fbpx

সম্পাদকীয় জুলাই ২০১৫

দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, “খাঁটি গরুর দুধের চা। প্রতি কাপ ৬ টাকা। প্রোঃ আজমত আলি।”

বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছে পিয়াল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে সে, পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মৌলভীবাজারে বড় বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছে। সকালে বের হয়ে ঘন্টায় এক শ টাকা দরে রিকশা ভাড়া করে ঘুরতে ঘুরতে এই গ্রামে চলে এসেছে। দোকানটির কাছে এসে রিকশার চেইন ছিঁড়ে গেল। ভাড়া দেড় শ টাকা হয়েছিলো, লোকটি ঝামেলায় পড়েছে বলে তাকে দু শ টাকা দিয়েছে পিয়াল।

এত স্বাদের চা আগে কখনও খায়নি ও। মনে মনে ‘আর খাব না’ বলতে বলতে এই গরমের মধ্যে পাঁচ কাপ চা খেয়ে ফেলেছে।

আজমত আলি মহা উৎসাহে চা বানিয়ে দিচ্ছেন। পুরো এলাকায় খরা চলছে বলে তার ব্যবসাতেও খরা চলছে। এত গরমে কে চা খায়? এই মুহূর্তে পিয়ালই তার একমাত্র কাস্টোমার।

খরা চলছে পিয়ালের মনেও। মাস্টার্সে পড়ে ও, আজও প্রেম আসেনি জীবনে। ও ভালো মানুষ, বুদ্ধিমান, দেখতেও মন্দ নয়। কিন্তু, প্রেম একটি দৈব ঘটনা।

দূর থেকে একটি মিছিল আসতে দেখা গেল। প্রথমে মনে হলো বাচ্চাদের মিছিল, পরে দেখা গেল বেশ কয়েকজন তরুণীও রয়েছে পিছনে। সবার পরনে উৎসবের পোশাক। কী একটা গান গাইছে সবাই মিলে। আর একটু কাছে আসতেই গানের কথাগুলো বোঝা গেলঃ

বেঙা বেঙির বিয়া
পাটল মাথায় দিয়া
ও বেঙা মেঘ আনো, মেঘ আনো গিয়া
খালো নাই পানি
বিলো নাই পানি
ও বেঙা মেঘ আনো, মেঘ আনো গিয়া।

পঁচিশ-ত্রিশ জনের দলটি দোকানের কাছে এসে থেমে গেল। বছর দশেক বয়সের একটি মেয়ের হাতে কুলো, তাতে লতা-পাতার মধ্যে দুটি ব্যাঙ বেঁধে রাখা হয়েছে। একটু পর পর ব্যাঙ দুটির গায়ে পানি ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছে।

পিয়ালের দৃষ্টি আটকে আছে হলুদ শাড়ি পরা একজন তরুণীর দিকে। আর কোন কিছুই চোখে পড়ছে না ওর। ভাবছে, এমন একটা মেয়ের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্রাহ্মণ কোন দ্বিধা না করে মৌলভীবাজারের মৌলভী হয়ে যাবে।

জানা গেলো, তরুণীটির নাম লতা। একটি খালি কুলো তার হাতে দিয়ে পাশের মেয়েটি বললো, “লতা আপু, যাও।”

লতা এগিয়ে আসতেই আজমত আলি কিছু না বলে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট কুলোর মধ্যে রাখলেন।

“বিয়ে খেতে আসবেন তো, চাচা?” জানতে চাইলো লতা। ওর কথা শুনে পিয়ালের মনে হলো, কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সে।

“না মা, কাম আছে।”

পিয়ালের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যাবার জন্য ঘুরলো লতা। মনে হলো, অপরিচিত ছেলে বলে ওকে দাওয়াত দিবে না মেয়েটি। কিন্তু, হাজার বছরের বাঙালী ঐতিহ্য পিয়ালের সহায় হলো- এই গ্রামে আজ ও একজন অতিথি।

ঘাড় ঘুরিয়ে পিয়ালের দিকে তাকালো লতা। জানতে চাইলো, “আপনি কোন্ বাড়িতে এসেছেন?”

“কারও বাড়িতে নয়,” একটু হেসে বললো পিয়াল। “ঘুরতে ঘুরতে এদিকে চলে এসেছি।”

“ভালো দিনেই এসেছেন। আজ আমরা ব্যাঙের বিয়ে দিচ্ছি। জানেন বোধ হয়, বৃষ্টির জন্যে?”

“পত্র-পত্রিকায় দু একবার পড়েছি,” বললো পিয়াল। “কখনও চোখে দেখিনি।”

“আজ দেখার সুযোগ পাবেন। আপনার দাওয়াত রইলো। আয়োজনটা সবার, তবে, অনুষ্ঠানটা আমাদের বাড়িতে। দুপুরে চলে আসুন। ঐ যে দূরে পিয়াল গাছটা দেখছেন, ওখানেই আমাদের বাড়ি।”

পিয়াল গাছ চেনে না পিয়াল, কিন্তু ও তা বলতে গেলো না। বিয়ে বাড়ি চিনে নেয়া কঠিন হবে না।

“দাওয়াতের জন্য ধন্যবাদ। আমি যাবো। চাঁদা কত?” মানিব্যাগ বের করে জানতে চাইলো পিয়াল।

“চাঁদা তো চাল, ডাল টাকা- যার যা খুশি। তবে, আপনি মেহমান, আপনার কাছ থেকে চাঁদা নেবো না।”

পিয়াল বলতে চাইলো, “চাঁদকে চাঁদা দেবো না তো কাকে দেবো?” কিন্তু, সাহস পেলো না। একটা পাঁচ শ টাকার নোট কুলোর মধ্যে রাখতে গেলো, কিন্তু মেয়েটি কুলো সরিয়ে নিলো।

“বেশ,” বললো পিয়াল, “আমি আপনাদের জন্য মিষ্টি নিয়ে যাবো।”

“মিষ্টি নিতে হবে না। কাদের জন্য মিষ্টি নিবেন? আয়োজক তো সবাই।”

“সবার জন্যই মিষ্টি নিয়ে যাবো।”

“সবার জন্য?” কটাক্ষ করে বললো লতা। “লোক সংখ্যা কত জানেন? প্রায় আড়াই শ।”

এতক্ষণে পিয়াল খেয়াল করলো, মিছিলের পিছনে একটা ভ্যানে দুটি বড় ডেকচি রয়েছে। প্রত্যেক বাড়ি থেকে চাল-ডাল নিয়ে ডেকচিতে রাখা হচ্ছে। এলাহি কারবার!

পিয়ালের ফ্যামিলি স্বচ্ছল হলেও ধনী বলা যাবে না। কিন্তু, ও দমে যাবার পাত্র নয়। বিশেষ করে এই মেয়েটির সামনে আজ ও পিছু হটবে না।

“সবার জন্যই মিষ্টি আনবো,” আবার বললো পিয়াল।

কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না লতা। শেষে বললো, “আপনার যা ইচ্ছে। তবে, ব্যাঙের বিয়ে দেখতে চাইলে দেরী করবেন না।”

লতারা চলে যেতেই বোনকে ফোন করে পাঁচ হাজার টাকা বিকাশ করতে বললো পিয়াল। বোন কারণ জানতে চাইলে এড়িয়ে গেল। ব্যাঙের বিয়ের মিষ্টি কিনবে, এ কথা কি ফোনে বলা যায়?

ঘন্টাখানেকের মধ্যে আধা মণ মিষ্টি নিয়ে লতাদের বাড়িতে হাজির হলো পিয়াল। ওকে দেখে অবাক হলো মেয়েটি, হয়তো ভেবেছিলো ও পালাবে। মিষ্টির প্যাকেটগুলো দেখে ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করলো লতা, তারপর আপ্যায়নের জন্য ছুটোছুটি শুরু করলো। তবে, এক গ্লাস লেবুর শরবৎ ছাড়া আর কিছুই খেলো না পিয়াল।

বিয়ের সময় হতেই ওকে পুকুর পাড়ে নিয়ে গেল লতা, একটি চেয়ারে বসতে দিলো। বিয়েটা ওখানেই হচ্ছে। বাচ্চা-কাচ্চাসহ গ্রামের মহিলারা জড় হয়েছেন। কয়েকজন হিন্দু মহিলাও চোখে পড়লো। পুরুষরাও এসেছেন, তবে তাদেরকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে বলা হয়েছে। পিয়ালের কথা আলাদা। ও অতিথি। গ্রাম-বাংলায় এখনও অতিথি দেবতুল্য। ঝামেলা এড়াতে লতা সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে, পিয়াল ওর বান্ধবীর বড় ভাই।

জানা গেল, পূব কান্দির বাচ্চারা (লতাদের বাড়ি যেখানে) ধরেছে ছেলে ব্যাঙ, নাম দিয়েছে ‘মেঘ’। পশ্চিম কান্দির বাচ্চারা ধরেছে মেয়ে ব্যাঙ, নাম দিয়েছে ‘বিজলি’।

কুলোর মধ্যে পাশাপাশি বন্দী হয়ে আছে মেঘ আর বিজলি। চুপচাপ সবকিছু দেখছে। ওরা কি জানে আজকের এত বড় আয়োজন ওদেরকে নিয়ে?

বিয়ে পড়ানোর জন্য কোন মৌলভী নেই। পিয়াল ছাড়া আশে পাশে কোন মৌ-লোভীও নেই। বউ-ঝিরাই বিয়ে পড়াবে মনে হচ্ছে।

একটি মেয়ে এসে বিজলির গলায় সাদা পুতির মালা পরিয়ে দিলো। বাচ্চারা এখনও সুর করে “বেঙা বেঙির বিয়া” গানটি গাইছে।

একজন বয়স্কা মহিলা এসে ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’ বলতে বলতে ব্যাঙ দুটির মাথায় পাটল রঙের (হাল্কা লাল রঙের) একটি করে ফোঁটা দিলেন। এটাই নাকি বিয়ের মূল অংশ।

একজন হিন্দু মহিলা এসে ধান-দূর্বা দিয়ে নব-দম্পতিকে আশীর্বাদ করলেন।

এবার নিশ্চয়ই বাসর-দুপুরের পালা। লতা আর ওর এক বান্ধবী গিয়ে বাঁধন খুলে মেঘ আর বিজলিকে বাসর-পুকুরে ছেড়ে দিলো। সবাই হাততালি দিয়ে আর চিৎকার করে নব-দম্পতিকে বিদায় জানালো।

ভাত, গরুর মাংস, রুই মাছ আর ডাল দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করা হলো। যারা গরু খান না, তাদের জন্য মুরগীর মাংসের ব্যবস্থা রয়েছে। এরপর সবাই পেলো বাতাসা আর পিয়ালের আনা রসগোল্লা। সবশেষে পান।

বিকেল পর্যন্ত বিয়ে-বাড়িতে কাটালো পিয়াল। এর মধ্যে দু একবার লতার কাছে বিদায় নিতে গিয়েছিল, কিন্তু মেয়েটি ব্যস্ত বলে কথা না বলে চলে এসেছে। লতার কর্মব্যস্ততা শেষ হবার পর পিয়াল জানালো, ও এখন রওয়ানা হবে।

“চলুন, আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি,” বললো লতা। কিছুদূর একসাথে হেঁটে মেয়েটি জানতে চাইলো, “এবার বলুন তো, এমনটি কেন করলেন? অচেনা জায়গায়, অচেনা লোকদেরকে এতগুলো টাকা খরচ করে মিষ্টি খাওয়ালেন!”

পিয়াল ওর মনের কথা বলবে কি না, বুঝতে পারছে না। কিছুটা পিছনে লতাদের বাড়ির দু একটি ছেলে রয়েছে, লতা বিরক্তি প্রকাশ করলে ওরা অর্ধচন্দ্র (গলাধাক্কা) দিয়ে ওকে গ্রাম থেকে বের করে দিবে। কিন্তু, এখন যদি না বলে, আর কোনদিন হয়তো বলা হবে না।

যা আছে কপালে। অর্ধচন্দ্রের বিনিময়ে যদি পূর্ণচন্দ্র পাওয়া যায়, তাহলে গণিতের হিসেবে লাভ ঠিক এক শ পারসেন্ট।

“আপনার জন্য,” বললো পিয়াল।

“মানে? আমি কটাক্ষ করেছি বলে? আমার সঙ্গে জেদ করে?” থেমে দাঁড়িয়েছে লতা।

“না, আপনাকে খুশি করার জন্যে।”

কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলো লতা। ওর মনের কথা পড়ার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে বললো, “আমি খুশি হয়েছি।”

লতার চোখের দৃষ্টিতে পিয়ালের মনের খরা দূর হয়ে গেল।

পরদিন ভোরে বৃষ্টি হলো পুরো মৌলভীবাজারে। সেটা ব্যাঙের বিয়ের কারণে, নাকি কোন মৌলভীর দোয়ায়, তা বোঝা গেল না। তবে, পিয়াল জানে ব্যাঙের বিয়েতে খরা কাটে।

পাঠক, দেখেছেন তো খরা কাটাতে সবাই কত কষ্ট করে! বৃষ্টির জন্যে লতাদের গ্রামে এত আয়োজন করে ব্যাঙের বিয়ে দেয়া হলো! আজমত আলি গরীব দোকানি হয়েও খরা (একই সাথে ব্যবসার খরা) কাটাতে পঞ্চাশ টাকা চাঁদা দিলেন! পিয়াল ছাত্র হয়েও প্রেমের খরা কাটাতে বিশ কেজি মিষ্টি কিনে ফেললো!

প্যাপাইরাসের ‘বর্ষা’ সংখ্যাটি বের হতে এই যে এত দেরি হলো, সব দোষ কি আমাদের? আপনাদের কি কোন দোষ নেই? ব্যাঙের বিয়ে দেননি, কোন টাকা-পয়সা চাঁদা দেননি, “আল্লাহ  মেঘ দে, পানি দে” গান গাননি- ‘বর্ষা’ আসতে দেরি তো হবেই।

পাল্টাপাল্টি দোষারোপ বন্ধ করা যাক। চলুন, বৃষ্টিতে ভিজি।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪

জাফর আহমেদ খান

প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪