারিয়েটা, গুলিস্তান ভবনের প্যারামাউন্ট। আরও বলা যায় তেজগাঁও রেলস্টেশনে যে বিপুল দেশি বিদেশি বই পাওয়া যেত তা আর এখন দেখা যায় না।

আশার কথা হ’ল যে, এই আধুনিক যুগে সব কিছুতে আধুনিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। কিছু কিছু বইয়ের চেইনশপ হচ্ছে সেখানে গিয়ে বই দেখে বই কেনা যায়। যেমন, শান্তিনগরে আছে পিবিএস। বাংলাদেশের প্রথম চেইন বুকশপ। শান্তিনগর, উত্তরা, ধানমন্ডি এই তিন জায়গায় এর অবস্থান রয়েছে। এর ফোনঃ ৯৩৪০৫৩০, মোবাইল: ০১৭৯০৩৩১১, ওয়েবসাইট: http://www.pbschain.com, ই-মেইল: [email protected]

প্রতি বছর বাংলা একাডেমিতে একুশে বই মেলা হয়, সেটা একটা বড় সুযোগ বই প্রেমীদের জন্য। বই পড়ার নিমিত্তে এ সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে। আমরা আশা করি, সাহিত্যপ্রেমী তথা বই প্রেমী যারা, তারা যে কোনো ভাবে বই সংগ্রহ করবে এবং বই পড়বে। সৃজনশীল মেধা বিকাশে বইয়ের ভূমিকা অন্যতম। বিশ্ব এখন সৃজনশীল মেধা কে স্বাগত জানাতে তৎপর। কাছেই বিশ্ব অগ্রগতির প্রচেষ্টায় শামিল হতে হলে বই পড়তে হবে সকলকে ।

তথ্য সূত্র: (i) ওয়েব সাইট (ii) মাসিক পত্রিকা “ক্যানভাস" ফেব্রুয়ারি ২০১২।
সিনিয়র শিক্ষিকা | মগবাজার গার্লস হাই স্কুল

প্রাক্তন শিক্ষার্থী
পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সেশন: ১৯৭৯-৮০

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp

আরও লেখা সমূহ