সাম্প্রতিককালের কিছু ধর্ষণের ঘটনায় অনেককেই দেখছি প্রতিবাদের ঝড় তুলতে। ঝড়ের নমুনা বিভিন্ন রকম। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে কিছু লোকজন দেখলাম আন্দোলনে নেমেছেন যে শিশুরা যৌন সম্পর্কের বিষয়টাই এখনো বোঝে না। আবার অনেকে দেখছি ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হোক এ ধরনের দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন যে, ধর্ষণ যেহেতু পুরুষ জাতি কর্তৃক সংঘটিত একটি অপরাধ এ কারণে পুরুষ জাতির পক্ষ থেকেও কণ্ঠ জোরালো হওয়া উচিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য। তবে বর্তমান যুগে যে অবস্থা দেখা যায় তাতে প্রধানমন্ত্রী ‘অ’ বলামাত্র ‘অসীম’ তৎপরতায় বিভিন্ন গ্রুপ যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েন তা বাস্তবায়নে; এখানেও তেমন হবে কি না এখন পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না। যাই হোক, মূল কথায় আসি।
লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিয়ে। ইদানিং কালে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে বাংলাদেশে যে কোন অপরাধ হলেই মৃত্যুদণ্ডকে শাস্তি হিসেবে দাবি তোলার একটা রেওয়াজ চলে এসেছে। অপরাধের মূলে কী কারণ বা অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্য কী এসব বিশ্লেষণের সুযোগ থাকে না; তার আগেই শাস্তি নির্ধারণ করতে আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছি। বিশেষ করে ফেসবুকে যখন এমন দাবির প্রতি বিভিন্ন জনের ব্যাপক সমর্থন দেখি তখন কিছুটা কিছুটা দ্বিধান্বিত হই যে, আসলেও এমন দাবি উত্তোলন যৌক্তিক কি না। যে কোন শাস্তি প্রদান বা নির্ধারণের পূর্বে গভীর চিন্তার প্রয়োজন।
একটা কথা এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমি ব্যক্তিগত ভাবে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে, সে যে অপরাধই হোক না কেন। মৃত্যু এমন একটা বিষয় যেটা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কারো অধিকারে নেই – সেটা সময়, ধরন কিংবা প্রচণ্ডতা যে বিচারেই হোক না কেন। এ ধরনের একটি কাণ্ডকে মানুষ নিজে নির্ধারণ করবে এটা মানা যায় না। তাছাড়া মানুষের মতো ত্রুটিপূর্ণ একটি প্রাণি সব সময়ই সঠিক বিবেচনায় শাস্তি বিধান করতে পারবে এটা আশা করা যায় না। তার চেয়েও বড় কথা মানুষ যেখানে তার আবেগ বিচার করে সম্পূর্ণ আপেক্ষিতকার উপর সেখানে মৃত্যুকে দণ্ড হিসেবে চাপিয়ে দেয়াটা বোধ হয় মানুষের জন্য অনধিকার চর্চা।
আর ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে হবে এটাও আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। মৃত্যুদণ্ডই যদি সকল অপরাধকে প্রতিরোধ করতে পারতো তাহলে তো সকল অপরাধের শাস্তিই মৃত্যুদণ্ড রাখা যেতো। হত্যাকাণ্ডের শাস্তিও তো আমাদের দেশে মৃত্যুদণ্ড, কই হত্যাকাণ্ড তো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পায়নি। আমাদের দেশে যতদূর মনে পড়ে এসিড নিক্ষেপের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। কিন্তু তাতে করে এসিড নিক্ষেপ হ্রাস পেয়ে গেছে যদি কেউ বলেন তা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ শুধু মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেই এটা হ্রাস করা সম্ভব নয়, সরকার অন্যান্য জায়গায় আরো কড়ারোপ করায় এটা হ্রাস পেয়েছে। কাজেই ধর্ষণের ক্ষেত্রেও মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিধান করলেই ধর্ষণ দ্রুত হ্রাস পেয়ে যাবে এটা ভাবার কোন কারণ আমি দেখি না।
চরম দণ্ডের বিধানের চেয়েও অধিকতর জরুরি বোধ হয় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আইন প্রয়োগে দুর্বলতা অপরাধীকে খুব স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী অপরাধ সংঘটনের জন্য অধিকতর সাহসী করে তোলে। রাষ্ট্র যদি এ কাজে দক্ষতার পরিচয় দিতে না পারে তবে সুনির্দিষ্ট যে কোন অপরাধের ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃত অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং দ্রুততম সময়ে প্রমাণাদি সাপেক্ষে শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। প্রকৃত অপরাধীকে ন্যায় বিচারের আওতায় আনা আমাদের মতো ক্ষমতার প্রভাব বিস্তারে অতি উৎসাহী জাতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কেন না আইন প্রয়োগ করা এবং সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রতি পদক্ষেপে আমরা এ দেশের আমজনতার কম বেশি সকলেই সর্ব শক্তি দিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে অভ্যস্ত। ফলে ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমরা যদি সততার পরিচয় দিতে না পারি তবে ধর্ষণের মতো অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিধানও খুব কার্যকর হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে বলে আমার মনে হয় না।
তাছাড়া ধর্ষণ হত্যাকাণ্ড বা এসিড নিক্ষেপের মতো আক্রোশজনিত অপরাধ না। ধর্ষণ একটি মানসিক বিকারগ্রস্ত অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে কঠিন শাস্তির বিধানের চেয়ে বিকার দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলে আমার মনে হয়। অনেক আগে আমাদের ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এর প্রয়াত মেয়র জনাব আনিসুল-এর একটা লেখায় (যত দূর মনে পড়ে) তিনি লিখেছিলেন যে, যৌন সঙ্গমের মতো একটা পারষ্পরিক কর্মকাণ্ড জোরপূর্বক কী করে সংঘটিত হয় এবং তা থেকে এক পক্ষ কী করে পরম তৃপ্তি লাভ করে তা উনার নিকট বোধগম্য নয়। আমিও উনার সাথে একমত।
যৌন সঙ্গমের মতো পারষ্পরিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত অনুকূল আবেগীয় পরিবেশ ছাড়া সাধারণ মানবিক পুলক অনুভবের মাধ্যমে তৃপ্তিকর স্বস্তি পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাহলে জোরপূর্বক এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের কারণ কী? আমার সাধারণ বুদ্ধিতে যেটা মনে হয় এর মূল কারণ দুর্বলের উপর সবলের শক্তি ও ক্ষমতা প্রকাশের একটা আনন্দদায়ক অভিব্যক্তির মাধ্যমে বীরত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস। আর এটা তখনই ঘটে যখন একজন সাধারণ সবল মানসিকতার ব্যক্তি নিজস্ব সামর্থকেও সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারে না যেটা তার মাঝে গোপন ক্ষোভের জন্ম দেয়। নিজ সামর্থ অনুযায়ী মত প্রকাশ বা স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে না পারা পৌরুষত্বের উপর বিরাট আঘাত। আর তাই পুরুষের এই ক্ষোভের আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করতে ব্যবহৃত হচ্ছে নারীরা। নারীদের উপর এই অত্যাচারের একটা কারণও রয়েছে বলে মনে হয়। বর্তমান যুগে অধিকার চর্চার যোগ্যতা অর্জনের পূর্বেই অধিকার সচেতনতার মনোভাব গড়ে ওঠায় এবং অধিকার খাটানোর চর্চায় বেশি মনোনিবেশ করায় নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজের অবস্থান নিয়ে প্রতিনিয়ত পুরুষের সাথে এতো বেশি তুলনামূলক মূল্যায়ন করেন যে কর্মস্থল সহ অন্যান্য অনেক স্থানেই নারী-পুরুষের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের তুলনায় প্রতিযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। ফলে পরষ্পরের প্রতি নির্ভরশীল হওয়াটাকে এখন অপরাধ বলে মনে করা হয় যেখানে মানুষ সমাজবদ্ধই হয়েছিলো নির্ভরশীলতাকে পুঁজি করে। আমার ধারণা নারী কতটুকু অধিকার পেলে সন্তুষ্ট আর পুরুষের কতটুকু দায়িত্ব তার প্রতি নারী আশা করেন এটা এখনো আমাদের দেশের নারীরা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারবেন না। একই ভাবে পুরুষও নারীর প্রতি দায়িত্ব পালনে কতটুকু অঙ্গীকারাবদ্ধ হবেন সে বিষয়ে পুরুষরা সততার পরিচয় দিতে এখনো অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন। ফলে পৌরুষত্বের দম্ভকে গুড়িয়ে দিতে নারী যেমন সোচ্চার তেমনি পৌরুষত্বের প্রতি আঘাত সয়ে পুরুষরাও বিকারগ্রস্ত হচ্ছেন দিন দিন। যার অন্তর্নিহিত ফলাফল উভয়ের প্রতি অবিশ্বাস আর অনাস্থা বৃদ্ধি আর বাহ্যিক ফলাফল যৌন নিপীড়ন। দু’টার কোনটাই আশাপ্রদ নয়।
এখানে মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে জরুরি পারষ্পরিক মানসিক সম্পর্কে আস্থা ফিরিয়ে আনা। আস্থা আর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার দাবি করুন। মত প্রকাশ, মত গ্রহণ, নিজের চাওয়াকে অন্যের জন্য উৎসর্গ করা আর নিজের পাওয়াকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দিতে শিখলে মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি দাবি করতে হবে না; অপরাধ এমনিই কমে আসবে।
সদস্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প্যাপাইরাস
প্রাক্তন শিক্ষার্থী
পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সেশন:১৯৯৯-২০০০
- রোকনুজ্জামানhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a6%a8%e0%a7%81%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ১, ২০১৫
- রোকনুজ্জামানhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a6%a8%e0%a7%81%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8/বুধবার, জুলাই ১, ২০১৫
- রোকনুজ্জামানhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a6%a8%e0%a7%81%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8/মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৬, ২০১৯
- রোকনুজ্জামানhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a6%a8%e0%a7%81%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০১৯
- রোকনুজ্জামানhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a6%a8%e0%a7%81%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০১৯