এপ্রিল ২৭, ২০২৫

ঘুষখোর ধরার গাণিতিক উপায়

আচ্ছা অনুমান করুন দেখি, বাংলাদেশে কত লোক ঘুষ খায়? আন্দাজে বলা কঠিন, তাই না?  কিন্তু ধরুন, আমরা জানতে চাই কোনো এলাকায় বা সরকারের কোনো বিভাগে প্রায় কত লোক ঘুষ খায় । আমরা যদি মানুষকে গিয়ে এভাবে জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি ঘুষ খান কি না?’ তাহলে তো আর সব সময় সঠিক উত্তর পাবো না। কিন্তু পরিসংখ্যান আর সম্ভাবনা তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই মোটামুটি একটা হিসাব করে ফেলা যায়।

এ কৌশলের মাধ্যমে আমরা কত লোকের মধ্যে প্রায় কত লোক ঘুষ খায় তা জানতে পারবো। অবশ্য ঠিক কারা কারা ঘুষ খায় তা জানতে পারবো না।

আমরা কাজটি করবো পরিসংখ্যানের সম্ভ্যবনার ধারণা কাজে লাগিয়ে। প্রথমেই আমাদেরকে পরীক্ষা চালানোর জন্যে কিছু লোক বাছাই করতে হবে। এই সংখ্যা যত বেশি হবে ততই ভালো, অন্তত এক হাজার নিলেও মোটামুটি চলবে। এদেরকে আমরা বলবো টার্গেট গ্রুপ। এখন সাথে রাখতে হবে একটি ভালো (Fair) কয়েন। কয়েনটিকে হতে হবে নিখুঁত, অর্থাৎ একে এমন হতে হবে যেন টস করলে হেড ও টেইল ওঠার সম্ভাবনা সমান থাকে। এই কয়েন নিয়ে আমরা এক এক করে আমাদের টার্গেট গ্রুপের ব্যক্তিদের কাছে যেতে থাকবো।

ধরুন, আমরা মিস্টার এক্স এর কাছে গেলাম। তার কাছে প্রশ্ন থাকবে তিনি ঘুষ খান কি না। কিন্তু তাকে বিব্রত করা যাবে না। তা কী করে সম্ভব? সেটাই বলছি।

তাকে কয়েনটি দিয়ে বলতে হবে,

আপনি কয়েনটি টস করবেন। টসের ফলাফল আমাদেরকে জানানো লাগবে না। যদি টসে হেড পড়ে, তাহলে প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলবেন। আর যদি টেইল দেখেন তবে সত্য কথা বলবেন।

এখানেই হলো মূল ব্যাপার। মনে রাখতে হবে যে উত্তর হ্যাঁ হতে পারে দুটো কারণে। এক, তিনি টস করে হেড পেয়েছেন অথবা দুই, তিনি টস করে টেইল পেয়েছেন এবং সত্যি সত্যিই ঘুষ খান। অতএব তিনি কি টসে হেড পড়াতে হ্যাঁ বলেছেন নাকি (টসে টেইল পেয়ে এবং) আসলেই ঘুষ খান বলে হ্যাঁ বলেছেন সেটা আমরা জানবো না। ফলে তিনি নিরাপদ, তার সম্মান হানি হচ্ছে না। এই কথাটি ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বলতে হবে, না হলে সৃষ্টি হবে বিব্রতকর পরিস্থিতির।

এই পরীক্ষা চালিয়ে আমরা অনেকগুলো হ্যাঁ ও না পেলাম। মনে করি, আমরা এক হাজার লোকের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে মোট ৮০০ উত্তর পেলাম হ্যাঁ। অর্থাৎ ঘুষ খায় কি না এই প্রশ্নের উত্তরে ৮০০ জন হ্যাঁ বলেছে। মনে রাখতে হবে এর মানে কিন্তু এটা নয় যে ৮০০ লোক ঘুষ খায়। এই ৮০০ লোকের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা সত্যি সত্যি ঘুষ খায় বলে হ্যাঁ বলেছে, আর কিছু লোক হ্যাঁ বলেছে কয়েনে হেড পড়তে দেখে।

তাহলে আমরা কীভাবে জানবো কত লোক আসলেই ঘুষ খায়?

মনে করে দেখুন, আমরা পরীক্ষা চালিয়েছিলাম নিখুঁত কয়েন দিয়ে। এতে হেড ও টেইল পড়ার সম্ভাবনা ছিল সমান। এখন ১০০০ লোক নিয়ে পরীক্ষা চালানোর অর্থ হল ১০০০ বার কয়েন টস হবে। হেড ও টেইল পড়ার সম্ভাবনা সমান থাকার কারণে আমরা ধরে নিতে পারি যে এক হাজার টসের মধ্যে প্রায় ৫০০ টি হেড পড়েছিল। ফলে ৮০০ লোকের মধ্যে প্রায় ৫০০ লোক এমন থাকবে যারা হ্যাঁ বলেছে টসে হেড পড়ার কারণে। এরা আসলে ঘুষ খায় কি না তা আমরা জানবো না। কিন্তু বাকি ৩০০ টি হ্যাঁ বলা লোক হ্যাঁ বলেছে এ জন্যেই যে তারা আসলেই ঘুষ খায়। কারণ আমরা বলেছি টেইল পড়লে যাতে উনি সত্য কথা বলেন।

কয়েন নিখুঁত হবার কারণে টেইলও পড়বে প্রায় ৫০০ বার। এখন টেইল পড়ার পরও হ্যাঁ বলার অর্থ হল, এরা আসলেই ঘুষ খায়। তার মানে আমরা পেলাম, প্রতি ৫০০ লোকের মধ্যে প্রায় ৩০০ লোক ঘুষ খায়।

মজার ব্যাপার, তাই না?

কিছু বিষয় মাখায় রাখতে হবে:

১. টার্গেট গ্রুপকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে উনি ঘুষ খান কি না তা আমরা জানবো না। উনি নিশ্চিন্তে উত্তর দিতে পারেন।

২. কয়েন নিখুঁত হলেও ঠিক অর্ধেক পরিমাণে হেড ও টেইল পড়বে না, দুটোর পরিমাণই হবে অর্ধেকের কাছাকাছি। ফলে আমরা যত বেশি মানুষ নিয়ে টেস্ট করব, ভুলের পরিমাণ তত কমবে।

৩. এই কৌশল খাটিয়ে একই রকম অন্য পরীক্ষাও চালানো সম্ভব। যেমন কেউ ধূমপান করেন কি না বা অ্যালকোহল সেবন করেন কি না, বা আয়কর ফাঁকি দেন কি না ইত্যাদি।

৪. এখানে আমাদেরকে আরও ধরে নিতে হচ্ছে, মানুষ সত্য কথা বলবে। বাস্তবে যারা ঘুষ খাওয়ার মতো ঘৃণ্য কাজ করতে পারে, তারা মিথ্যাও বলতে পারে। তবে যেহেতু ঘুষ খাওয়ার তথ্য ফাঁস হচ্ছে না, তাই আশা করা যায়, আমরা সত্যিটাই শুনব।

পুনশ্চঃ এখানে আমরা ফেয়ার বা নিখুঁত কয়েন দিয়ে টস করেছি। ফলে হেড ও টেইল প্রায় ৫০০টি করে পড়ার কথা। এর মধ্যে ৫০০ লোককে আমাদের স্টাডি থেকে বাদ দিতে হয়েছে। এরা ঘুষ খান কি না তা আমরা জানি না। কিন্তু আমরা যদি ফেয়ার কয়েনের বদলে আনফেয়ায়র কয়েন ব্যবহার করি, তাহলে আরও কম লোককে বাদ দিতে হবে। মানে আমাদের কার্যকর নমুনা সাইজ (effective sample size)বাড়বে। যেমন টেইল পড়ার সম্ভাবনা ০.৯ হলে মাত্র প্রায় ১০০ লোককে স্টাডি থেকে বাদ দিতে হবে। বাকি ৯০০ লোক মূল পরিমাপে কাজে লাগবে।

এবার আরেকটু গভীরে গিয়ে চিন্তা করি। আমরা যদি এমন একটি কয়েন নেই, যার হেড ওঠার সম্ভবনা ০, তাহলে কী হবে? বাস্তবে এমন কয়েন বানানো হয়ত কঠিন। কিন্তু চিন্তা করা যেতেই পারে। এক্ষেত্রে একটি মজার ঘটনা ঘটবে। প্রায় সব টসেই টেইল পড়বে। তার মানে, মানুষ হ্যাঁ বলে উত্তর দিলে বুঝতে হবে তিনি আসলেই ঘুষ খান। দুয়েকটি ক্ষেত্রে অবশ্য এর ব্যতিক্রম হতে পারে। আমরা আগে বলেছি, ঠিক কারা ঘুষ খান সেটা আমরা জানবো না। কিন্তু এভাবে আমরা সেটাও জেনে নিতে পারি।

তবে একটি বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। আমরা কিন্তু টার্গেট গ্রুপকে বলেছি, তিনি আসলেই ঘুষ খান কি না সেটা আমরা জানবো না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আমরা সেটা জেনে ফেলতে যাচ্ছি। এটা অনৈতিক। আর একটা অনৈতিক কাজের মোকাবেলা আরেকটি অনৈতিক কাজের মাধ্যমে করার কোনো অর্থ নেই। তাছাড়া বিষয়টি রিসার্চ এথিক্সের বিপরীত।

এই পদ্ধতি শেলডন রসের বই থেকে নেয়া।

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাবর্ষঃ ২০১০-১১