fbpx

উপলব্ধি

এক

মাহমুদ সাহেবের বুকের ব্যথাটা সন্ধ্যা থেকেই একটু একটু বোঝা যাচ্ছিলো, কিন্তু পাত্তা দেয়ার মতো না; তিনি পাত্তাও দেননি। কিন্তু এখন, এই রাত সাড়ে এগারোটায় আর পাত্তা না দিয়ে পারছিলেন না। ঊনষাট বছরের এই শরীরটাতে এক হার্টের সমস্যা ছাড়া মাহমুদ সাহেবের তেমন কোন জটিলতা নেই। এই জটিলতাকেও তিনি একেবারে যে অবহেলা করে চলেছেন তা বলা যাবে না। তবে হয়তো আরও গুরুত্ব দেয়া যেত যেটা তিনি দেননি; দেয়ার প্রয়োজনও মনে করেননি। যাই হোক সন্ধ্যার ব্যথা যখন রাত এগারোটা পার করলো তখন মাহমুদ সাহেবের মনে হলো জীবনের শেষ দুর্ঘটনা বোধ হয় হাজির হয়েছে। মাহমুদ সাহেব বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসলেন। বিছানার পাশের টেবিলটা থেকে কাগজ আর কলম নিয়ে লিখতে বসলেন।

মাহমুদ সাহেব যে ওল্ড হোমটাতে আছেন সেটা সাধারণভাবে বেশ আধুনিক বলা যায়। আধুনিক ডিজাইন এর ফ্ল্যাট বাড়িতে প্রতি ফ্ল্যাটে ৩/৪ জনের জন্য একেকটা রুম রয়েছে। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন; খাবার ও অন্যান্য বিনোদনের ব্যবস্থাও খারাপ না। মাহমুদ সাহেব এখানটাতে উঠেছেন প্রায় দুই সপ্তাহ হলো। নিজের ফ্ল্যাটটার একটা বন্দোবস্ত করে শেষ সামান্য সঞ্চয় নিয়ে এখানে উঠেছেন জীবনের শেষ দিনের অপেক্ষা নিয়ে। এ কারণেই বুকের ব্যথাটা যখন মনে একটা দুর্ঘটনার চিন্তা এনে দিলো, তখন কাগজ কলমের কথাটাই আগে মনে পড়লো। কেননা শিপ্রাকে কিছু কথা না লিখে গেলে মেয়েটার কাছে দায়ী  থেকে যাবেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

শিপ্রা মাহমুদ সাহেবের এক মাত্র সন্তান। শিপ্রাকে নিজ সন্তান হিসেবে মাহমুদ সাহেব মনে প্রাণে বিশ্বাস করলেও শিপ্রা করে না। করার খুব যৌক্তিক কারণও নেই; কারণ তৈরির জন্য মাহমুদ সাহেব কখনো জোরও করেননি। মাহমুদ সাহেব সব সময়ই চেয়েছেন তার মেয়ে একজন আধুনিক চিন্তার মানুষ হোক। এ কারণে মেয়ের চিন্তায় বা ধারণায় প্রভাব ফেলার চেষ্টা করতে উনার কখনো ভালো লাগেনি। শিপ্রার মা শায়লাকে যখন মাহমুদ সাহেব বিয়ে করেন তখন শিপ্রার বয়স আট বছর। শিপ্রা ক্লাস টু তে পড়ে। শিপ্রার বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যাবার দুই বছর পর শায়লার সাথে মাহমুদ সাহেবের বিয়ে হয়।

বিয়ের ব্যাপারটাতে মাহমুদ সাহেবের তেমন আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু ছোট বেলা থেকে অভিভাবক হিসেবে যে বড় ভাই ভাবী মানুষ করেছেন সেই বারো বছরের বড় ভাই যখন মারা গেলেন এবং ভাবী যখন একমাত্র ছেলের কাছে কানাডাতে চলে গেলেন তখন ভাবীর চাপাচাপিতেই মাহমুদ সাহেব বিয়ের ব্যাপারে রাজি হয়েছিলেন। শুধু ভাবী নয়, ভাইয়ের মেয়ে টুম্পা যাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন তার জেদটাকেও মাহমুদ সাহেব ফেলতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু বয়স তখন চল্লিশ। এ বয়সে কোন রকম আয়োজন না করেই শায়লাকে ঘরে তুলে নিয়ে আসেন; সাথে শিপ্রাকেও।

মজার ব্যাপার হলো অনেক পুরুষ মানুষের মতো বিয়ের পর মাহমুদ সাহেবের মনে হতো যে বিয়েটা পুরুষ মানুষের জন্য দরকার কেননা এই শায়লার সাথে বিয়েটাই মাহমুদ সাহেবের জীবনটা পুরো পাল্টে দিলো। তবে শায়লা এখানে খুব বড় ভুমিকা রাখতে পারেনি। মাহমুদ সাহেবের জীবনটা যে পাল্টে দিয়েছে সে হচ্ছে শিপ্রা। শিপ্রা যেন আর এক টুম্পা। আট বছরের শিপ্রাকে যখন শায়লা প্রথম মাহমুদ সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় তখন শিপ্রা মাহমুদ সাহেবের দিকে খুব অনাগ্রহ নিয়েই তাকায়। যত দিন যায় মাহমুদ সাহেব বুঝতে পারেন যে, শিপ্রা আসলে তাকে বাবার জায়গাটা দিতে রাজি নয়। শায়লা শিপ্রাকে নিয়ে বেশ বিব্রতই বোধ করতো তখন। কিন্তু মাহমুদ সাহেব সে দিন থেকে এ শিশুটার জন্য জীবনের সব সুখ ত্যাগ করার একটা গোপন সিদ্ধান্ত নেন। একটা বাচ্চা যে একজন মানুষের জীবনের চাওয়া পাওয়া ঘুরিয়ে দিতে পারে এটা মাহমুদ সাহেবের ধারণাই ছিলো না।

শিপ্রা মাহমুদ সাহেবকে এড়িয়েই চলেছে সব সময়। বাসায় বা অন্য কোথাও মাহমুদ সাহেবের সাথে তেমন একটা কথা বলতো না কখনই। স্কুল বা কলেজে অভিভাবক হাজির থাকতে হলে শায়লাই থাকতো সব সময়। মাহমুদ সাহেবের যে এতে খুব খারাপ লাগতো তা না; কিংবা তিনি খারাপ লাগাটাকে খুব একটা পাত্তা দিতেন না। তবে মাহমুদ সাহেবের খুব ইচ্ছে হতো শিপ্রার অভিভাবক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে। কিন্তু সেটা কখনো করা হয়নি। কেন না শিপ্রার পছন্দ ছিলও তখন মাহমুদ সাহেবের কাছে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত মাহমুদ সাহেব তার সীমিত আয়ে যে বিলাসিতাটুকু করেছেন সেটা হচ্ছে শিপ্রার জন্য যখন তখন জামা, জুতা আর খেলনা কিনে আনা। কিন্তু এসব কোন কিছুই শিপ্রাকে খুব একটা খুশি করতে পারতো না এটা মাহমুদ সাহেব বুঝতেন। আর এ থেকে মাহমুদ সাহেবের অপরাধ বোধটা বাড়তেই থাকে। তার মনে হতো তিনি আসলে শিপ্রাকে বাবার আদরটা দিতে পারেন নি।

একটা সময় শায়লা বাচ্চা নিতে চাইছিলো কিন্তু মাহমুদ সাহেবে রাজি হননি। তার বারবারই মনে হয়েছে সে বাচ্চাটাকে শিপ্রা মেনে নিতে পারবে না। তাছাড়া শিপ্রা তো তার লক্ষ্মী মেয়ে, তাকে কষ্ট দেয়া তার পক্ষে সম্ভব না। শায়লাকে তিনি শিপ্রার বাবার কোন স্মৃতিই নষ্ট করতে দেননি শুধু মাত্র শিপ্রার কথা ভেবেই। কিন্তু তারপরও তিনি বিভিন্ন সময় শিপ্রার কষ্টের কারণ হয়েছেন যেটা নিয়ে মাহমুদ সাহেবের জীবনভর আক্ষেপ রয়েই গেছে। শিপ্রার জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয় যখন এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময় বাবার নাম লিখতে বললে শায়লা মাহমুদ সাহেবের নাম লিখতে বলে। শিপ্রা খুব বিরক্তি নিয়ে তার মা’র দিকে তাকিয়েছিলো সে সময়। মাহমুদ সাহেবও সে সময় বাসায় ছিলেন। তিনি শিপ্রার কাছ থেকে ফরমটা চেয়ে নিয়ে নিজেই শিপ্রার জন্মদাতা বাবার নামটা লিখে দিয়েছিলেন। শায়লা খুব বিরক্ত হয়েছিলো সে সময়। শায়লার মতে একটু বাড়াবাড়িই না কি করে ফেলছিলেন মাহমুদ সাহেব। কিন্তু মাহমুদ সাহেব সব সময়ই চেয়েছেন যেন তার মেয়ে সত্যটা নিয়ে বড় হোক সেটা যত কঠিনই হোক না কেন।

এ কারণে শিপ্রার অভিমানকে তিনি পাত্তা দিয়ে গেছেন সব সময়। শিপ্রা যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে হলে চলে যেতে চাইলো তখন শায়লা অনেক আপত্তি করলেও মাহমুদ সাহেব করেননি। কারণ তিনি বুঝতেন যে শিপ্রা তার ছায়া থেকে বের হতে চায়। তিনি যখন শিপ্রার জন্য হলে থাকা ভালো হবে এটা শায়লাকে বোঝাতে গেলেন তখন অবশ্য শায়লা উল্টোটা বুঝলো। শায়লা ভাবলো তার মেয়েটাকে মাহমুদ সাহেব আর নিতে পারছেন না! কিন্তু তার পরও মাহমুদ সাহেব শিপ্রার চাওয়াটাই গুরুত্ব দিলেন। শিপ্রা হলে উঠার দুই বছরের মাথায় শায়লা মারা গেলেন। হয়তো মেয়েটার কথা ভেবে ভেবেই দুশ্চিন্তা করতেন!

শায়লা মারা যাওয়ার পর থেকে শিপ্রার বাসায় যাতায়াত একেবারেই কমে গেলো। মাহমুদ সাহেবই যেচে কিছু খোঁজ খবর নিতেন। বিভিন্ন সময় টাকা পয়সার দরকার হলে পৌঁছে দিতেন। মাহমুদ সাহেব বুঝতেন যে, এ সব খরচ দেয়াটা শিপ্রার পছন্দ না, সে নিজেই নিজের খরচ যোগাড় করে নিতে চায়। তারপরও মাহমুদ সাহেব শিপ্রার ছোট খালার মাধ্যমে শিপ্রার দেখা শোনা করে যেতে লাগলেন। মাহমুদ সাহেব শিপ্রার বিয়ের জন্য কিছু আলাদা সঞ্চয়ও রাখছিলেন নিয়মিত। কিন্তু বছর তিনেক আগে হঠাৎ খবর পেলেন শিপ্রা তার এক সিনিয়রকে বিয়ে করেছে। মাহমুদ সাহেব কষ্টই পেয়েছেন খবরটা শুনে যদিও কষ্টটা প্রকাশ করার কোন মানুষ ছিলো না। শিপ্রা মাহমুদ সাহেবের মতামত না নিয়ে বিয়ে করেছে এটা কষ্টের কারণ না। মাহমুদ সাহেবের শেষ ইচ্ছাটা ছিলো মেয়েটার ধুমধাম করে বিয়ে দিবেন; অন্তত শিপ্রার মা-বাবা থাকলে যেমন আদরে দিতে চাইতেন তার কোন ঘাটতি যেন না হয় সে বিষয়ে তিনি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। এ কারণে তিনি শায়লা মারা যাবার পর সখের গাড়িটা বিক্রি করে রিক্সায় অফিস যাতায়াত করা শুরু করেছিলেন।

শিপ্রার ছোট খালা নায়লার কাছ থেকে মাহমুদ সাহেব শিপ্রার সব খবরই পেতেন। একমাত্র খালা বলে এই খালার সাথেই শিপ্রার সখ্য বেশি। মাহমুদ সাহেব নায়লার মাধ্যমেই শিপ্রাকে টাকা পয়সা দিতেন। শিপ্রা অবশ্য জানতো নায়লাই দিচ্ছে। শিপ্রার বিয়ের পর সংসার খুব ভালো চলছে না এ খবর মাহমুদ সাহেব নায়লার কাছ থেকেই পান। তার মনটা ভেঙ্গে যায় একদম। মাহমুদ সাহেব অনেক ভেবে চিন্তে তার থাকার ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে সঞ্চয় থেকে আরো কিছু টাকা দিয়ে একটা নতুন ফ্ল্যাট কিনলেন শিপ্রার জন্য। একমাত্র নায়লাই জানতো ব্যপারটা। নায়লা যখন ফ্ল্যাটের ব্যাপারে শিপ্রাকে বলে তখন শিপ্রা এতোটাই বিরক্ত হয় যে, মাহমুদ সাহেবকে ফোনে স্পষ্ট বলে দেয় যে তার ভাবনা সে নিজেই করতে চায়। এসব নিয়ে যেন মাহমুদ সাহেব না ভাবেন।

মাহমুদ সাহেব আর ভাবেননি নতুন করে কিছু। শুধুমাত্র অবসরে গিয়ে জীবনের সঞ্চয়ের প্রায় সবটুকু নায়লার কাছে জমা রেখে এই ওল্ড হোমটাতে এসে উঠেছেন দিন পনেরো হলো। আসার সময় নায়লাকে বলে এসেছেন, তার মেয়ে যেন কখনো কষ্টে না থাকে।

দুই

শিপ্রার সকাল থেকেই বিষণ্ণ লাগছে। বিয়ের প্রায় দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে কিন্তু অভাব অনটন কাটাতে পারছে না। শিপ্রার স্বামী তমালের চাকরিটা ছোট খাটো হলেও তাতে দুজনের চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তমালের বাড়িতে যে সাপোর্টটা দিতে হয় তাতে মাস শেষে টানাটানি তো থাকেই। মাঝে মধ্যে মাস শেষের আগেই শুরু হয়ে যায়। এই মাসটাও তেমনই। আজ মাসের ২২ তারিখ। কিন্তু তমালের কাছে মনে হয় টাকা পয়সা নেই। সকালে অফিস যাওয়ার সময় শিপ্রার কাছ থেকে দু’শ টাকা ধার নিয়ে গেছে। শিপ্রা যদিও কিছু করে না কিন্তু ছোট খালা মাসে মাসে শিপ্রাকে কিছু হাত খরচ দেয়। ওটা থেকেই শিপ্রা সংসারটা চালিয়ে নিয়ে যায় কোন রকম।

কিন্তু আজ অবস্থা খুব খারাপ। সকালে চা বানাতে গেলে দেখে চা বা চিনি কোনটাই নেই। তমালকে ফোন করে বলে লাভ নেই কারণ ওর হাতে টাকা পয়সা নেই এটা শিপ্রা বুঝতেই পারছে। শিপ্রা হাতের অবস্থা চিন্তা করে তখনই ভেবেছে বিকেলে একবার ছোট খালার কাছে যাবে।

সংসারের এই দৈন্য দশাতে শিপ্রার এখন কিছুতা ক্লান্ত লাগে। কিন্তু তারপরও তো মুক্তির পথ নেই। কেউ যে এসে শিপ্রাকে উদ্ধার করবে তার কোন উপায় নেই। মা থাকলে তাও না হয় একটা কথা ছিলো। মা না থাকায় শিপ্রার এখন আর আশ্রয়ের কেউ নেই। মাহমুদ সাহেব অবশ্য রয়েছেন। কিন্তু তাকে শিপ্রা ছেলেবেলা থেকেই ঠিক আপন করতে পারেনি। শিপ্রার সব সময়ই মনে হয়েছে যে এই লোকটা তার মা আর তার সুন্দর সংসারটাতে একটা বাগড়া দিতে এসেছে। এ কারণে মা’র উপরও শিপ্রার কিছুটা অভিমান রয়েছে। মা যখন এই লোকটার কোন কিছুতে কোন দোষ খুঁজে পেতো না তখন মায়ের উপর শিপ্রার রাগটা আরো বেড়ে যেতো। মনে হতো এই লোকটা মাকেও তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। বাবা হতে হলে জন্ম দিতে হয় এই বিশ্বাসটা কেন যেন শিপ্রার মাথায় ছোট থেকেই ঢুকে গিয়েছিলো। তাই জন্ম দিয়েও যখন তার বাবা তার পাশে থাকতে পারেনি তখন তাকে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি ও। আর তাই মাহমুদ সাহেব যখন তার বাবার জায়গায় আসলেন তখন সেই দুর্ভাগ্যের বোঝা আরও যেন বেড়েই গেলো; অন্তত শিপ্রার কাছে তাই মনে হতো।

শিপ্রা যখন বাসায় বসে এসব কথা ভাবছে তখনই কলিং বেলটা বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখে ছোট খালা। শিপ্রার মনটাই ভালো হয়ে গেলো।

“খালামনি” বলেই চিৎকার করে নায়লার উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো শিপ্রা।

“কী রে, কেমন আছিস?” নায়লার গলাটা কেমন ভারি শোনালো শিপ্রার কাছে।

“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো, খালামনি?”

নায়লা শিপ্রার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললো,

“তুই একটু তৈরি হয়ে নে। তোকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবো”। এবারো নায়লার গলাটা কেমন যেন শোনালো শিপ্রার কাছে। একটু যেন মনমরা।

“কী হয়েছে খালামনি?” শিপ্রা এবার প্রশ্ন না করে পারলো না।

“তুই একটু বোস আমার কাছে” বলে নায়লা একটা কাগজ বের করে শিপ্রার হাতে দিলো।

“কী এটা?” শিপ্রার এ প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না নায়লা।

শিপ্রা কোন জবাব না পেয়ে কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করলো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছোট্ট একটা চিঠি।

“শিপ্রা মা,

আমার কোন দিনই যে কথাগুলো বলা হয়নি সেটা বলতে লিখছি। তোমাকে বলার সময় আমার শেষ হয়ে আসছে। তুমি তোমার অভিমানটুকু দূরে সরিয়ে রেখে আমার লেখাটা পড়বে। মা, আমি জানি আমি কোন দিন তোমার বাবা হতে পারিনি। আমি অবশ্য সে চেষ্টাটাও করিনি; কেননা আমার মনে হয়েছে তোমার বাবার জায়গাটা নিতে পারার যোগ্যতা আমার নেই। কেন এ কথা মনে হলো জানো? তোমার সাথে আমার যে দিন প্রথম পরিচয় হয় তখনই আমি তোমার দৃষ্টিতে আমাকে অগ্রাহ্য করার শক্তি দেখেছিলাম। সেই এতটুকু মেয়ের দৃষ্টিতে তার জন্মদাতা বাবার অধিকারকে রক্ষার যে প্রতিজ্ঞা আমি দেখেছিলাম তা আমাকে বিস্ময়ে অভিভূত করেছিলো। আমার সেদিনই মনে হয়েছিলো যে, এ মেয়েটা আমার। কিন্তু এ মেয়েকে যে জন্ম দিতে পারে তার জায়গা নেয়ার যোগ্যতা আমার নেই।   

শিপ্রা মা, আমি তোমাকে বাবার ভালবাসা দিতে পারিনি জানি; কিন্তু তুমি আমাকে সন্তানের অনুভূতি দিয়েছো। জন্মদাতা বাবা না হয়েও বাবার উপলব্ধি আমি পেয়েছি তোমার কাছে। তুমি না থাকলে জীবনের এতো মহৎ অনুভূতির আমি কোন স্পর্শই পেতাম না। আমি এ অনুভূতির মূল্য কোনদিনই দিতে পারবো না। তবু তুমি যেন একটা আরামদায়ক জীবন যাপন করতে পারো তার কিছু ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। আমি তো আর কখনো তোমাকে কোন অনুরোধ করতে পারবো না, সে ক্ষমতা আমার আর নেই। তাই এই ব্যবস্থাগুলো তুমি গ্রহণ করলে আমি খুশি হবো। আমি বেঁচে থেকে কোনদিন তোমাকে এ অনুরোধ করতে সাহস পাবো না বলেই মৃত্যুর পর করছি।

মা, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। বাবা হতে না পেরে তোমাকে যে কষ্ট দিয়েছি তার শাস্তি যেন পাই এ প্রার্থনা করো।

শিপ্রা মা, ভালো থেকো সব সময়।

মাহমুদ (শেষ সময়ে এসেও ‘তোমার বাবা’ কথাটা লেখার সাহস হলো না।)

পড়া শেষ করতেই শিপ্রার চোখটা কেন যেন ঝাপসা হয়ে যেতে লাগলো।

ব্যবস্থাপক |

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন:১৯৯৯-২০০০

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০