জুন ১৮, ২০২৫

যুক্তি থেকেও বেশি

প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত চা-এর রাজধানী শ্রীমঙ্গল। চলছি এর আঁকাবাঁকা মনোরম পথ ধরে। তবে যাত্রাটা ঘোরাঘুরি করার জন্য নয়, কারণ এই মুহূর্তে যাচ্ছি একটি মৃতদেহ সাথে নিয়ে। লাশের সাথে গাড়িতে আমরা মাত্র তিন জন। ড্রাইভার, আমি আর সবুর চাচা। চাচা ড্রাইভার এর পাশের সিটে বসা আর আমি বসে আছি পিছনের সিটে, লাশের পাশে। মরা মানুষের সাথে একা এভাবে বসে থাকলে একটা গা ছমছম অনুভূতি হওয়ার কথা; যেন লাশটা হাত পা নাড়া দিয়ে উঠে বসবে, বিদঘুটে এক হাসি দিয়ে বলবে, কি রে সাঈদ? খুব ঘাবড়ে দিলাম, তাই না? যদিও আমার কাছে এই লাশকে বাক্স পোটলা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। ভয় পাওয়ার বদলে ব্যাপক ঘুম পাচ্ছে আমার। গতদিন থেকে খুব একটা ঘুমানোর সময় হয় নি, তাই একটু আয়েশ করে হালকা ঘুমিয়ে নিতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি খুব সাহসী যে তা কিন্তু না, আমি ভয়ানক অলস আর খুবই উদাসীন প্রকৃতির। আজও সেরকমই অবস্থা। উদাস মনে নিজের অতীত ভাবছি আর কিছু পরিস্থিতি চিন্তা করছি।

ছোটবেলা থেকেই আমি খুব ফাঁকিবাজ, কোনো কাজ কখনোই ঠিকমতো করতাম না। কেউ কোনো কাজ করতে বললে সরাসরি না করে দিতাম। এমন না যে যেই কাজ আমাকে করতে বলা হয়েছে তা আমি পারি না। কিন্তু তবুও আমি করতাম না; কারণ আমার ইচ্ছা করতো না। খুবই অলস প্রকৃতির এবং গোঁয়ার হওয়ায় কাউকেই পাত্তা দিতাম না। যখন যা ভালো লাগতো তা ই করে বেড়াতাম। যখন পাঠশালায় পড়ি তখন মনে হতো জীবন মানেই তো খেলাধুলা করা। তারপর আরো কিছু বছর গেলো, মাধ্যমিক পাস করলাম। চোখে রঙিন চশমা লাগলো। টই টই করে ঘুরে বেড়ানো আর আড্ডাবাজির অভ্যাস গড়ে উঠলো। জীবনের এই সময়টায় মন মানসিকতারও কিছু পরিবর্তন আসলো। এই রঙিন চশমার যুগে জীবনের মানে শিখলাম শুধু আবেগ। আবেগের তোরে প্রেমেও পড়লাম। অবশ্য কথাটা অন্যভাবেও বলা যায় যে, প্রেমটা জোর করে আমার ঘাড়ে এসে পড়লো। তখন জীবনের ডাইমেনশন হয়ে গেল একমুখী। এভাবে তিন চার বছর কেটে গেলো। রঙিন পৃথিবী আস্তে আস্তে সাদাকালো হওয়া শুরু হলো এবং এক সময় প্রেম নামক বস্তুটাও জীবন থেকে উধাও হলো। এর প্রধান কারণ ছিলো আমার অগোছালো স্বভাব।

আমি কথা বার্তায় তেমন গোছানো না। হঠাৎ করেই রেগে যাই। রাগ উঠলে কী সব বলি হুঁশ থাকে না, মুখেরও লাগাম থাকে না। প্রচন্ড রেগে গেলে উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করি। খুবই ঘুমকাতুরে হওয়ায় আমার ঘুম হঠাৎ করে যদি কেউ ভাঙায় তাহলে আমি কী সব আবোলতাবোল বকি তা আমারও বুঝে আসে না মাঝে মাঝে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আকাশ কুসুম চিন্তা ভাবনা করতাম। মনের মধ্যে উদাসীনতা বেড়ে গেলো। তখনই সৃষ্টিকর্তা কে ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারলাম এবং এর জন্য কিছু মানুষ এর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ঐ অবস্থায় একটা কথা খুবই মনে হতো যে মানুষ যখন কোনো কিছুতে কষ্ট পায় বা হঠাৎ খুব আঘাত অথবা দুর্দশার মধ্যে পড়ে যায় তখন সে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বটা উপলব্ধি করতে পারে মনের গভীর থেকে। দুইটা উপায়ে সে তখন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে বুঝতে পারে। প্রথমত, হয় সে নিজের অবস্থার জন্য নিজের ভুল ত্রুটি না ভেবে সৃষ্টিকর্তা কে অনবরত দোষারোপ করতে থাকে; অথবা সে সবকিছুতে ধৈর্য  ধারণ করে নিজেকে সৃষ্টিকর্তার সুন্দর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মেনে নেয়।

যাই হোক।

রাজ, আমার ছোটবেলার বন্ধু। ছোট অবস্থা থেকেই খুব চঞ্চল আর ডানপিটে। খুবই উৎফুল্ল মন মানসিকতার ছেলে ও। পড়ালেখার প্রতি অতো মনোযোগ ছিলো না কিন্তু বাস্তবতা খুব ভালো বুঝতো। ওর ছিলো সুন্দর একটা মন। আর এ কারণেই হয়তো ও যে কারো বিপদ আপদে সব সময় এগিয়ে আসতো। সাধারণত পরিবারের ছোট সদস্যদের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব কম পালন করতে দেখা যায়, কিন্তু রাজ ছিলো তার ব্যতিক্রম। তবে ধর্ম কর্ম পালনের ব্যাপারে সে খুব উদাসীন ছিলো, কোনো নিয়মের বেড়াজালে থাকা তার অপছন্দ ছিলো। একা একাই অ্যাডভেঞ্চার এ বেড়িয়ে পড়তো। কথাও বলতো আবার কেউ কিছু বলতে চাইলে ও খুব ধৈর্য নিয়ে শুনতো। আর ওর কাছে যেন সব সমস্যারই খুব সুন্দর সমাধান থাকতো। ও ধৈর্য নিয়ে সেই সমাধানগুলো যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতো। আমি যখন মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম ও তখন অনেক ভাবে আমাকে বুঝিয়ে ছিলো।

আমি যখন ওকে জিজ্ঞেস করতাম, কেন এরকম হলো আমার জীবনটা? ও তখন উত্তর দিতো, তুই এমন ভাবে বলছিস যেন তোর জীবনটা শেষ হয়ে গেছে; আরে জীবনের তো অনেক কিছুই বাকি এখনও। তোর জীবন কেমন হবে তা তো দেখাই হয়নি এখনও। ও বলতো, দেখ মানুষ সব সময় চিন্তা করে সে যেখানে আছে সেখান থেকে আরো বেশি কিছু করা যায় কি না। মানুষ তার অবস্থান এর উপর ভিত্তি করে নিজেকে আরো উন্নত করতে চায়। এটাই স্বাভাবিক। কাজেই জীবনের সামনের দিকে দেখ।

আমি তখন বলতাম আবেগ এর কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু তাই বলে কি কাউকে কোনো কথা দিয়ে সে কথা রাখা উচিৎ না?

রাজ এর তীক্ষ্ণ জবাব, আরে অনুচিত শব্দটার জন্ম কেনো হয়েছে বল তো? সব উচিৎ-ই উচিৎ হবে না বলেই তো, না কি? আর প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গাই যদি না হবে তবে প্রতিশ্রুতি নামক শব্দটার প্রয়োজন কি বল দেখি?  সব কিছুতে কথা দিয়ে কথা রাখতে গেলে পৃথিবীতে চলা যায় না, এটা বুঝতে হবে।

আমাকে চুপ থাকতে দেখে বললো, এটাই মানুষের স্বভাব। যে যেই অবস্থায় আছে সে অবস্থা থেকে পরিবর্তিত অবস্থানে যেতে চায় মানুষ।

আমি বললাম, তাই বলে কি আমি যাকে কথা দিলাম সেই কথা আমি রাখবো না?

তোর ঐ কথা না রাখলে তার যদি কোনো ক্ষতি না হয় আর ঐ সময় তোর কথা না রাখা যদি তোর অবস্থান পরিবর্তনে প্রয়োজন হয় তা হলে কথা না রাখাই যৌক্তিক।

তাহলে তো আর মানুষের উপর মানুষের বিশ্বাস বলতে কিছু থাকলো না!?

শোন, সবাই এখন বাস্তব জীবন নিয়ে চিন্তা করে। সবাই বুঝে কোনটা ভাল কোনটা খারাপ। কী ভাল কী খারাপ তা বুঝতে কঠিন কোনো যুক্তির প্রয়োজন হয় না। যে কাজগুলো যৌক্তিক  তুই সেই কাজ গুলোই করবি।

মনের অশান্তি কি যুক্তি দিয়ে দূর করতে পারবি?

বুঝিসই যদি মনে অশান্তি হবে তাহলে সে কাজে যাস কেনো? যে কারণে অশান্তি সেই বিষয় থেকে মন কে দূরে রাখার চেষ্টা কর।

অতো সহজ না। মন থেকে অশান্তি দূর করার জন্য কোনো  একটা অবলম্বন দরকার হয়। সেই অবলম্বনকে ভরসা করেই আগাতে হয়। যে কারণে মনের অশান্তি, তা তো আর একেবারে দূর করা সম্ভব হয় না। প্রতিটি ঘটনার কিছু না কিছু ব্যাখ্যা আছে বুঝলাম কিন্তু এর সাথে সাথে নিজের উপর, আশেপাশের মানুষের উপর বিশ্বাস রাখাটাও জরুরি।

কী জানি! রাজ এর নির্লিপ্ত জবাব।

ও সব কিছু তেই যুক্তি খুঁজে সমাধানের চেষ্টা করতো কিন্তু মানুষের ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। তবে ওর ভালো গুণটা হচ্ছে যখন সে কোনো বিষয়ের  ব্যাখ্যা করতে পারতো না তখন থেমে যেতো, আর কথা বাড়াতো না। তার বিশ্বাস এর মাত্রা ছিলো খুবই নগণ্য। মানুষের মনের যে অশান্তি তা সবসময় যুক্তি দিয়ে দূর করা যায় না এই কথাটা আমি কখনোই তাকে বুঝাতে পারিনি। মনের অশান্তি দূর করার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হচ্ছে বিশ্বাসী হওয়া। যুক্তি যেখানে পরাস্ত, বিশ্বাস সেখানে সবচেয়ে বড় নির্ভরতা। শুধু যুক্তিনির্ভর না থেকে এর সাথে সাথে বিশ্বাসী হওয়াটাও জরুরি এই কথাটা ওকে বারবার বুঝাতে চেষ্টা করতাম কিন্তু ও আমার কথায় পাত্তা দিতো না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যুক্তি তর্কের দোলনায় দুলে, হতাশায় এবং ক্রমে বিরক্ত হয়ে প্রিয় বন্ধুটা আমাদেরকে বোকা বানিয়ে নিজেই নিজেকে শেষ করে দিলো। সে বুঝলো না জীবনটা সে নিজে তৈরি করে নাই, সৃষ্টিকর্তার সুন্দর পরিকল্পনা নষ্ট করার তার কোনো অধিকার নাই। সে এইটাও বুঝলো না তার জন্মের আগে থেকে এই অবধি তাকে গড়ে তুলতে তার মা’কে কত ত্যাগ কত কষ্ট হাসিমুখে স্বীকার করতে হয়েছে। নিজের উপরও সে বিশ্বাসটা রাখতে পারলো না। জীবনকে কঠিন সব যুক্তি দিয়ে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেছিলো। কী এমন সমস্যায় পড়লো যেখানে সে যুক্তি দিয়ে নিজেকে বুঝাতে না পেরে আত্নহত্যা করলো সেই ব্যাখ্যাটা আমি এখনো খুঁজে পাইনি। ব্যর্থতা আমারও তাকে বুঝাতে পারিনি। বুঝাতে পারিনি যে সকল সমস্যার সমাধানের জন্য যৌক্তিক কোনো পথ নাই সে সকল পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র ধৈর্যশীল আর বিশ্বাসী হলেই পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এটাও বুঝাতে পারিনি যে, যুক্তির সাথে বিশ্বাস এর একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

রাজের লাশ নিয়ে আমরা ওদের গ্রামের বাড়ীতে পৌছালাম। দাফন করতে গিয়ে মনে হলো ওর যুক্তিগুলোর ভার ওর দেহের চেয়ে অনেক হালকাই ছিলো।

Ahsan Rahman Jamee
প্রভাষক | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১২-১৩ (৬২-তম ব্যাচ)

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp

আরও লেখা সমূহ