fbpx

নভেম্বর ১৩, ২০২৪

বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে হারিয়ে ফেলা বীর, বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ জাহাঙ্গীর

৭ই মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে উজ্জ্বলতম একটি দিন। যেদিন ভোরে পুরো জাতি সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিল এক নতুন সূর্য। যে সূর্যের কারণেই আজও বাংলাদেশের প্রতিটি মুহূর্ত আলোকিত।

সময় তখন ৭ই মার্চ, ১৯৪৯ সাল। পিতা আব্দুল মোতালেব হাওলাদার এবং মা সাফিয়া বেগম এর কোলে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক শিশু। শিশুটির নাম রাখা হয় জাহাঙ্গীর। ফারসি শব্দ ‘জাহাঙ্গীর’ এর অর্থ ‘বিশ্ববিজেতা’। সেদিন কে জানত, একদিন এই শিশুই নিজের সাহস, দক্ষতা, বিচক্ষণতা আর ত্যাগের মাধ্যমে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মন জয় করে সকলের কাছে হয়ে উঠবে ‘আদর্শ’। বলছি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর এর কথা।

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এর জন্ম  বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে। পিতা ছিলেন কৃষক এবং মা গৃহিণী। ছয় ভাইবোনের সংসারে পিতার অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। তাইতো মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে তাকে পাড়ি জমাতে হয়েছিল মামার বাড়ি, মুলাদি উপজেলার পাতারচর গ্রামে। মা থেকে এই বিচ্ছেদই হয়ত মায়ের প্রতি তাঁর ভালবাসা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। যতটা তাঁর গর্ভধারিণী মায়ের প্রতি, ঠিক ততটাই ‘দেশ মা’-এর প্রতি। যা তাঁর কর্মজীবনে আরও ভালোভাবে ফুটে উঠেছিল।

জাহাঙ্গীর মুলাদি মাহমুদ জান পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৬৬ সালে বরিশাল বি.এম (ব্রজমোহন) কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ছাত্র হিসেবে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বেশ মেধাবী ছিলেন। তাই সুযোগ পেয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। ভর্তি হন পরিসংখ্যান বিভাগে।

ছাত্রাবস্থায়  মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বিমানবাহিনীতে যোগদানের চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁর ডান চোখে অসুবিধা থাকায় তিনি ব্যর্থ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। সেনাবাহিনীতে তার নম্বর ছিল  PSS-১০৪৩৯। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৯৬৯-৭০ সালে রিসালপুরে মিলিটারি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বেসিক কোর্স ট্রেনিং এবং পরে ইনফ্যান্ট্রি স্কুল অব ট্যাক্টিক্র্ থেকে অফিসার উইপন ও ডব্লিউ কোর্স-১৩ সমাপ্ত করেন। ১৯৭০ সালের ৩০শে আগষ্ট তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন।

১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানে ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটেলিয়ানে ‘পাকিস্তান–চীন সংযোগকারী মহাসড়ক’ নির্মাণে কর্তব্যরত ছিলেন। সেখানেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলমান পাক হানাদারদের সহিংসতা এবং ২৫শে মার্চ সংঘটিত অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে জানতে পারেন। তখনই সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। ১৯৭১ সালের ৩রা জুলাই তিনি তাঁর তিনজন সহকর্মীদের সাথে নিয়ে দুর্গম পার্বত্য এলাকা ও  মুনাওয়ার তায়ী নদী অতিক্রম করে শিয়ালকোটের নিকটে সীমান্ত পার হন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

FB IMG 15763761392983103

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে ৭নং সেক্টরের মেহেদিপুর (মালদহ জেলায়) সাবসেক্টরের কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। কানসাট, আরগরার হাট ও শাহপুর সহ বেশ কয়েকটি অভিযানে সফলতার পর তাঁকে রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখলের জন্য তাঁকে একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দেয়া হয়।

১০ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়া এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখানে পরিকল্পনা করা হয়, মিত্রবাহিনী দিয়ে পাক হানাদারদের উপর গোলাবর্ষণ করে তাদেরকে বিভ্রান্ত করে দেয়ার। এইসময় আক্রমণ চালাবে মুক্তিবাহিনী। কিন্তু মিত্রবাহিনী শেষ পর্যন্ত আক্রমণ না করায় মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর নতুন করে পরিকল্পনা সাজান। ১৪ই ডিসেম্বর ভোরে তিনি মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বারঘরিয়া এলাকা থেকে ৩/৪ টি দেশি নৌকায় মহানন্দা নদী অতিক্রম করেন। এরপর শহরের উত্তর দিক থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালান। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পিছু হটতে থাকে হানাদার বাহিনী।

একটি একটি করে বাঙ্কার দখল করে এগিয়ে যেতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। শহরে ঢোকার মুখে একটি দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে একটি মেশিনগানের মাধ্যমে অনবরত মুক্তিযোদ্ধাদের উপর গুলি চালাতে থাকে হানাদাররা। এই সংকটময় সময়ে মহিউদ্দিন শত্রুর মেশিনগান ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন।

তিনি একটি এসএমজি ও একটি গ্রেনেড নিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে গোপনে মেশিনগানবাহী বাড়িটির দিকে ধাবিত হন। ত্বরিত গতিতে তিনি মেশিনগান বরাবর গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। বিস্ফোরিত গ্রেনেডের আঘাতে মেশিনগানের স্থলটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। অকস্মাৎ রাস্তার পাশের একটি বাড়ি থেকে শত্রুর ছোড়া একটি গুলি বিদ্ধ হয় তাঁর কপালে। শহিদ হন অকুতোভয় জাহাঙ্গীর। এসময় তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর ৯ মাস ৬ দিন।

মুক্তিবাহিনী এই শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করে প্রতিশোধের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত বর্বর পাক হানাদার বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মুক্ত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ১৯৭১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর শহিদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে এনে  সমাহিত করা হয়।

যুদ্ধক্ষেত্রে অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপনকারী যোদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ শহিদ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরকে ১৯৭৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধি দেয়া হয়।

এই বীর যোদ্ধার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘আগরপুর’ ইউনিয়নের নাম তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে। তাঁর কলেজের নামও বর্তমানে ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর কলেজ’। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রধান ফটকের নাম রাখা হয়েছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ জাহাঙ্গীর গেট’। বরিশালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর স্মৃতি যাদুঘর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে আয়োজিত হয় ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর স্মৃতি টুর্নামেন্ট’।

৪৮তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে এই অকুতোভয় বীরের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

Humayun Kabir
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৮-১৯