fbpx

দৈবচয়িত ৫

প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পঞ্চম অধ্যায়
দ্বিতীয় বিকেল

লোকটাকে ইমাম ইমাম লাগছেনা।

ফজলুল হক হল মসজিদে জুমার নামাজের খুতবা হচ্ছে। মহিন, বিজয়, আর অরণ্য তিন জনই বসে আছে। ফজলুল হক হল মসজিদের ইমাম মাওলানা ফজলুল হক। কাকতালীয়ভাবে হলের নামে তার নাম। ফরসা, বেঁটে করে লোকটা। মাথায় একটা গোল টুপি। দূর থেকে মনে হচ্ছে তালের টুপি-জাতীয় কিছু হবে।

-আপনারা সবাই এখানে এসেছেন জ্ঞানের সন্ধানে। জ্ঞান অর্জন পুণ্যের কাজ। পবিত্র কুরানের সুরা জুমারের নয় নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক জিজ্ঞেস করছেন, “জ্ঞানী এবং মূর্খরা কি সমান হতে পারে?”। বুখারী শরীফে আছেঃ “জ্ঞানের অন্বেষণে যারা বের হয়, তাদের জন্য আল্লাহ পাক বেহেশত সহজ করে দেন”।

নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত…

ইমাম সাহেবের বয়ানে সুরের প্রচণ্ড অভাব! কিন্তু মন দিয়ে শুনছে সবাই।  নোয়াখালীতে চান মিয়া হাজী সাহেবের মসজিদে নামাজ পড়তে যেত অরণ্য। সুরেলা টানে বেসুরো গলায় মাইক বাজিয়ে মাওলানা লুতফর রহমান যে খুতবা দিতেন তা শুনে মনে হয় কাক-পক্ষীও গ্রামছাড়া হত। “কাল কেয়ামতের মাঠে আল্লাহ পাক যখন জিজ্ঞেস করবেন…’’ বলে দোজখের যে ভয়াবহ বর্ণনা শুরু করতেন পেছনে বসে অরণ্য আর বন্ধুরা মিলে নিজেদের মাঝে ফিস ফিস করে বিকেলে ভলিবল খেলার পরিকল্পনা করত। এমন অনেকদিন হয়েছে ভক্তির আতিশয্যে কিশোরগঞ্জের বেচু মিয়া ডাল পালা ভেঙ্গে চিৎকার করে বাচ্চাদের পিটিয়েছে মসজিদকে বাজার বানিয়ে ফেলার অপরাধে। অরণ্যর পৃষ্ঠদেশ অক্ষত রয়ে গেছে শুধু বাবার কল্যাণে। এমন নয় বাবাকে ওরা ভয় পায় – কিন্তু বেচু মিয়ার ধারণা এমন বাবার ছেলে এমন কাজ করতেই পারে না!

কিন্তু এখানে মসজিদভর্তি যুবারা মন্ত্রমুগ্ধের মত মাওলানা ফজলুল হক সাহেবের বয়ান শুনছে।  

“ভুলে যাবেন না আপনাদের আল্লাহ পাক পছন্দ করে এখানে নিয়ে এসেছেন। চিন্তা করে দেখুন আপনাদের সঙ্গে প্রাইমারী স্কুল, হাই স্কুল, বা কলেজে যারা যারা পড়তেন তাদের কয়জন এখানে আসতে পেরেছেন? তারা নিশ্চয়ই সবাই খারাপ ছাত্র ছিলেন না। তাহলে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেননি কেন? কারণ তাদের জন্য আল্লাহ পাক অন্য কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন। আর আপনাদেরকে নিয়ে এসেছেন এখানে – দেশের সেরা বিদ্যাপীঠে। বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। আপনারা আপনাদের মেধা দিয়ে নিজেকে যেমন এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তেমনি এগিয়ে নিয়ে যাবেন দেশকে। আপনি মাইক্রোবায়োলজি পড়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অরগানিজম নিয়ে গবেষণা করবেন, আর আবিষ্কারের প্রতিটি মূহুর্তে আল্লাহপাকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপনার হৃদয় ভরে উঠবে। আপনি সৃষ্টির জটিল প্রক্রিয়া অনুধাবন করতে পেরে নিজের মনে বলে উঠবেন, সুবহানাল্লাহ! আপনি পদার্থবিজ্ঞানে নিউটনের সূত্র পড়ে অবাক হচ্ছেন আর ভাবছেন কী অসীম ক্ষমতাবলে পুরো মহাবিশ্বকে এভাবে নিয়মনীতির সমীকরণে নির্ভরশীল করে রেখেছেন আল্লাহ পাক। সুবহানাল্লাহ! বলুন সুবহানাল্লাহ!”

মন্ত্রমুগ্ধের মত সবাই বলে, সুবহানাল্লাহ!

“আপনারা কেউ কেউ পলিটিশিয়ান হবেন। কেউ কেউ ব্যারিস্টার হবেন। ম্যাজিস্ট্রেট হবেন। বিচারপতি হবেন। কিন্তু দুটো জিনিস মনে রাখবেন,”… অরণ্যর মনে হল এই ইমাম সাহেব খুব স্মার্ট। তিনি জানেন তার শ্রোতা কারা। এদেরকে সুরে সুরে বেহেশত দোজখের গল্প শুনিয়ে লাভ নেই। এদেরকে এদের জিনিষ দিয়েই ধর্ম শেখাতে হবে। ইমাম সাহেব বলে চলেন, “এক, যেহেতু আল্লাহ আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছেন, তাঁকে ভুলবেন না যেন কখনও। আল্লাহ পাক কোরানে মজিদে বলেছেন, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, ‘কুল্লিল্লাহুম্মা মালিকাল মুল্কে, তুতিল মুল্কা মান তাশাউ, ওয়া তাঞ্জিউল মুল্কা মেম্মান তাশাউ, ওয়া তুয়েজ্জু মান তাশাউ ওয়া তুজেল্লু মান তাশাউ বে ইয়াদিকাল খাইর; ইন্নাকা আলা কুল্লে শাইয়িন কাদির’। আল্লাহ, সার্বভৌম শক্তির মালিক, আপনি যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান করেন, আর যাহার নিকট হইতে ইচ্ছা, ক্ষমতা কাড়িয়া নেন; আর যাহাকে ইচ্ছা সম্মান প্রদান করেন, যাহাকে ইচ্ছা হীন করেন। কল্যাণ আপনার হাতেই। নিশ্চয়ই আপনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান। দুই, আপনার দায়িত্ব পালনে আপনি কোরান মজিদের শিক্ষা স্মরণে রাখবেন। তাহলে আপনি কখনো অন্যায় করবেননা, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবেন না। বরং, আল্লাহ পাকের নির্দেশ মোতাবেক আপনি সৎ কাজের ভাগীদার হবেন। আল্লাহ পাক বলেছেন, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ‘ইন্নাল ইন্সানা লা ফি খুসর। ইল্লাল্লাজীনা আমানু ওয়া আমেলুস সোয়ালেহাত; ওয়াতাওয়া সাও বিল হাককে, ওয়াতাওয়া সাও বিস সবর’, অর্থাৎ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; তারা বাদে, যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে, এবং পরষ্পরকে সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়”।

অরণ্য ভাবল, এরকম ইমামদের পৃথিবীর সব মসজিদে রাখলে ধর্ম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান আরো বাড়ত। এই ইমাম সাহেবকে একদিন সুদ-সংক্রান্ত প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে হবে। 

—–

অরণ্যকে ছ’টার দিকে ঘোরাতে নিয়ে যাবে বলে মহিন চলে গেছে কোথাও। জিমে এসে দিবানিদ্রায় বেহুঁশ বিজয়। পাশেই একটা খাতা আর কলম নিয়ে লিখতে বসল অরণ্য। সবুজ মলাটের খাতাটায় একটার পর একটা নোট। ডায়েরি ঠিক নয় –জনসচেতনতামূলক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর তালিকা বলা চলে। পাতায় পাতায় বিভিন্ন শিরোনামের নিচে কিছু বুলেট। গত তিনদিনে তিনটি পাতার ব্যবহার এরকমঃ

পাতা – ১৩

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা

  • ছাত্রছাত্রীদের ভোগান্তি
  • অর্থ/সময় সাশ্রয়
  • টেকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি

পাতা-১৪

নোয়াখালী এক্সপ্রেস

  • এক্সপ্রেস কেন?

পাতা-১৫

ছাত্র রাজনীতি

  • গৌরবগাঁথা
  • ক্রান্তিকাল
  • পরিবর্তন

এগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে সময়-সুযোগ বুঝে লিখতে বসা। কিন্তু আজ লিখতে ইচ্ছে করল না। বাড়ির কথা মনে পড়ছে খুব করে। বিশেষ করে বাবাকে। অরণ্য বুঝতে পারলনা কেন এমন হচ্ছে। যে বাবাকে ওরা সব ভাই-বোনেরা যমের মত ভয় পায়, তাকে এত করে মনে পড়ার কোন কারণ খুঁজে পেল না ও। বাবাকে ভয় পাওয়ার ব্যপারটা মনে পড়লে হাসিও আসে। একবার হয়েছিল কী – পুকুরঘাটের একেবারে নিচের ধাপে পানিতে কাপড় ধুচ্ছিল অরণ্য। উপরে পুকুরঘাটের ঠিক উপরের ধাপে দাঁড়িয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কিরে সাবান আছে? অরণ্য নিচের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিয়েছিল, জ্বী। এর উত্তরে বাবা কিছু বলেননি।  অরণ্যর কাপড় ধোয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরপরও প্রায় অনেকক্ষণ ও পানিতে হাত ডুবিয়ে খেলা করছিল পাছে উপরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে বাবার চোখাচোখি হতে হয়। বাবা কখন চলে গিয়েছেন ওখান থেকে, ও জানেই না। অনেকক্ষণ পরে উপরে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই ওখানে। অদ্ভুত!

ও ঠিক করল, বাবাকে একটা চিঠি লেখা যায়। ওর ফিরতে অন্তত এক সপ্তাহ বাকি। এর মধ্যেই নিশ্চয়ই চলে যাবে বাড়িতে।

“বাবা,

সালাম জানিবেন। আম্মাকে সালাম দিবেন। বড় আপা, মেজ আপার জন্যও সালাম রহিল। দীপা, সুহাস, সুদীপ, তন্ময়, মিতুল, স্নিগ্ধা, অসীম, আর মৃম্ময়ীর জন্য রহিল আদর ও স্নেহ।

পর সমাচার এই যে, আমি নিরাপদে ঢাকায় আসিয়া পৌঁছাইয়াছি। ভাইয়া স্টেশনে আসিয়াছিলেন আমাকে লইয়া যাইতে। কোন অসুবিধা হয় নাই। আজ একটা পরীক্ষা শেষ হইয়াছে। পরীক্ষার কেন্দ্র খুঁজিয়া পাইতে একটু বিড়ম্বনার শিকার হইতে হইয়াছে, কিন্তু মনে হয় না পরীক্ষা খারাপ হইয়াছে”।

শেষের বাক্যটি লিখে ওর মনে হল বাবা এ চিঠি পড়তে পড়তেই বকা দেবেন। “মনে হয় না” মানে কী? পরীক্ষা কে দিয়েছে? তুই না অন্য কেউ? তুইই যদি পরীক্ষা দিয়ে থাকিস তাহলে তোর মনে হবে বা হবে না কেন? তুই তো সেটা জানবি। গাধা কোথাকার!

অরণ্যর হাসি পেল। ও ইচ্ছে করেই পরিবর্তন  করল না। না করেই আবার লিখতে শুরু করল।

“এখানকার সব কিছুই খুব সুন্দর সাজানো-গোছানো। সুন্দর সুন্দর লাল রঙের দালান। হলের সহিত আবার সুন্দর একখানা বড় পুকুরও রহিয়াছে। পুকুরে অন্যরা গোসল করিলেও ছাত্ররা বাথরুমেই গোসল করিয়া থাকে। পানি ভাল না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষেধাজ্ঞা রহিয়াছে। পুকুরের চারিপাশে আমাদের বাড়ির মত নারিকেল গাছ। পুকুরের পাড়ে বসিয়া থাকিলে সুন্দর ঝিরি ঝিরি শব্দ পাওয়া যায়।

খাওয়া-দাওয়ার কোন অসুবিধা হইতেছে না। ভাইয়ার বিছানায় আমরা দুইজন থাকি। মহিন ভাইয়া আপাতত অন্য এক বন্ধুর সহিত রাত্রি যাপন করিতেছেন। উনি খুব ভাল মানুষ। আজ বলিয়াছেন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় দেখাইতে লইয়া যাইবেন। আপনাকে পরে ইহার বিবরণ জানাইব।

আমার জন্য দোয়া করিবেন যাহাতে পরের পরীক্ষাও ভালমত দিতে পারি এবং আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করিতে পারি।

ইতি,

আপনার স্নেহের

অরণ্য”।

—–

মানুষের ঢল টিএসসিতে। বিকাল বেলা এত মানুষ এখানে কী করছে, টিএসসির দিকে হাঁটতে হাঁটতে কৌতুহল নিয়ে জানতে চায় অরণ্য। মহিন ওকে বুঝিয়ে বলে।

-আড্ডা দিচ্ছে। সারাদিন ক্লাস করার পর ছেলেমেয়েরা আসে এখানে সময় কাটাতে। চা নাস্তা খায়, গালগল্প করে, আবার হলে ফিরে যায়।

-কতক্ষণ থাকে সবাই?

-যার যতক্ষণ ইচ্ছা। তবে আটটার পরে ভিড় কমে যায়। বেশির ভাগ ডাইনিং দশটার দিকে বন্ধ হয়ে যায়। আর তাছাড়া পড়াশোনা থাকে যে! কেউ কেউ আবার টিভি দেখার জন্য তাড়াতাড়ি ফেরে। চল তোমারে  ভিতরে নিয়ে দেখাই। অনেক রকম গ্ৰুপ আছে এখানে। নাটকের দল, নাচের দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন, বিতর্ক সংসদ, আরও অনেক কিছু। ওরা এখানে ওদের প্র্যাকটিস করে, মিটিং করে।

-এরা সবাই কি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে?

-না, না । টিএচসি হচ্ছে ওপেন এরিয়া। মানে সবার জন্য উম্মুক্ত। এখানে সব ধরণের সৃজনশীল কাজকে উৎসাহিত করে বিশ্ববিদ্যালয়।

-খুব ভালো তো! আপনি তো দেখেছেন আমরা কিশোর ক্লাবটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি খালি জায়গার অভাবে। এরকম স্কুল কলেজ গুলো যদি এদের সাপোর্ট দেয় তাহলে খুব ভাল হয়।

– আস দেখি, আজকে কোন নাটকের দল আছে কিনা। এটা তোমার ভাগ্যের উপর। থিয়েটার, আরণ্যক, লোকনাট্য দল এরা খুব আসে। মামুনূর রশীদ,  ফজলুর রহমান বাবু, চমী কায়সার, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, উনাদের কমবেশি সবসময়ই এখানে পাবা।

বলতে বলতে হাত ধরে অরণ্যকে নিয়ে  টিএসসির ভেতরে ঢুকে পড়ে মহিন।

বিল্ডিংয়ের ভেতরে যে মাঠ থাকতে পারে তা অরণ্য ফজলুল হক হলেই দেখেছে। কিন্তু এমন সুন্দর সবুজ মাঠ যে টিএসসির  ভেতরে থাকবে ও কল্পনাও করতে পারেনি। সে মাঠের বিভিন্ন কোণ জুড়ে বিভিন্ন গরুপ বসেছে গোল হয়ে। মনে হচ্ছে মেলা বসেছে এখানে। প্রাণের মেলা। এমন উচ্ছলতা অরণ্য আগে কোথাও কখনও দেখেছে বলে ওর মনে পড়ছে না।

-আস আস, তোমার কপাল ভাল। ওই যে ওই কোনায় দেখতেচ, ওখানে আরণ্যক রিহারসাল করতেছে।

অরণ্য তাকিয়ে দেখল গোটা পনের-বিশ নারী-পুরুষের একটা দল গোল হয়ে বসেছে সেখানে। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু তিন জন অভিনয় করে তাদের সংলাপ বলছে।  আর তাদের এদিক ওদিক করে দেখিয়ে দিচ্ছেন আর কেউ নন – বিখ্যাত অভিনেতা মামুনুর রশীদ। নাটকের নামটা জানতে পারলে ভাল হত। আজিজুল হাকিমকে দেখা যাচ্ছে। পাশের মেয়েটাকে চেনা যাচ্ছে না। অরণ্যদের বাড়িতে টিভি নেই। কিন্তু পত্রিকায় চোখ বুলানোর কল্যাণে সব বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীকেই চেনা অরণ্যর। এত কাছে থেকে উনাদের দেখা যাবে সেটা তার  মাথায় আসেনি কখনো। বাবাকে লিখতে হবে চিঠিতে। চিঠিটা যেহেতু ছাড়া হয়নি এখনো, আজ রাতেই লিখতে হবে।

অরণ্যকে ওখানে অপেক্ষা করতে বলে মহিন উধাও হয়ে গেল। অরণ্য টিএসসির ক্যাফিটেরিয়ার সামনের বারান্দায় পা-টা ঘাসে দিয়ে বসে বসে আরণ্যকের রিহার্সাল দেখতে লাগল।  এতটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিল যে সময়ের কোন ভ্রুক্ষেপ ছিলনা।

-অর্ণি, নাও সিঙ্গারা খাও।

মহিনের ডাকে চমকে ঘুরে তাকাল অর্ণি।

-ও, অর্ণি, শুন, এ হচ্ছে রুমা, আমার বন্ধু। আর রুমা, এ হচ্ছে অর্ণি। তোমাকে বলেছি না, বিজুর ছোট ভাই।

মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়াল অরণ্য। মাথা নিচু করেই বলল, স্লামালেকুম।

-তোমাকে উঠতে হবে না, বস। তুমি কি লজ্জা পাচ্ছ আমাকে?

সত্যি বলতে, অরণ্যের খুব লজ্জা হচ্ছিল। কেন, ও জানে না। মুখে বলল, জ্বী না।

-আচ্ছা, বস। মহিন, চল আমরাও বসি।

ওরা তিনজন ঘাসের উপর বসল। রুমা বসতে বসতে বলল, খাচ্ছ না যে! কেমন লাগছে ঢাকা?

-জ্বী, খুব ভাল।

-পরীক্ষা কেমন হল?

-জ্বী, ভাল।

-চান্স পাবে বলে মনে হয়?

অরণ্য উত্তর দিল না। মহিন বলল, ও খুব ভাল ছাত্র। আমি শিওর, ও টিকবে।

-টিকলে কী পড়বে ঠিক করেছ?

-জ্বী না। তবে ফিজিক্স পড়তে ভাল লাগে আমার।

-হা হা। ভাইয়ের মত ফিজিসিস্ট হতে চাও তাহলে। আর শুন, জ্বী জ্বী করতে হবেনা আমার সঙ্গে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কোন ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলছ। আমি তোমার ম্যাডাম না।

-জ্বী আচ্ছা।

রুমা হেসে ফেলে। শব্দ করে হাসি।

-তুমি তো আবার বললে। শুন, আমি তোমার বড় বোন না। আমি তোমার বন্ধুও না। আমি কী জান, আমি মাঝামাঝি একটা কিছু। কাজেই আমাকে ভয় পেতে হবে না। এই যে ধর, আর একটা সিঙ্গারা নাও।

অরণ্য এতক্ষণে ভাল করে রুমার দিকে তাকাল। প্রশান্তির একটা প্রলেপ পুরো চেহারায়। হাসি লেগে আছে পুরো মুখ জুড়ে। মায়া মায়া একটা ভাব চোখেমুখে।

অরণ্য হাত বাড়িয়ে সিঙ্গারাটা নিল। বলল, আপনি খাবেন না?

-না আমি অলরেডি খেয়ে ফেলেছি দু’টা। তোমার মহিন ভাইয়ার পাল্লায় পড়লে তুমি সারাদিনই কলিজা সিঙ্গারা খাবে।

-এই আমার অজুহাত দিবা না। তুমিও তো কলিজা সিঙ্গারা খেতে পছন্দ কর, কর না?

-তা করি।

রুমা মনে মনে বলল, কেন করি, তা কিন্তু তুমি জান না।

-চা খাবে? এই পিচ্চি, এদিকে আয়।

চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে একটা পিচ্চি এগিয়ে এল। এই, তিন কাপ চা দে।  বালতির ময়লা পানিতে তিনটে ছোট ছোট কাপ ডুবিয়ে ধুয়ে নিল পিচ্চি। তারপর তিনটা কাপে ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালল।

অরণ্যর সঙ্গে রুমা অনেক গল্প করল। বাসায় কে আছেন, বাবা কী করেন,  বোনেরা কি করছে, এসব। অরণ্য এখন আর লজ্জা পাচ্ছে না একটুও। রুমা আপার কথাই ঠিক। মনে হচ্ছে একটা বড় বোন যে চোখ রাঙ্গিয়ে শাসন করবে না কিন্তু আদর করবে। বন্ধুও না কিন্তু বন্ধুর মত সব কথা শুনবে। গল্প করতে করতে অরণ্যর মনে হল, রুমা আপার সঙ্গে কার যেন প্রচণ্ড মিল। ঠিক মনে করতে পারল না। কোন বইতে পড়েছে, এমন চরিত্র? কোন নাটক দেখেছে,  যেখানে এমন কেউ ছিল? না মনে আসছে না।  কিন্তু এটা বুঝল যে মহিন ভাইয়া আর রুমা আপা শুধু বন্ধু নয়। রুমাকে যখন ওরা ডাসের কোণে বিদায় দিচ্ছিল, তখন ওর মুখ ফসকে বের হল, অন্নদা দিদি। রুমা এবং মহিন একসঙ্গে বলে উঠল।

-কোথায়?

-না না, আমার মনে হচ্ছিল আপনার সঙ্গে কার যেন মিল আছে কোথাও। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। এখন মনে হল, আমার মাথার ভেতরে শ্রীকান্তের অন্নদা দিদির যে ছবি আঁকা আছে, সেটার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। 

-আমাকে তোমার এতটা দুঃখী মনে হয়?

-না না, সরি। আমি সেটা ভেবে বলিনি। কেন মনে হল আমি নিজেও জানি না।

-আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন যাই তাহলে। মহিন তোমার সঙ্গে ক্লাসে দেখা হবে।

-আচ্ছা, রুমাদি।

রুমা মিষ্টি করে হেসে ঘুরে রোকেয়া হলের গেটের দিকে চলে গেল।

দেরি হয়ে গিয়েছিল। বিজয় বসে থাকবে ওদের জন্য। একসঙ্গে খেতে যাবে। সেজন্য  মহিন একটা রিকশা ডাকল। রিকশায় উঠেই অরণ্য জিজ্ঞেস করল, রুমাদি কিছু মনে করল না তো, আমি যে উনাকে অন্নদা দিদির সঙ্গে তুলনা করলাম?

-আরে না! ও কিছুই মনে করবে না। কিন্তু, আমারে বলবা, কেন তোমার মনে হইছে?

-না মহিন ভাই। আমার সবসময় মনে হয় অন্নদাদিদি একটা মায়া ভরা নাম। রুমাদি এত মায়া করে কথা বলে…

-আচ্ছা, আমি বলব ওকে।

-আচ্ছা, মহিন ভাই, রুমাদি কি খ্রীষ্টান?

-কেন, কী করে বুঝলে?

-না, উনি যে নেকলেসটা পরেছিলেন, তার লকেটে একটা ক্রুশ ছিল।

-ও আচ্ছা, তাই বল। আচ্ছা সে গল্প অনেক লম্বা। তোমার দিদির কাছ থেকেই শুনবা একদিন।

ফজলুল বাসেত (পুরো নাম: আবদুশ শাকুর ফজলুল ওয়াহেদ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক ।

বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন।

পরিসংখ্যান নিয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের পত্রিকায় অনিয়মিত কলাম লেখেন।

ফজলুল বাসেত

ফজলুল বাসেত (পুরো নাম: আবদুশ শাকুর ফজলুল ওয়াহেদ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক । বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। পরিসংখ্যান নিয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের পত্রিকায় অনিয়মিত কলাম লেখেন।