fbpx

কাশ্মীর এক বিতর্কিত উত্তরাধিকার: ১৮৪৬-১৯৯০ (১ম খণ্ড : তৃতীয় অধ্যায়)

জম্মু ও কাশ্মীর এবং বৃটিশ ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা : উত্তর সীমান্ত অঞ্চলের সমস্যা

মহারাজা রণবীর সিং-এর শহিদুল্লা অভিযান অধ্যায় এবং জনসনের খোটান ভ্রমণ, সাথে ১৮৬৮-৭২ সময়ে রুশ, ইয়াকুব বেগ এবং আফগানদের সাথে বিভিন্ন ভাবে যোগাযোগ রক্ষা (যে বিষয়ে ইংরেজরা প্রথমদিকে কিছুই জানতো না) – এ সব কিছুই খুব পরিষ্কারভাবে ভারত সরকারের কাছে এটা তুলে ধরেছিলো যে, সতর্ক নজরদারি ছাড়া জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য তার অনন্য ভৌগলিক অবস্থানের কারণে একটি স্বাধীন বৈদেশিক নীতির লক্ষ্যে অগ্রসর হতে পারে। ১৮৬০ দশকের শেষ দিকে লেহ্-তে অবস্থানকারী বৃটিশ কমিশনার কর্তৃক যখন লাদাখে মহারাজার বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ নজরদারি করা হতো তখন মহারাজার এই তৎপরতার জন্য গিলগিট রুটই পরম ভরসা ছিলো; যে পার্বত্য পথ দিয়ে ১৮৭৭ থেকে বৃটিশদের গিলগিট এজেন্সিতে যাতায়াত করা যেতো (বর্তমানে এটা পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে পড়েছে)।

দারদিস্তানে মহারাজার সীমানা কোথায় সে বিষয়ে ১৮৪৬ সালের অমৃতসর চুক্তি একেবারেই অস্পষ্ট। চুক্তির অনুচ্ছেদ ১ অনুযায়ী তা ইন্দু নদী পর্যন্ত যার পূর্বদিকে জম্মু ও কাশ্মীর অবস্থিত। কিন্তু যেখানে ইন্দুর বেশির ভাগ অংশ রাজ্যের পূর্ব-পশ্চিমে বয়ে চলেছে সেখানে উত্তরদিকের কী অবস্থা? এক্ষেত্রে ইন্দু এবং অপরিচিত পর্বতশ্রেণি – যার পেছনে পূর্বাঞ্চলীয় তুর্কিস্তান অবস্থিত –এর মধ্যে বেশ কিছু ছোট রাজ্য রয়েছে, যেমন- চিত্রাল, হুনজা, নাগর, গিলগিট, পুনিয়াল, ইক্ষুমান, ইয়াসিন এবং এমন আরো কিছু (চিলাস ও অ্যাস্টর এর মতো রাজ্য যারা হয় ইন্দুর পাড়ে জম্মু ও কাশ্মীর সীমান্তে অথবা ইন্দুর দুই পাড়ে পড়েছে)।

এ সম্পূর্ণ এলাকার মুল চাবিকাঠি হচ্ছে গিলগিট। উত্তর থেকে ইন্দুতে গিয়ে পড়া একটি নদীর কিনারায় অবস্থিত গিলগিট হুনজায় (বালতিত হুনজা’র রাজধানী) প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতো। সংরক্ষিত ইতিহাস মোতাবেক পূর্বাঞ্চলীয় তুর্কিস্তানে প্রবেশের পর্বতশ্রেণির উপর দিয়ে একটি বাণিজ্য পথ ছিলো যদিও এটি ছিলো দুর্গম ও দস্যুদের লুটতরাজের জন্য পরিচিত। ঊনিশ শতকের দিকে হুনজার অধিবাসী কানঝুটিরা এ ধরনের লুটেরা হিসেবে চিহ্নিত ছিলো।২৫ গিলগিট থেকে চিত্রাল, এমন কি বর্তমান আফগানিস্তান, কাফিরিস্তান (“অবিশ্বাসী”দের ভূমি) এর মতো দুর্গম ও রহস্যজনক স্থানে যাওয়া যেতো। অমৃতসর চুক্তির অল্প কিছু দিন আগে শিখরা গিলগিট এর উপর খুব ক্ষীণ একটি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলো যেটা গুলাব সিং ১৮৪৬ সালে উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। ১৮৫২ সালে তাঁর এই চৌকি উপজাতিদের বিদ্রোহের তোড়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় এবং তাঁর কার্যকর সৈন্যদল বাধ্য হয়ে ইন্দুর বাঁদিকের তীরে (এখান থেকে পূর্বে) বুনঝিতে স্থানান্তরিত হয়। মহারাজা রণবীর সিং কর্তৃক ১৮৬০ সালে গিলগিট পুনঃদখল হয় এবং গিলগিটের রাজধানী ওয়াজারাত হিসেবে এটি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য পর্যন্ত বর্ধিত হয়।

হুনজা (এবং ঠিক এর পূর্বেই এর ঐতিহ্যগত বিরোধী, নাগর) দীর্ঘদিন গিলগিটের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে ছিলো।২৬ ফলে মহারাজা রণবীর সিং কর্তৃক সীমান্তবর্তী পর্বতশ্রেণিতে কর্তৃত্বকারী উত্তরাঞ্চলের এই পর্বত রাজ্যগুলোতে প্রভাব বিস্তার করাটা অবশ্যম্ভাবী ছিলো। ১৮৭০ নাগাদ একটি চুক্তির মাধ্যমে হুনজার শাসক (অর্থাৎ মির) ডগরাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন যেটা হুনজা কর্তৃক ডগরা আনুগত্য মেনে নেয়া বলেই মহারাজা রণবীর সিং মনে করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, হুনজা ইতিমধ্যে পূর্বাঞ্চলীয় তুর্কিস্তানের (যেটা ১৮৬০ এর পূর্ব পর্যন্ত চাইনিজদের অংশ ছিলো) কর্তৃপক্ষের সাথে একটি গভীর সম্পর্ক স্থাপন করেছিলো এবং এর শাসকগণ জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের অংশ হিসেবে নিজেদেরকে স্পষ্টভাবেই অস্বীকার করে এসেছে।২৭ অপরদিকে চাইনিজ দৃষ্টিতে মাঞ্চু সাম্রাজ্যের সম্রাটের অধীনে হুনজা ছিলো একটি ছোট্ট আনুগত্যশীল রাজ্য।২৮

দারদিস্তানে ডগরাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে চিত্রালের শাসক মেহতা’র বেশ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছিলেন; মেহতা’র ১৮৬০ দশকব্যাপী চিত্রালে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন। চিত্রাল, দারদিস্তানের অপর রাষ্ট্রগুলোর বিশেষ করে ইয়াসিন-এর উপর প্রভাব বিস্তার করতে ডগরার প্রতিযোগী ছিলো এবং গিলগিটে ডগরাদের অবস্থানের প্রতি এটি ধারাবাহিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলো। চিত্রাল দীর্ঘদিন যাবৎ আফগান রাজনৈতিক অঙ্গনেও জড়িত ছিলো। ভূরাজনৈতিকভাবে ১৮৬০ এর দশকে এটি মূলতঃ জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য এবং কাবুলের শাসক কর্তৃপক্ষের চাপের মধ্যবর্তী অবস্থানে ছিলো। ১৮৭০ দশকে চিত্রাল ডগরাদের আধিপত্য স্বীকার করে নেয়; যেটা ১৯১৪ এর মাসতুজ চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে বৃটিশ তদারকিতে আসে। কিন্তু যে ইতিহাস আমাদের কৌতুহলের বিষয় সেটা হচ্ছে এটা জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের কাহিনীর তুলনায় বৃটিশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের ক্রমবিকাশের সাথে অধিক জড়িত।২৯

১৮৭০ দশকে দারদিস্তানের কৌশলগত গুরুত্ব নিয়ে বৃটিশদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ শুরু হয়। এটা উত্তরাঞ্চলীয় আফগানিস্তান ও চাইনিজ তুর্কিস্তান উভয়ের আক্রমণ বা নাশকতা থেকে বৃটিশ ভারতকে ঢালের মতো প্রতিহত করতো যেখানে ভারত সরকার মনে করতো যে এ দুটোই জারের সম্ভাবনাময় লক্ষ্যবস্তু ছিলো। এ বছরগুলোতে দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধ আসন্ন হওয়ায় (এবং রুশ অভিসন্ধির বিষয়ে সন্দেহ বৃদ্ধি পাওযায়) ভারত সরকার এ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, প্রত্যক্ষ বৃটিশ নিয়ন্ত্রণের বিকল্প হিসেবে দারদিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চলে জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা কর্তৃক তাঁর প্রভাব প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সমর্থন দেয়াই শ্রেয়।

১৮৭৬ এর নভেম্বরে জম্মু সীমান্তের ঠিক দক্ষিণে বৃটিশ ভূখন্ডের শহর মাধোপুরে একটি বৈঠকে এ সমস্যাদির বিষয়ে ভাইসরয় লর্ড লিটন মহারাজা রণবীর সিং এর সাথে আলোচনা করেন। বৈঠকে এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো হয় যে, ভারত সরকার মহারাজাকে গিলগিট ছাড়িয়ে দারদিস্তানে অনুপ্রবেশের জন্য অস্ত্র ও সৈন্য বাহিনী দিয়ে সহযোগিতা করবে।৩০ এর পরিবর্তে লাদাখে পূর্ব থেকে অবস্থানকৃত বৃটিশ প্রতিনিধি ছাড়াও সীমান্ত বিষয়ক নীতির সঠিক অনুসরণ হচ্ছে কি না তা তদারকি  করতে একজন বৃটিশ এজেন্টকে নিয়োজিত করা হবে। নিজ ভূমিতে আরো বৃটিশ কর্মকর্তার শিকড় গাড়ার ব্যাপারে মহারাজার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ১৮৭৭ সালে প্রথম গিলগিট এজেন্সি স্থাপন করা হয়।

নতুন এজেন্সি ১৮৮১ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিলো। ভারত সরকারের দৃষ্টিতে এটি ছিলো একটি ব্যর্থতা। রাজনৈতিক প্রতিনিধি মেজর জে. বিড্ডাল্ফ এর সাথে মহারাজার সম্পর্ক হৃদ্যতাপূর্ণ ছিলো না; কলকাতায় এটা সন্দেহ করা হতো যে, তিনি বৃটিশদের অজান্তে মহারাজা কর্তৃক রুশ ও আফগান উভয়ের সাথে গোপন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়টি প্রতিহত করতে পারেননি। এই চৌকি সম্পর্কে যে গোয়েন্দা তথ্য ছিলো তা ছিলো চরম হতাশাব্যঞ্জক। হুনজাকে বৃটিশ আয়ত্বে আনা সম্ভব হয়নি। নিকটবর্তী সামরিক ঘাঁটি থেকে দপ্তর স্থাপনের মতো সরঞ্জমাদি সরিয়ে আনার ব্যবস্থা ছিলো অত্যন্ত কঠিন (ও ব্যয়বহুল)। রুশ হুমকির যে ধারণা এজেন্সি এক সময় পোষণ করতো তার সম্ভাবনা ঐ মূহুর্তে একেবারেই কম ছিলো (এ ধরণের হুমকির আবির্ভাবের সম্ভাবনা কম এমন ধারণা পোষণ করতেন অন্ততঃ একজন, নতুন ভাইসরয় লর্ড রিপন, যিনি গ্ল্যাডস্টোনের ধারণাপুষ্ট হয়ে সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণে তাঁর পূর্বসূরী লর্ড লিটন থেকে ভিন্ন মতে সম্পূর্ণ নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন।) ১৮৮১ সালে এজেন্সি প্রত্যাহার করা হয়।৩১ ফলে ভারত সরকারের কোন প্রতিনিধির তদারকি ছাড়াই জম্মু ও কাশ্মীর মহারাজা উত্তরাঞ্চল সীমান্ত পাহারার জন্য একাই রইলেন।

এ সময়টাতে অসহনশীল অবস্থা তৈরি হয়েছিলো। ১৮৮০’র দশক জুড়ে এশিয়াতে ইংরেজ-রুশ প্রতিযোগিতা চরম পরিণতির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলো। রুশরা বর্তমানকালের তুর্কমেনিস্তান ও পামির থেকে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের দিকে উদ্বেগজনক গতিতে এগিয়ে আসছিলো। চিত্রাল ও হুনজার শাসকদের সাথে রুশদের যোগাযোগের প্রমাণাদি বেড়েই চলছিলো। ১৮৮৫ সালে মহারাজা রণবীর সিং-এর উত্তরসূরী জম্মু ও কাশ্মীর-এর নতুন মহারাজা প্রতাপ সিং-কে এ বিষয়ে সন্দেহ করা হচ্ছিলো যে, তিনি জারের প্রতিনিধিদের সাথে (এবং শিখ সম্রাটের ক্ষমতাচ্যুত উত্তরাধিকার দালিপ সিং-এর সাথে যিনি বর্তমানে ইংল্যান্ডে নির্বাসনে রয়েছেন)৩২ রাষ্ট্রদ্রোহমূলক যোগাযোগ স্থাপনের কাজে জড়িত ছিলেন। যে কোন ভাবেই হোক না কেন, রাজ্যে মহারাজার শাসন ব্যবস্থার অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অত্যাচারিতা বিষয়ক কুখ্যাতি ইংল্যান্ড ও ভারতের খবরের কাগজগুলোতে উল্লেখযোগ্য মন্তব্য সহ প্রকাশিত হতো। এ অবস্থায় ভারত সরকার এ বিষয়কে এভাবেই নেয় যে, মহারাজার উপর আস্থা রাখা মানে উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকার প্রতিরক্ষার সমাধি তৈরি করা।

১৮৮৬ নাগাদ কিছু বৃটিশ কর্মকর্তা এ যুক্তি দেখাতে লাগলো যে, ভারত সরকার কর্তৃক সম্পূর্ণ গিলগিট অঞ্চল পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেয়া উচিত। এ প্রেক্ষিতে নতুন গিলগিট এজেন্সি স্থাপন করা হলো; এবারে সরাসরি শাসন করতে এবং জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের চালচলনের উপর কেবলমাত্র নজরদারি করতে।৩৩ যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া এতে প্রকৃতই ঝুঁকি ছিলো, যেমনটা বৃটিশ কুটনীতিক নে ইলিয়াস ১৮৮৫ সালে তার ইয়াখন্দ ও কাশগড় সফরের পরে মনে করছিলেন যে, চাইনিজরা কোন রাখঢাক ছাড়াই হুনজার বিস্তৃতিতে উদ্যোগ নিতে পারে।৩৪ অন্যান্যরা (লর্ড র‍্যানডল্ফ চার্চিল সহ) কিছু সংখ্যক অতুৎসাহী রাজনীতিবিদদের সমর্থনে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য বর্ধিতকরণে মত দিচ্ছিলেন। ১৮৮৯ সালে এ বিষয়ে একটি মীমাংসায় পৌঁছানো হয়। এটা আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে, মহারাজা প্রতাপ সিং-এর ক্ষমতাকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিলো এবং সম্পূর্ণ রাজ্যকে শ্রীনগরে অবস্থানকারী একজন বৃটিশ রেসিডেন্ট-এর অভেদ্য তদারকিতে একটি রাজ্য কাউন্সিল-এর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়েছিলো। এ যাবৎ জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদার প্রতীক হিসেবে ভারত সরকার রাজ্যে একজন রেসিডেন্ট-এর পরিবর্তে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিক কৌশলস্বরূপ একজন বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) দ্বারা নিজের প্রতিনিধিত্ব করতো।৩৫

উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে এই নতুন ব্যবস্থার অনেকগুলো সুবিধা ছিলো। এটা ভারতীয় জনমত জাগ্রত করার বিষয়টি এড়াতে পেরেছিলো, কেননা ভারত সরকার ১৮৫৭ থেকে রাজকীয় রাজ্যের বর্ধিতকরণে চরম সতর্ক ছিলো। বৃটিশরা সীমান্ত নীতির নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে পারতো যদিও এর ফলে অনেক ব্যয় সম্পূর্ণই রাজ্যকে বহন করতে হতো। এ সকল ব্যয়ের মধ্যে একটি বড় অংশই ছিলো প্রয়োজনীয় সামরিক বাহিনী ও শ্রীনগর থেকে বুনজি প্রবেশের প্রধান পথের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়।৩৬ এ সকল পরিস্থিতির মধ্যেই ১৮৮৯ সালে আলজেরনন্ ডুরান্ড গিলগিট এজেন্সি পুনঃ স্থাপনের নির্দেশ দেন, এবারে আরো শক্ত ভিতের উপর।

ডুরান্ড-এর অধীনে এজেন্সির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজের ভার পড়ে সেটা হচ্ছে হুনজার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা। জানুয়ারি ১৮৮৮ মাসে প্রতিবেশী নাগর এর সাথে একটি ব্যতিক্রমী জোট গঠনের মাধ্যমে হুনজা ডগরা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে এবং গিলগিট, চাল্ট ও চাপরট-এর উত্তরে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি থেকে জম্মু ও কাশ্মীর সৈন্যদলকে বিতাড়িত করে। এ সৈন্যদলকে সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের পূর্ব পর্যন্ত কয়েক মাস এদের আটকাবস্থায় রাখা হয়েছিলো। কিছু সময়ের জন্য গিলগিট নিজেই ঝুঁকির মধ্যে ছিলো। ১৮৮৮ সালে শহিদুল্লায় কারাকোরাম পর্বত অতিক্রম করে যাতায়াতের বাণিজ্যিক পথে হুনজার হানা দেয়ার সাথে সাথে গিলগিট পুনরায় আবার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

আলজেরনন্ ডুরান্ড হুনজার উচ্চাভিলাষকে কুটনীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস নিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারেন যে, বৃটিশ দৃষ্টিতে মির, সফদর আলী ছিলেন শঠ, বিশ্বাসঘাতক ও বৈরী ভাবাপন্ন। বৃটিশদের প্ররোচনা এবং বন্ধুত্ব ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব সত্ত্বেও এটা জানা গিয়েছিলো যে, সফদর আলী কাশগড়ে রুশ কনস্যুল এম. পেত্রভস্কি’র সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন (এম. পেত্রভস্কি ১৮৮২ থেকে সেখানে ঘাঁটি গেড়েছিলেন।)৩৭ আলজেরনন্ ডুরান্ড এবং প্রতিবেশী নাগর এর সমর্থনপুষ্ট হুনজার মধ্যে সম্পর্ক দ্রুতই ভেঙ্গে পড়ে; এবং ১৮৯১ এর শেষ দিকে বৃটিশরা উভয় রাজ্যেই এদেরকে যুদ্ধরত অবস্থায় দেখতে পায়। সংঘর্ষ খুব সংক্ষিপ্ত হলেও মারাত্মক যুদ্ধ হয় এবং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বৃটিশরা জয়লাভ করেছিলো। সফদর আলী পালিয়ে গিয়ে সিনকিয়াং-এ চাইনিজ কর্তৃপক্ষের কাছে আশ্রয় নেন এবং চল্লিশ বছর পর ইয়ারখন্দে খুব নাজুক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৯০ দশকে রুশদের সাথে তাঁর সম্পর্ক, এবং মৃত্যু পর্যন্ত চাইনিজ দাপ্তরিক স্থাপনায় ক্রমাগত অবস্থান, চাইনিজ মাটিতে তাঁর উপস্থিতি বহুবছর বৃটিশদের দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে ছিলো। হুনজার ক্ষমতা থেকে তিনি বৃটিশ কর্তৃক পদচ্যুত হয়েছিলেন এবং বৃটিশরা তার সৎ ভাই মোহাম্মদ নাজিম খানকে সফদর আলীর স্থলাভিষিক্ত করে।

এ বই এর আলোচনার বাইরের বিষয় হলেও গিলগিট এজেন্সির উপর এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ইতিহাসের উপর ১৮৯৫ সালে চিত্রাল সংকট-এর একটি প্রভাব ছিলো। এর ফলে গিলগিটের রাজনৈতিক এজেন্ট এর তদারকি থেকে চিত্রালকে সরিয়ে নিয়ে চিত্রাল ও তার পার্শ্ববর্তী দির ও স্বাত রাজ্য নজরদারি করতে মালাখন্দে নতুন রাজনৈতিক এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করা হলো। এভাবেই যে চিত্রাল সন্দেহাতীতভাবে ১৮৭৮ সালে জম্মু ও কাশ্মীর মহারাজার আধিপত্য স্বীকার করে নিতো (যেটা ১৯১৪ সালে পুনঃ নিশ্চিত হয়েছিলো) তা ১৮৯৬ সালে বৃটিশ প্রশাসনিক সম্পর্কের দিক থেকে কার্যকরভাবে ঐ রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং স্বাধিকার নিয়ে একটি ভারতীয় রাজকীয় রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। রাজ্যটি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিজ ইচ্ছায় পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে পারতো। প্রকৃতপক্ষে, ১৮৮৬ সালে কর্ণেল ডব্লিউ. (পরবর্তীতে জেনারেল স্যার উইলিয়াম) লকহার্ট এর প্রস্তাব মতো গিলগিট এজেন্সি কাশ্মীরের বৃটিশ রেসিডেন্ট (যেটা ছিলো উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী গিলগিট ও লাদাখ উভয় অংশকে একক কর্তৃত্বের অধীনে রাখার একটি নিখুঁত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা) এর অধীনে তদারকিতে না থেকে যদি মালাখন্দ এজেন্সির মতো সমমর্যাদা লাভ করতো, তবে গিলগিট ও এর উপর নির্ভরশীল রাজ্যগুলোও জম্মু ও কাশ্মীর সীমানার বাইরে চলে আসতো। এর ফলে হয়তো ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে যে বিতর্কের উদ্ভব হয়েছিলো তার উৎপত্তিই হতো না।

হুনজা যুদ্ধ এবং এর ফলে সৃষ্ট গিলগিট এজেন্সি ও চিত্রাল সংকট এমন এ সময়ে সংঘটিত হয়েছিলো যখন উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইংরেজ-রুশ প্রতিযোগিতার বিষয়ে ইংরেজ-রুশকে সমঝোতার সুযোগ করে দিয়েছিলো। এ প্রক্রিয়ার বিস্তারিত আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। তবে এর নির্যাস পাওয়া যায় দুইটি চুক্তিপত্র থেকে।

প্রথমটি হচ্ছে ১৮৯৩ সালের ১২ নভেম্বর আমির আব্দুর রহমান এবং স্যার হেনরি ডুরান্ড এর মধ্যে স্বাক্ষরিত ইংরেজ-আফগান চুক্তিপত্র যেটা বিখ্যাত ‘ডুরান্ড লাইন’ নামে আফগানিস্তান ও বৃটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করেছিলো। এ চুক্তির মাধ্যমে চীন, আফগানিস্তান ও ভারতীয় সাম্রাজ্যপামিরের একেবারে পূর্ব প্রান্তে ওয়াখানে যেখানে পরষ্পরের দিকে অগ্রসর হয়েছে সেখানের সীমান্তের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলো। শুধুমাত্র চিত্রাল অঞ্চলের সীমানা চিহ্নিতকরণ নিয়েই এখানে সমস্যা ছিলো তা না, ডুরান্ড লাইনও সমস্যার একটি মূল কারণ ছিলো যেটা ১৮৯৫ সালে হঠাৎ-ই আবির্ভূত হয়েছিলো। কিন্তু তখন থেকে বৃটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য একটি পশ্চিমাঞ্চলীয় পবর্ত সীমানার অধিকারী হলো।৩৮

দ্বিতীয়টি হচ্ছে “পামীর অঞ্চলে দুই দেশের প্রভাব বিস্তারের মাত্রা” বিষয়ে বৃটিশ ও রুশদের একটি সমঝোতায় পৌঁছানো; এর ফলে “গুপ্তচরবৃত্তি”র নিয়মের মধ্যে চরম প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরবর্তী ছয়টি বছর অর্জিত হয়েছিলো। ফ্রান্সিস ইয়াংহাসব্যান্ড ও তার তরুণ সহকারী জর্জ ম্যাকার্টনি৩৯–এর মতো বৃটিশ মূল চরিত্রগুলো জারের প্রতিনিধি যেমন, পোলিশ উচ্চ বংশীয় গ্রমচেভস্কি ও কোজাকের রুশ কমান্ডার কর্ণেল ইয়ানভের সাথে অস্পষ্ট সীমান্ত অঞ্চলের দখল নিয়ে প্রবল সক্রিয়ভাবে প্রতিযোগিতা করছিলেন। এর ফলাফল ছিলো জার সম্রাট কর্তৃক আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় সীমানা চৌকি স্থাপন এবংপামিরে পাভালো-শেইখোভস্কি শৃঙ্গ (ফারঘানার রুশ গভর্নরের নামানুসারে) একটি স্থান প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই স্থানটি ছিলো সম্ভবতপামিরে রুশদের সবচেয়ে পূর্ব দিকের সীমার সাথে সাথে রাশিয়া ও সিনকিয়াং এর মধ্যকার সীমান্তের দক্ষিণের স্টেশনের সর্বশেষ বিন্দু। (প্রকৃতপক্ষে, এটি আজ পর্যন্ত সীমানা চিহ্নিত করা ছাড়াই পড়ে রয়েছে এবং সারিকল পর্বতশ্রেণির মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া জলপ্রবাহ অনুসরণ করে তারিম বেসিন এবং মুরঘাব শহর ঘেষে আকসু নদী হয়ে আমু দরিয়ায় পড়েছে।

(চলবে)

২৫. হুনজার অধিবাসী কানঝুটিরা ১৮৮৮ সালে কারাকোরাম পাসের উত্তরে শহিদুল্লায় লেহ্-কাশগড় রুটে যাত্রী বহরে আক্রমণ করে বসে। হামলাকারীরা ছিলো সব মিলে সাতাশি জন যারা প্রায় দুইশ মাইল দূরবর্তী হুনজার শিমশাল জেলা থেকে এসেছিলো। তারা একটি যাত্রীবহর লুট করে এবং নারী-পুরুষ মিলে প্রায় বিশ জনের মতো বন্দী নিয়ে যায় যাদের প্রতিজনকে আশি রুপি মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয়। এ কান্ডকে শহিদুল্লায় জম্মু ও কাশ্মীর দরবারে যেমন গুরুত্বের সাথে নেয়া হয় তেমনি হুনজা ও গিলগিট এজেন্সির মধ্যে সম্পর্কের অবনতির জন্য কাজ করে। দেখুন: Francis Younghusband, The Heart of a Continent. Narrative of Travels in Manchuria, across the Gobi Desert, through the Himalayas, the Pamirs, and Chitral, 1884-94, London 1896, p. 227.
২৬. হুনজা ও নাগর এর মধ্যকার বিরোধ প্রবাদতুল্য। এই দুই রাজ্যের মধ্যে ভিন্নতা  হচ্ছে হুনজা অধিবাসীদের একটি বড় অংশ আগা খান নেতৃত্বাধীন মুসলিম সম্প্রদায় ইসমাইলী দলভুক্ত, যেখানে নাগরে অধিকাংশ অধিবাসী দ্বাদশবাদী শিয়া বা ইমামিয়া বা ইসনা আশারিয়া দলভুক্ত। 
২৭. হুনজার মির ১৮৬৯ সাল থেকে জম্মু ও কাশ্মীর মহারাজাকে একুশ তোলা সোনা ও দুই ঝুরি এপ্রিকোট ফল বাৎসরিক কর হিসেবে প্রদান করতো। এর পরিবর্তে তিনি জম্মু ও কাশ্মীর থেকে বড় অংকের ভর্তুকি পেতেন। পার্শ্ববর্তী নাগর রাজ্য ১৮৬৮ সালে মহারাজা রণবীর সিং এর সাথে একই রকম চুক্তিতে আসে। 
২৮. কাশগড়ে চাইনিজ দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্ততঃ মধ্যভাগ থেকে
হুনজা দেড় আউন্স সোনা - যার ১৯৩০ এর বাজার মূল্য প্রায় ১০ পাউন্ড স্টারলিং  - বার্ষিক কর প্রদান করতো। এটা করের হিসাব যথাযথ ভাবে পিকিং রেকর্ডভুক্ত করতো এবং জনসম্মুখে ঘোষণা করতো। মাঞ্চু কর ব্যবস্থার অধীনে থাকায় হুনজার শাসক চাইনিজদের থেকে তার প্রদানকৃত করের চেয়েও বেশি সুবিধা পেতেন (১৯৩০ এর হিসেবে তা প্রায় ৪০ পাউন্ড স্টারলিং এর সমপরিমাণ)। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তিনি এ ব্যবস্থা নস্যাৎ করতে রাজি ছিলেন না। এক সময় চাইনিজরা হুনজার নতুন মির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে প্রতিনিধি প্রেরণের অধিকার দাবি করে বসলো। ১৮৯২ সালে বালতিতে মোহাম্মদ নাজিম
খানের নিয়োগের সময় ভারত সরকার দুইজন চাইনিজ কর্মকর্তাকে উপস্থিত থাকার বিষয় অনুমোদন করেছিলো। মোহাম্মদ নাজিম খান ১৯৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে ঘাজান খানের নিয়োগের সময় কোন চাইনিজ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না।  হুনজার প্রতিবেশী নাগর চাইনিজদের সাথে কোন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলো বলে মনে হয়নি।  
২৯. চিত্রালের রাজধানী মাসতুজে ১৯১৪ সালের ২২ মার্চ (বৃটিশ রাজনৈতিক প্রতিনিধি ডি. জে.উইলসন এর উপস্থিতিতে) যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তার শর্তমতে, মেহতার, সুজা-উল-মুলক্ কাশ্মীরের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি হন এবং মহারাজাকে বার্ষিক কর হিসেবে তিনটি ঘোড়া, পাঁচটি বাজপাখি ও পাঁচটি শিকারী কুকুর দেয়ার বিষয়ে একমত হন। এটি ছিলো ১৮৭৮ সালে মহারাজা রণবীর সিং এর সাথে চিত্রাল চুক্তির নিশ্চিতকরণ। এটা ভারত সরকার কর্তৃক ১৯৩৩ সালে পুনরায় নিশ্চিত করা হয়। (দেখুন: L/P&S/12/3286 in IOL for papers on Mastuj Agreement and 1933 confirmation)।  তবে ১৯৩৬ সালে চিত্রালের নতুন মেহতার জন্য আসন্ন অনুষ্ঠানের বিষয়ে  ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজাকে কিছুই জানায়নি এবং মহারাজা যখন এই অসাবধানতার বিষয়ে প্রতিবাদ করেন তখন বৃটিশরা প্রস্তাব করে যে, বাস্তবতার খাতিরে চিত্রাল এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়ে নতুন চুক্তি সম্পন্ন করা যেতে পারে। এটা কখনোই আর করা হয়নি এবং কাগজপত্রে পরিস্থিতি ১৯১৪ এর মাসতুজ চুক্তিপত্রের মতোই ছিলো। প্রকৃত বিষয় যেটা হয়, সেটা হচ্ছে প্রশাসনিক কারণে বৃটিশরা চিত্রালকে ১৮৯০ দশকের মধ্যভাগ থেকে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের কোন তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করতো না; যার ফলে ১৯৩৫ এর গিলগিট লিজের সাথে এটি সম্পর্কিত ছিলো না। ১৯৪৭ থেকে ভারতীয় পক্ষ বিভিন্ন সময়ে দাবি করে আসছে যে, চিত্রাল কাশ্মীর বিতর্কের অংশ ছিলো; কিন্তু এটা কোন ধরণের দৃঢ় প্রত্যয় দ্বারা ব্যক্ত করা হয়নি। আমাদের বর্তমান আলোচনায় তাই আমরা চিত্রাল ইতিহাসকে এক পাশে সরিয়ে রাখতে পারি। 
৩০. বৃটিশরা ১৮৬৮-৭২ সময়ে মহারাজা রণবীর সিং-এর সাথে রুশ ও আফগান যোগাযোগের আসল প্রকৃতি উদ্ধার করতে পারেনি, নয়তো লিটন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের আনুগত্যের উপর আগ্রহ সহকারে এতোটা আস্থা রাখতেন না।        
৩১. গিলগিট এজেন্সির উপর আদর্শ কাজগুলো হচ্ছে: Alder, Northern Frontier, op. cit.; A.S. Chohan, The Gilgit Agency 1877-1935, New Delhi n.d.; F. M. Hassnain, Gilgit, the Northern Gate of India, New Delhi 1978।
৩২. যেটা রণবীর সিং অস্বীকার করেছিলেন। ডগরা রাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক ইতিহাসবিদ ডগরা-রুশদের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া সমর্থন করে এমন প্রমাণাদির বিশ্বসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বর্তমান লেখকের এ বিষয়ে মতামত হচ্ছে প্রমাণাদি যথেষ্ট পরিমাণে ভালোই মনে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, দেখুন: M. L. Kapur, Kashmir Sold and Snatched, Jammu Tawi 1968, p. 149।
    রঞ্জিত সিং-এর পুত্র দালিপ সিং ১৮৪৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন যখন বৃটিশরা পাঞ্জাবের সীমানা বর্ধিত করে। তিনি তখন মাত্র ১১ বছর বয়সী। ১৮৫৩ সালে তিনি খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান যেখানে তিনি ১৮৯৩ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয় তাঁকে সাফোক-এর এলভেডন-এ একটি স্টেট উপহার দেন। ১৮৮০ সালে তিনি পুনরায় শিখ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং এ বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে উঠেন যে, ভারতে এখনো তাঁর কিছু করার রয়েছে। তিনি রুশ সরকার ও ভারতের বিভিন্ন রাজন্যবর্গের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন এবং ১৮৮৭-৮৮ সালে তিনি রাশিয়া ভ্রমণ করেন। রুশ জারের কাছে তাঁর মূল প্রস্তাব ছিলো যে ভারত থেকে বৃটিশকে বিতাড়িত করতে জার যেন ভারতে একটি বৃহৎ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। রুশরা তাঁর এই প্রাথমিক প্রস্তাবে কোন ইতিবাচক সাড়া দেয়নি এবং বৃটিশরাও তাঁকে তেমন গুরুত্ব সহকারে নেয়নি। কিন্তু সম্ভবত প্রতাপ সিং, দালিপ সিং যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। দেখুন: M. Alexander & S. Anand, Queen Vitoria’s maharajah. Duleep Singh 1838-93, London 1986, pp. 228-276।
৩৩. কর্ণেল লকহার্টের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো এমন। কর্ণেল লকহার্ট ১৮৮৫-৮৬ সময়ে দারদিস্তানের
কৌশলগত সমস্যা বিশেষ করে গিলগিটের নিরাপত্তা ও চিত্রালের আনুগত্যের প্রকৃতি বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেছিলেন। দেখুন: Alder, Northern Frontier, op. cit., p. 156।
৩৪. দেখুন: G. Morgan, Ney Elias. Explorer and Envoy Extraordianry in High Asia, London 1971, p. 153। 
৩৫. জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ইতিহাসের এ অংশ বিস্তারিত আলোচনা M. Yasin, British
Paramountcy in Kashmir 1876-1894, New Delhi n.d দ্রষ্টব্য।
৩৬. শ্রীনগর থেকে গিলগিট ২২৫ মাইলের রাস্তা যা ভালো অবস্থায় ১৫ দিনের পথ। এ রাস্তাটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো এবং বলপূর্বক শ্রমিকের ব্যাপক ব্যবহার করে এতে যানবাহন চলাচল করানো হতো। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে কাশ্মীর উপত্যকার গ্রামবাসীদের মধ্যে গিলগিট সড়ক একটি ভয়ঙ্কর খ্যাতি অর্জন করেছিলো। এ সকল গ্রামবাসীরা এ সড়ক দিয়ে সামরিক বাহিনী যাবে এমন খবরে গা ঢাকা দিতো। দেখুন: A. S. Chohan, Historical Study of Society and Culture in Dardistan and Ladakh, New Delhi n. d., p. 168। 
৩৭.  পেট্রভস্কি ১৮৮২ থেকে ১৯০৩ নাগাদ কাশগড়ে ছিলেন। তিনি ১৯০৯ সালে মৃত্যু বরণ করেন। তার সেক্রেটারি কলোকলোভ পেট্রভস্কির উত্তরসূরী হন। কলোকলোভ ১৯০৮ পর্যন্ত কনস্যুলেটে ছিলেন এবং সকভ তার স্থলাভিষিক্ত হন। সকভ-এর অবসরের পর প্রিন্স মেসশেরস্কি তার স্থানে সেপ্টেম্বর ১৯১৭ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
৩৮. ডুরান্ড লাইন এর এ যাবৎ কালের সেরা বিশ্লেষণ দেখুন: J. R. V. Prescott, The Map of Mainland Asia by Treaty, Melbourne 1975। ১৮৯৩ এর সমঝোতার বিষয়ে
জানতে আরো দেখুন: Sir P. Sykes, The Right Honourable Sir Mortimer Durand, P.C., G.C.M.G., K.C.S.I., K.C.I.E.; a Biography, London 1926। 
     চিত্রাল সংকট বিষয়ে অনেক লেখা রয়েছে। দেখুন: Major-General J. G. Elliot, The Frontier 1839-1947, Chapters 11 & 12।
৩৯. জর্জ (পরবর্তীতে স্যার জর্জ) ম্যাকার্টনি ১৮৬৭ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা স্যার
হ্যালিডে ম্যাকার্টনি স্মরণীয় তাইপিং বিদ্রোহের সময় চীনে মাঞ্চু সাম্রাজ্যের একজন উচ্চ
পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন; সে সময় তিনি আকস্মিক ভাবে একটি তাইপিং শাসক পরিবারে বিয়ে করে বসেন এবং এর পত ঘটাতে সহায়তা করেন। এ কারণে জর্জ ম্যাকার্টনি’র মা ছিলেন চাইনিজ। তিনি চাইনিজ বলতে পারতেন এবং চাইনিজ চিন্তাধারা সম্পর্কে অগাধ ধারণা রাখতেন। এ সব কিছুই ১৮৯০-১৯১৮ পর্যন্ত কাশগড়ে তাঁর দীর্ঘ অবস্থানের সময় কার্যকর ভূমিকা রাখতে তাঁকে সহায়তা করে। তিনি ১৯৪৫ সালে মৃত্যু বরণ করেন। 
     ভারত সরকারে ম্যাকার্টনির প্রথম কাজ ছিলো ১৮৮৮ সালে সিকিম ফিল্ড ফোর্সে চাইনিজ অনুবাদক হিসেবে কাজ করা। ম্যাকার্টনি যখন ১৮৯০ সালে কাশগড়ে যান তখন তিনি ভারতীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানে কোন দাপ্তরিক পদে ছিলেন না; তিনি শুধুমাত্র ফ্রান্সিস ইয়াংহাজব্যান্ডের সহকারী ছিলেন। ১৮৯৩ সালে তিনি কাশ্মীরে রেসিডেন্ট যার বেশির ভাগ সময় কাশগড়েই কাটতো তার চায়না বিষয়ক বিশেষ সহকারীর পদ লাভ করেন। ১৯০৫ সালে ম্যাকার্টনিকে কনস্যুল-এর ব্যক্তিগত পদ দেয়া হয়; যদিও চাইনিজরা ১৯০৮ পর্যন্ত কাশগড়ে কোন কনস্যুলেট-এর উপস্থিতির বিষয়ে একমত ছিলো না। তিনি ১৯১০ সালে কনস্যুল-জেনারেল পদে পদোন্নতি পান এবং ১৯১৩ সালে নাইট উপাধি পান। তিনি ১৯১৮ সালে অবসরে যান।
ব্যবস্থাপক |

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন:১৯৯৯-২০০০

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০