fbpx

দ্য সাইকিক

(১)

শহীদুল্লাহ হল ক্যান্টিনে সকালের নাস্তা শেষ করে চায়ের জন্য বসে আছে মইন। হাতে কোন কাজ নেই – কয়েকদিন আগে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রেজাল্ট কবে দেয় কে জানে।

মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো। তারানা আপু! বহুদিন তার সাথে যোগাযোগ নেই। পরিসংখ্যানেই পড়তো তারানা। মইনের দুই ব্যাচ আগের ছাত্রী। ৩৫তম বিসিএস দিয়ে এখন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সহকারী কমিশনার।

‘স্লামালেকুম, আপু।’ মইনের কণ্ঠে খুশি খুশি ভাবটা অকৃত্রিম। তারানা আপু ওর পছন্দের একজন মানুষ।

‘কেমন আছিস, ময়েন?’ এটা তারানার পুরানো জোক। ইংরেজিতে মইনের নামের বানান এম-ও-আই-এন। তারানার যুক্তি হলো, সি-ও-আই-এন কয়েন, জে-ও-আই-এন জয়েন, সুতরাং এম-ও-আই-এন ময়েন। তবে, এই জোকে মইন এখন হাসেও না, কাঁদেও না।

‘ভালো,’ তারানার প্রশ্নের উত্তরে জানালো মইন। ‘মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে বেকার বসে আছি। আপনার খবর কী?’

‘আমার পোস্টিং হয়েছে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে (ডিবি), “সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন” বিভাগে। একটা দরকারে তোকে ফোন দিয়েছি। তুই কি এখনই আমার অফিসে চলে আসতে পারবি?’

‘পারবো না কেন?’ বললো মইন।

‘ডিউটি শেষ করে আমাদের একটা মাইক্রো বংশাল থেকে ফিরছে। তোকে নিয়ে আসতে বলে দেই – ’ কাউকে দ্রুত কণ্ঠে কিছু নির্দেশ দিলো তারানা। তারপর ওকে বললো, ‘মিনিট দশেক পর হল গেট থেকে তোকে তুলে নিবে।’

‘ও.কে.। কিন্তু, ঘটনা কী তা তো বললেন না, আপু?’

‘একটা মার্ডার কেসের তদন্ত করছি। সাক্ষ্য দিতে হাজির হয়েছেন এক লোক। দাবি করছেন তিনি একজন সাইকিক। সাইকিক বুঝিস তো?’

‘মানুষের মনের কথা পড়তে পারেন, আধ্যাত্মিক শক্তি আছে – এরকম কেউ?’

‘ঠিক ধরেছিস। সাইকিক শব্দটার বাংলা করা মুশকিল। যা হোক, লোকটা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কেউ তেমন কিছু বলতে পারছে না। ডিসি স্যার (ডিএমপি-র ডেপুটি কমিশনার, এসপি পদমর্যাদার) বললেন, বিদেশে নাকি মাঝে মাঝে পরিসংখ্যান ব্যবহার করে যাচাই করা হয় কেউ সত্যিই সাইকিক কিনা। স্যার আমাকেই কাজটা করতে বলেছিলেন। আমি বললাম, দু বছরে তো পরিসংখ্যান সব ভুলে গেছি। স্যারকে তোর কথা বললাম। তুই আয়, বাকি কথা তখন হবে।’

তারানা কথা শেষ করতেই মইন Google-এ টাইপ করলো ‘psychic’ – তারপর সার্চ রেজাল্টগুলো দেখতে দেখতে হল গেটের দিকে এগোলো।

(২)

ডিবি অফিস, মিন্টু রোড। বেলা এগারোটা।

তারানাকে সিভিল ড্রেসে দেখে অবাক হলো মইন। পরক্ষণেই ওর মনে পড়লো, ডিবি সদস্যদের ইউনিফর্ম পরা বাধ্যতামূলক নয়।

ওকে একটা চেয়ারে বসতে দিয়ে তারানা বললো, ‘ডিসি স্যার ডেকেছেন, দেখা করে আসি। তুই এই ফাঁকে খুনের কেইসটা সম্পর্কে পড়ে ফেল (হাত দিয়ে টেবিলের উপর একটা ফাইল দেখালো তারানা)। আমি এসে সাইকিক লোকটার ব্যাপারে কথা বলবো।’

ফাইলে কিছু পেপার কাটিং। সাথে তারানার হাতে লেখা কিছু নোট। দ্রুত সব পড়ে ফেললো মইন। গত পরশু রাতে সবুজবাগে একজন মহিলাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। রাত এগারোটায় গুলির শব্দ শোনা গিয়েছিল। তবে, সবাই তখন ভেবেছিল রিক্সা বা গাড়ির টায়ার ফেটেছে।

ভিকটিমের নাম সুরভি, বয়স ৩৮, ডিভোর্স্ড্। দোতলায় তার নিজের ফ্ল্যাটে একা থাকতেন। সাতাশ বছর বয়সে এক ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে হয়েছিলো। নয় বছরেও সন্তান না হওয়ায় স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে সুরভি ফ্ল্যাটটা লিখিয়ে নিয়ে তাকে ডিভোর্স দেন। সেটা প্রায় দু বছর আগের কথা।

বছরখানেক আগে পঞ্চাশোর্ধ এক বিপত্নীক লোকের সাথে সুরভির সম্পর্ক হয়। লোকটার নাম আনিস, পেশা ঠিকাদারি। সুরভির ফ্ল্যাটে তার নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। তবে, মাস তিনেক আগে আনিসের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন সুরভি। ফলে আনিস ক্ষিপ্ত হন। ঘটনার দিন রাত দশটা চল্লিশে সুরভির বাসায় এসে আনিস বাদানুবাদে লিপ্ত হন। এ কারণে আনিসকে সবচেয়ে বেশী সন্দেহ করে তারানা। যদিও আনিসের দাবি তিনি এগারোটার আগেই চলে গেছেন।

আনিসের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পর পরই সুরভির নতুন সম্পর্ক শুরু হয়। বর্তমান প্রেমিকের নাম বশির। বয়স চল্লিশ, মোটর পার্টসের দোকানের মালিক। সম্পর্ক চলছিলো ভালই, তবে সুরভি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়লে (অটোপ্সি রিপোর্টে তাকে দেড় মাসের অন্ত:সত্ত্বা বলা হয়েছে) ঝামেলা শুরু হয়। বশির গর্ভপাতের উদ্যোগ নেন, কিন্তু সুরভি তাতে রাজি না হয়ে বিয়ের জন্য চাপ দেন। হত্যাকান্ডের দিন রাত সোয়া এগারোটায় (?) সুরভির বাসায় যান বশির। তাকেও তাই সন্দেহের তালিকায় রেখেছে তারানা।

তৃতীয় ও শেষ সন্দেহভাজন হিসেবে রয়েছেন সুরভির খালাতো ভাই। নাম খালেক, বয়স ৪৫, একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। ঘটনার দিন আনিস সুরভির বাসায় এসে ঝামেলা শুরু করলে খালেককে কল করেন সুরভি। তিনি হত্যাকান্ডের পরপরই ফ্ল্যাটে এসেছেন বলে তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে, সুরভির সাথে তার কোন শত্রুতার কথা এখনও জানা যায়নি।

তারানার নোটে সবশেষে রয়েছে একটা আনুমানিক টাইমলাইন:

১০:৪০আনিস (আগের প্রেমিক) এলেন।
১০:৫০সুরভি খালেককে কল করলেন। আনিস চলে গেলেন। (১১:০০ টায় গুলি করে তারপর গেলেন?)
১১:০০ গুলির শব্দ।
১১:১০খালেক এলেন। (তিনি কি ১১:০০ টায় এসে গুলি করে বন্দুক লুকিয়ে ফেলে অপেক্ষা করলেন?)
১১:১৫বশির (বর্তমান প্রেমিক) এলেন। খালেককে ঘটনাস্থলে পেলেন। তবে, বশিরের আসার কথা ছিলো ১১:০০ টায়, তেমনটাই জানিয়েছিলেন সুরভিকে এসএমএস করে। (তিনি কি ১১:০০ টায় এসে গুলি করে বন্দুক লুকিয়ে ১১:১৫ টায় দ্বিতীয়বার এলেন?)

(৩)

তারানা ফিরে এসে তার চেয়ারে বসলো। মইনকে বললো, ‘সবটা পড়েছিস? কোন প্রশ্ন আছে?’

‘না, প্রশ্ন নেই। আপনি তো সব গুছিয়ে নোট করেছেন। এবার আপনার সাইকিকের কথা বলুন।’

‘আজ সকালে ভদ্রলোক এসে হাজির হয়েছেন। নাম সাইফুল, বয়স পঞ্চান্নের কাছাকাছি। বললেন, হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত রিভলভারটা তিনি স্বপ্নে দেখেছেন। খুনটা যেখানে হয়েছে, তার কয়েকটা বাড়ি পরে একটা মাঝারি সাইজের পুকুর আছে। খুন করার পর রিভলভারটা ঐ পুকুরে ফেলা হয়েছে। অস্ত্রটা পাওয়া গেলে সন্দেহভাজনদের সামনে সেটাতে হাত রেখে তিনি বলতে পারবেন খুনি কে। অর্থাৎ, তিনি দাবি করছেন তার টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা আছে। আরও বলছেন, ৮০% ক্ষেত্রে তার ধারণা সঠিক হয়।’

‘কাউকে ফাঁসানোর জন্য তিনি চেষ্টা করছেন না তো?’ জিজ্ঞাসা করলো মইন। ‘ঐ তিনজনের কারও সাথে কি তার পরিচয় আছে? চেক করেছেন?’

‘কী যে বলিস! ঐ তিনজনের সামনে তাকে নিয়েছি, কেউই তাকে চিনেন না। ভিকটিমের সাথেও তার পরিচয় ছিলো না। এখন তোর কাজ হলো পরিসংখ্যান ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নেয়া, তাকে সাইকিক ধরে নেয়া যায় কিনা।’

‘পরিসংখ্যান ব্যবহারের দরকার কী? পুকুরে খুঁজলেই তো হলো।’ একটু হেসে মইন যোগ করলো, ‘রিভলভারটা পাওয়া গেলে তিনি সাইকিক, পাওয়া না গেলে ভূয়া।’

‘পুকুরে রিভলভার খুঁজতে অনেক লোকবল আর সময় লাগবে। যে কেউ বললেই খুঁজতে শুরু করা যায় না। লোকটা সাইকিক হলে আলাদা কথা। তুই ঠিক কর কীভাবে কী করবি। তোর প্ল্যানটা ডিসি স্যার ও.কে. করলে কাজ শুরু করবি।’

‘খুব সহজ উপায়ে কাজটা করতে চাই। একটা হিসেব করা বাকী। মিনিট পাঁচেক সময় দিন।’

(৪)

‘আপনি ১০০ বার কয়েন টস করতে চান?’ মইনকে জিজ্ঞাসা করলেন ডিসি মিজানুর রহমান। ‘দেখতে চান কয়বার সাইফুল সাহেব বলতে পারেন হেড না টেইল পড়েছে?’

‘জী স্যার।’

‘মাত্র ১০০ বার কেন? আপনাদের স্ট্যান্ডার্ড স্যাম্পল সাইজ ৩৮৪ না?’

‘এ ক্ষেত্রে এত বড় স্যাম্পল সাইজ দরকার হবে না,’ বললো মইন। ‘হিসেব করে দেখেছি, সর্বনিম্ন ৭৬ বার টস করলেই চলে।’

‘তারানা, আপনার মত কী?’ ডিসি মিজান জানতে চাইলেন।

‘ওর হিসেবটা ঠিক মনে হয়েছে, স্যার,’ তারানা নার্ভাস কন্ঠে বললেন। স্যাম্পল সাইজের বিষয়ে ৩৮৪ ছাড়া আর কিছু তারও মনে নেই।

‘কোন্ কোন্ বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আপনি ৭৬ সংখ্যাটি পেয়েছেন?’ মইনের কাছে জানতে চাইলেন ডিসি মিজান।

‘কয়েন টসের ক্ষেত্রে সাধারণ লোকের অনুমান সঠিক হয় গড়ে শতকরা ৫০টি। যাচাই করতে হবে সাধারণ লোকের চেয়ে সাইফুল সাহেবের অনুমান ক্ষমতা বেশী কিনা। তিনি দাবি করছেন তার ৮০% অনুমান সঠিক হয়। আমি হিসেব করার সময় তার অনুমান ক্ষমতা ৭৫% ধরেছি, যাতে স্যাম্পল সাইজটা একটু বড় আসে। আমরা যদি ৯৯% নিশ্চিত হতে চাই যে, তিনি সাধারণ লোক হয়ে থাকলে আমরা ভুল করে তাকে সাইকিক মনে করবো না, আবার একই সাথে ৯৯% নিশ্চিত হতে চাই যে তিনি সাইকিক হয়ে থাকলে আমরা ভুল করে তাকে সাধারণ লোক মনে করবো না – তাহলে পরিসংখ্যানের ফর্মূলা ব্যবহার করে স্যাম্পল সাইজ পাওয়া যায় ৭৫.৩৮ বা ৭৬। আরও ভালো ফলাফলের জন্য ১০০ বার টস করা যেতে পারে।’

‘লোকটির অনুমান কতবার সঠিক হলে তাকে সাইকিক ধরে নেয়া যাবে?’

‘১০০ বারের মধ্যে ৭০ বার সঠিক হলেই চলবে।’

‘কয়েন টসটা তার জন্য সহজ হয়ে যাবে না?’ চিন্তিত কণ্ঠে বললেন ডিসি মিজান। ‘মাত্র দুটো চয়েস থেকে সঠিকটা বাছাই করতে হবে। বিদেশে তো অনেক ক্ষেত্রে চারটা চয়েস দেয়া হয়।’

‘তা ঠিক, স্যার। তবে, মাঝে মাঝে দুটো চয়েসও দেয়া হয়। ঘুরে ফিরে এক কথা, স্যার। চারটা চয়েস দিলে সাধারণ লোকের অনুমান সঠিক হয় গড়ে শতকরা ২৫টা। আমাদেরকে তখন যাচাই করতে হবে লোকটির অনুমান ক্ষমতা ২৫% এর বেশী কিনা।’

‘রিভলভারটা পাওয়া গেলে সাইফুল সাহেব তো তিনজন থেকে একজনকে খুনি হিসেবে বেছে নিবেন। তাহলে দুটো চয়েসের বদলে তিনটা চয়েস দিয়ে তাকে যাচাই করলে ভাল হয় না?’

‘খুনি হয়তো তিনজনই, দল বেঁধে খুন করেছেন। আবার, হয়তো তিনজনের কেউই না, অন্য কেউ খুন করেছেন। তাই, আমি মনে করি তিনজনের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সাইকিকের মত নিতে হবে, সন্দেহভাজন ব্যক্তিটি খুনের সাথে জড়িত কিনা। হ্যাঁ অথবা না, কয়েনের হেড অথবা টেইলের মতো।’

‘তাই তো! দারুন বলেছেন আপনি,’ মইনকে বললেন ডিসি মিজান। তারপর তারানার দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন। মইন পরিসংখ্যান ভাল বোঝেন, বোঝাতেও পারেন। তার প্ল্যানেই কাজটা হোক। দেখা যাক কী হয়।’

তারানার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

ডিসি মিজানের সাথে আরও কিছু প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে নিলো তারানা আর মইন।

(৫)

তারানার অফিসের পাশেই একটা কনফারেন্স রুমে সাইকিক দাবিদার সাইফুল সাহেবের টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা যাচাইয়ের কাজ চলছে।

লম্বা টেবিলের এক পাশে বসেছে মইন। ওর সামনে ফাইলপত্র রেখে কিছুটা আড়াল সৃষ্টি করা হয়েছে। টেবিলের অন্যপাশে ওর মুখোমুখি বসেছেন সাইফুল সাহেব।

টস করার জন্য একটা দুই টাকার কয়েন ব্যবহার করছে মইন। প্রতিবার টস করে কয়েনটার উপর তর্জনী রেখে লোকটার দিকে তাকাচ্ছে ও। এমনটাই চেয়েছেন তিনি, যাতে মইনের মনের কথা পড়তে পারেন।

লোকটা হেড বা টেইল বলার পর রাইটিং প্যাডে টালি মার্ক দিচ্ছে মইন। এখনও অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতির চেয়ে টালি মার্ক ভাল।

একশ বার টস করা শেষ হতেই মইন দ্রুত সঠিক উত্তরের সংখ্যা বের করলো। তারানার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘একাত্তর বার সঠিক হয়েছে।’

তারানা সাইফুল সাহেবের দিকে ফিরে বললো, ‘কনগ্রাচুলেশন্স্।’ তারপর মইনকে সাথে নিয়ে ডিসি স্যারের অফিসের দিকে চললো।

(৬)

ডিবি অফিসের ক্যান্টিনে তারানার সাথে লাঞ্চ করলো মইন। খাওয়া শেষে তারানা বললো, ‘চল্, তোকে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখাই।’

ওকে ডিবি অফিসের কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল রুমে নিয়ে গেলো তারানা। বিশাল তিনটা টিভি স্ক্রিনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটা মাঝারি আকারের স্ক্রিন রয়েছে রুমটিতে। এক পাশে একটা বড় আর দুটো মাঝারি স্ক্রিনে সবুজবাগের পুকুরে রিভলভার খোঁজার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। লাইভ টেলিকাস্ট।

তারানা আর মইন দুটো চেয়ারে বসে ঘটনা প্রবাহ দেখতে লাগলো।

মইন ভেবেছিল পুকুরের পানি সেচে বা ডুবুরি নামিয়ে রিভলভার খোঁজা হবে। কিন্তু, দেখা যাচ্ছে তিনটা ছোট নৌকায় বসে তিনজন ডিবি সদস্য যেন মাছ ধরছেন। তারানা বললো, ওরা ‘ম্যাগনেট ফিশিং’ করছেন। নাইলনের রশিতে চাকতি আকারের ম্যাগনেট বাঁধা রয়েছে। সেটা পানিতে ফেলে রশি ছেড়ে পুকুরের তলদেশ পর্যন্ত নামিয়ে পরক্ষণেই তুলে ফেলা হচ্ছে। প্রায় প্রতিবারই নানা ধরণের জিনিস উঠে আসছে – লোহার রড,  খুন্তি, চাকু, আরও কত কী!

রিভলভারটাই পাওয়া যাচ্ছে না।

মইন ধীরে ধীরে নার্ভাস হয়ে পড়ছে। ও যদিও এখানে বহিরাগত, এখন পর্যন্ত ওর পরামর্শেই সব হচ্ছে। ওর ধারণা ভুল প্রমাণ হলে ওর কিছু হবে না, কিন্তু ওকে ডেকে আনায় তারানা তার বসের অপছন্দের তালিকায় চলে যাবে। এটা চাকরি জীবনে তার প্রথম মার্ডার কেইস।

একটু হাঁটাহাঁটি করবে বলে উঠে দাঁড়ালো মইন। দরজার দিকে এগোতেই হঠাৎ তারানা পিছন থেকে চিৎকার করে উঠলো, ‘পাওয়া গেছে!’

(৭)

একটা মাঝারি আকারের টেবিলের একপাশে বসে আছেন সাইকিক লোকটি। অন্যপাশে, সাইকিকের মুখোমুখি, বসে আছেন ভিকটিমের প্রাক্তন প্রেমিক আনিস। তার হাতকড়া খুলে দেয়া হয়েছে। দুজনের মাঝে টেবিলের উপর সদ্য উদ্ধার করা রিভলভারটি রাখা হয়েছে। পানির মধ্যে ছিল বলে এটাতে কারও হাতের ছাপ থাকার কথা নয়। এটাকে ভালো করে মুছে এর ভেতর থেকে গুলি বের করে ফেলা হয়েছে।

তারানা আর মইন দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের তৃতীয় পাশে। তারানা হঠাৎ করেই তার সিভিল ড্রেসের উপর জলপাই কালারের স্লিভলেস জ্যাকেট পরে এসেছে, তবে বোতাম আটকায়নি। জ্যাকেটের বাম পাশে বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘DB’। ডানপাশে ডিএমপি-র মনোগ্রাম।

তারানার নির্দেশে আনিস টেবিলে রাখা রিভলভারটির উপর হাত রেখে সাইকিকের দিকে তাকালেন। গভীর মনযোগের সাথে তাকে লক্ষ্য করলেন সাইকিক, অনিশ্চয়তার সাথে ভ্রু কুঁচকালেন। মনে হচ্ছে, যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এক পর্যায়ে মনস্থির করে বললেন, ‘না।’

আনিসকে আবার হাতকড়া পরিয়ে লক-আপে নিয়ে যাওয়া হলো। নিয়ে আসা হলো সুরভির খালাতো ভাই খালেককে। তার বেলাতেও সাইকিক না-সূচক মাথা নাড়লেন।

সবশেষে আনা হলো সুরভির বর্তমান প্রেমিক বশিরকে, বসানো হলো নির্ধারিত চেয়ারে। তিনি রিভলভারে হাত রেখে সামনে তাকাতেই সাইকিক হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। তার শরীরে হাল্কা কাঁপুনি দেখা গেলো। একবার কথা বলতে গিয়েও পারলেন না। তারপর ফিসফিস করে বললেন, ‘হ্যাঁ, ইনি।’

তারানা মইনের দিকে তাকালো, যেন ওর সম্মতির জন্য অপেক্ষা করছে। মইন মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝাতেই তারানার হাত চলে গেল জ্যাকেটের ভিতরে। পরক্ষণেই তার হাতে দেখা গেল একটা ‘Glock 17’ পিস্তল, ডিবি সদস্যদের অনেকে যেটা ব্যবহার করেন।

সাইকিকের দিকে পিস্তলটা তাক করলো তারানা, বললো, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।’

(৮)

কিছুই স্বীকার করছেন না সাইফুল। বার বার বলছেন, আমি আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী, আমার উত্তর ৭১% সঠিক হয়েছে, সাধারণ লোকের পক্ষে এটা সম্ভব নয়।

তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলো তারানা। বললো, ‘আপনার উত্তর ঠিক হয়েছে মাত্র ৫৬টা। যে কারও ক্ষেত্রেই এটা হতে পারে। আপনার সামনে ৭১টা বলা হয়েছে যাতে আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে আপনার মতলব হাসিলের চেষ্টা করেন। আমরা এখন জানি, আপনি বশিরকে ফাঁসাতে এখানে এসেছেন। আপনি যদি নাও বলেন কে আপনাকে পাঠিয়েছে, আমরা বের করতে পারবো। বশিরের সাথে শত্রুতা আছে, এমন লোকদের মধ্যে খুঁজলেই হবে। আপনি যদি সহযোগিতা করেন, আপনার শাস্তি কম হবে।’

সাইফুল ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। কিন্তু, কিছু বললেন না। অবশেষে, একজন এস.আই. গিয়ে একটা চড় কষাতেই গড়গড় করে সব বলতে শুরু করলেন তিনি।

বশিরের বিজনেস পার্টনার ফরহাদ প্রথমে বশিরকে মারার পরিকল্পনা করে। কিন্তু, ওদের শত্রুতার কথা সবাই জানে বলে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে সেই প্ল্যান বাদ দেয়। বশিরের সাথে সুরভির ঝামেলা শুরু হলে ফরহাদ সুযোগটা কাজে লাগায়। সে জানতো সেদিন রাত এগারোটায় বশির সুরভির বাসায় যাবে। সে অনুযায়ী ফরহাদ খুনটা করে, যাতে বশিরকে ফাঁসাতে পারে। কিন্তু, পুলিশ বশিরের চেয়ে আনিসকে বেশী সন্দেহ করায় ফরহাদ সাইকিককে কাজে লাগাতে চেষ্টা করে।

(৯)

‘তোকে আনা হলো পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে। কিন্তু, তুই কাজ করলি ঝানু গোয়েন্দার মত। আচ্ছা, ডিসি স্যার তো অনেক স্মার্ট, তিনি কেন চিন্তা করলেন না, লোকটা সাইকিক না হলেও পুকুরটা সার্চ করতে হবে?’

‘তিনি স্মার্ট তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। পরিসংখ্যান নিয়ে আমাকে কী জেরাটাই না করলেন! কিন্তু, তিনি সাইকিক, গণক – এসবে বিশ্বাস করেন বলেই তার ফোকাসটা ভুল দিকে চলে গেছে। ভেবেছেন, লোকটা সাইকিক হলে সম্মান করবেন, না হলে ঘাড় ধরে বের করে দিবেন। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন, লোকটা সাইকিক হয়ে থাকলে বরং রিভলবারটা না-ও পেতে পারতেন?’

‘কী!’ খুবই অবাক হলো তারানা।

‘হ্যাঁ, আপু। সাইকিকদের ক্ষমতা সাধারণ লোকদের চেয়ে বেশী, কিন্তু তাদের ধারণা ১০০% সঠিক তো নয়। এমন হতে পারতো, লোকটা সত্যিই সাইকিক, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভুল করেছেন।’

‘তাই তো!’

‘কিন্তু, সাইকিক না হয়েও তিনি যেহেতু বলেছেন পুকুরে রিভলভার আছে, এতে নিশ্চিত হয়েছি পুকুরে রিভলভারটা সত্যিই আছে – তিনি সেটা জানেন এবং সাইকিক সেজে কোন একটা স্বার্থ আদায় করতে চান।’

‘তুই একটা জিনিয়াস।’

জিনিয়াস হয়ে কী লাভ হলো, মনে মনে বললো মইন। বয়স বছর তিনেক বেশী হলে হয়তো সুযোগ ছিলো। এখন মনের কথা কোনদিন বলা হবে না।

তারানা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে মইনের দিকে তাকালো। বললো, ‘তোকে একটা কথা বলি। কিছু কিছু চিন্তা মনে কখনও ঠাঁই দিতে নেই। মনে থাকবে?’

‘জ্বী, আপু।’ মইন একটু চমকে গেছে। ভাবছে, নকল সাইকিকের পর এবার আসল সাইকিকের সামনে পড়েছে।

(শেষ)

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪

জাফর আহমেদ খান

প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪