fbpx

একজন শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে আমার ভাবনা

বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা গণিতের শিক্ষক হিসেবে আমি এখনো শিক্ষার্থী। আমি সবসময়ই বলি, গণিত একটা সমুদ্র এবং আমি সেই সমুদ্র’র বিন্দু মাত্র জ্ঞান অর্জন করেছি। প্রতি মুহূর্তে আমি শিখছি এবং জানছি। একজন পদার্থবিদ কে কিছু নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সেটার বাস্তব কারণ এবং বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে কিন্তু একজন গণিতবিদ শুধু দিতে পারবে গাণিতিক যুক্তি । এজন্যই মনে হয়, একজন পদার্থবিদ ভালো গণিতবিদ হতে পারেন কিন্তু একজন গণিতবিদ ভালো পদার্থবিদ হতে পারেন আবার নাও হতে পারেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, গণিতবিদ না হয়ে পদার্থবিদ হলেই ভালো হতো।  জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে গিয়ে আমার সবচেয়ে মূল্যবান শিক্ষা এই যে, শেখার কোনো শেষ নেই এবং  জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা ছাড়া জ্ঞানের রাজ্যে টিকে থাকার কোনো বিকল্প নেই। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মাস্টার্স, পিএইচ ডি, পোস্ট ডক এগুলো হলো শুধুই একটা ভিত্তি, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান অর্জনে গবেষণার বিকল্প নেই।  যুক্তরাজ্য আর কানাডার পড়ালেখা থেকে  এটা জানলাম, গবেষণার ক্ষেত্রে এখনো  আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এই গবেষণার জায়গায় টিকে থাকতে হলে নিজেদের অনেক অনেক শিখতে হবে। শেখার কোনো বিকল্প নেই। এ থেকেই আমার উপলব্ধি একজন শিক্ষক হওয়া যতটা সহজ ঠিক ততটাই কঠিন একজন ভালো গবেষক হওয়া।

 একজন গবেষক হওয়ার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে উচ্চ শিক্ষা। এই উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কেমন? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা  নিজেদের মাসিক বেতন থেকে টাকা জমিয়ে দেশের বাইরে পড়তে  যান। একটা স্কলারশিপ পাবার জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকেন , সুযোগ পেলে তবেই না উচ্চ শিক্ষার সুযোগ । ফান্ড এর অভাবে কষ্ট করছেন, সব মুখ বুঝে মেনে নিচ্ছেন কারণ পড়ার সুযোগটা  তো হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করে থাকে আর আমাদের দেশে এ খাতে বিনিয়োগকে অনেকটা অপচয় হিসেবে বিবেচনা করা হয় । আমার অনেক ছাত্র আমার কাছে আসে যাদের অনার্স এর রেজাল্ট ভালো হয়নি বা ফাইনাল ফলাফল ভালো হবে না। তারা খুবই হতাশ কারণ তাদের ইচ্ছে ছিল গবেষক হবার  বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার । আমরা সবাই জানি, একজন ছাত্র অনেক কারণেই ভালো ফলাফল নাও করতে পারে কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সে একজন ভালো শিক্ষক হতে পারবে না। আমি তাদেরকে সব সময় একটা উপদেশই দেই, সেটা হলো মাস্টার্স এ একটা ভালো ফলাফল  করো। এরপর সেটা  দিয়ে দেশের বাইরে গিয়ে আরেকটা মাস্টার্স এবং পিএইচ ডি করে আসো। দেখবে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন গবেষক এবং পরবর্তীতে একজন শিক্ষক হবার সুযোগ পাবে। শুধু শুরুটা করা দরকার!

অর্থ বা ফান্ড যেখানে দেশের বাইরে উচ্চ শিক্ষার একটি বড় প্রতিবন্ধকতা সেখানে বর্তমানে অনলাইন শিক্ষা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিকল্প পথ খুলে দিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে সোশ্যাল মিডিয়া যেমন ফেইসবুক, গুগল ক্লাসরুম, গুগল সাইট ইত্যাদি ব্যবহার করছে আমাদের শিক্ষকরা, আমিও করছি। অনলাইন ক্লাস রুম এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, একজন শিক্ষক হয়তো ক্লাসরুমে একভাবে পড়াতে পারে কিন্তু আরো অনেক রিলেটেড মেটেরিয়াল থাকে যা হয়তো ক্লাসরুমে আপনি সময়ের অভাবে পড়াতে পারছেন না। সেটা আপনি সহজেই শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন। কোনো শিক্ষার্থী হয়তো আপনাকে ক্লাস এ প্রশ্ন করছে না, সে সহজেই আপনার কাছে পৌঁছাতে পারছে অনলাইন ক্লাসরুমের কারণে। যেমন এ বছর আমি প্রোগ্রামিং ক্লাস এসাইনমেন্ট দিচ্ছি শিক্ষার্থীদেরকে। অনলাইন ক্লাসরুমে তারা আমাকে অনলাইন এ প্রোগ্রামিং এসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে, আমি দেখে গ্রেডিং করে ফেলছি। একই সাথে তাদের সাথে আমি নতুন নতুন ক্লাস ম্যাটেরিয়ালস-ও শেয়ার করছি যেটা  থেকে ক্লাসরুমের বাইরেও তারা কিছু  শিখতে পারবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আপনি ক্লাসরুমে ক্লাস নিচ্ছেন সপ্তাহে ২-৩ ঘন্টা কিন্তু অনলাইন ক্লাসরুমে আপনি ক্লাস নিতেন পারেন ২৪/৭। আমরা যদি ছাত্র-শিক্ষকদের চাহিদা অনুযায়ী একটা অনলাইন ক্লাসরুম তৈরি করতে পারি তাহলে আমার মনে হয়, বাংলাদেশে খুব শীঘ্রই এটা জনপ্রিয়  হয়ে উঠবে। আমার মনে হয় না, এটা খুব একটা কঠিন কাজ হবে। বরং আস্তে আস্তে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসরুমের পাশাপাশি অনলাইন ক্লাসরুম চালু করা এখন সময়ের দাবি।

রিভিউয়ার : একজন শিক্ষকের শিক্ষকতার পাশাপাশি আরেকটা কাজ হলো গবেষণা করা । সেই গবেষণার ই একটি অংশ রিভিউয়ার এর দায়িত্ব পালন করা ।  গত সাত বছর ধরে আমি এলসভিআর এবং স্পিনজার পাবলিশার এর বিভিন্ন জার্নাল এর পেপার রিভিউ করছি।  আমার মনে হয়, গত ৫ বছরে আমি প্রতি ১০ টা পেপার এর ১ টা পেপার কে একসেপ্ট করেছি। একসেপটান্স এর হার ১০%. এর পিছনে আরেকটা কারণ আছে। রিভিউয়াররা যেভাবে আমার পেপার কে রিভিউ করে তাতে মনে হয়, আমি তাহলে আরেকটু কঠিন ভাবে করি না কেন? আমি আগে দেখি কাজটা কতটা ইউনিক এরপর শুরু করি কাজটাকে আরো কত বেশি আপডেট করা যেত কিন্তু কেন করা হয়নি। সেই কাজ গুলো করার জন্য রেকোমেন্ড করি। ভালো জার্নাল গুলোতে এখন পেপার দেবার পর একসেপটান্স পাবার চান্স ২০-২৫% হয়ে গেছে। ৫০% পেপার তো এডিটর এর প্রি- এসেসমেন্ট থেকেই বাতিলের খাতায় নাম লেখায়। বাকি পেপারগুলো রিভিউ হবার পর ডিসিশন হয়। এখন আর বলে না একসেপ্টেড উইথ মাইনর কারেকশন। বরং সরাসরি বলে দেয় রিজেক্টেড। একটা ভালো কাজ করতে লেগে যায় ১ থেকে দেড় বছর আর পাবলিশ করতে লাগে আরো ৬ মাস থেকে ১ বছর। আবার ভালো কাজ করলেই হয় না, ভালো জার্নাল গুলোতে আমাদের মতো যাদের ফার্স্ট ল্যাংগুয়েজ ইংলিশ নয় তাদেরকে সবসময়ই শুনতে হয় “লেখার কোয়ালিটি মানসম্মত হয়নি”। রিয়ালিটি চেক!

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের গবেষণার জন্য আর্থিক সুবিধা বা তহবিল সুবিধা কেমন সেদিকে যদি আমরা একটু দৃষ্টিপাত করি তাহলে স্পষ্টতই বোঝা যাবে কেন এদেশে গবেষক তৈরি হচ্ছে না। বাংলাদেশে ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুমানিক কত জন শিক্ষক আছেন? তারপর গবেষণা খাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ৬৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা কে যদি আমরা শিক্ষক সংখ্যা দিয়ে ভাগ দেই, তাহলে একজন শিক্ষক মাথা পিছু কত টাকা করে পাবেন গবেষণার জন্য? সে তুলনায়  উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতের বাজেট আমাদের থেকে অন্তত ৪০ গুন বেশি। গবেষণার বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে তো গড়পরতা হিসেব করলে হয় না, গবেষণার বিষয়বস্তুও এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।  একজন গবেষকের গবেষণার ব্যয় বা বাজেট নির্ভর করে গবেষণার বিষয়বস্তু, গবেষণার ধরণ ও প্রক্রিয়ার উপর।  ধরা যাক, একজন গবেষকের একটা  সাধারণ গবেষণা প্রকল্পে  বছরে ৪-৫ লক্ষ টাকার  প্রয়োজন হবে। কিন্তু  গবেষণা করার জন্য তিনি পাবেন ২-৩ লক্ষ টাকা।  এক্ষেত্রে বাকি টাকা  সংগ্রহ করার জন্য  তাঁকে দেশি-বিদেশি বহু প্রতিষ্ঠান এর কাছে  ধরণা দিতে হবে। এক্ষেত্রে এ প্রশ্ন তো খুবই যৌক্তিক যে একজন  গবেষক কি ফান্ড আনার জন্য  দ্বারে দ্বারে  ঘুরবেন না কি  গবেষণা প্রকল্পের  কাজ করবেন। উন্নত দেশে কি শিক্ষক বা গবেষকরা ফান্ড এর জন্য ঘুরে বেড়ান?  সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় আর ইন্ডাস্ট্রি গুলোর  মধ্যে একটা কমন প্লাটফর্ম থাকে যারা গবেষণা প্রকল্পে অর্থায়ন করে থাকে। ভালো গবেষণার জন্য ভালো অবকাঠামো সুবিধা অত্যাবশ্যক।সেটা আমাদের কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে? ভালো অবকাঠামো সুবিধার জন্যও অর্থের প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে যথাযথ অবকাঠামো সুবিধা, দক্ষ লোকবল, উন্নত যান্ত্রিক সুবিধা প্রভৃতি ছাড়া উন্নত গবেষণা সম্ভব নয়। আর এ সব কিছুর জন্য গবেষণা বাজেট শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অপ্রতুল। স্বল্প ব্যয়ে উন্নত গবেষণা সম্ভব নয় বলেই উন্নত দেশগুলো গবেষণার জন্য বড় বাজেট বরাদ্দ রাখে। আমি যদি বলি, আমি বাংলাদেশের মশার দ্বারা সৃষ্ট রোগ নিয়ে কাজ করবো, সেটা করার জন্য যে অর্থ এবং যন্ত্রপাতি লাগবে, সেটাই তো আমি পাবো না। একটা গবেষণার জন্য যদি দেয়া হয় বছরে ২-৩ লক্ষ টাকা, তাহলে একজন গবেষণা সহকারীকে যদি আমি আমার কাজে ১ বছরের জন্য ব্যবহার করি, তাকে মাসে অন্তত: ২০০০০ টাকা করে দিতে হবে, তাহলে তার পিছনে আমার খরচ হবে ২,৪০,০০০ টাকা। ফিল্ড ওয়ার্ক করার জন্য তাকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে, সেটার খরচ আছে। যন্ত্রপাতি কেনা এবং অন্যান্য কাজ করার জন্য ও তো লোক লাগবে। সব কাজ তো আর একটা খাতা আর কম্পিউটার এর সামনে বসে করা যায় না। এটাই যদি হতো, তাহলে বাইরের দেশে গবেষণার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করতো না।  গবেষণার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে এর ফলাফল বিশ্লেষণ করে প্রয়োগ ও সে অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ। গবেষণা করা মানে এই নয় যে, ভালো জার্নাল এ একটা পেপার পাবলিশ করা বরং তার প্রয়োগও থাকতে হয়। আমিতো আর বিশুদ্ধ গণিত নিয়ে কাজ করি না, তাই ফলিত গণিত এ তার বাস্তব প্রয়োগ এবং তার সুবিধা গুলো কি সেটাও ভাবতে হয়। এখন ছাত্রছাত্রীরা পাস করে বার হবার পর চাকরি খুঁজে, ভালোরা তো পেয়েও যায়। এখন একজন ফুল টাইম গবেষককে প্রতি মাসে ২০০০০ টাকা দিয়ে ধরে রাখা যায় না। আর একটা ভালো গবেষণা করার জন্য যিনি গবেষণা করান তারও অনেক পরিশ্রম করতে হয়।  দিন শেষে,  গবেষককে ভাবতে হয়,  এই গবেষণা করে তিনি  কী পেতে  যাচ্ছেন। মূল গবেষক ও সহকারী গবেষক সবারই জ্ঞান অর্জনের বিচারে চাওয়া পাওয়ার একটা হিসেব  থাকে।

গবেষণাগার নিয়ে আরো একটু বলা দরকার বলে মনে হয়; বিশেষ করে এক্সপেরিমেন্টাল গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষণাগারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একজন শিক্ষক যখন দেশের বাইরে গিয়ে গবেষণা কাজে এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করেন, তখন তাঁর সবচেয়ে বেশি দরকার হয় একটা গবেষণাগার যাকে আমরা ল্যাব বলি। এই ল্যাব মানে শুধু এই নয় যে সেখানে টেবিল আর চেয়ার থাকে, বরং সেখানে এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য যন্ত্রপাতি-ও থাকে। একটা ল্যাব-এ যে যন্ত্রপাতি থাকে তার মূল্য পরবে ৩০ লক্ষ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা। কখনো এর থেকে বেশিও হতে পারে। আমাদের দেশে গবেষণা অবকাঠামো খাতে এ ধরনের ব্যয়ের মানসিকতাই নেই।  সাইন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির বেশিরভাগ কাজ-ই তো এক্সপেরিমেন্টাল। আমাদের যন্ত্রপাতি নেই, তাই আমরা না শিক্ষার্থীদের শেখাই, না  নিজেরা ব্যবহার করি। আমার পিএইচডি কাজের সময় আমাকে যখন বলা হলো, তুমি তোমার কাজের একটা অংশ এক্সপেরিমেন্ট করো, আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! আমি তো কখনো এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করিনি। অথচ, আমার সাথে নাইজেরিয়া থেকে আসা ছেলেটা কিন্তু ঠিক-ই করতে পেরেছে। বিশেষ করে, যারা ফলিত গণিত, পদার্থ, রসায়ন এবং বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট-এ পড়ছে, তাদের জন্য এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করা বাধ্যতামূলক। আমাদের শিক্ষার্থী যারা এই এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করে দেশে ফিরে আসে তাদেরকে জিজ্ঞাসা  করলে দেখা যাবে যে, তারা খুব কমই দেশে বসে তাদের গবেষণা কাজ করতে পারছে। একসময় তারা নিজেরাই শিখে আসা বিদ্যা ভুলে যাচ্ছে। আমি যেমন পিএইচডি করার সময় প্যারালাল কম্পিউটিং করেছিলাম, আমাদের কয়টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা করার অপশন আছে? এখন যদি আমি সেই কোডটা নিয়েই কাজ করতে যাই, যদি সেই অপশন-ও থাকে, সেটার যে খরচ তা কি গবেষণা খাতে যে ১-২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় সেটা দিয়ে  বহন করা সম্ভব? আর যদি ধরে নেই সম্ভব, তাহলে কি পুরো  গবেষণা করার জন্য সেই ১-২ লক্ষ টাকা পর্যাপ্ত হবে? উন্নত দেশে গবেষণা প্রস্তাবের উপর যেখানে বাজেট বরাদ্দ হয় আমাদের দেশে হয় উল্টোটা – বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী গবেষণা প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। ফলে উন্নত ও কার্যকর গবেষণা করা সম্ভব হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের গবেষণামুখী করতে উন্নত অবকাঠামো সুবিধাসহ বাজেটের দিকে মনোযোগী হওয়া জরুরি এবং উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে শিক্ষক কর্তৃক গবেষণার বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। যখন বাংলাদেশে আমাদের গবেষণা করার জন্য ফান্ডিং এপ্লিকেশন করতে বলা হয় তখন বলা হয়, সেই ফান্ড মাথায় রেখেই প্রপোসাল দিতে। এমন নয় যে, আপনি চাইলেন ১ লক্ষ টাকা, আপনাকে ১ লক্ষ টাকাই দেয়া হবে । চাইবেন ১ লক্ষ টাকা, পাবেন হয়তো ৭৫ হাজার টাকা। ব্যাপারটা এমন যে, যারা যাচাই বাছাই করেন, তারাও মনে করেন, টাকা টা বেশি চাওয়া হয়েছে। যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের ভাবা উচিত, কিভাবে শিক্ষকদের গবেষণামুখী করা যায়। যেসব শিক্ষকরা গবেষণা করবে না, বরং তাদের সময় অন্য কিছুতে ব্যবহার করবে, তাদের সব ধরণের প্রমোশন বন্ধ করে দিন। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে সেখানে অনেক শিক্ষক প্রভাষক হিসাবে তাদের চাকরি জীবন শেষ করেন। অনেক শিক্ষক আছে, যারা কম সময়ে শুধু গবেষণা করার জন্য দ্রুততম সময়ে প্রমোশন পেয়ে যাচ্ছে। ইউ.জি.সির বুঝা উচিত, সরকার একা কিছু পরিবর্তন করতে পারবে না, পরিবর্তন করার জন্য আমাদের সকল কে একটি নির্দিষ্টতো লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত একটি গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে যেখানে শিক্ষকরা তাদের অধিকাংশ সময় গবেষণার জন্য দেবেন এবং সেই গবেষণার জন্য অবশ্যই পর্যাপ্ত ফান্ড থাকতে হবে। শিক্ষকদেরকে শুধু ক্লাস রুম-এ পড়ানোর জন্য বাধ্য না করে গবেষণামুখী করতে হবে। পৃথিবীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়-ই প্রাচ্যের পাঠশালা নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষা আর গবেষণা ছাড়া একটি দেশ কখনোই উন্নত দেশ হতে পারেনি। আমি বলবো না যে, গবেষণা হচ্ছে না । হচ্ছে, কিন্তু খুবই সীমিত পরিসরে। বিশ্বাস না হলে, একবার ৪৫ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে আসুন। উত্তর আপনিই পেয়ে যাবেন। দেশের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শিক্ষার মান কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।  বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার মতো পর্যাপ্ত সময়, সুযোগ, অর্থ কিছুই নেই। শিক্ষকদের কাজ একটাই, ক্লাস-এ যাও আর পড়াও। বিশ্ববিদ্যালয় যেন প্রাচ্যের পাঠশালা। বাংলাদেশে এমন অনেক ধনকুবের আছেন তারা হাজার হাজার কোটি টাকা দান করে দিলেও তাদের কোনো ক্ষতি হবে না, তারা যদি এই টাকাটাই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য দান করতেন তাহলে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগুলে আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশ একটা ভালো অবস্থানে পৌঁছে যেতো। জাপান. চীন এভাবেই নিজেদেরকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সবশেষে, প্রতিভাকে বেড়ে উঠার জন্য সুযোগ করে দিতে হয়, সেটা করতে হয় ভবিষ্যতের জন্য। শুধু বর্তমান নিয়ে আত্মতৃপ্তি থাকলে কখনো স্বপ্নকে সত্যি করা যায় না।

শিক্ষক | গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়