সপ্তম শ্রেণি।
শৈশব থেকে কৈশোরে পা দেয়ার বয়স। বড় হবার যাত্রা শুরু। বড় হয়ে যাচ্ছি এই বোধটাই যেন দুনিয়াটা রঙ্গিন করে তুলছে। বড়দের মতো কথা বলা, বড়দের মতো ভঙ্গিমায় চাল-চলন অভ্যাস করা, বড়দের মতো চুল আঁচড়ানো, বড়দের মতো ভাব ভঙ্গিমা রপ্ত করাই যেন আমাদের ছোটদের মূল কাজ এখন। প্রাইমারি পাশ করে আরো এক বছর পর দ্বিতীয় বছরে এখন, বড়ই তো আমরা- এমনই মনোভাব নিয়ে চলাফেরা আমাদের।
আমাদের ক্লাসের রোল এক, নাম তমা। দুর্দান্ত ছাত্রী। কচুরীপানা থেকে শুরু করে গাঙ্গচিল পর্যন্ত শব্দের ইংরেজি পর্যন্ত বলে দিতে পারে। তের কিংবা সতের যে ঘরের নামতাই জিজ্ঞেস করা হোক না কেন একেবারে ঠোটস্থ। বিজ্ঞানের পদার্থ বা অপদার্থ যাই হোক না কেন তার সঙ্গা-প্রকারভেদ তার নখদর্পনে। ফলে শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্রীও সে। তমা শুধু মেধায় নয়, রুপেও সেরা। শ্যামলা মেয়ে, চোখ দুটো মায়াকাড়া যেন গভীর কালো জলে টইটুম্বুর দিঘী। পৃথিবীর খুব মানুষের চোখেই ডুব দেওয়া যায়, এই মেয়ে সে ক’জনের মধ্যে একজন। মেয়েটি রঙ্গিন ফিতা দিয়ে মাথায় ঝুটি বেঁধে আসে প্রতিদিন, আর কিছুক্ষণ পর পর সেই ঝুটি দোলায়। দেখতে বড় ভালো লাগে।
ক্লাসের ছেলেরা সবাই নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই কৃষ্ণ-নয়না মেয়ের দিকে তাকিয়ে। ফার্স্ট বেঞ্চে বসা তমার পেছনের সিটে কে বসবে তা নিয়ে প্রতিদিন রীতিমত একটা ছোটখাটো যুদ্ধ হয়ে যায় নিলয়, রিপন আর সাকিবের মধ্যে। হুম, পিছনের সিটে। কারণ তমার পাশের সিটটা যে আমার, রোল নং দুই। আর সে সুবাদে আমরা দু’জন ক্লাস ক্যাপ্টেন, বসিও পাশাপাশি। তমার পাশের সিটটাতে বসার সৌভাগ্যে কিছুটা অহংকারবোধও হয় আমার। এ জন্য অবশ্য বন্ধু নিলয়, রিপন আর সাকিব হিংসাও করে আমাকে। সেটা আমি উপভোগও করি। তমার পাশে বসে তমাকে নিজের করে পাওয়ার বাসনাও মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে থাকে।
তমার পাশের সিটটা আমার হলেও তমাকে পাওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে নিলয়। কারণ তমা আর নিলয়ের বাসা কাছাকাছি। গোপন সূত্রে পাওয়া খবরে আমরা জানতে পেরেছি, নিলয় তমাকে একটা ফুলগাছ উপহার দিয়েছে। মানুষ ভালবেসে ফুল উপহার দেয়, কিন্তু নিলয় একেবারে গোটা গাছ কেন উপহার দিলো? সে ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকছে না। আমি নিলয়কে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। সে হাই তুলতে তুলতে গম্ভীর মুখে উত্তর দিলো, তুই এসব বুঝবি না।
হুম, আমি আসলেই এসব বুঝি না। আমি শুধু বুঝি, তমাকে আমার প্রয়োজন, বড় বেশি প্রয়োজন।
কিছুদিনের মাঝেই নিলয়ের দেওয়া সেই ফুলগাছে ফুল ফুটলো। নিলয় খুশি, তমাও খুশি, আমিও খুশি। আজকাল তমাকে দেখলে নিলয়ের মুখে কথার খই ফুটে যেন পপকর্ন হয়, আর আমার মুখে মিসাইল মারলেও কথা বের হয় না। ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে প্রতিদিন কমনরুম থেকে খাতা নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়ে তমার আর আমার কাঁধে। দু’জন মিলে খাতা বয়ে আনি। তমা তার রঙিন ফিতা দিয়ে বাঁধা ঝুটি দোলাতে দোলাতে খাতা নিয়ে আসে, মাঝে মাঝে আমি সেই চুলের ঘ্রাণ পাই। একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম, তমা আমি কি তোমার ঝুটি দুটো ধরতে পারি। তমা মুখ বাকিয়ে বললো, না, পারো না। মাঝে মাঝে তমা আমাকে জিজ্ঞেস করে, এই শোন না, আমি না পড়াটা বুঝছি না। একটু বুঝিয়ে দেবে? আমি চুইংগাম চাবাতে চাবাতে ভাবলেশহীন মুখে বলি, যেদিন আমি ফার্স্ট হবো, সেদিন বুঝিয়ে দেবো। তার আগে না। তমা তার ঝুটি দুলিয়ে বলে, এতো হিংসুটে কেন তুমি? আমি মনে মনে বলি, আমি তোমার জন্য হিংসুটে হতে পারি, হতে পারি একগুচ্ছ নীল গোলাপ। তমা আমার মনের কথাগুলো কখনোই শুনতে পায় না।
আমি আজকাল ঘরে বসে বসে কাব্য রচনা করি আর বাংলা সিনেমা দেখি। একটা কবিতাও লিখে ফেলেছি। কবিতার নাম ‘তোমার রঙিন ঝুটির আড়ালে’। কবিতা পড়ে আমার নিজেরই হাসি পেলো। কবিতার কাগজটা ছিঁড়ে কুঁচিকুঁচি করে আকাশে উড়িয়ে দিলাম। তারপর বাংলা সিনেমা দেখার দিকে মনোনিবেশ করলাম। সিনেমায় নায়কের সাথে ধাক্কা খেয়ে নায়িকার হাত থেকে বই খাতা পড়ে যায়, অত:পর তাদের প্রেম হয়। আমিও স্বপ্ন দেখি, কোন একদিন আমারদের ধাক্কা লাগবে, প্রেম হবে। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝে বিশাল ব্যবধান।
নায়ক সিনেমার শেষে আইন নিজের হাতে তুলে না নিলেও আমি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। গায়ে পড়ে একদিন ধাক্কা খেলাম। ধাক্কা খেলাম না বলে বলা ভালো ধাক্কা দিলাম। তমার হাত থেকে খাতাও পড়লো। কিন্তু বিধি বাম, তমার পাশে বসে বাদাম খাওয়ার বদলে আমার স্থান হলো বারান্দার কোণায়। আমি কর্ণযুগলে হাত দিয়ে এক পা অভিকর্ষ বলের বিরুদ্ধে তুলে দাঁড়িয়ে আছি। তমা ক্লাসরুম থেকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, আর তার সেই ঝুটি দোলাচ্ছে।
আমি সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বাইরে খোলা আকাশের দিকে তাকালাম। নীল আকাশে কালো কাক চক্রাকারে উড়ছে। আকাশে মেঘ, বৃষ্টি আসি আসি করছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলাম। একটু পর চোখ খুলে দেখি, একি! তমা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাতে তার আলতো ছোঁয়া। আমি ভয়ে ভয়ে ক্লাসরুমের দিকে তাকাই। অবাক হয়ে দেখি, সেখানেও তমা বসে আছে।
কোনটা সত্যি? নাকি দুটোই মরীচিকা? যেটাই সত্যি হোক কিংবা কোনটাই সত্যি না হোক, আমার পাশে কার যেন অস্তিত্ব টের পাই। পরম মমতায় আমার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে কেউ একজন। তার কন্ঠ শোনা যায়, শুনছো? তুমির আমার ঝুটি ধরতে চাইলে ধরতে পারো। আমি তমার চোখের দিকে তাকিয়ে তার হাতটা ধরলাম। তমা খিলখিল করে হাসছে। মৃদু বাতাসে তার ঝুটি দোল খাচ্ছে। এই কয়েকটা মুহূর্তের জন্য তাকে কতটা সুন্দর দেখালো, তা সে কোনদিনও জানতে পারবে না।
এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত, তিন মুহূর্ত। শ্রাবণের আকাশে ঘন কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। চারিদিক অন্ধকার করে মেঘ গুড়ুগুড় শব্দে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। আমরা দুজন দাঁড়িয়ে আছি পাশাপাশি। বৃষ্টির ছাটে পিঠ ভিজে যাচ্ছে। তমা আলতো স্বরে বলছে, সরে এসো। ভিজে যাচ্ছি তো! আমি দুচোখ বন্ধ করে মনে মনে কল্পনা করছি, এই বালিকা যখন তরুণী হবে তখন সে দেখতে কেমন হবে? তার গালে কি টোল পড়বে? তার হাসি কি কাঁচভাঙা হাসি হয়ে কানে বাজবে? আচ্ছা, তার দুচোখ কি তখন চশমার আড়ালে মুখ লুকোবে? কিংবা তার রঙিন ফিতে দিয়ে বাঁধা ঝুটি দুটো যখন রুপ নেবে ঢেউ খেলানো চুলে, তখন তাকে কেমন দেখাবে? কল্পনা করতে ভালো লাগছে, আমি কল্পনা করছি।
বৃষ্টি শেষে হালকা রোদ উঠেছে আকাশে, তার ভিতর টিপটিপ বৃষ্টি। আমার পাশে দাঁড়ানো বিষাদমাখা চেহারার মেয়েটার দিকে আমি তাকিয়ে থাকি কয়েক মুহূর্ত। তমার গাল ভেজা, তবে তা কি বৃষ্টিজল না কি অশ্রুজল সেটি বোঝা যাচ্ছে না।
- This author does not have any more posts.