fbpx

স্বপ্নের মৃত্যু

শ্রাবণের শেষ। প্রায়ই আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা থাকে। আর সময়ে অসময়ে সেই মেঘলা আকাশ তার সবটুকু কালো মেঘ উজাড় করে দিয়ে অবিরাম ধারায় সিক্ত করে সবুজ-শ্যামল নিরীহ প্রকৃতিকে। বিরামহীন বর্ষণে তার যেন একটুও ক্লান্তি নেই। পাশ্চাত্যে এ ধরনের বৃষ্টির নাম দেয়া হয়েছে ‘কুকুর-বিড়াল’। আরেক ধরনের বৃষ্টি রয়েছে টিপ-টিপ করে ঝরে পড়ে সারাদিন, একেবারে স্মৃতিমগ্ন হয়ে বিষণ্নতায় ডুবে যাওয়ার মত বৃষ্টি। ছোটগল্পের ন্যায় এ বৃষ্টি যেন শেষ হয়েও হয় না শেষ। এদেশের পণ্ডিতেরা এর নাম দিয়েছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি।

কিছুদিনের বিরামহীন বর্ষণে প্রমত্ত করোতোয়া তার স্বরূপে ফিরে এসেছে। এখন সে ভরা যৌবনের উত্তাল নদী। এ নদীর তীরে হিমালয়কন্যাখ্যাত পঞ্চগড় জেলার সাঁকোয়া নামক গ্রাম। ‌গ্রামের নামকরণের পেছনেও রয়েছে রঙিন পটভূমি। নদী পেরিয়েই গ্রামে আসতে হয়। দু-চার গ্রাম পরেই ভারতের ছিটমহল। এখান থেকে শিলিগুঁড়ি মাইল দুয়েক দূরে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। নদীর উপর নড়বড়ে একটি সাঁকো, বাঁশের তৈরি সাঁকো। সাঁকোটি অনেক পুরনো। লুডুর ছক্কা যেমন কৌটার মধ্যে খট্ খট্ শব্দ করে সাঁকো পেরোনোর  সময় ঠিক তেমনি শব্দ হয়। তবে জনমানুষের কাছে এ নড়বড়ে সাঁকোটি যে কতটা গুরুত্ববহন করে তা গ্রামের নামকরণেই বোঝা যায়।

নদীর তীরেই ছোট্ট বাজার। বিস্তীর্ণ বালুকারাশি আর বাতাসে দোদুল্যমান কাশফুলের শুভ্রতার অপূর্ব মিতালী চোখে পড়ে নদীর ধারে। কাশবন এর পরেই সবুজ সমতল মাঠ। আমরা কতক উঠ্তিবয়সী ছেলে সেই কর্দমাক্ত মাঠে ফুটবল খেলছি। আমাদের খেলার নিয়ম-কানুনে রয়েছে অনেক ভিন্নতা। যেমন- অফসাইড নেই, কর্নার নেই। গোলপোস্টের পার্শ্বসীমা আছে, কিন্তু উচ্চসীমা নেই। তবে গোলকিপারের নাগালের বাইরে দিয়ে বল গেলে গোল হবে না। তাই দলের সবচেয়ে খাটো খেলোয়ার কে গোলপোস্টে দাঁড় করিয়ে দেই। আমরা ছয় জন, বিপক্ষ দলে সাতজন। দুজন করে জোড়াবদ্ধ হয়ে আসি। ‘ঘাস-না-মাটি’ এই পরীক্ষার মাধ্যমে দল নির্বাচিত হয়। প্রথমে আমরা চৌদ্দ জনই ছিলাম। মুকিত কেন জানি খেলছে না। অগত্যা ওর জোড়ায় যে ছিল তার এক হাতে ঘাস অন্য হাতে মাটি আনতে বলা হলো। আমি ‘ঘাস’ বলে এক হাত ধরে দেখি সে হাতে ঘাস নেই, রয়েছে মাটি। সপ্তম খেলোয়াড় ভাগ্যে জুটলো না। কিছুক্ষণ খেলতে না খেলতেই আছাড় খেয়ে ধপ্পাস্। ব্যথা পেয়েছি, তবু মুখে হাসি। ব্যথার কথা প্রকাশ করলেই কেল্লা ফতে। এমনিতেই একজনের যা ব্যঙ্গাত্মক হাসি। এমন পরিস্থিতিতে অগত্যা হাসতেই হয়। খেলা শেষ। সকলে কাঁদামাখা শরীরে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ফুটবল নিয়ে পানিতেও একটা মজার খেলা আছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না খেলাটির নাম। তবে এটিও অনেক মজার খেলা ছিলো। মুকিত সাঁকোর উপর নির্বিকার বসে আছে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম-

“তোর কী হয়েছে রে?”

“কিছু হয়নি তো! কেন?”

“খেলা ছেড়ে চলে গেলি। এখন আবার চুপচাপ বসে আছিস যে? বাড়িতে কি কোন সমস্যা হয়েছে?”

“আরে নাহ্। এমনি ভাল্লাগছে না।”

“আয় সাঁতার কাটি। সবাই মিলে পাল্লা দিবো কে আগে ওপারে পৌঁছাতে পারে।”

মুকিত আসলো না। আগের মতোই মনমরা হয়ে বসে রইল।

“ওর বউ মারা গেছে নাকি রে!”

কেউ একজন ব্যঙ্গ করল। সাথে সাথে হাসির রোল পড়ে গেল।

“ওর আবার বউ কোথায় পেলি! ও তো আদার্স।” এভাবেই ওকে নিয়ে আমরা মজা করছি। অন্যকে নিয়ে মজা করাটাই যেন আমাদের জন্য ফরযে আইন। এরই মধ্যে সাঁতারের চ্যাম্পিয়নশিপ হয়ে গেল। বরাবরের ন্যায় আমি সকলের পিছনে। 

আমাদের গ্রামটি একটি নিভৃত, অবহেলিত পল্লী। তবে আশার বিষয় হলো আমরা অনেকেই পড়াশোনা করছি। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের কচি হাতগুলো ধরেই গ্রামের উন্নতির স্বপ্ন দেখে এখানকার দৃষ্টিহীন চোখগুলো। তাঁদের স্বপ্ন দেখানো শিখিয়েছেন যিনি তিনি আমাদের সকলের প্রিয় মতিন স্যার, মুকিতের বাবা। হাইস্কুলে আমাদের অনেক যত্ন করে পড়াতেন। অসুস্থতার কারণে ইদানিং স্কুলে কম যেতে পারেন। তার কিডনির সমস্যা। এস.এস.সি পাশ করে মুকিত আর আমি বিভাগীয় শহরে পড়তে গিয়েছি। সরকারি কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে আমরা এখন ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছি। ছোটবেলা থেকেই আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন।

ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। মুকিতের রেজাল্টও অনেক ভালো হবে। ও কলেজে প্রথম দশজনের মধ্যেই থাকতো। ওর বাবা চায় ছেলে ডাক্তার হোক। মস্ত বড় ডাক্তার।

কাশবনের পাশ দিয়ে মেঠো পথ। মুকিত আর আমি দু’জন বাড়ি ফিরছি। মুকিত আমার কাছে সবই বলে, কিছু লুকোয় না। হয়তো সবার সামনে বলতে দ্বিধাবোধ করছিলো। তাই এখন আবার জিজ্ঞেস করলাম,“কী হয়েছে রে?” ও বললো-

“শোন, মা ডাকছিলো। গিয়ে দেখি তরকারি কাটতে গিয়ে মা’র হাত কেটে গেছে।”

“অনেকটা কেটেছে না কি?”

“নাহ। খুব বেশি কাটে নি। অল্পই কেটেছে।”

“তো এটা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছিস কেনো?”

“না, এটা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছি না, ভাবছি…।”

বাক্যটা অসম্পূর্ণ রেখেই মুকিত থেমে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো-

“আমি মা’র হাতে যত্ন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছিলাম। এ সময় বাবা যেন কোথা থেকে এলেন। রসিকতা করে বললেন – আজ মায়ের হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধছিস, একদিন অন্যদের হাতে শুধু ব্যান্ডেজই নয়, রীতিমতো শরীর কাটতে হবে, সেলাই করতে হবে, তখন যেন যত্নের ঘাটতি না পড়ে।”

মা আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন- “আমার ছেলে নিশ্চয়ই বড় ডাক্তার হবে। দো’আ করি বাবা তুই অনেক বড় ডাক্তার হ। বড় ডাক্তার হয়ে বাবার চিকিৎসা করবি তুই, কেমন?”

মুকিতের চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রুকণা আমার দীর্ঘদৃষ্টি ত্রুটিযুক্ত চোখকে ফাঁকি দিতে পারলো না। ও অনেক ভালো পরীক্ষাই দিয়েছে। গতকালই ফলাফল প্রকাশের কথা ছিলো। দেশের চলমান অস্থির পরিস্থিতির কারণে তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। আগামী পরশু ফলাফল প্রকাশ হবে। তবুও ওর চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রুর ব্যাখ্যা আমার অজানা নয়। মুকিত ডাক্তার হতে চায় না, বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওর ডাক্তারি পড়াতে। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছে না মুকিত। ছোটবেলা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন ওর। মনে আছে ক্লাস এইটে থাকতে একাডেমিক সুপারভাইজার জিজ্ঞেস করেছিলো ওকে –“বড় হয়ে কী পড়তে চাও?”

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই।” তড়িৎ জবাব ছিলো ওর।

কিন্তু বাবা-মার কাছে নিজের ইচ্ছার কথা বলতে পারছে না ও। বাবা-মার আশা-স্বপ্নের জ্বলন্ত প্রদীপে ওর ইচ্ছা নামক পর্দার আড়ালে আলোকময় সম্পর্কের ঘরটিও হয়তো কালো আঁধারে ভরে যেতে পারে। কোনো সম্ভানাকেই তো উড়িয়ে দেয়া যায় না। কন্টিনিউয়াস ফাংশন এর পয়েন্ট প্রব্যাবিলিটি শুন্য হতে পারে শুধু বইয়ের পাতায়, স্যারের ক্লাসে। জীবন নামক অবিচ্ছিন্ন ফাংশনে কোন কিছুরই মুহূর্তময় সম্ভাবনা শুন্য নয়, শুন্য হতে পারে না। 

দু’দিনের অপেক্ষার পর আজ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। মুকিত ও আমি দু’জনেই সোনায় মোড়ানো জিপিএ পাঁচ পেয়েছি। মতিন স্যারের আশীর্বাদ নিতে গেলাম। স্যার চিরচেনা সেই পুরোনো ভঙ্গিতে বললেন- “তুই বাংলায় অনেক ভালো। বাংলা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বি। তুই না ম্যাজিস্ট্রেট হতে চাস! ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে বঙ্কিম সাহেবের মতো বাংলা সাহিত্যের চর্চা করবি। জানিস তো উনি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন?”

“জ্বী স্যার।”

আমি ‘ক’ ইউনিটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ছোটবেলায় আমারও স্বপ্ন ছিলো বাংলা নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। কলেজে গিয়ে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। এখানেই স্বপ্নের বাঁক, জীবনের বাঁক নতুন পথে চলতে শুরু করেছে। অন্যান্য সব বিজ্ঞানের ছাত্রের মত আমিও বাংলার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পদার্থ, রসায়ন আর গণিত নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছি। ইদানিং প্রকৌশলী হওয়ার ভূতও মাথায় চাপতে শুরু করেছে। স্যারকে আমি আমার বর্তমান সময়ের লক্ষ্যের কথা আর বললাম না। পাছে উনি কষ্ট পান।

আন্টি আমাদের খেতে ডাকলেন। আন্টি না খেয়ে আসতেই দেবেন না। অগত্যা খেতে বসলাম। মুকিত আর আমি পাশাপাশি বসা। স্যার আন্টিকে ডেকে বললেন, “শোন শাহানা, ওদের দু’জনকে যত্ন করে খাওয়াও। দু’জনকে দুটো মাছের মাথা দাও। ওরাই তো আমাদের স্বপ্ন, আমদের গর্ব। তোমার ছেলে শুধু ডাক্তারই হবে না, সে হবে সবচেয়ে ভালো ডাক্তারদের একজন। যাও কথা দিলাম, তোমাকে আর নাম ধরে ডাকব না। ‘ডাক্তারের মা’ বলে ডাকব। গ্রামের মানুষকেও বলে দেবো যেন ‘ডাক্তারের মা’ বলে ডাকে।” স্যার হাসছেন।

আন্টি মুচকি হেসে বললেন, “তোমায় কিন্তু কেউই ‘ডাক্তারের বাবা’ বলে ডাকবে না। আগের মতোই ‘মতিন স্যার’ নামে ডাকবে।”   

আমি মুকিতের দিকে তাকালাম। ও গম্ভীরভাবে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় আমরা বেশ সহজেই উত্তীর্ণ হলাম। আমি ‘ঘ’ ইউনিটেও ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম। মতিন স্যারের আশা হয়তো বা পূরণ করতে পারতাম, বাংলা নিয়ে পড়ে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে বাংলা সাহিত্যের চর্চা করতাম। অভিজ্ঞদের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত ঠাঁই হলো বিজ্ঞান অনুষদে। কাকতালীয়ভাবে আমরা দুজনই ভর্তি হলাম পরিসংখ্যান বিভাগে। 

মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার তখনো কিছুদিন বাকি। মুকিত অবশ্য শেষ পর্যন্ত মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিলো না। বাড়িতে জানালো, “পরীক্ষা তো ভালোই হয়েছিলো, চান্স যে কেন হলো না!” আস্থাশীল পিতামাতা তাই বিশ্বাস করেছেন। এ তো অসম্ভব কিছু না। তাঁদের আস্থার যে অবমূল্যায়ন করা হতে পারে ঘুণাক্ষরেও হয়তো বা তাঁরা ভাবেন নি এ কথা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুকিত আর আমি দুই বন্ধু নতুন জীবন শুরু করলাম। দু’জনই হলে থাকি। গণরুমে পাশাপাশি ঘুমাই। পড়াশুনা করি না বললেই চলে। ইনকোর্স পরীক্ষার আগের রাতে পড়ে যা হয়! আমি যা-ও একটু পড়ালেখা করি মুকিতের তা-ও হচ্ছে না ইদানিং। হঠাৎ করেই মতিন স্যারের অসুস্থতাও বেড়ে গেছে। স্যারের চিকিৎসার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। প্রবাবিলিটি কোর্সের একটি পরীক্ষাও ইতিমধ্যে বাদ পড়েছে মুকিতের। ক্লাসগুলোও ঠিকমতো করতে পারছে না। ভ্যারিয়েন্স, মোমেন্ট, রিগ্রেসন কোন কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর। তবু চেষ্টা করছে। যেটুকু বুঝতে পারছে সেটুকু দিয়েই পরের ইনকোর্সের সাঁকো-টি পার হতে চাচ্ছে এখন।

এদিকে মতিন স্যার কেমন করে যেন ছেলের মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা না দেয়ার কথাটা জেনে গেছেন। ছেলের এহেন আচরণে প্রচণ্ড রকম আঘাত পেয়েছেন স্যার। মুকিতের ওপর প্রচণ্ড রেগে আছেন তিনি। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বাড়িতে গেলাম আমি; মুকিত গেলো না। মুকিতের কথা, বাবার সামনে কীভাবে দাঁড়াবে গিয়ে! কত দিন হয় বাসা থেকে ওকে কেউ একটিবারের জন্য ফোন করে নি। 

বাড়ি যাওয়ার জন্য আমিও ওকে আর জোর করলাম না। এদিকে স্যারের অসুস্থতা বেড়ে গেছে শুনে দেখতে গেলাম স্যারকে মুকিতদের বাসায়। ভদ্রতার খাতিরে যা না বললেই নয়, এমন কথা ছাড়া আর একটি কথাও স্যার বললেন না আমার সাথে। স্যারের সামনে বসে থাকতেই অস্বস্তি লাগছিলো। আন্টি ডাকলেন। বললেন, “তোমার স্যার অনেক রাগ করেছেন। দেখছোই তো কেমন অসুস্থ! তোমার বন্ধুকে নিয়ে আসলে না কেন? এতো সব কাণ্ড ঘটিয়ে বাবার অসুস্থতা জেনেও ছুটিতে ঢাকায় বসে আছে!” আমি আন্টিকে সমস্ত ব্যাপারটা খোলাসা করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আন্টির ক্ষোভ কমলো বলে মনে হলো না।

ছুটি শেষে হলে ফিরলাম। প্রতিদিনের মতো এক সন্ধ্যায় কার্জন হলের প্রাঙ্গণে আড্ডা দিচ্ছি। মুকিতের বাসা থেকে ফোন এলো এ সময়। মতিন স্যার অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ফোনটা পেয়ে মুকিতের চেহারাটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বুঝতে পারছিলাম বাবার জন্য মন খারাপ লাগছে কিন্তু বাড়িতে গিয়ে বাবার সামনে দাঁড়ানোর সাহসও পাচ্ছে না। ওকে আলাদা ডেকে নিয়ে বুঝিয়ে বললাম যে, “যত যাই হোক স্যার তো আর তোর উপর রাগ করে থাকতে পারেন না। তোর উচিত এ সময় স্যারের পাশে থাকা। তুই পাশে থাকলে হয়তো স্যারের রাগও পড়ে আসবে।” আমার কথাতেই হোক কিংবা বাবার জন্য মন খারাপের কারণেই হোক সে রাতেই মুকিত বাড়ি চলে গেলো। 

বাড়ি চলে যাওয়ার পরও প্রতি দিনই খোঁজ খবর নিই মুকিতের, সাথে স্যারেরও। শুনলাম স্যারের সামনে যাওয়ার সাহস এখনো জোগাতে পারেনি মনে। স্যার ঘুমিয়ে পড়লে যত্ন নেয় উনার। জেগে থাকলে আড়ালে আড়ালে থাকে। বাবার কাছে সমস্ত ব্যাপারটার জন্য মাফ চেয়ে নেবে ঠিক করেও তা করতে পারে না। ফোনে ওকে অনেক বোঝালাম, “সাহস করে সামনে যা, সব খুলে বলে ক্ষমা চেয়ে নে৷ উনার যদি কিছু একটা হয়ে যায়!” এর মধ্যে একদিন রাতে ওর সাথে অনেক কথা হলো। কীভাবে বাবার কাছে বিষয়টি বললে সর্বোচ্চ আউটপুট পাওয়া যাবে সেই ফাংশনের ম্যাক্সিমাইজেশন করতে লাগলো। কপালে যাই থাক পরদিন সকালেই বাবাকে সব খুলে বলে মনের ক্ষত মুছে ফেলবে প্রতিজ্ঞা করে ঘুমাতে গেল।

পরদিন খুব সকালে মা’র আর্তচিৎকারে ঘুম ভাঙলো মুকিতের। মনের ক্ষতকে মুছে ফেলার কোনো সুযোগ না দিয়েই ক্ষতটাকে আরও গভীর করতেই হয়তো মতিন স্যার ভোরের আলো ফোটার আগেই সব অভিমান সাঙ্গ করে বিদায় নিলেন চিরদিনের জন্য। খবরটা শুনেই ছুটে গেলাম বাড়িতে। কী বলে মুকিতকে স্বান্ত্বনা দেব বুঝতে পারছিলাম না। অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় একেবারে পাথর হয়ে গেছে ও। আমার প্রিয় স্যারের চলে যাওয়া আমার মনকেও ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। শৈশবে ঐ আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখানোর কারিগর আজ আর নেই। 

মুকিতের জন্যই বেশ কিছুদিন বাড়িতে থেকে গেলাম। বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ওকে নিয়েই ফিরে আসলাম। ও আসতে চাচ্ছিলো না। কী কারণে যেন সবকিছুর জন্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটাকেই দায়ী করতে লাগলো মন থেকে। ওকে বোঝালাম, “কী আর করবি। স্যার তো নেই, কিন্তু স্যারের স্বপ্ন পূরণের দিন তো রয়েছে। ভালো করে পড়ালেখা কর”। স্যারের স্বপ্ন পূরণ করতেই হয়তো ও মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

বিভাগের পড়ালেখা বাদ দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির পড়ালেখা বাড়িয়ে দিলো মুকিত। ইদানীং বেশিরভাগ সময়ই থাকে হলের পাঠকক্ষে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে ও। ডাক্তার হওয়ার শেষ সুযোগটা নিতে চায় ও৷ ডাক্তার ওকে হতেই হবে। আজকাল পাঠকক্ষে ওকে পাওয়া যাচ্ছে না, এমন খুব কমই ঘটছে। সবকিছু থেকেই ও নিজেকে কেমন যেন খোলসবদ্ধ করে ফেলেছে। সবুজ পাতা ভরা বৃক্ষের হঠাৎ রসহীন, পাতাহীন রুক্ষ চেহারা শুধু যে অনাকর্ষণীয় তাই নয়, এটা বৃক্ষের জীবনকেও অনাকাঙ্ক্ষিত আশঙ্কায় ফেলে দেয়। তিনতলার পাঠকক্ষ হতে নিচতলায় খেতে আসাটাও এখন নিয়মিতভাবে অনিয়মিত হয়ে উঠছে মুকিতের জন্য। বলা যায় না হয়তো সময় বাঁচানোর উপায় এটা। যার স্বপ্ন পূরণের জন্য আজ এতো সময় বাঁচানো তারই সময় হলো না এই কঠোর পরিশ্রম দেখে যাওয়ার। এটাই হয়তো অদৃষ্ট! ওর পড়ালেখার ধরনই বলছে স্যারের স্বপ্ন পূরণ না হয়ে যায়ই না।

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার দিন এসে গেলো। সারারাত পড়ে সকালে পরীক্ষার আগে আগে রুমে আসলো মুকিত। আমি একটু বাইরে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। রুমের বাকি সবাই ঘুমাচ্ছে তখনও৷ ছুটির দিন বলে সবাই যেন প্রাণভরে ঘুমানোর অপপ্রয়াস পেয়েছে। সারা সপ্তাহের ঘুম যেন সুদে-আসলে তুলে নিবে। ও কাউকে আর ডাকলো না, দ্রুত প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়লো। 

এদিকে বৃষ্টির বাঁধায় আটকা পড়ে গেলাম। বাইরে বের হওয়া হলো না৷ গণরুমে জটলা করে বসে টুয়েন্টি-নাইন খেলছি। একদিকে নিক্সন, আরিফ, সজল আর আমি। অন্যদিকে আরেক জায়গায় জটলা করে খেলছে হুমায়ুন, জাবের, নাঈম আর সাদিক। জাহিদ ছেলেটা খেলতে পারে না। হা করে আমাদের খেলা দেখেই সে বেশি তৃপ্তি পায় বলে মনে হয়। পাশেই ছোটবেলা থেকে লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বাঁশি বাজানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে হেলাল। বাঁশির করুণ সুরের সাথে সাথে বেসুরো গলায় গান ধরেছে ইমরান। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে কাকভেজা হয়ে মুকিত ফিরলো। ওর পরীক্ষা অনেক ভালো হয়েছে। পরীক্ষা দিয়ে ও সন্তুষ্ট, তবে কিছুটা বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে। ভিজে ভিজে যেতে হয়েছে। উপস্থিত হতেও কিছুটা দেরি! তবে ওর পরীক্ষা মন মতোই হয়েছে। আর কেনই বা হবে না? স্বপ্ন পূরণের প্রতীজ্ঞা বলে কথা!

পড়ালেখার চাপের সাথে বৃষ্টিতে ভেজার ফলে গত চারদিন ধরে মুকিত অসুস্থ। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে সেবা নিয়েও কাজ হচ্ছে না। এ শরীর নিয়েই বাড়ি যেতে চাচ্ছে। এরকম শরীর নিয়ে বাড়িই বা কীভাবে যায়! আমারও আবার পরীক্ষা সামনে। ওকে নিয়ে বাড়ি যেতে পারছি না। ওর পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত আসাদগেট হতে গাড়িতে উঠিয়ে দিলাম। ঈদ ছাড়া অন্যান্য সময় বাড়ি যাওয়ার টিকিটের কোনো সমস্যা অবশ্য হয় না। সারারাত বেচারা অসুস্থ শরীর নিয়ে কীভাবে যে গাড়িতে যাবে!

পরদিন সকালে ক্লাস দেরিতে। অ্যালার্ম না দিয়েই ঘুমাতে গেলাম৷ খুব সকালে বালিশের নিচে ফোনের উপর্যুপরি কম্পনে ঘুম ভাঙলো। নিতান্ত অনাগ্রহ আর বিরক্তির সাথে কল রিসিভ করলাম। এক মিনিটের মতো কথা হলো। এক মিনিটের কথাতেই ঘুম ছুটে গেল চোখ থেকে। হতভম্বের মতো আমি বিছানায় বসে রইলাম। রুমের সবাই মোষের মত ঘুমাচ্ছে। কাউকে ডাক দেওয়ার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। বুকে কেউ যেন দুই টন ওজনের পাথর চাপা দিয়েছে।

ঘণ্টাখানেক পরে কয়েকজন মিলে রংপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মেডিকেল মোড়ে নেমেই দৌড় দিয়ে গেলাম যেখানে মুকিতকে রাখা হয়েছে। ভিতরে প্রবেশ করতে দিলো না। অপেক্ষা করছি… কখন ওকে ছাড়বে, ওর মায়ের কাছে নিয়ে যাবো।

হঠাৎ বৃষ্টি এলো। কাছেই চায়ের দোকানে যাবো তাও ইচ্ছে করছে না। সবাই দোকানে আশ্রয় নিচ্ছে। অগত্যা আমাকেও যেতে হলো। টিভিতে ছাত্রসমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ দেখানো হচ্ছে। সবাই আগ্রহ নিয়ে দেখছে। টিভির পর্দার নিচে সংবাদ শিরোনামে জানা সংবাদটিতেই আবারও চোখ পড়লো- “রংপুরের মডার্ন মোড়ে বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে ঢাবি ছাত্রসহ তিন জনের মৃত্যু”। আমি ভাবছি ওর মায়ের কাছে ওকে কী করে হাজির করবো! আগামীকাল মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবে। ওর মা’কে কি কেউ ‘ডাক্তারের মা’ বলে ডাকবে? আর ভাবতে পারছি না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখ বন্ধ করলাম। আমার চোখে ভেসে উঠছে গণরুমের দরজার কপাটে মুকিতের হাতে লেখা ছত্রটুকু-

কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই গণরুমে
কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়,
কতজন এলো, গেলো কতজন আসবে
গণরুমটা শুধু থেকে যায়।

হাসিব আল ফারাজি

সেশন:- ২০১৩-১৪