fbpx

মধ্যবিত্তের মধ্যচিত্ত

সারাদিনের ঝিরঝিরে বৃষ্টি থেমে গিয়ে গধুলীলগ্নে হিমেল হাওয়া বইছে। সেই স্নিগ্ধ বাতাসে বাড়ির ছাদে বসে এক ঝাঁক গাঢ় সবুজ রঙের টিয়ে পাখির উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে আনিসের সন্ধ্যেটাই কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেলো। এমন সময় একটু তন্দ্রা ভাবও হলো যেনো, সেই তালে ও ছন্দে একটু একটু করে সময়টা পিছনের দিকে বাঁক নিয়ে দূর অতীতে এসে স্থির হয়ে গেলো। স্মৃতি আনিসকে নিয়ে গেলো সেই কবেকার কোনো এক নিভৃত পল্লীর বাঁশ ঝাড়ে। পাখির কলকাকলি পেরিয়ে ঘন কালো মেঘে ঢাকা থমথমে এক সন্ধ্যায়। ঘন আম বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের পানিতে মাছ ধরায় ব্যস্ত সখের জেলে বাতেনের চোখ ফাঁকি দিয়ে; এ রকমই এক সন্ধ্যায় ঝুম্ বৃষ্টিতে ঘন সবুজ বাঁশবনের গহীনের যৌবনের প্রথম অনুরাগ ছুঁয়ে দিয়েছিলো তানিয়ার অধর, চিবুক ও ভরা যৌবনে। সে এক পরাবাস্তব অনুভূতি,যার সাথে তুলনা চলেনা এই জীবনে পাওয়া অন্য কোনো অভিজ্ঞতার।

সেই জ্বলন্ত ও সহজাত অভিজ্ঞতার সাথে শহুরে কপটতায় ভরপুর, কনক্রিটে মোড়ানো ব্যস্ত ও মেকী নাগরিক অভিজ্ঞতার তুলনা করে আনিসের মাঝে মাঝে হাসি পায়। কিন্ত হাসি পেলে কী হবে, এই তো আনিসের নিয়তি; তার জীবনের কঠিন বাস্তবতা। মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নে জ্বলন্ত স্মৃতির তাড়া খেয়ে আহত পাখির মতো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ঘুমের মাঝে পাশ ফিরে তানিয়াকে হাতরে বেড়ায় আনিস, কিন্তু তানিয়া কোথায়? চোখ কচলে পাশ ফিরে যাকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে সে তানিয়া নয়, সে ইসরাত। দুঃস্বপ্নজাত ভীতির আবেশেই হক কিংবা জৈবিক তাড়নাতেই হক ইসরাতকে সে সজোরে বুকে টেনে নেয়। স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমসুখে আনিস খুঁজে ফিরে তানিয়ার আদল; কিন্ত কখন যে তানিয়ারত মুখ অফিসের বসের মুখ হয়ে একটা সিস্টেমের আদলে রুপান্তরিত হয়, সে টেরও পায় না। ঘৃণায় কুঁচকে ওঠে তার সমস্ত মুখ, মনে এক ধরণের পাপবোধের জন্ম নেয়। কিন্তু তার বিবেক তো জানে সে কোনো অন্যায় করে নাই। তবুও কেনো এ পাপবোধ। এর উৎস কোথায়? তার চিন্তার কোন বিন্দুতে এর জন্ম?

এই যান্ত্রিক শহুরে জীবনে নিত্য দিনের টানাপড়েনে তার নিজের জন্য সময় কোথায়? সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে সিগারেটে দু’টান দিয়েছে তো অমনি বউয়ের চিৎকার চেচামেচি-

এখনো সে তৈরি হয় নাই কেন! তারপর আনিস বাচ্চাকে স্কুলে রেখে পলাশী হয়ে শহীদ মিনারে এসে একটু জিড়িয়ে নেয়। ছুটে চলা ব্যস্ত এই শহরে ব্যস্ততার যাঁতাকলে ক্লান্তিজনিত যে তন্দ্রা ভাব তা সকালের নির্মল হাওয়ার ছোঁয়ায় নিমিষেই কেটে যায়, নিজেকে সে আবিস্কার করে রাজপথে। স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে উঠে তার বিশ্ববিদ্যালয়কালীন তরুণ জীবনের কথা; মনে পরে যায় রাজপথে কত মিছিল,মিটিং ও বন্ধুদের কথা । কত বক্তৃতায় শুনেছে,”রাষ্ট্রযন্ত্র থাকলে, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থাকবেই, শ্রেণি থাকলে, শ্রেণি শোষণ থাকবেই, সিস্টেম থাকলে, সিস্টেম ভাঙ্গার কথা হবেই”। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কতবার বলেছে শোষণহীণ শ্রেনীহীণ সমাজের কথা; সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে কত কি-ই না করেছিলো সে। অথচ আজ সে নিজেই সিস্টেমের ও শোষণের মধ্যে কীভাবে আটকে গেছে। এখন রাষ্ট্রযন্ত্রের যাঁতাকলের তদারকি করে বেড়ায়। তার এক সময়কার আদর্শিক বান্ধবী বসের বউ হয়ে তার পাশ দিয়ে পাজেরো কিংবা বিএমডব্লিউ গাড়িতে চড়ে বেড়ায়। আথচ এ রকম তো হওয়ার ছিল না!

নিত্যদিন বসের ঝারিতে নিজের পাছায় চাবুক চাবকে দেয়ার অনুভূতি বোধ হয় আনিসের। ইচ্ছে করে লোকটার পশ্চাৎ দেশে একটা লাথি মেরে, তাকে সিস্টেম থেকে বের দেয় কিংবা এই ভয়ংকর,রুঢ় ও অমানিবিক সিস্টেমটিকে এক ঝটকায় Ctrl+Alt।+Del চেপে চিরতরে বিদায় করে দেয়। কিন্তু আনিস তা পারে না। অফিস শেষে দু’একদিন সে ছবির হাটের পাশ দিয়ে চারুকলায় ঢু মেরে যায়। রাস্তায় না খেয়ে পড়ে থাকাদের মডেল বানিয়ে ক্ষুধার শিল্পগুণ উদ্ধারের প্রগতিশীল প্রক্রিয়া অবলোকন করে বাড়ি ফিরে বউয়ের সঙ্গে একচোট উচ্চবাচ্য করে বেশ মর্মপীড়ায় ভোগে আনিস। এই যে চেতনার নির্লিপ্ততা, দ্বিধাহীন তা অবলীলায় ও নিঃশঙ্ক চিত্তে করতে না পারার মর্মপীড়া এর উৎস আসলে কী? এর উৎস কি অর্থনৈতিক কাঠামোতে না কি তার সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়ায়, না চিন্তায় ও মননে? আনিসের চিত্ত জাগেনা, সে শুধু জানে মধ্যবিত্তের ভয়, দ্বিধা, সঙ্কোচ ও সংকট নিয়েই তাকে প্রতিনিয়ত চলতে হয় । এই তার নিয়তি । বড়জোর বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাজারে দোকানদারদের সাথে চোটপাটই সে করতে পারে। এর বেশি কিছু করার সাহস বা ধৃষ্টতা বুঝি তার কোনো দিনই হয়ে উঠবে না ।

সেশন: ২০০৭ - ২০০৮

সাঈদ বিলাস

সেশন: ২০০৭ - ২০০৮