fbpx

প্রহেলিকা

এক

সারাহ্’র খুব চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু উঠে গিয়ে চা আনতে ইচ্ছে হচ্ছে না, আবার কাউকে ডেকে দিতে বলতেও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু চায়ের তেষ্টা জিনিসটা এমন যে, একবার পেয়ে বসলে অস্বস্তি কাটতে চায় না চা না খাওয়া পর্যন্ত। বরং চা খেতে পারা যাচ্ছে না এটা ভাবতেই তেষ্টা আরো পেয়ে বসে যেন।

চায়ের তেষ্টা পাওয়ার বিষয়টিও অদ্ভুত। সাধারণতঃ লেখালেখি করতে বসলে সারাহ্’র হঠাৎ হঠাৎ তেষ্টা পায় চায়ের। কিন্তু এখন লিখতে না বসেও তেষ্টা পাচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে ততই মনে হচ্ছে চা টা খেতে না পারলে এই মুহূর্তে সব ব্যর্থ হয়ে যাবে। সারাহ্ চায়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করলো। এটা খুব কঠিন কাজ নয়। সারাহ্ যে জায়গাটায় বসে আছে সেখান থেকে সামনে যত দূর দৃষ্টি যায় সবটাই সবুজ পাহাড়ি চাদরের মতো।

এ জায়গাটায় সারাহ্ এসেছে গত রাতে। রাতে পৌঁছানোর পর জায়গাটা ভালো করে দেখার সুযোগ বা অবস্থা ছিলো না। ভ্রমণজনিত ক্লান্তি ছাড়াও মানসিক অবসাদে সারাহ্’র শরীরটা ভেঙ্গে আসছিলো রাতে। তাই রাত না জেগে হালকা ডিনার করে শুয়ে পড়েছিলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে ডুব দিয়েছিলো। ঘুম বেশ ভালোই হয়েছে। কিন্তু শেষ হয়েছে একটা স্বপ্ন দেখে।

ঘুমিয়ে থেকে  সারাহ্’র কাছে মনে হচ্ছিলো যেন একটা জীবন্ত স্মৃতি, ঠিক স্বপ্ন না। সারাহ্ একটা সমুদ্র তীরে দুর্দান্ত বাতাসে হাঁটছে, যেন স্নিগ্ধ সকালের নির্মল বাতাসে ভালো হয়ে উঠছে মন। এমন একটা স্নিগ্ধতায় হঠাৎ-ই কেন যেন সারাহ্’র খুব বিষণ্ন লাগতে লাগলো। এমন সময় হঠাৎ চোখে পড়লো একটা ধবধবে সাদা ইজি চেয়ার নিয়ে সমুদ্র সৈকতে মা বসে রয়েছে। সারাহ্কে দেখেই মা বলে উঠলেন, “যা তো, এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়। খুব চায়ের তেষ্টা পেয়েছে।” সারাহ্ খুব অবাক হয়ে বললো, “এখানে মা চা পাবো কোথায়? তাছাড়া তুমি এখন চা খাবে কী করে? তুমি না মারা গেছো!” মা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, “মারা গেলে চা খাওয়া নিষেধ এ কথা তোকে কে বললো? কোন দিন তো এক গ্লাস পানি এনে খাওয়ালি না! এখন এক কাপ চা অন্তত খাওয়া, নইলে মরেও শান্তি পাবো না রে!”

সারাহ্ খুব বিস্মিত হয়ে স্বপ্নেই ভাবতে বসলো – মৃত মানুষ আবার মারা যায় কী করে! তবে মা’র আকুতিটা তখনই সারাহ্’র মনে খুব লাগলো। আর এমন সময়ই সারাহ্ দেখে সে একটা দোকানে চা বানাচ্ছে – যেন রাস্তার একটা চায়ের ঝুপড়ি দোকান। সারাহ্ সে দোকানের মালিক। একটা বড় চুলায় তিনটা কেতলিতে চা তৈরি হচ্ছে। আর চারপাশের মানুষ ভিড় করে বলছে, কী ব্যাপার চা দিচ্ছেন না কেন? সারাহ্ কেতলি থেকে চা ঢালতে গিয়ে দেখে শুধু গরম পানি পড়ছে। সারাহ্ অন্য আর একটা কেতলি নিয়েও দেখে একই অবস্থা! সারাহ্’র খুব অসহায় লাগতে লাগলো। মনে হচ্ছিলো যেন সেই মুহুর্তেই চারপাশের মানুষগুলো চায়ের জন্য তার উপর চড়াও হয়ে পড়বে। সারাহ্ খুব টেনশনে একটার পর আর একটা কেতলি হাতে নিয়ে ঢালছে আর গরম পানি বের হচ্ছে চায়ের পরিবর্তে। এদিকে মানুষগুলো হৈ হুল্লোড় করে ভেঙ্গে পড়তে চাইছে দোকানটার উপর – চা দিচ্ছেন না কেন? কী হলো? হারিয়ে গেলেন না কি? – এমন শত শত চিৎকারে সারাহ্’র ঘুম ভেঙ্গে গেলো।

ঘুম ভেঙ্গে ঘড়ি হাতে নিয়ে দেখে সকাল সাড়ে দশটা বাজে। তার মানে বেশ বেলা হয়েছে। সকালের নাস্তাটা মিস্ করেছে। সারাহ্ যে বাংলোতে রয়েছে তার ব্রেকফাস্ট আওয়ার সকাল দশটা পর্যন্ত। যেহেতু দেরি হয়েই গেছে, তাই আর তাড়াহুড়ো না করে সারাহ্ চোখ বন্ধ করে আবারো গা’টা এলিয়ে দিলো বিছানায়।

চোখ বন্ধ করতেই মা’কে নিয়ে স্বপ্নটার কথা মনে পড়লো। হঠাৎ মা’কে কেন স্বপ্নে দেখলো সারাহ্? মা মারা গেছেন দু’ বছর হলো। এই দু’ বছরে তো কোন দিন মা’কে নিয়ে কোন স্বপ্ন দেখেনি সারাহ্। তবে কি মা’র ব্যাপারে কোন অপরাধ বোধ কাজ করছে মনে?

মা’কে নিয়ে তো কোন অপরাধ বোধ সারাহ্ জামানের হওয়ার কথা না। কেন না মা’র সাথে তেমন আবেগীয় সম্পর্কই সারাহ্’র কখনো গড়ে ওঠেনি। বরঞ্চ মা’র প্রতি বিরক্তি বোধই ছিলো সব সময়। ছোট থেকে মা’কে খুব একটা কাছে পাওয়া হয়নি সারাহ্’র; কাছে মা খুব একটা টানতেও চাননি। সারাহ্’র সব সময়ই মনে হয়েছে মা ওকে একরকম বোঝা বা ঝামেলাই ভাবে। প্রাইমারি স্কুলের পর থেকেই সারাহ্’র জীবন কেটেছে হোস্টেলে। কলেজ শেষ করে যখন সারাহ্ ভার্সিটিতে ভর্তি হবে ততো দিনে মা’র থেকে অনেক দূরে সরে গেছে ও। হোস্টেলে মা খুব একটা আসতো না। বাড়িতে গেলেও মা খুব বেশি দিন ওর বাড়ি থাকা পছন্দ করতো না। কেমন যেন একটা বিরক্তি বোধ নিয়ে থাকতো। হোস্টেলের খরচ যোগানো নিয়েও মা’র যন্ত্রণা বোধ ছিলো। বিভিন্ন আবদার করলে একেবারে জ্বলে উঠতেন। বলতেন, বাপ মরা মেয়ের এতো আহ্লাদ কেন! মা’র কথা শুনে সারাহ্’র চোখে পানি চলে আসতো। খুব গোপনে সে পানিটুকু আড়াল করে সারাহ্ হোস্টেলে চলে আসতো। ওর হোস্টেলের খরচ কীভাবে মা জোগাড় করতো তা খোঁজ নেয়ার কোন ইচ্ছা সারাহ্’র কোন দিন হয়নি। ওর শুধু মনে হতো, যে সামান্য শখ-আহ্লাদ পূরণ করতে পারে না তার ব্যাপারে এতো খোঁজ নেয়ার কিছু নেই। হোস্টেলে সব বন্ধুদের মা বাবা কত সুন্দর সুন্দর উপহার পাঠাতো। অথচ সারাহ্’র মা হোস্টেলে আসতোই না বলতে গেলে। মা’কে দেখলে মনে হতো সম্পূর্ণ জীবনটা নিয়ে বিরক্ত তিনি। পৃথিবীটা যদি এক তুড়িতে ধ্বংস করে দিতে পারতেন তাহলেই বোধ হয় উনার শান্তি হতো।

তবে সারাহ্’র জন্য একজন উপহার পাঠাতো। মাঝে মধ্যে এসে জোর করে বাসাতেও নিয়ে যেতো। সে হচ্ছে তন্বী আপু। হোস্টেলে থেকে সারাহ্ পরিবার থেকেই অনেকটা দূরে সরে গেছে। তাছাড়া মা’র সাথে সম্পর্কটা সহজ করতে না পারায় সবার থেকে দূরে থাকতেই ভালো লাগতো ওর। মা’র মেজাজের কারণে মা’র দিককার পরিবারের কারো সাথেই সারাহ্’র যোগাযোগ নেই তেমন। আর বাবার দিকের পরিবারের একমাত্র তন্বী আপুর সাথেই ওর কিছুটা যোগাযোগ রয়েছে। ওর যোগাযোগ না বলে বলা ভালো তন্বী আপুই যোগাযোগটা রেখেছে। সব জন্মদিনেই একমাত্র তন্বী আপুই কিছু না কিছু উপহার পাঠায়। জন্মদিনে অবশ্য মা-ও যোগাযোগ করতো, কখনো কখনো উপহার-ও কিনে দিতো। তবে সেই মেজাজের বহরটা কমতো না কখনো। প্রতি জন্মদিনে মা একবার খোঁজ নিতো ওর। ফোন করে খোঁজ খবর নিতো। সারাহ্ সব সময়ই ভাবতো মা বোধ হয় বিশেষ কিছু বলবে। কিন্তু তেমন কিছুই বলতো না; নিয়মিত খোঁজ খবর নেয়ার জন্যই যেন ফোন করা এমন। তবে তন্বী আপুকে সারাহ্’র বেশ লাগে। সারাহ্ যোগাযোগ না করলেও তন্বী আপু সব সময়ই ওর খোঁজ খবর করার চেষ্টা করতো। তন্বী আপু সারাহ্’র ফুপাতো বোন, তবে বয়সের ফারাকটা অনেক বেশি, প্রায় আঠারো বছরের বড় আপু। তাই সারাহ্’র একটু অস্বস্তিও লাগে। তবে তন্বী আপুর ধৈর্য্য আর লেগে থাকার স্পৃহা দেখে সারাহ্ বিস্মিত। বারো বছর আগে সারাহ্ যখন দেশ ছেড়ে পালায়, তখনো তন্বী আপু নিয়মিত মেইল করে ওর খোঁজ খবর জানার চেষ্টা করেছে। দেশ থেকে চলে গিয়ে কানাডা পাড়ি জমানোর চার বছরের মাথায় কানাডাতে ওর ঠিকানা জানতে পেরে জন্মদিনে ওকে উপহার পাঠিয়েছে।

তন্বী আপুর কারণেই বারো বছর পর এবার একটু সময় নিয়ে দেশে আসা। তন্বী আপুর ছেলের বিয়ে। সারাহ্ দেশের বিয়ে অনেক দিন দেখেনি, তাই সুযোগ পেয়ে এ দাওয়াতে একটু সময় নিয়ে এসেছে। দেশে আসার আরও একটা কারণও আছে। দু’বছর আগে মা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে সারাহ্ দেশে আসেনি। তন্বী আপু বারবার বলেছিলো, তোমার মা’র কিছু জিনিস রয়েছে তোমার জন্য। তুমি একবার দেশে আসো। এই অনুরোধ আর দাওয়াত শেষ পর্যন্ত সারাহ্’কে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে।

মা’কে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সারাহ্’র আবার তন্দ্রা মতো চলে এসেছিলো। সে তন্দ্রা যখন ছুটেছে তখন বেলা প্রায় ১২টা। সারাহ্ বিছানা ছেড়ে বাংলোর জানালার পর্দা সরাতেই ডিসেম্বরের শীতের ঝলমলে মৃদু রোদে ঘরটা ভরে গেলো। আর একটা ঝটকায় সারাহ্’র ক্লান্তিগুলো উবে গেলো। একটা মাঝারি লম্বা হট্ শাওয়ার নিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলো বাংলোর রেস্তোরায়। রেস্তোরাটা বেশ সুন্দর করে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে সাজানো। লাঞ্চ সেরে হাঁটতে হাঁটতে বাংলোটা ঘুরে বেড়াচ্ছিলো সারাহ্। একটা কর্ণারে একটা আরাম কেদারার মতো বসার চেয়ার দেখে রোদে গা এলিয়ে দিয়ে বসলো সারাহ্।

রোদের উষ্ণতায় পূর্ণতা আনতেই বোধ হয় সারাহ্’র চায়ের তেষ্টা পেয়ে গেলো। আর জায়গাটা এমন যে রোদের ওম্ ছেড়ে উঠতে মন চায় না। সারাহ্ এখানে এসে পৌঁছেছে গত রাতে। বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার সবুজে ঘেরা পাহাড়ের গল্প শুনেছে অনেক, কিন্তু দেখা হয়নি সেভাবে। এবার একটু সময় থাকায় বেরিয়ে পড়েছে। অবশ্য তন্বী আপুর তোড়জোরেই বের হওয়া।

পাহাড় দেখতে আসার সময় না কি এটাই। সারাহ্ যে রিসোর্টে উঠেছে তা পাহাড়ের গা ঘেষে দাঁড়ানো। পেছনে সুদীর্ঘ সবুজ পাহাড় পুরো বাংলোর উপর একটা ছায়া ফেলেছে। আর সামনে পূর্ব দিকে ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড় কিছু দূরে গিয়ে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সাথে মিশেছে। রিসোর্টটার বিভিন্ন দিকে বাংলোগুলো বাঁশ আর কাঠ দিয়ে একেবারে প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাকৃতিক আবহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলোগুলোর সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই মেশিন পত্রের যুগেও যাবতীয় আসবাবপত্রে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলোগুলোর বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা অবশ্য আধুনিক প্রযুক্তিতে করা। রিসোর্টটা পাহাড়ের উপরে হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু বসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে খোলা জায়গায়। এ জায়গাগুলোর একটাতে সারাহ্ বসে রয়েছে। একটা কাঠের আরাম কেদারার মতো তৈরি করা হয়েছে ঘাসে ঢাকা পাহাড়ি ঢালের ঠিক চূড়ায়। বসে গা এলিয়ে দিলে মনে হয় পৃথিবীটা অনেক নিচে, আর সামনে সবুজ পাহাড় মেশা নীল দিগন্ত ছাড়া আর কিছুই নেই। একেবারে যেন শূন্যে ভাসা অনুভূতি! এখানে ডিসেম্বরের বিকেলে গা এলিয়ে দিতেই সারাহ্’র স্মৃতির জানালা যেন খুলে গেলো।

হোস্টেলের জীবনে হোস্টেলে থাকা বন্ধুরাই পরিবার থেকে বেশি আপন হয়ে গিয়েছিলো সারাহ্’র। আর এ আপন লোকজনের সূত্রেই আলাপ হয় ত্রিশোর্ধ্ব এক তরুণ ইরফানের সাথে। সেই ইরফানের সাথে আবেগের টানে কানাডায় পাড়ি জমানো। কানাডায় গিয়ে এক বছরের মধ্যে ইরফানের ব্যাপক পরিবর্তন এবং দুই বছরের মধ্যে এক সুইস তরুণীকে বিয়ে করা – এ সবই ইরফান থেকে সারাহ্কে সরিয়ে নিয়েছিলো যোজন যোজন দূরত্বে। একটা সময় চ্যালেঞ্জিং জীবনে কী করে যে সারাহ্ লড়াই করে এসেছে তা ও নিজেই জানে না। গ্রাজুয়েশন শেষ করে সারাহ্ যখন আরো পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলো তখনই বাঙালি কমিউনিটিতে লেখিকা হিসেবে সারাহ্’র বেশ খানিকটা পরিচিতি গড়ে উঠেছে। উঠতি তরুণী লেখক হিসেবে বেশ মূল্যায়নও পাচ্ছে। এক্ষেত্রে অবশ্য তন্বী আপুরও কিছু ভূমিকা রয়েছে। তন্বী আপু বাংলাদেশে মাঝারি মানের উঁচু দরের একজন লেখক। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লিখে; বই-ও বের হয়েছে কয়েকটা। সারাহ্কে লেখালেখির বিষয়ে বেশ উৎসাহ দিয়ে এসেছে সব সময়। খেলাধুলার প্রতিও সারাহ্’র একটা ঝোঁক ছিলো। এটা বোধ হয় সারাহ্ মা’র কাছ থেকে পেয়েছে। মা না কি এক সময় খেলোয়াড় ছিলো যদিও এ বিষয়টা নিয়ে মা তেমন আলোচনা করেনি কখনো। খেলাধুলা আর লেখালেখি সারাহ্কে সারাহ্ জামান নামে বাঙালি কমিউনিটিতে বেশ পরিচিত করে তুলেছে।

সারাহ্ জামান হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার বিষয়টা মা কতটুকু জানতো সারাহ্ জানে না। তবে তন্বী আপুর কাছে শুনেছে যে, মা জানতো। তন্বী আপু মাঝে মাঝে মা’র খোঁজ খবর রাখতো। আপুই খুব সম্ভবতঃ এ খবরটা মাকে দেয়। আপুর মুখে শোনা যে, মা না কি এ খবরে খুব প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, তবে তার চোখ মুখে উজ্জ্বলতা দেখা যেতো।

সত্যি কথা বলতে মা’র সাথে দূরত্বটা সারাহ্ ঘোচাতে পারেনি। দেশে থাকতেই দূরত্বটা তৈরি হয়েছিলো। দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর এটা আর কমেনি। মা’র শেষ সময়েও মা সারাহ্’র সাথে যোগাযোগ করেননি, জেদটা ধরে রেখেছিলেন। মা খুব অল্প সময়ের অসুস্থতায় মারা যান। তন্বী আপুই মৃত্যুর খবরটা সারাহ্কে দেয়। সারাহ্ ভেবেছিলো খবরটাতে ও খুব কষ্ট পাবে না, কিন্তু খবরটা শোনার পর সারাহ্’র বুকটা হাহাকার করে উঠলো। এর কারণ অবশ্য পরিষ্কার না। এটা কি প্রাকৃতিক মাতৃত্বজনিত বন্ধনের কারণে না কি কিছু গভীর আবেগ মনের কোণে লুকিয়ে ছিলো তার জন্যে – সারাহ্ জানে না। মা’র মৃত্যুতে দু’ বছর আগে সারাহ্’র দেশে আসতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু মাস তিনেক আগে যখন তন্বী আপু বললো যে, একবার দেশে আসো; তোমার মা তোমার জন্য কিছু জিনিস রেখে গেছেন। এটা তোমার বুঝে নেয়া উচিত। তখন কেন জানি মনের সে গোপন প্রকোষ্ঠ খুলে গভীর আবেগটা নীল আকাশে সাদা মেঘের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে উড়ে বেড়াতে লাগলো। আর চোখের কোণটা ভিজে যেতে লাগলো সে মেঘের মতো আবেগের তোড়ে।

কিন্তু এ আবেগের মর্মার্থ সারাহ্’র অজানা। কার জন্য এ আবেগ – মা, বাবা, তন্বী আপু না দেশ? মা’র সাথে তো অভিমানই ছিলো শেষ আবেগ; বাবার সাথে তো কোনদিনই যোগাযোগ ছিলো না; এমন কি মা বাবার কোন ছবিও দেখাননি কখনো। তন্বী আপু অবশ্য কিছু ছবি লুকিয়ে দিয়েছিলো, মা জানতে পারলে যদি রাগ করেন এ কারণে। কিন্তু তাতে তো বাড়তি কোন আবেগ ছিলো না। আর আপুর জন্য ভালোবাসা সব সময়, কিন্তু তার টানে দেশে আসার কারণ নেই। আর দেশ! এ দেশ তো তাকে ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। তবে কী এমন আবেগ যে সারাহ্কে এ দেশে টেনে আনলো তা এক রহস্য সারাহ্’র কাছে। সে রহস্য উদ্ঘাটন না করেই দিন পনের আগে দেশে এসেছে সারাহ্।

দুই

উঠতি যৌবনের কৌতূহলী মানসিকতা নিয়ে যখন দেশ ছেড়ে গিয়েছিলো তখন সারাহ্’র দু’চোখ জীবন পাল্টানোর স্বপ্নে বিভোর। পৃথিবীকে নিজের হাতের মুঠোয় নেড়েচেড়ে জয় করে ফেলবে এমন আত্মবিশ্বাসী মন তখন। দেশের কৈশোর জীবনের তরতাজা স্মৃতি, নতুন সম্ভাবনাময় জীবনের স্বপ্ন – সব মিলে আর কিছু ভাববার সুযোগ ছিলো না তখন। নিজের জীবন ছাড়া আর সব কিছুই তুচ্ছ – এমন স্বার্থপরতায় মন কাতর তখন। দেশ ছাড়ার পর সেই উন্মাদনায় যখন ধাক্কা লাগলো, তখন জীবনকে শাসন করতে হয়েছে কঠোর হাতে। আবেগের রাশ টেনে ধরে একাকী জীবনে যুদ্ধটা করতে হয়েছে শুধু মাত্র হেরে না যাবার জন্য। সারাহ্ প্রায়ই ভাবে এই হেরে না যাওয়ার জেদটা কোথা থেকে আসলো। হয়তো মা’র জেদী ভাবটার কিছু সারাহ্’র মধ্যেও রয়েছে। সারাহ্’র খুব বিস্ময় বোধ হয়, যে জেদ তাকে মা’র থেকে যোজন যোজন দূরে সরিয়ে দিলো, তা-ই তাকে আবার জীবনটা গোছাতে সম্বল হয়ে দাঁড়ালো। আর এই জেদটা যে মনে গেঁথে দিয়ে গেলো সেই মা’র জন্য তো কখনো বিশেষ কোন অনুভূতির ছোঁয়া পায় না সারাহ্! না কি পায়? নইলে হাজার মাইল দূরে থেকে তন্বী আপুর ডাকে দেশে কেন আসলো? শুধু তো বেড়াতে নয়; মন হয়তো সঙ্গোপনেই চেয়েছিলো মা’র শেষ জীবন যাপনটা কেমন ছিলো তা জানতে। একেই কি নাড়ীর টান বলে?

দেশে ফিরে সারাহ্ তন্বী আপুর বাসাতেই উঠেছে। আপু আদরে আদরে অস্থির করে ফেলছে। ঢাকায় এসে কয়েক দিন ঘুমিয়ে আর আপুর সাথে ছেলের বিয়ের কেনাকাটা করে সময় কেটেছে সারাহ্’র। চারদিন আগে আপু এক সন্ধ্যায় ওকে ডেকে পাঠালো। সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে কথা হচ্ছিলো। সারাহ্কে রুমের দরজায় দেখে আপু ডেকে উঠলো –

এই যে সারাহ্, আয়। চা খেতে ডেকেছি তোকে।

কী করো আপু?

কী আর করবো। যন্ত্রণার কি শেষ আছে? কেনাকাটা তো মোটামুটি হয়েছে। এখন দাওয়াতের জন্য কিছু লোকজন বাদ পড়েছিলো, তাদের বলার ব্যবস্থা করছি। তারপর বল, তোর কী অবস্থা?

এই তো – খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি আর তোমার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

লেখালেখি হচ্ছে কিছু?

নাহ্। লেখালেখি থেকে কয়েকদিন একদম দূরে থাকবো ভেবেই এসেছি। এতো দিন পর দেশে আসলাম। আগে কিছু সময় ঘুরে দেখি, তারপর লেখালেখির বিষয় দেখা যাবে।

ঘুরেই দেখবি যদি তাহলে ঘুমিয়ে দিন পার করলে ঘুরে দেখবি কী করে?

আপুর কথা শুনে সারাহ্ হেসে উঠলো।

আরে বোঝো না, ঘুরে বেড়ানোর জন্য এনার্জি স্টোর করছি ঘুমিয়ে।

হুম, এনার্জি স্টোর করছো ঘুমিয়ে! তুমি তো আইপিএস!!

আপুর কথায় দু’জনেরই হাসি পেয়ে গেলো।

আচ্ছা শোন, ঘুরে বেড়াতে চাচ্ছিস যেহেতু, তোকে বেড়াতে পাঠাবো।

সত্যি!

হুম, আমি তোর বেড়ানোর সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তুই পরশু দিন যাবি।

পরশু দিন? আমি? কোথায়?

আরে বাবা, বলছি। ব্যস্ত হচ্ছিস কেন?

আমরা কে কে যাচ্ছি?

আমরা না, আমি; মানে তুই একা যাচ্ছিস।

কেন?

অনেকটা আর্ত চিৎকারের ভঙ্গিতে প্রশ্নটা বেরিয়ে আসলো সারাহ্’র মুখ থেকে। তন্বী একটু হেসে বললো,

কারণ অন্য কেউ গেলে তুই জায়গাটা উপভোগ করতে পারবি না। তুই তো লেখক মানুষ, তোর ভালো লাগবে।

কোথায় এটা?

বলছি, বোস। চায়ের কাপগুলো রেখে আসি।

কাপগুলো রেখে একটা ড্রয়ার থেকে ছোট একটা খাম হাতে নিয়ে তন্বী বিছানায় এসে সারাহ্’র মুখোমুখি বসলো।

‘শোন সারাহ্, তুই তো দেশ ছেড়েছিস অনেক দিন। তোর সাথে আমি ছাড়া আর তো কারো যোগাযোগও ছিলো না। অনেক কিছুই তোর সাথে বলার সুযোগ হয়নি। ফোনে আর মেইলে তো সব বলা যায় না, বুঝিসই তো। তাছাড়া মামী, মানে তোর মা মারা যাওয়ার পর আমার মনে হয়েছে তোকে কথাগুলো বলা দরকার। নইলে আজীবন তুই কিছু ভুল ধারণা নিয়ে থাকবি। তোর ধারণা ভাঙ্গা দরকার। ভুল বিশ্বাসে বিশ্বস্ত হয়ে গেলে মানুষের মনের উপর স্বচ্ছ কালো পর্দা পড়ে যায়, যে পর্দা কখনো দেখা যায় না; কিন্তু পর্দার কারণে বিশ্বাসও দৃঢ় হয় না। তখন মনে অনেক সন্দেহ আর অযাচিত চিন্তা ভর করে মনকে প্রতারিত করে। তুই এমন প্রতারণার ফাঁদে পড়িস এটা আমি কখনো চাই না।

সারাহ্ ভাবছিলো লেখক হওয়ার বোধ হয় এই সুবিধা। কী সুন্দর করে গুছিয়ে কথাগুলো বললো আপু।

‘সারাহ্, তোর মা আমার বলার কাজটা অনেকটা গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছে। মামীর উপর তোর অনেক রাগ, আমি জানি। তুই সব সময়ই জেনে এসেছিস কিংবা ভেবে এসেছিস যে, মামী তোর প্রতি উদাসীন। তোর জায়গায় থাকলে আমিও হয়তো তাই ভাবতাম। সত্যি বলতে কী, তোর মা তোর প্রতি উদাসীন ছিলেন না, তোর মা তার নিজের জীবনের বৈচিত্র্যতা নিয়ে হতবিহ্বল ছিলেন। সৃষ্টিকর্তা উনার জীবন নিয়ে কী চাইতেন এই রহস্যময় প্রশ্নের ভাবনা উনার মনকে অস্থির করে রাখতো। এই অস্থিরতার প্রকাশ তোর কাছে উনি কখনো করেননি।

        সারাহ্ অপলকে তন্বীর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো যে, আপু মা’কে যতটা চিনেছে ও নিজের মা’কে ততটা কখনো চেনেনি। চেনার সুযোগই বা হয়েছে কোথায় যে চিনবে।

        ‘মামী অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার শেষ সময়গুলোতে আমি ছিলাম সাথে। হাসপাতালে থাকতে চাইতো না বলে বাসায় নিয়ে গেলাম। আমার বাসায় আনতে চাইলাম, রাজি হলো না। তোর মা’র জেদ তো তুই জানিস। এদিকে শরীরের অবস্থা এমন যে, কেউ সাথে না থাকলে চলে না। পরে একজন নার্স আর একটা কাজের লোক ঠিক করে দিলাম। কিন্তু ওদের দেখলেই বিরক্ত হয়ে যেতো। চিৎকার চেচামেচি করতো। আমি প্রতিদিন সকালে আর সন্ধ্যায় একবার করে দেখে আসতাম। যখন যেতাম মনে হতো আমার জন্য অস্থির হয়ে থাকতো। বলতো, তুমি আসলে একটু কথা বলতে পারি; তুমি থেকো কিছুক্ষণ।

সারাহ্’র খুব জানতে ইচ্ছা করছিলো যে, মা ওর কথা কিছু বলতো কি না। আপু কী করে যেন সারাহ্’র মনের কথা বুঝে ফেললো।

        ‘তোর কথা মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করতো। মনে হতো তোর কথা শুনতে চায়, কিন্তু শোনার আগ্রহ আছে বলতে চায় না। আমি নিজে থেকে তোর গল্প বলতাম, তোর লেখালেখির খবর দিতাম। শুনে কিছু বলতো না। মাঝে মাঝে বলতো যে, দেশ থেকে চলে গিয়েছে ভালো হয়েছে, নইলে এসব লেখালেখি করে বাউন্ডুলে জীবন কাটাতো। কথাগুলো হয়তো বলতো ঠিকই, কিন্তু আমি বুঝতাম যে তোর এ ব্যাপারটা সমর্থনও করতো মন থেকে। শেষের দিকে কথা শুনে মনে হতো, তোর জন্য কিছু কথা বোধ হয় বলার আছে, কিন্তু খুব দ্বিধায় ভুগতো বলা ঠিক হবে কি না এই ভেবে।

        ‘যে দিন সকালে মারা যাওয়ার খবর পেলাম তার আগের দিন সন্ধ্যায় মামীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বললো, শরীরটা অন্য দিন থেকে ভালো লাগছে, খুব ঘুমোতে ইচ্ছে করছে। আমাকে বললো, তোমার সাথে কথা আছে; কাল পারলে একটু সকাল সকাল এসো। এরপর বিছানার পাশের বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে দু’টা নোট বুক বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো, এটা যত্ন করে রেখো, সারাহ্’কে দিয়ো। আর এখানে একটা জায়গার নাম লেখা রয়েছে। সারাহ্ কখনো দেশে আসলে ওকে ঘুরে আসতে বলো ওখান থেকে। ও তো লেখালেখি করে, ভালো লাগবে ওর। 

        ‘আমি তখন বললাম, তাহলে সারাহ্’কে দেশে আসতে বলি। এ কথা শুনে মামী কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, ওর এতো সময় হবে না। দরকার নেই বলার, শুধু এ জিনিসটা দিয়ো। এ কথা বলে আমাকে বিদায় দিলো। উঠে আসার সময় বললো, কাল একটু সকাল সকাল এসো, কথা আছে।

        তন্বীর কথা হঠাৎ-ই যেন থেমে গেলো। সারাহ্ চোখে পরিষ্কার কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তন্বী কখন যে বিছানা ছেড়ে উঠে গেছে সারাহ্ খেয়ালই করেনি। আলমিরা থেকে একটা প্যাকেট হাতে ফিরে এসে তন্বী শাড়ীর আঁচলে সারাহ্’র গাল আর চোখ মুছিয়ে দিলো। তন্বীর গলাটাও যেন কেমন ধরে এসেছে।

        ‘এটা রাখ্, তোর জন্য। তোর মা নোট বুক দু’টা তোর জন্য দিয়ে গিয়েছে। একটা তোর মা’র লেখা – কালো নোট বুকটা; আর সবুজটা তোর বাবার লেখা। তোর মা’র সাথে শেষ কথা আর হয়নি আমার। পরদিন সকাল সকাল বের হওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি, এমন সময়ই ফোনে খবরটা পেলাম। ছুটে গিয়ে নার্সের কাছে শুনলাম রাতেই ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন; খুব নিরবে একাই চলে গেছেন। কী কথা যে এতো ব্যাকুল হয়ে বলতে চাইলেন তা আর জানা গেলো না।

        ‘নোট বুক দু’টা আমি পড়েছি, যদিও তোর মা এটা তোকে দিতে বলেছেন। পড়েছি বলে রাগ করিস না। এটা পড়ে মনে হয়েছে তোর মা এ কথাগুলোই আমাকে বলতে চেয়েছিলেন।

        কিছুক্ষণ চুপ থেকে তন্বী কথা বলে উঠলো।

        ‘নোট বুকটাতে যে জায়গার নাম লেখা রয়েছে আমি সেখানে গিয়েছিলাম মামী মারা যাওয়ার দুই মাস পর। গিয়ে বুঝতে পারলাম কেন মামী তোকে ঘুরে আসতে বলেছেন। তাই তোর যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। তুই গোছগাছ করে নে। পরশু সকালে নাস্তা করে রওনা দিবি। আমি তোর জন্য গাড়ি ঠিক করে রেখেছি। তুই চার-পাঁচ দিন থেকে আয়। তবে বেশি দেরি করিস না, কেমন?

        নোট বুক দু’টা আর ছোট খামটা তন্বী সারাহ্’র হাতে দিয়ে বললো, এ খামে বুকিং-এর কাগজপত্র আর তোর জন্য কিছু টাকা আছে। রেখে দে, বেড়াতে গেলে লাগবে। আর শোন, নোট বুক দু’টা ওখানে গিয়ে পড়বি।

        সারাহ্ জিনিসগুলো হাতে নিয়ে রুমে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলো যে, মা শেষ মুহূর্তেও রহস্যময়ী থেকে গেলো।

তিন

রহস্যময়ী মা’র রহস্যকে জিইয়ে রাখতেই কি না সারাহ্ গাড়িতে ওঠার আগে বুকিং-এর কাগজের ছোট খামটা খুললো না। গাড়িতে রওনা দিয়ে ঢাকা থেকে বের হওয়ার পর খামটা খুলে দেখলো যে, ঢাকার থেকে অনেক দূর পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা রিসোর্টে বুকিং দেয়া হয়েছে। সারাহ্ জামান নামে বুকিং রয়েছে পাঁচ দিনের জন্য। আপু সব ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত ভাবে করেছে। চমৎকার একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বলেছে, গাড়িটা সারাহ্’র সাথেই থাকবে। যদি ভালো লাগে চাইলে আরো দু’দিন বেশি থেকে আসতে পারে; ভালো না লাগলে আগেই চলে আসতে বলেছে।

        গতকাল সকালে রওনা দিয়ে রাতে এখানে পৌঁছেছে সারাহ্। রাতে রিসোর্টের অভ্যর্থনা ডেস্কে এসে কাগজটা দেখাতে ডেস্কের ছেলেটা বেশ সপ্রতিভ হয়ে উঠলো কেন বোঝা গেলো না। খুব সম্ভবতঃ তন্বী আপু ফোন করে বলে রেখেছিলো। আপু তো বেশ সুপরিচিত লেখিকা দেশে। ছেলেটা কাগজটা হাতে নিয়েই একটা মার্জিত হাসি দিয়ে বললো, ‘ম্যা’ম, আপনি আজ পৌঁছাবেন আমরা খবর পেয়েছি।’ এরপর পথে কোন অসুবিধা হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করে ছোট্ট র্ফম ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘ম্যা’ম, শুধু সিগ্নেচার করলেই চলবে’। সিগ্নেচার করে র্ফমটা ফিরিয়ে দিতেই ছেলেটা ডেস্কের দায়িত্ব অন্য একটি ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে নিজেই চাবি হাতে সারাহ্কে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো সারাহ্’র বাংলোর দিকে।

সারাহ্’কে নিয়ে ছেলেটা যে বাংলোর সামনে দাঁড়ালো সেটাতে নাম লেখা ‘প্রিয়দর্শিনী’। সারাহ্ অস্ফুটে বলে উঠলো, ‘বাহ্! চমৎকার তো!’

ছেলেটি সারাহ্কে জানালো যে, এখানে পাশাপাশি তিনটি কটেজ রয়েছে, একটা ‘প্রিয়দর্শিনী’, একটা ‘প্রিয়সঙ্গিনী’, আর একটা ‘সুহাসিনী’। সারাহ্ না বলে পারলো না যে, বেশ আবেগপূর্ণ নাম। ছেলেটি হেসে সারাহ্’র কথায় সম্মতি জানালো। ‘প্রিয়দর্শিনী’র দরজা খুলে দাঁড়িয়ে সারাহ্’কে ঢোকার জায়গা করে দিয়ে বললো, ‘ম্যা’ম, ইউ আর আওয়ার স্পেশাল অনারেবল গেস্ট; মোস্ট ওয়েলকাম টু আওয়ার ভ্যালী।’ সারাহ্কে চাবি দিয়ে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে ডিনারের ম্যানু জেনে ‘গুড ইভনিং’ বলে ছেলেটি বিদায় নিলো। সারাহ্ সময় নষ্ট না করে ফ্রেশ হয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ডিনার করে নিলো। এরপর বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম।

এই দুপুরে লনে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে সূর্যের ওম্ নিতে নিতে সারাহ্ রিসোর্টটা দেখছিলো। বেশ অনেকটা পুরানো রিসোর্ট বোঝা যাচ্ছে কারণ কিছু বাংলোতে প্রায় ৩০/৪০ বছর আগের ডিজাইন ধরে রাখা হয়েছে। লাঞ্চ করার সময়ও রেস্তোরার ম্যানেজার সারাহ্’র খোঁজ নিতে এসেছিলো। এদের আতিথেয়তায় সারাহ্ একটু বিস্মিত। সারাহ্ ঠিক বুঝতে পারছে না যে, এরা কি সবার সাথেই এমন আতিথেয়তা করে, না কি শুধু সারাহ্’র সাথে করছে তন্বী আপুর খাতিরে। রেস্তোরার বয়স্ক ম্যানেজারের সাথে বেশ খানিকটা কথা হলো লাঞ্চের সময়। তিনি প্রায় তেইশ বছর ধরে আছেন এখানে। তিনিই জানালেন রিসোর্টটা এ এলাকার প্রথম দিকের রিসোর্টগুলোর একটা। রিসোর্টটার বেশির ভাগ বাংলো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি এবং নতুন নতুন ঢং-এ সাজানো হয়েছে কয়েক বছর পর পর; শুধুমাত্র একটি বাংলো সেই শুরু থেকে একই রকম রাখা হয়েছে নমুনা হিসেবে এবং রিসোর্টের প্রথম দিকের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। কাল একবার ঐ বাংলোটা দেখতে যাবে বলে ঠিক করলো সারাহ্।

রিসোর্টটার চারদিক ছিম ছাম পাহাড়। বিকেলের শেষ লগ্নে পূব আকাশ পশ্চিমের আলোয় আবছা ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। কুয়াশার চাদর হিম বাতাসের সাথে ঢেকে দিচ্ছে সব। বিকেলের রোদটা মরে যেতেই ঠান্ডা পড়া শুরু করলো। সারাহ্ গরম কাপড় আনেনি বলে আর বসে না থেকে উঠে পড়লো। রুমে গিয়ে চোখে মুখে একটু পানি দিয়ে হালকা প্রসাধন করে বাংলোর বারান্দায় গিয়ে বসলো। চেয়ারে দু’পা তুলে হাঁটু মুড়ে বসে চাদরে গা ঢেকে বসে সামনে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক সারাহ্। এতক্ষণ খেয়ালই হয়নি যে, আকাশে মস্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে, আর তার আলোয় পুরো ব্যালকনি ঝলমল করে উঠছে। সারাহ্ রুমে ঢুকে ব্যালকনির বাতি নিভিয়ে এসে আবার বসলো।

জোছনা যেন সারাহ্কে গ্রাস করে নিচ্ছে। রূপালি আলোয় হালকা কুয়াশায় মাদকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে যেন! পুরো পাহাড়ি নির্জনতায় শুধু শিশির পড়ার শব্দ। আর হঠাৎ হঠাৎ কটেজের ছাদে পাতা ঝরা শব্দ। সারাহ্’র মন দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ মনে হলো তন্বী আপু কেন সারাহ্কে এখানে পাঠালো। আর নোট বুক দু’টা কেন এখানে এসে পড়তে বললো। সারাহ্ নোট বুকটা সেদিন হাতে নিয়ে এসে আর খুলে দেখেনি। ভেবেছে যারা নেই তাদের এই লেখাগুলো পড়ে কী আর হবে। তাছাড়া কী-ই বা লেখা থাকবে। মা হয়তো তাকে ভালো কিছু উপদেশ দিয়ে কিছু লিখে রেখে গেছেন। আর বাবা তো সারাহ্’র জন্মের আগেই পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। সারাহ্কে নিয়ে কিছু লেখার অবকাশ তো তার হয়নি। তো এটা পড়েই বা কী আর ফেলে রাখলেই বা কী। তবে সামান্য যে কৌতুহল জেগেছে তা হচ্ছে ঐ নোট বুকে না কি এ জায়গাটার কথা লেখা রয়েছে। তাই তন্বী আপু সারাহ্কে এখানে  পাঠিয়েছে। কিন্তু এতো জায়গা থাকতে এ জায়গা কেন? মা তো বেঁচে থাকতে কোন দিন এ জায়গার কথা বলেনি। এমন কি বাবার কথা বলতে গেলেও বলেনি। বাবার কথা অবশ্য মা তেমন বলতোই না। কেন জানি মা বাবার বিষয়ে কিছু বলতে পছন্দ করতো না; বিরক্ত হয়ে যেতো। এমন কি বাবা কী করে মারা গেছেন তা-ও বলেনি কখনো। সারাহ্ তন্বী আপুর কাছে শুনেছে বাবা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু কীভাবে জিজ্ঞেস করলেই উত্তর দিতো, ‘তোর মা জানে’। সারাহ্’র ধারণা হয়েছে এ কারণেই হয়তো মা বাবার বিষয়ে কিছু বলতে চাইতো না। সারাহ্’র কাছে এটাও মনে হয়েছে যে, বাবা মা’র মধ্যে আসলে সুসম্পর্ক ছিলো না। যে কারণে মা বাবার প্রসঙ্গে আলোচনা করতে চাইতো না; বরং বিরক্ত হতো।

সারাহ্’র একবার মনে হলো নোট বুক দু’টা এনে পড়ে দেখে। কিন্তু সাথে সাথে এ চিন্তা বাদ দিলো। বরং জোছনা উপভোগ করা যাক। নিকষ আঁধার রাত, একটা রূপালি চাঁদ আর সারাহ্! 

চার

সকালের নাস্তা খেয়ে চায়ের কাপ হাতে সারাহ্ ব্যালকনিতে এসে বসলো। আজও স্নিগ্ধ সকাল এখানে। আজ ভোরে ঘুম ভেঙ্গেছে সারাহ্’র। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় সকালে শিশির ভেজা ঘাটে হেঁটে বেরিয়েছে সারাহ্। পুরো রিসোর্টটা ঘুরে ঘুরে দেখেছে। চমৎকার করে সাজানো হয়েছে রিসোর্টটা। পাহাড়ের ভাজে ভাজে বাংলোগুলো তৈরি আর বাংলোগুলোর ব্যালকনি ঝুলে রয়েছে পাহাড়ের কিনার জুড়ে। পুরো রিসোর্টটা জুড়ে ছড়ানো রয়েছে সেগুন গাছ; পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় সুন্দর চায়ের টেবিল চেয়ার পাতা রয়েছে অলস সময় কাটানোর জন্য। রিসোর্টেও একটা কর্নারে সবচেয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে খুব সম্ভবতঃ একটা খোলা ক্যাফে। জায়গাটাতে সারাহ্ ঢুকতে পারেনি, কারণ জায়গাটা তারের কৃত্রিম দেয়াল দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো যে, ক্যাফে টাইপের কিছু; সবই বড় বড় প্লাস্টিক কাগজ দিয়ে ঢাকা। ঢোকার জায়গাটার দেয়ালে একটা নাম ফলক রয়েছে, সেটাও ঢাকা। সারাহ্ পরে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবে ভেবে চলে এসেছে। তবে ঐ কর্নারটাই খুব সুন্দর একটা পজিশনে যেখান থেকে পুরো জোছনা পাহাড়ের ছাদে বসে যেন দেখা যাবে এমন।

        সারাহ্ চায়ের কাপ হাতে নোট বুক দু’টার প্যাকেটটা নিয়ে আসলো। কাপটা টেবিলে রেখে প্যাকেট থেকে নোট বুক দু’টা বের করলো। কোনটা আগে হাতে নিবে বুঝতে পারছিলো না। শেষ পর্যন্ত সবুজ নোট বুকটা হাতে নিলো। একটা চিকচিকে  রেক্সিনে মোড়ানো কাভারে সাধারণ বই-এর আকার থেকে বেশ বড়, অনেকটা বাচ্চাদের ছবির বই-এর মতো একটা রোল টানা নোট বুক। কাভারটা মসৃন, ছুঁয়ে খুব আরাম বোধ হয়। নোট বুকের পাতাগুলো বয়সের ভারে হলদেটে হয়ে গিয়েছে, যদিও মনে হচ্ছে অনেক বছর আগে কিছুটা হলদে রঙের পাতাই ছিলো নোট বুকটার। পুরনো হলেও খুব যত্নে ছিলো বোঝা যায়। পাতাগুলো মোড়ানো নয়, ভাঁজ করা নয় কোথাও। সারাহ্ পুরো নোট বুকটার সব পাতা একেবারে উল্টে দেখলো। প্রায় দেড়শ পৃষ্ঠার নোট বুকটার এক তৃতীয়াংশের মতো লেখা রয়েছে। প্রতিটা লেখার ফাঁকে ফাঁকে এক-দুই পৃষ্ঠার বিরতি।

        সারাহ্ নোট বুকটার কাভার পেজ উল্টালো। প্রথম পৃষ্ঠায় পরিষ্কার ইংরেজি বড় অক্ষরে কালো কালিতে লেখা রয়েছে ‘আর জামান’। সারাহ্’র মনটা একটু নাড়া দিয়ে উঠলো। বাবার হাতের লেখা সারাহ্ কখনো দেখেনি। সারাহ্ আলতো করে নামটার লেখাটা ছুঁয়ে গেলো। এরপর কয়েক পৃষ্ঠা ফাঁকা। চার পাঁচ পৃষ্ঠা পর থেকে লেখা শুরু। লেখা শুরু হয়েছে যে পৃষ্ঠা থেকে সারাহ্ সে পৃষ্ঠাটা খুললো। লেখার উপর তারিখ দেয়া রয়েছে – প্রায় ত্রিশ বছর আগের ডিসেম্বরের একটা তারিখ। সারাহ্ পড়তে শুরু করলো।

        ‘আজ ঠিক নয়শ সত্তর দিন পর তোমার সঙ্গে দেখা। জীবন কী বিচিত্র! আমার আবারও এ কথাটা মনে হলো তোমাকে দেখার পর। স্বপ্নেও  ভাবিনি এতো সহজভাবে আচমকা তোমার সঙ্গে দেখা হবে। কফি খেতে ঢুকে একটা টেবিলের দু’টা চেয়ার ফাঁকা দেখে বসে পড়লাম। খেয়ালই করলাম না যে উল্টো পাশের চেয়ারে একটা হ্যান্ড ব্যাগ ঝোলানো। কী কফির অর্ডার দেবো ভাবতে ভাবতেই যেন স্বপ্নের মতো উদয় হয়ে উল্টো পাশের চেয়ারে বসলে তুমি। বিস্মিত আনন্দিত কণ্ঠে বলে উঠলে, তুমি! আমার বিস্ময়ের ধাক্কা তখনো কাটেনি। সুমনা, আমার সুমনা!! খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো আমার বুকের ভেতর থেকে। মনে হচ্ছিলো, কনডেম সেলে বন্দি যেন আমি। তোমাকে দেখছি চোখের সামনেই, কিন্তু যেন হাজারো আলোক বর্ষ দূরে। সেই সুমনা হক যেন ঠিক স্পর্শের বাইরে।

        এরপর নোট বুকটার কয়েকটা পাতা খালি। খালি পাতাগুলো উল্টে এসে কিছু দিন পরের আর একটা লেখা পড়া শুরু করলো সারাহ্।

        ‘মনের দরজা খুলেছে আমার; যেন স্বাধীনভাবে নীল আকাশে ডানা মেলতে পারছি এখন। মনের অসুখের যন্ত্রণার তীব্রতার উপশম হয়েছে কিছুটা। সুমনাকে কাছে পেয়ে ব্যথা ভুলে যাচ্ছি হয়তো, কিন্তু সুমনার কষ্টটা কি মুছতে পারছি আমি? মনে পড়ে যাচ্ছে আট বছর আগে থেকে তিন বছর আগের সময়গুলো। রঙিন আর সাদাকালো সব স্মৃতিই উড়ে বেড়াচ্ছে মনে। রঙিন স্মৃতিগুলো সব অস্থিরতার ডানায় চড়ে বেড়াচ্ছে আর সাদাকালো স্মৃতিগুলো ধুসর চাদরে মুড়ে থিতু হয়ে আছে। কত আলাপ, হাসি, আনন্দ আর মনের দ্বিধা, সাথে অভিমান ও নিরবতা, কিছু স্বার্থহীন ভালোবাসা আর অর্থহীন সিদ্ধান্ত। সবকিছু মিলে কী হয়েছে শেষে – একাকীত্বের বেশি কিছু নয় – না সুমনার, না আমার। সুমনার জীবন যেমন পাল্টেছে, তেমনি পাল্টেছে আমার জীবন। আমার জীবনের আকস্মিক পরিবর্তনগুলো হয়তো অভাবনীয়। আর সুমনার জীবন আমার মতো এলোমেলো না হলেও স্থিত না। কেমন জীবন আমাদের! আমি বুঝি না, ওলট পালট জীবন না হয়ে আমাদেরও তো গোছানো জীবন হতে পারতো। তা হয়নি। হয়তো পৃথিবীর জীবনযাত্রার জন্য কিছু মানুষের এলোমেলো জীবনের প্রয়োজন। প্রকৃতি হয়তো তাই চায়।

        সারাহ্ ভাবছিলো লেখাটা পড়ে – বাবা নিজের জীবনের প্রতি আক্ষেপকে প্রকৃতির চিরাচরিত বিধানের কাছে আত্মসমর্পন করেছিলেন মনে হয়। তবে বাবার সাথে মা’র বিয়ের অনেক আগে থেকেই পরিচয় ছিলো তা বোঝা যাচ্ছে। এটা সারাহ্’র কাছে পরম বিস্ময়কর! এ বিষয়টা একদমই জানা ছিলো না। যে তারিখটাতে লেখাটা লিখেছিলেন তা সারাহ্’র জন্মের এক বছরের কিছু সময় আগে। তার মানে এরও প্রায় আট বছর আগে থেকেই দু’জন দু’জনকে চিনতেন। কী অদ্ভুত! মা কোন দিন কথাটা বলেনি। সারাহ্ আরো সামনে এগিয়ে গেলো। আরও কয়েক পৃষ্ঠা খালি। এরপর আবার লেখা।

        ‘আজ  আবার সেই পুরনো অনুভূতি! সেই দেখা হওয়ার উন্মাদনা আর কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা! গোপনীয়তা প্রকাশের আশঙ্কা আর গোপনীয়তা রক্ষার চ্যালেঞ্জ। এ সব কিছু নিয়ে সুমনার সাথে কয়েক ঘণ্টা কাটানো। আমার বারবার অতীত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিলো। সুমনা অবশ্য চিরদিন বর্তমান নিয়ে থাকতে অভ্যস্ত। আমি আমার স্মৃতির স্রোত আটকাতে পারছিলাম না। অনুভূতি বিষয়ক ভুল সিদ্ধান্তের জন্য অনুশোচনা আমার তীব্র। কিন্তু এ অনুশোচনাকে অপরাধ বোধের চরম সীমায় নিয়ে যাচ্ছিলো সুমনার সহজ স্বাভাবিক আচরণ। ওর এ বদান্যতার সীমা নেই। এমন সহজ স্বাভাবিক ভাবে ও আমাকে মেনে নিলো এতদিন পর যে, ওকে কষ্ট দেয়ার অপরাধ বোধগুলো আমার মনে রেডিয়ামের মতো জ্বলছিলো।

        ‘সহজ হতে আমার কষ্ট হচ্ছিলো, কিন্তু ও এতটা আপনজনের মতো কথা বলছিলো যেন আমাদের নিয়মিত দেখা হওয়ার ফাঁকে গত দু’তিন দিন শুধু দেখা হয়নি। সুমনার সারল্য মাখা মিশুক ও প্রাঞ্জল আচরণ আমার সমস্ত দ্বিধার মেঘকে সরিয়ে দিয়েছে শরতের হাওয়ার মতো। কিন্তু একই সাথে গুমোট অপরাধ বোধের কষ্টের বোঝা চাপিয়েছে মনে। সুমনাকে একা করে দিয়ে আমার আবেগকে আমি যেমন বাক্সবন্দী করেছিলাম, তেমনি সে বন্দী আবেগ বন্দী জীবনে মৃতপ্রায় অনুভূতি নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলো। সুমনা ওর একাকীত্ব নিয়ে যদি আমাকে দোষারোপ করতো, তবে বোধ হয় আমার অপরাধ বোধটা কিছুটা কমতো। ওর নিশ্চুপ অভিমান আর প্রাঞ্জল আবেগ আমাকে অপরাধী করে ফেলছে ক্রমে। আলোকবর্ষ পরিমাণ দূরত্ব কমে গেলেও অনুতাপের বোঝাটা তীব্র হচ্ছে যেন! ক্ষমা করো সুমনা। তোমার কাছ থেকে শাস্তি পাওয়া আমার প্রাপ্য হলেও অসহনীয়।

        সারাহ্ এটুকু পড়ে বুঝতে পারলো না কী অপরাধের জন্য ক্ষমা চাচ্ছে বাবা। এটুকু বোঝা যাচ্ছে অপরাধ অতটা না; নইলে মা’র মতো জেদি মেয়ে বাবাকে নিশ্চয়ই এ অপরাধ ক্ষমা করে মেনে নিতো না। সারাহ্ আরো কিছু ফাঁকা পৃষ্ঠা উল্টে আবার একটা লেখা পৃষ্ঠা পেয়ে পড়া শুরু করলো।

        ‘সুমনাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সুনীল আকাশের মতো সীমাহীন স্বপ্ন ছিলো আমার। আমি আমার ভালো লাগা জায়গাগুলোর কথা ভেবে রেখেছিলাম সব সময় ওকে নিয়ে যাবো বলে। এ ভালো লাগার জায়গাগুলোতে যখন আমি গিয়েছি সব সময়ই মনে হয়েছে একটা সময় সুমনাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো। স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছিলো এক সময়।

        ‘সুমনা আর আমি দু’জনেই চাচ্ছিলাম একটু ফ্রি সময় কাটাতে – একেবারে নিরবে ও নির্জনে। শুধু বসে থাকা হবে, কোন কথা হবে না। পাশাপাশি বসে নিরবতা প্রকাশই হবে অনভূতি প্রকাশের ভাষা। আমরা নিজেদের চাঁপা থেকে যাওয়া অনুভূতিগুলো নির্জনে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বের করে দেবো মন থেকে। এ কথা ভেবেই বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। তবে আমার পছন্দে নয়, সুমনার ভালো লাগার একটা জায়গায়।

        ‘এরকম সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা ছিলো প্রথমে। কিন্তু দ্বিধাটাকে আমরা ঝেড়ে ফেললাম। কেন না হৃদয়ের লেনদেনে এ সব দ্বিধার কোন জায়গা নেই। হৃদয় যখন সমর্পিত তখন দ্বিধাকে প্রশ্রয় দেয়ার কোন যুক্তি দু’জন পূর্ণবয়স্ক নর-নারীর জন্য থাকার প্রশ্নই আসে না। তার চেয়েও বড় কথা আমরা নিজেদের জীবনে কোন স্বার্থপরতার সুযোগ নেইনি। নিঃস্বার্থ অবস্থানে থেকে জীবনে হারিয়েছি অনেক। হৃদয় আলিঙ্গনে উষ্ণতা অনুভব করেছি কিন্তু উষ্ণতা ছুঁয়ে ওম্ নেইনি কখনো। আমরা তো অস্পৃশ্য না, আমরা তো অবিশ্বস্ত নই। আমাদের ভালোবাসা আর অনুভূতিতে কোন খাঁদ নেই। তবে আর দ্বিধা কিসের? হারিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে – অসীমে!

        সারাহ্ পড়া থামিয়ে নোট বুকটা হাতে কিছুক্ষণ বিস্মিত ও স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। বাবা নামক ব্যক্তিটার সাথে সারাহ্’র পরিচয় কখনই ছিলো না। বলা যায়, এ নোট বুকটা বাবা নামক মানুষটা সম্পর্কে কিছু ভাবার ও জানার প্রথম উপকরণ। বাবার সাথে মা’র এ রকম আবেগীয় সম্পর্ক তো অকল্পনীয়! সারাহ্’র স্বপ্নেরও বাইরে। বাবার বিষয়ে মা’র যে উদাসীনতা আর বিরক্তি বোধ তা থেকে তো কখনোই মনে হয়নি বাবার সঙ্গে মা’র বিশেষ কোন গভীর প্রণয়ের ব্যাপার ছিলো। তাছাড়া মা যেমন জেদি ও গম্ভীর প্রকৃতির তাতে তো কোন ধরনের গভীর আবেগীয় সম্পর্কে জড়ানো মা’র পক্ষে অসম্ভব বলেই সারাহ্’র মনে হয়। বিস্ময়ের ঘোর নিয়েই সারাহ্ আরো কয়েকটি ফাঁকা পৃষ্ঠা উল্টে গিয়ে আবার পড়া শুরু করলো।

        ‘আজ বিকেলে আমরা এখানে পৌঁছেছি। আমরা মানে সুমনা আর আমি। অভিভূত হয়ে যাওয়ার মতো জায়গা এটা। সুমনার রুচি ও পছন্দের ব্যাপারে আমি চিরদিনই শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত। এক্ষেত্রেও বলতে হচ্ছে জায়গাটা পছন্দের ব্যাপারে সুমনাকে পুরোপুরি ক্রেডিট দিতে হয়। চমৎকার একটি পাহাড়ি রিসোর্ট। খুব সাদামাটা ভাবে বাঁশের তৈরি বাংলো আর উপরে খড়ের ছাউনী দেয়া। চারদিকে সবুজের সমারোহ। তিনটি বাংলো রয়েছে এখানটায় আর একটা ছোট খাবার ঘরের ব্যবস্থা। একেবারে পাহাড়ি গ্রাম্য পরিবেশ। মনকে বিষণ্ন ও শান্ত করার জন্য যথেষ্ট পরিবেশটা।

        ‘আমরা বিকেলের চা খেয়ে সন্ধ্যার পর বাংলোর বারান্দায় পা ঝুলিয়ে মেঝেতে পাশাপাশি বসে গল্প করলাম বেশ কিছুক্ষণ। চাঁদের পূর্ণতা চলে গিয়েছে দু’দিন হলো, তবুও জোছনার সমুদ্র যেন চারদিক। হিম বাতাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র ভরা রাত আর জোছনার সাগরে আমরা মাতাল দুই নর-নারী ভাবাবেগে পূর্ণ। সুমনার আঙ্গুলের স্পর্শে আমার ধমনীর রক্ত টগবগ করে ছুটছিলো। হৃদস্পন্দনগুলো ঢাকের বাড়ি দিচ্ছিলো করোটিতে। মনে হচ্ছিলো সুমনাকে বুকে চেপে লোক-লোকান্তরে হারিয়ে যাই চিরতরে। ওর গরম নিঃশ্বাসের তাপে পুড়ছিলো আমার চেতনা। খুব দ্রুতই অবচেতনে পাড়ি জমালাম দু’জনে। শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা।

        কী অদ্ভুত! কী অদ্ভুত!! আবেগে ভেসে যাওয়া তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প যেন এক!!! সারাহ্ ভাবছিলো। সারাহ্’র মনে হলো পৃথিবীতে কত কথাই না অজানা মানুষের। মেয়ে হয়েও বাবা-মা’র এই আবেগঘন সম্পর্কের পরিচয়টুকু পায়নি কখনো ও। এটা কি কেউ জানতো না? এই তরুণ-তরুণীর গল্পটা শুধু তাদের গল্প হয়েই ছিলো। আবেগের শীর্ষে পৌঁছেও মা তবে কেন এত উদাসীন বাবার প্রতি? কী এমন ঘৃণার জন্ম নিলো মা’র মধ্যে যে বাবাকে কোন দিন প্রকাশ করলো না। সারাহ্’র আর পড়তে ইচ্ছে করছিলো না। কারণ মনে হচ্ছিলো এ সুসময়ের নিশ্চয়ই পরিসমাপ্তি হয়েছে কোথাও। নইলে মা’র মন বিক্ষিপ্ত হলো কী করে? সেই পরিসমাপ্তিটা আর পড়তে ইচ্ছা করছিলো না সারাহ্’র। মনে হচ্ছিলো যেন যে আবেগটুকু ইতিবাচক হয়ে বাবা নামক অচেনা মানুষটার প্রতি তৈরি হয়েছে, তা হয়তো এক ধাক্কায় চুরমার হয়ে যাবে। অনেকটা অনিচ্ছা নিয়েই সারাহ্ আরো কয়েকটি খালি পৃষ্ঠা উল্টে আবার পড়তে শুরু করলো।

        ‘আজ আমাদের ফেরার দিন। দু’দিন থেকে জীবনের চমৎকারতম সময় কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছি আজ আমরা। সকালের স্নিগ্ধতায় লিখতে বসেছি। সুমনার ঘুম এখনো ভাঙেনি। বাঁশের জানালার ফাঁক গলে মৃদু সূর্যের আলো সুমনার মুখটাতে আভা ছড়াচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে দুই হাতে মুখটা তুলে আলতো করে অধর স্পর্শ করার, কিন্তু ‘ঘুমন্ত দেবী’র ধ্যান ভঙ্গ হয় যদি সেই ভয়ে শুধু তাকিয়ে দেখছি। নইলে সে কাজ করে ‘শাপভ্রষ্ট’ হতে পারি আবার!

        ‘অনুভূতির আকালে আবেগের জোয়ারে ভেসেছি আমরা। আর হয়তো ঠেকিয়ে রাখা যাবে না আমাদের। ঢাকায় ফিরে তাই সংসার বাঁধার চিন্তা করছি দু’জনেই যদিও একাকী জীবনে সংসারের প্রতি ব্যাপক অনীহা দু’জনের। তবুও নির্ভরশীল হতে চাই আমরা। শুধু ভালোবাসা নয়, পরম নির্ভরশীলতার চাদরে জড়াতে চাই দু’জনে। এখন দেখা যাক্ সময় কী বলে।

        ‘ঘর বাঁধার স্বপ্নের পাশাপাশি নতুন আর একটা স্বপ্ন জন্ম নিয়েছে আমার। আমি ভেবেছি এই রিসোর্টটার যে বাংলোটাতে আমরা ছিলাম সেটা আমাদের জন্য করে নেয়ার কোন ব্যবস্থা করা যায় কি না তা আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো; প্রয়োজনে এই রিসোর্টের শেয়ার কিনবো। কাল রাতে এটা নিয়ে সুমনার সাথে আলাপ করলাম। এরপর এখানে আরো কয়েকটি বাংলো বানাবো যার জন্য আমি তিনটা নামও ঠিক করে রেখেছি। এখানে আমরা মাঝে মাঝেই আসবো আর আমাদের এ দু’দিনের পুলকিত সময়গুলো উপভোগ করবো। 

        স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সারাহ্ ভাবলো, যাক্ আরো কিছু সুখের স্মৃতি রয়েছে তাহলে। অন্ততঃ ঘর বাঁধার সিদ্ধান্তে তা-ই বোঝা গেলো। আবেগের সমুদ্র মহাসাগরে পড়েছে কি না তাই জানতে আরো কয়েক পৃষ্ঠা উল্টে গেলো সারাহ্, কিন্তু নাহ্, আর কোন লেখা নেই। পুরো নোট বুকটা উল্টে গিয়েও আর কোন লেখা পাওয়া গেলো না। একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো সারাহ্’র বুক থেকে। কী অদ্ভুত! আর কিছু লিখলো না বাবা!! না কি অন্য কোথাও লিখে রেখেছে? সারাহ্’র মনটা একটা অতৃপ্তিতে ভরে উঠলো।

        নোট বুকটা রেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো লাঞ্চের সময় অনেক আগেই হয়েছে। খিদেও পেয়েছে খুব, কিন্তু পড়ার ঝোঁকে বুঝতে পারেনি এতক্ষণ। দেরি না করে সারাহ্ লাঞ্চের জন্য বেরিয়ে পড়লো।

পাঁচ

আজও জোছনায় ভাসছে চারদিক। সন্ধ্যার তারারা ঝিকমিক করছে আকাশে। কুয়াশা নেই আজ, সে কারণে আকাশ পরিষ্কার। শিশিরে ভিজে গেছে চারদিকের ঘাসগুলো। সারাহ্’র মনের অতৃপ্তি বোধটা যাচ্ছে না। দুপুরে খেয়ে রুমে ফিরে এ অতৃপ্তি বোধটা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম থেকে উঠে দেখে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যায় পড়েছে সময়। মুখ-হাত ধুয়ে বেশ খানিকটা প্রসাধন করে হেঁটে হেঁটে রেস্তোরায় গিয়ে বসেছে কফি খেতে।

        রেস্তোরার কাঁচের দেয়ালে জোছনার আলো পড়ে একটা আবছায়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আজ রেস্তোরায় অনেক লোকজন, মনে হচ্ছে রিসোর্টে নতুন অতিথি এসেছে। সারাহ্কে দেখে রেস্তোরার ম্যানেজার হাসি মুখে এগিয়ে আসলো। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে কী খাবে জেনে নিয়ে গেলো। ম্যানেজার চলে যাওয়ার মুহুর্তে হঠাৎ সারাহ্’র মনে পড়লো যে, সকালে দেখা রিসোর্টের সবচেয়ে সুন্দর কর্ণারের ঐ ক্যাফের মতো জিনিসটার ব্যাপারে তো জিজ্ঞেস করা হলো না। সারাহ্ ম্যানেজারকে পিছন থেকে ডাকলো।

        ‘এক্সিউজ মি।

        ‘ইয়েস ম্যা’ম।

        ম্যানেজার ঘুরে দাঁড়িয়ে সাড়া দিলো।

        ‘একটা ব্যাপার জানতে চাচ্ছিলাম। আজ সকালে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম রিসোর্টের এক কর্ণারে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে একটা আলাদা জায়গা। ওটা কী? সব কিছু ঢেকে রাখা হয়েছে যেখানটায়।

        ‘ওহ্, ম্যা’ম। ওটা আমাদের একটা নতুন কফি ও টি কর্ণার।

        ‘ও আচ্ছা।

        ‘আপনি জানেন না বোধ হয় ম্যা’ম, আগামি কাল নতুন কর্ণারটা চালু হবে। অল অব দ্য গেস্ট আর ইনভাইটেড ফর কফি এন্ড ডিনার টুমরো।

        ‘তাই না কি!

‘জ্বী, ম্যা’ম।

‘থ্যাংক ইউ। এটা জানতেই ডেকেছিলাম।

‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।

বলে ম্যানেজার অর্ডার নিয়ে চলে গেলো।

কফি শেষ করে সারাহ্ রেস্তোরা থেকে বের হয়ে রুমের দিকে হাঁটতে লাগলো। হিম্ হিম্ সন্ধ্যায় হাঁটতে ভালোই লাগছে। কিন্তু মনের ভেতরকার অতৃপ্তিটা যাচ্ছে না। আজ সকালে তন্বী আপুকে একবার ফোন দিয়েছিলো নোট বুকটার পরের কথাগুলো জানতে, কিন্তু আপু বাইরে থাকায় আর কথা বলা হয়নি। এর মধ্যে আর ফোন দেয়া হয়নি। এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না সারাহ্’র। সারাহ্ ঠিক করলো রুমের দিকেই যাবে। রুমে গিয়ে অন্য নোট বুকটা নিয়ে বসবে।

সারাহ্ ব্যালকনির স্পট লাইটটা জ্বালিয়ে নোট বুকটা নিয়ে তার নিচে বসলো। নোট বুকটা কালো চিকচিকে মসৃন একটা  কাভার ঢাকা, হাত বুলাতে খুব আরাম। সারাহ্ কাভার পেজটা উল্টালো। কোন নাম লেখা নেই। নোট বুকটার পাতা খুব হালকা সবুজাভ সাদা রং-এর, তার উপর কালো কালিতে লেখা। লেখার অক্ষর পরিচিত; মা’র হাতের লেখা। নোট বুকের লেখায় কোন তারিখ উল্লেখ নেই। সারাহ্ পড়তে শুরু করলো।

‘নোট বুক বা ডায়েরি লেখার অভ্যাস অনেক আগেই ছেড়েছি। লেখার ইচ্ছাও হয় না, ভালোও লাগে না। আজ অনেক অনেক বছর পর লিখতে বসেছি। কী লিখবো, কেন লিখবো, কিছুই জানি না। শুধু মনে হচ্ছে আমার জীবনে যা ঘটে যাচ্ছে তা আমি কাকে বলবো, কীভাবে বলবো? জীবনের ঝড়ঝঞ্ঝায় আমি পুরোপুরি পর্যুদস্ত। আমি না পারছি কাউকে বলতে, না পারছি কিছু সইতে। সব কিছু নিয়ে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কী করবো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এতো নিঃস্ব আর অসহায় আমি কখনো বোধ করিনি।

‘জামান আমার জীবনটা পুরোপুরি ওলোট-পালট করে দিয়ে গেছে। আমার সাথে জামানের প্রায় আট বছর আগে প্রথম যখন দেখা হয়, তখন কে জানতো ও আমার জীবটাতে এমন ভাবে জড়াবে। আমি ঘুণাক্ষরেও ওর ফন্দি বুঝতে পারিনি। জামান যখন আমাকে প্রোপোজ করলো আমি বিস্ময়ে হতবাক! ছেলেবেলা থেকেই খেলোয়াড় হিসেবে ছন্নছাড়ার মতো বড় হয়েছি। খেলাধুলার কারণে চালচলনে মেয়েলেপিনার চেয়ে ছেলে ছেলে স্বভাবই আমার মাঝে প্রকট। আমার মতো ছন্নছাড়া মেয়েকে কোন ছেলের ভালো লাগতে পারে আমার ধারণাই ছিলো না। আমি ওর প্রোপোাজাল এক তুড়িতে উড়িয়ে দিতে পারিনি। দিলে হয়তো আজ জীবন অন্য রকম হতো। আমি জামানকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ছেলেটা নাছোড়বান্দা। তবে কোন বিষয়ে অন্ততঃ অমার্জিত নয়। একটা সময় আমি নিজেকে আটকাতে পারলাম না। আবেগের ফাঁদে পড়ে গেলাম এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বাস করতে শুরু করলাম যে, আমার জীবনে জামানকেই আমি পুরুষ হিসেবে জানি ও চিনি। ওর বাইরে আর কোন পুরুষ আমার জীবনে নেই। আমার মনটাকে আমি কখন যে ওর কাছে পুরোপুরি সমর্পন করলাম তা বুঝতেই পারিনি। কিন্তু নিজেকে নারী হিসেবে ওর সামনে তুলে ধরতে আমার দ্বিধা ছিলো সব সময়। আমার চাল-চলনে নারীত্বের প্রকাশ খুব কমই ছিলো। এটা বুঝেও জামান কেন যে আমার সাথে লেগে ছিলো তা আমার মাথায় ঢোকে না। আমি স্বাধীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত। আর এ জীবন যাপনে জবাবদিহিতার বালাই নেই। জামান আমার এ জীবনটাতে এসে আমার নারীত্বকে নাড়া দিয়ে গেলো। ওর মনের স্পর্শে আমি প্রথম অনুভব করলাম যে, আমি নারী; আমারও একটা পৃথক সত্তা রয়েছে।

সারাহ্ হতবাক হয়ে বসে রয়েছে। মা’র এমন অনুভূতির কথা কল্পনাতেও ছিলো না সারাহ্’র। সারাহ্ দ্রুত পৃষ্ঠা উল্টে গেলো। এক পৃষ্ঠা পরই আবার তারিখবিহীন লেখা।

‘জামানকে ছাড়া আমার জীবন তো ভালোই চলছিলো। আমি জীবনকে আমার মতো করে সাজিয়েছি। আমার যে জীবন তাকে কি সাজানো বলা যায়? বরঞ্চ আমি আরো ছন্নছাড়া হয়েছি হয়তো! স্বাধীন জীবনকে আরো কি লাগামহীন করেছি আমি? জানি না। এসব ভাবতে ভালো লাগে না। জামানকে আমি সব সময় দূরে রাখতে চেয়েছি; মনে হয়েছে আমি ওর প্রত্যাশা অনুযায়ী কিছু দিতে পারবো না। এই দূরত্বের কারণে ও যে সত্যি এমন করে দূরে সরে যাবে আমি ভাবিনি। যখন তিন বছর আগে ও এভাবেই আরো দূরে সরে গেলো তখন আমি বুঝতে পারলাম ওর অভাবে আমি ভীষণ একা! কিন্তু তখন তো আর কিছুই করার ছিলো না। আমি শুধু দূরে থেকে ওর সুখী জীবন কল্পনা করে গিয়েছি।

‘কিন্তু জীবন কী অদ্ভুত! জামানের সাথে আমার এমনভাবে আবার কোন দিন দেখা হবে আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিলো তা। কফির অর্ডার দিয়ে ওয়াশ রুম থেকে ফিরতে গিয়ে দেখি এক লোক আমার টেবিলে আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসা, শুধু পিঠটা দেখা যাচ্ছে। খুব বিরক্ত হলাম; চেয়ারে বসে কড়া দু’টা কথা বলবো ভেবে চেয়ারে বসতে গিয়ে স্তম্ভিত হলাম। আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। চশমা পড়া, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর এলোমেলো চুলের মুখটা হতবাক বিষণ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কখন যে টেবিলে হাতটা রেখে চেয়ারে বসলাম আমি নিজেও বলতে পারবো না। জামান কোন কথা বলতে পারছিলো না, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আমার গলা দিয়ে বেশ জোরেসোরেই বোধ হয় বেরিয়ে এলো, ‘তুমি!?’ আশপাশের বেশ কয়েকজন আমার চিৎকারে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। আমি দ্রুত সামলে নিলাম নিজেকে। জামানও বোধ হয় কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে ততক্ষণে। এরপর গল্পে গল্পে অনেক সময় গেলো। সেদিন কথা বলে একটা জিনিস বুঝলাম, সেটা হচ্ছে আমরা যেমনটা ভাবি জীবন তেমনটা চলে না; এবং আমরা যেমন চাই জীবন সব সময় তেমন হয় না। প্রায় তিন বছর ব্যবধানে দেখা, জীবন তো আমাদের অনেক পাল্টেছে। কিন্তু মনে হচ্ছিলো যেন তিন দিন পর আবার দেখা।

সারাহ্ বুঝতে পারছিলো যে, দু’জনের আবার দেখা হওয়াটা তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অবচেতন মনের চাওয়া ছিলো। দু’জনেই আবেগটা চেপে রেখে দূরে সরে ছিলো। কিন্তু কেন? এ উত্তরটা কারো লেখা থেকে পাওয়া গেলো না। কী হয়েছিলো যে, দু’জনকে এমন দূরে সরে যেতে হলো মনের গহীনে ভালোবাসাকে বন্দী করে? কোথায় ছিলো এরা দু’জন? এরা কি এতাটাই বোকা হয়ে গিয়েছিলো তখন যে, নিজেদের আবেগের মাত্রাটা পর্যন্ত বুঝতে পারলো না। ভালোবাসলে মানুষ অন্ধ হয়, কিন্তু এদের অন্তর্চক্ষুও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো মনে হয়। নোট বুকটা হাতে নিয়ে ঐ তিন বছর সময়ের আক্ষেপে সারাহ্’র বুকটা ফেটে যাচ্ছে; অথচ এরা কেমন মানুষ তখন একটুও বোঝেনি! নিজেদের আবেগকে পাথর চাপা দিয়ে চুপ করে ছিলো। কী দুর্ভাগ্য!

‘আমি অতীত নয়, বর্তমান নিয়ে থাকতে ভালোবাসি। কিন্তু এই এক সময়ের বর্তমান নিয়েও কি আমি দ্বিধান্বিত ছিলাম। সোজাসাপ্টা চিন্তা করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে অতীতে যাই ঘটুক বর্তমানে জামানের সাথে আমার আলাপচারিতা আমার জীবনকে কি আবার পরাধীন করে দিবে? আমি তো স্বাধীন জীবন উপভোগ করি সব সময়। তবে ওর অভাব বোধ করি কেন? আমার নিজেকে নিজের বিশ্বাস হয় না, যদি আবারও আবেগের ফাঁদে পা দিই! আবারও যদি ভেসে যেতে ইচ্ছে হয় আবেগের স্রোতে! এ সব কিছু নিয়ে আমি হয়তো দ্বিধায় ছিলাম। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাকে কখনো দ্বিধায় ফেলেনি। সেটা হচ্ছে আমার জীবনে আবেগের স্থান একটাই – জামান। ও আমাকে যেমন আমার নারীত্বকে স্পষ্ট করে তুলেছে, তেমনি আমার আত্মমর্যাদা বোধকেও শ্রদ্ধা করেছে সব সময়। এ কারণেই বোধ হয় ওর সাথে সময় কাটাতে আমার কোন সময় সংশয় থাকে না। সংশয় ও ভাবনাহীন কিছু সময় কাটাতেই আমরা বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

‘বেড়াতে আসার আগে ভাবছিলাম নিজেদের সামলাতে পারবো তো আবেগের স্রোত থেকে। জামান বলছিলো, আবেগের স্রোত ঠেকানো হয়েছে বাঁধ দিয়ে। যে স্রোত সময়ের প্রয়োজনে তীব্র হতে পারে তা বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা যায় না; এর প্রয়োজনও নেই। আমরা আবেগহীন রোবট নই। আর আবেগ আমাদের জন্য নিষিদ্ধ নয়। ও হয়তো ঠিকই বলেছিলো। নিজেদের ভালোবাসা তো আমরা কখনোই চাপিয়ে দিইনি কারো উপর। আর সবার কথা চিন্তা করেই তো স্বার্থপর হইনি কখনো। আমি তো আর যেখানে সেখানে আবেগের দোকান খুলে বসিনি। যে মানুষটার কাছে নিজেকে উজাড় করে দেয়া যায় তার সাথে সুখময় কিছু সময় কাটানোতে আমি দোষের কিছু দেখছিলাম না বলেই তো একান্তে সময় কাটাতে এই সবুজে ঘেরা পাহাড়ে আসা। আমার খুব ভালো লাগার জায়গা। জামান আর আমি কিছু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েছিলাম সেখানে। অল্প দু’তিন দিনে আমাদের স্বস্তি ছিলো, নিরবতা ছিলো, কথা ছিলো, হাসি, আনন্দ, স্মৃতি ছিলো, আবেগ, অভিমান আর লাগামহীন ভালোবাসা ছিলো। ছিলো স্পর্শের সুখ, ছিলো একে অন্যের মাঝে বিলীন হওয়ার তৃপ্তি, ছিলো উষ্ণতা আর আবেগের ভাগাভাগি, ছিলো শঙ্কার আড়ালে পরম সুখের ছোঁয়া।

‘জামানের প্রতিটি স্পর্শ আমাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিলো ভেতর থেকে; পরম সুখানুভূতিতে হারিয়েছিলাম তখন। এই স্পর্শের আরো গভীরতর সুখানুভূতি চরম বিপদাশঙ্কা নিয়ে উদয় হলো আমার মনে যখন আমার শরীরে কিছু পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন এক অনুভূতির ছোঁয়া পেতে লাগলাম। এ এক শিহরিত অনুভূতি! আমি আতঙ্কে নীল হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার ভেতরটা আতঙ্কে আর শিহরণে কেঁপে উঠছিলো বার বার। নিজেকে সামলানো কষ্টকর হয়ে পড়ছিলো আমার জন্য। তবে কি জামান আমার শরীরে ওর শেষ চিহ্নটুকু রেখে গেলো।

‘পাহাড় থেকে ফেরার পর দুই মাসে জীবন আমার আর এক ঝড়ে উল্টেপাল্টে গিয়েছিলো। জামান আর আমি যখন ফিরে আসার উদ্যোগ নিচ্ছিলাম, রুম থেকে বেরোনোর সময় আমাকে হঠাৎ করেই ও একেবারে এক ঝটকায় বুকে টেনে নিলো। অধরের স্পর্শে আগুন ধরিয়ে দিলো আমার সর্বাঙ্গে। আমি মোটামুটি ঘোরের মধ্যে গাড়িতে উঠলাম। ঘোর লাগা স্বপ্নময় আনন্দ অনুভূতিতে একটা কথা শুধু কানে বাজছিলো। আমাকে ছেড়ে দেয়ার আগে কানে ফিসফিস করে  বলেছিলো, মনে রেখো। আমি যখন গাড়িতে কল্পনা সুখে বিভোর তখন পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে দুর্দান্ত বেগে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়িটা। এই ছুটে চলা গাড়ি কী থেকে কী হয়ে  হয়ে গেলো। আমি শুধু বুঝলাম গাড়িটা রাস্তায় নেই। এর পরের ঘটনা আমি আর কিছুই জানতে পারলাম না। আমার দু’দিন পর জ্ঞান হওয়ার পর জানলাম যে, গাড়ির আরোহী হিসেবে আমিই সৌভাগ্যবান।

‘আমার এ সৌভাগ্যের কী প্রয়োজন ছিলো জানি না। প্রয়োজন কি এই যে, জামান আমার মধ্যে ওর যে চিহ্নটা রেখে গিয়েছে তাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা! আমি আমার শরীরে জামানের অস্তিত্ব প্রতিদিন একটু একটু করে টের পাচ্ছি। আর আমার দম্ বন্ধ করা আতঙ্ক বাড়ছে। আমি কি আত্মহত্যা করবো? জামান যে চিহ্ন রেখে গেছে সে সম্পদ তো এ সমাজ মানতে চাইবে না। আমি কি অস্পৃশ্য হয়ে পড়বো এ সমাজ থেকে? আমাকে কে রক্ষা করবে? রক্ষা করার মানুষটাই তো আমাকে আবার একা ফেলে চলে গেলো। এর চেয়ে আগের একাকীত্বও তো ভালো ছিলো।

সারাহ্ শিউরে উঠছে এ লেখাটুকু পড়ে। তবে কি মা …..? সারাহ্ আর ভাবতে পারছে না। এই সমাজের এতো জঞ্জালে সেও কি তবে একটা কীট? কিন্তু তা কী করে হয়? মা তবে কী করে বাবার পরিচয় বহন করে গেলো! এই সমাজে একা মেয়ে হয়ে কী করে মা যুদ্ধটা করলো টিকে থাকার? সারাহ্’র নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সারাহ্ দ্রুত পরের পৃষ্ঠায় গেলো।

‘আমি হয়তো অসহায়ত্বের শেষ সীমায় গিয়ে নিজেকে সামলাতে পারবো না। নিজের জীবন বিপন্ন করে আমি কি জামানের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারবো? আমার পরিবার কি মানবে এটা? না কি জামানের পরিবার এর স্বীকৃতি কোন দিন দিবে? কী ভীষণ অনিশ্চয়তার জীবন আমার!

মা’র অসহায়ত্ব যেন সারাহ্’কে দিশেহারা করে তুললো। সারাহ্ দ্রুত পরের পৃষ্ঠায় গেলো।

‘আমার অসহায়ত্বে বোধ হয় সৃষ্টিকর্তার কিছু দয়া হয়েছে। আজ জামানের বোন এসেছিলো দেখা করতে। আমার শরীর খারাপ দেখে অনেক কথা জানতে চাইলো। আমি দ্বিধা আর লজ্জায় তেমন কিছু বলতে পারলাম না। উনি ধীর প্রকৃতির বুদ্ধিমান মহিলা বলে মনে হলো। জামানের ব্যাপারে অনেক কথা বললেন। আমার সম্পর্কে জামানের ধারণা, স্বপ্ন আর ব্যথার কথা বললেন। যাবার আগে কী মনে করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখটা এনে নিচু গলায় বললেন, তুমি জামানের অস্তিত্বকে ধরে রেখেছো, আমরা বেঁচে থাকতে তোমার ভয় কী?

‘একটা ছোট্ট কথায় আমার দ্বিধার মেঘ অনেকাংশে কেটে গেলো; কিন্তু শঙ্কার ভার থেকে মুক্ত হতে পারলাম না। কীভাবে যে কী হবে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি শুধু উনার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। উনি উঠে দাঁড়িয়ে শুধু বললেন, আমি আবার আসবো।

সারাহ্ পৃষ্ঠা উল্টে পরের পৃষ্ঠায় গেলো।

‘আজ প্রায় সাত মাস হলো জামান নেই। কিন্তু আমার কাছে যেন রয়েছে। আমি প্রতি মুহুর্তে ওর হৃদস্পন্দনের শব্দ পাই যেন আমার হৃদয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। আমার রক্তে যেন ওর রক্ত কণিকার ছুটে চলা! আমার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে ওর অস্তিত্ব অনুভব করি আমি। আমার শরীর এখন অনেক ভারী হয়ে গিয়েছে, হাঁটতে কষ্ট হয়। তবু একটু একটু করে হাঁটি। আমি এখন আছি জামানের বোনের বাসায়। উনি আমাকে অনেকটা জোর করেই উনার কাছে নিয়ে এসেছেন। আমাকে যেদিন নিয়ে আসতে গেলেন সেদিন বললেন, জামান কখনো মিথ্যা কথা বলতো না; ওর ভনিতা করারও স্বভাব ছিলো না। কাজেই তোমাকে ভালোবাসার ব্যাপারে ওর কোন খাঁদ ছিলো না। তিনি জামানের ডায়েরিটা পড়েছেন বললেন। ডায়েরিটা দুর্ঘটনায় পড়া গাড়ির পাশ থেকে উদ্ধার হয়েছিলো। তিনি আমাকে বললেন, তোমার স্বামী আর. জামান; আর তার স্ত্রী হয়ে তুমি আমার সাথে যেতে দ্বিধা করছো? উনার এ বাক্যটায় আমি যে মানসিক স্বীকৃতি পেলাম সেটাই আমাকে উনার সাথে আসতে প্ররোচিত করেছে। এই প্ররোচনাতেই আমি উনার কাছে রয়েছি বেশ কয়েক মাস।

আর এক দুই পৃষ্ঠা পর আবার লেখা রয়েছে। মনে হলো অনেক দিন পর লেখা। কাগজ ও লেখার কালির রঙে বেশ পার্থক্য বোঝা যাচ্ছে।

‘আজ অনেক দিন পর কাঁদলাম। কান্না আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিলো চোখের জল সব শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই। আমার জীবনে যা যা ঘটেছে তাতে চোখের জল ফেলে মায়ায় মন ভেজানোর কোন মানে হয় না। আমার শূন্যতা আমি আড়াল করে রেখেছিলাম দীর্ঘ দিন। আজ আর পারলাম না। তন্বী যখন খবরটা দিলো আমি ওর সামনেই ভেঙ্গে পড়লাম।

‘আমার মেয়েটা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। মেয়েটা না কি জীবনের প্রতি, পরিবারের প্রতি হতাশ হয়েই দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। সারাহ্ এভাবে আমাকে ছেড়ে যাবে আমি ভাবিনি। অন্ততঃ আমার গোপন স্বপ্নটা পূরণ হওয়া পর্যন্ত ও পাশে থাকবে বলে আমার আশা ছিলো। আমি জানি, সারাহ্কে আমি ওর জীবনের চাওয়া পাওয়ার কিছুই দিতে পারিনি। মা হিসেবে আমি ওকে সময় দিইনি কখনই। আর ওর বাবা তো নিজেকে মুক্ত করে গেছেন অনেক আগেই।

‘জামানের ব্যাপারে সারাহ্’র ক্ষোভ প্রচন্ড আমি জানি। আমি জামানের বিষয়ে ওকে কখনোই বেশি কিছু জানতে দিতে চাইনি। ও যেন তেমন কিছু জানতে না পারে এ জন্য আমি আপার সাথেও যোগাযোগ রাখিনি। কী করে আমি জানতে দিই সারাহ্কে? জামান আর আমার আবেগটা কি সারাহ্ কখনো মেনে নিবে? নিজের জন্মটাকে কি প্রশ্নবিদ্ধ করতে ভালো লাগবে ওর? নিশ্চয়ই না। কিন্তু আমার অপরাধবোধের স্বীকারোক্তি তো করা হলো না মেয়েটার কাছে! মেয়েটাকে আর কখনোই বলা হবে না হয়তো সব কিছু! পৃথিবীতে কিছু রহস্য হয়তো এভাবেই থাকে। কিছু কথা হয়তো এভাবে কষ্ট হয়ে বসবাস করে মনের গহীনে, কিছু বলতে না পারা কথা।

সারাহ্ পাতা উল্টে দেখলো এটাই শেষ লেখা। সারাহ্ পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলো। অজান্তেই দু’গাল ভিজে উঠছে বার বার। কী এক হাহাকার যেন ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে সারাহ্’র মনটা। মা’র না বলা কথাগুলো যেন ঝনঝন করে বেজে উঠছে সারাহ্’র কানে।

দরজায় ঠক্ ঠক্ করে শব্দ হচ্ছে; হয়তো অনেকক্ষণ ধরেই হচ্ছে। সারাহ্ খেয়াল করেনি। চোখ মুছে দরজা খুললো সারাহ্। বিস্ময় আর স্বস্তির তখনো বোধ হয় বাকি কিছুটা, দরজার সামনে তন্বী আপু দাঁড়িয়ে। তন্বী দু’হাত বাড়িয়ে দিলো, সারাহ্ পাগলের মতো ঝাপিয়ে পড়লো তন্বীর বুকে। তন্বী সারাহ্’র কেঁপে ওঠা পিঠটা হাত বুলাতে বুলাতে শুধু বুঝতে পারলো ওর দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে আসছে।

ছয়

সূর্যাস্তের লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে সবুজ পাহাড়ে। কাঁচের সিলিন্ডারের মতো ক্যাফের খোপটাতে বসে তন্বী আর সারাহ্ কফি খাচ্ছে। পুরো ক্যাফেটা সাজানো হয়েছে সিলিন্ডার আকৃতির কাঁচের ঘর দিয়ে যার চারপাশে কাঁচের দেয়াল। পূর্ব দিক থেকে ছাদ এবং দক্ষিণে পুরোটাই পাহাড়ে সবুজে ঢাকা এলাকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যার অন্ধকারে ছেয়ে যাবে চারদিক। আজ অবশ্য পুরো অন্ধকার হবে না। পূর্ণিমা চাঁদের আভাস দেখা যাচ্ছে পূব আকাশে। জোছনায় ভেসে যাবে এই কাঁচের ঘরগুলো। স্বপ্নগুলো স্নান করবে রূপালি জোছনায়। কফির কাপ হাতে জোছনা বিলাসের অপেক্ষায় তন্বী আর সারাহ্।

কাল অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে সারাহ্। তন্বী আপুর হঠাৎ উপস্থিতি সারাহ্কে আবেগে ভাসিয়েছে। সারাহ্’র মনে হচ্ছিলো আপু যদি ঐ মুহূর্তে সারাহ্’র কাছে না থাকতো তাহলে জীবনের চরম অসহায়ত্ব বোধে সারাহ্’র হারিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকতো না। তন্বী কাল রাতে কখন যে ওকে নিয়ে ওর ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসেছে সারাহ্ বলতেই পারবে না। সারাহ্’র সম্বিত ফেরে যখন তন্বী ওর মা’র ব্যাপারে কিছু বলছিলো। মা’র কথা শুনেই তন্বীর কথায় সারাহ্’র মনোযোগ ফেরে।

‘সুমনা মামীর কিছু গোপন স্বপ্ন ছিলো’, তন্বী বলছিলো।

‘এ স্বপ্নগুলোর কথা আমার মা মানে তোর ফুপু কিছুটা জানতো। মামী তো খুব জেদি আর চাঁপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তেমন কিছু বলতেন না কখনো। কিন্তু স্বপ্নটা পূরণের জেদ ছিলো ভীষণ। তোর বাবা মারা যাবার পর মামী মানসিক দিক থেকে চরম ভাবে ভেঙ্গে পড়েন। মা’র মুখে শুনেছি, সে সময় মামী কখনো হাসতেন না; খুব কথা বলতেন না; সব সময় বিষণ্ন হয়ে থাকতেন। মামীর প্রতি না কি মামার ভীষণ আবেগ ছিলো; আর মামীর সাথে বেশ কয়েক বছর সম্পর্কচ্ছেদ থাকায় মামাও না কি খুব ছন্নছাড়া জীবন যাপন করতেন। কিন্তু কখনো আবেগ প্রকাশ করতেন না। মা বলতেন, মামার জীবনের না কি একটাই চাওয়া আর সেটা হচ্ছে সুমনা মামীর জন্য একটা স্বস্তির জীবন যাপনের ব্যবস্থা করা; সেটা দূরে থেকে হলেও। কিন্তু মামা কী দ্বিধা থেকে মুখে কখনোই এ কথা বলতেন না; মামার কিছু লেখা থেকে না কি মা জানতে পেরেছিলেন। এ কারণে মামা মারা যাবার পর মা, মামীর জন্য কিছু টাকা পয়সার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। মামার রেখে যাওয়া সব কিছুই মা মামীর নামে করে দিয়ে গেছেন। পরে মামীই না কি এক সময় এই রিসোর্টটার শেয়ার কেনার আগ্রহ দেখায়। মা, মামীর ইচ্ছা অনুযায়ী সে ব্যবস্থা করে দেন। এই ব্যাপারটা পুরোটাই মা আমাকে বলে গিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, এ রিসোর্টটা নিয়ে মামীর কিছু গোপন স্বপ্ন রয়েছে; আমি যেন মামীর খোঁজখবর রাখি সব সময়।

‘সারাহ্, এ কারণেই তোকে আমি কখনো একা হতে দিতে পারিনি।’

খুব বেলা করে ঘুম থেকে উঠে তন্বীর কথাগুলো সারাহ্’র কানে বেজে যাচ্ছিলো। এর সাথে সাথে সারাহ্’র মন থেকে শূন্যতা বোধটাও দূর হয়ে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে। মনে হচ্ছিলো, সত্যিই তো আমি একা নই! মা’কে বুঝতে চেষ্টা না করার অপরাধ বোধটা যদিও একটু ভাবাচ্ছিলো। কিন্তু সাথে সাথে এটাও তৃপ্তি দিচ্ছিলো যে, মা বলেই স্বপ্ন পূরণে এমন আবেগী জেদ নিয়ে থাকতে পেরেছেন। আমার মা! ভাবতেই সারাহ্’র মনটা গর্বে ভরে যাচ্ছিলো। এই তবে ভালোবাসা! এই তবে আবেগ!! রিসোর্টের নতুন ক্যাফেটাতে বসে এ কথাগুলোই ভাবছিলো সারাহ্।  

রিসোর্টের ক্যাফেটা আজই চালু হয়েছে। ক্যাফের দরজায় ইংরেজিতে লেখা রয়েছে –

“This cafe is to show honor the memory of Mr. Jaman who died in an unfortunate road accident after had been two nights in this resort in the openning year”

তার নিচেই লেখা রয়েছে –

Sponsored by Mr. Jaman’s beloved wife Ms. Sumona Haque এ লেখাটা দেখিয়েই তন্বী সারাহ্’কে বলছিলো, তোর মা’র স্বপ্ন পূরণ এটা, খুব সম্ভবতঃ শেষ স্বপ্ন।

ব্যবস্থাপক |

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন:১৯৯৯-২০০০

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০