fbpx

মুদ্রার বিনিময় হার

বিনিময় হার

কোন দেশের মুদ্রার মূল্য হ্রাস বা বৃদ্ধি পেলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে চরম সংকটের সৃষ্টি হতে পারে। যেমন: যদি ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পায় তবে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে অর্থাৎ আমদানিকারক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে যেহেতু পণ্য রপ্তানির তুলনায় পণ্য আমদানি বেশি করা হয় তাই দেশ অর্থনেতিকভাবে চরম সংকটের মুখে পড়বে। অন্যদিকে, যদি ডলারের মূল্য হ্রাস পায় তবে দেশের রপ্তানিকারকরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে এবং তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হবে ফলে দেশের শিল্পায়ন বাঁধাগ্রস্ত হবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মান একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখা জরুরি।

এক দেশের মুদ্রার হিসেবে অন্য দেশের মুদ্রার যে মূল্য প্রকাশ করা হয় তাকে বিনিময় হার বলে। যেমন: টাকার হিসেবে মার্কিন ডলারের মূল্য প্রায় ৮৫ টাকা; ফরেন এক্সচেঞ্জের ভাষায় একে বিনিময় হার বলা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য বিনিময় হার একটা অপরিহার্য অঙ্গ। আমদানি মূল্য পরিশোধ, রপ্তানি মূল্য আদায় এবং অন্যান্য অসংখ্য ধরনের আন্তর্জাতিক লেনদেন, আদান-প্রদানের জন্য বিনিময় হার ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়।

বিনিময় হার নির্ধারণ প্রক্রিয়া

দুই দেশের মুদ্রার বিনিময় হার কেমন হবে তা নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের উপর। এক কথায় উত্তর দেয়া না গেলেও শুধু এটুকু বলা যায় যে, মোটামুটি দুই মুদ্রার চাহিদা-যোগান ও পারস্পরিক ক্রয় ক্ষমতার উপর বিনিময় হার নির্ভর করে। কোনো মুদ্রার বিনিময় হার অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় কেমন হবে কিংবা হওয়া উচিত সে সম্পর্কে বেশ কিছু তত্ত্ব ও মতবাদ রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে (ক) মিন্ট প্যারিটি তত্ত্ব, (খ) আই. এম.এফ. পার ভ্যালু তত্ত্ব, (গ) ক্রয় ক্ষমতা সমতা তত্ত্ব এবং (ঘ) ব্যালেন্স অব পেমেন্টস্ তত্ত্ব।

(ক) মিন্ট প্যারিটি তত্ত্ব

এ তত্ত্ব অনুযায়ী কোন দেশের মুদ্রার বিনিময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কতটুকু স্বর্ণ পাওয়া যেত, সে অনুপাতে অন্যান্য স্বর্ণমান সম্পন্ন দেশগুলোর মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ হত। ইতোমধ্যে এ ব্যবস্থার অবসান ঘটেছে।

(খ) পার ভ্যালু তত্ত্ব

আই.এম.এফ. প্রবর্তিত এ তত্ত্ব অনুযায়ী প্রত্যেক দেশ তাদের মুদ্রার মান নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ অথবা মার্কিন ডলারের হিসাবে ঘোষণা দিত এবং সে স্তরে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য মনিটারী পলিসি ও এক্সচেঞ্জ পলিসি অনুসরণ করার ব্যবস্থা করত। সত্তর দশকের শুরুতে আই. এম.এফ. পার ভ্যালু প্রথা আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয়।

(গ) ক্রয় ক্ষমতা সমতা তত্ত্ব

এ তত্ত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন কারেন্সির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিনিময়যোগ্য পণ্য ও সেবার ক্রয় ক্ষমতার উপর নির্ভর করে পারস্পরিক বিনিময় হার।

(ঘ) ব্যালেন্স অব পেমেন্টস্ তত্ত্ব

এ তত্ত্ব অনুযায়ী কারেন্সির যোগান ও চাহিদার টানাপোড়েনের মাধ্যমে বিনিময় হার নির্ধারণ হয়।

বিদ্যমান বিনিময় হার পরিস্থিতি

গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড বা স্বর্ণমান ব্যবস্থা ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়েছে। স্থির বিনিময় হারের অপর সংস্করণ আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের পার ভ্যালু প্রথাসত্তর দশকের শুরুতেই দৃশ্যপট থেকে অপসৃত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা এখন দাঁড়িয়ে আছে সঞ্চরণশীল বিনিময় হার ব্যবস্থার উপর যা Floating Exchange Rate Regime নামে পরিচিত। এ ব্যবস্থায় বিশ্বের প্রধান প্রধান মুদ্রার বিনিময় হার তাদের তুলনামূলক অন্তর্নিহিত শক্তি এবং চাহিদা ও সরবরাহের আলোকে নির্ণীত হয়।

সঞ্চরণশীল (Floating) বিনিময় হার ব্যবস্থা

চাহিদা এবং সরবরাহের পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন মুদ্রার বিনিময় হারে অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় নিরন্তর স্বাধীনভাবে যে হেরফের সংঘটিত হয় তাকে সঞ্চরণশীল (Floating) বিনিময় হার ব্যবস্থা বলে। অর্থাৎ চাহিদা এবং সরবরাহ অর্থনীতির আর দশটা দ্রব্যের মূল্যের উপর যে ধরনের প্রভাব ফেলে, তেমনি কোনো মুদ্রার চাহিদা এবং যোগানের পরিবর্তন সে মুদ্রার বিনিময় হারে একইভাবে পরিবর্তন ঘটায়। সঞ্চরণশীল (Floating) বিনিময় হার ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অথবা আর্থিক কর্তৃপক্ষ তাদের মুদ্রার বিনিময় হার নির্দিষ্ট পর্যায়ে রাখার বিষয়ে স্বপ্রণোদিতভাবে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতে বিরত থাকে। তবে, প্রায় প্রত্যেক দেশই অভ্যন্তরীণ রাজস্ব ও মুদ্রানীতি এমনভাবে পরিচালনা করার প্রয়াস পায় যাতে সময়ের দীর্ঘ পরিসরে দেশের এবং মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়।

সঞ্চরণশীল (Floating) বিনিময় হারের সুবিধা

ক. দেশীয় মুদ্রায় বিনিময় হার চাহিদা-যোগানের নিরিখে নির্ধারিত হয়।

খ. ব্যালেন্স অব পেমেন্টস্ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভারসাম্যে পৌঁছে।

গ. বিদেশ থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব সহজে মোকাবেলা করা যায়।

ঘ. সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে বিনিময় হার নির্ধারিত হয়।

ঙ. বিনিময় হার কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে।

চ. রাজনৈতিক মতভেদ বা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে না।

সঞ্চরণশীল (Floating) বিনিময় হারের অসুবিধা

ক. বিনিময় হার সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় বিশ্ব বাণিজ্য সংকুচিত হওয়ার আশংকা থাকে।

খ. শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেন।

গ. সাময়িক কারণে বিনিময় হারে পরিবর্তন সূচিত হলে, সে কারণ দূর হলেও বিনিময় হার পরিবর্তিত স্তরে রয়ে যেতে পারে।

বিনিময় হার পরিবর্তনের কারণ

স্বর্ণমান এবং আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের বন্ধন মুক্ত হয়ে বিশ্বের মুদ্রা বাজারে অহরহ বিনিময় হার পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। পরিবর্তন কখনও আসছে ধীর লয়ে, কখনও অস্থিরতার উপর ভর করে। স্বর্ণমান এবং আই. এম.এফ. ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন হত না তা নয়, কিন্তু বড় ধরনের পরিবর্তন হত দীর্ঘ বিরতিতে। দৈনন্দিন পরিবর্তন হত শুধুমাত্র নির্দিষ্ট গন্ডির মাঝে। প্রধানত যে কারণসমূহ বিনিময় হারের উপর প্রভাব বিস্তার করে সেগুলো নিম্নরূপ:

ক. সরবরাহ এবং চাহিদা

মুক্ত বাজারে যেমন সরবরাহ ও চাহিদার টানাপোড়েনে পণ্যের মূল্য ভারসাম্য বিন্দুতে এসে পৌঁছে, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারেও অনুরূপ চাহিদা ও সরবরাহের পারস্পরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলে বিনিময় হার ভারসাম্য বিন্দুতে অবস্থান নেয়। সোজা কথা, কোনো মুদ্রার চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি হল বিনিময় হার হ্রাস পেয়ে এমন স্তরে পৌঁছাবে যেখানে সরবরাহ হ্রাস এবং চাহিদা বৃদ্ধির ফলে বিনিময় হার ভারসাম্য বিন্দুতে এসে পৌঁছবে।

খ. ব্যালেন্স অব ট্রেড

আমদানি ব্যয় রপ্তানি আয়ের চেয়ে বেশি  হলে সে দেশের মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় রপ্তানি আয়ের চেয়ে কম হলে সে দেশের মুদ্রার চাহিদা হ্রাস পায়। সে সঙ্গে হ্রাস পায় বিনিময় হার। এ কারণে কোনো দেশের ব্যালেন্স অব ট্রেড সংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশিত হবার পর সে দেশের মুদ্রার বিনিময় হারে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে।

গ. বাণিজ্য শর্ত (Terms of Trade)

বাণিজ্য শর্তের হেরফেরের কারণে অনেক সময় মুদ্রার বিনিময় হারের পরিবর্তন আসে। কোন দেশের আমদানি কিংবা রপ্তানির পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকলেও যদি আমদানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় তাহলে তা বিনিময় হারের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে। তেমনি রপ্তানি পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি সত্ত্বেও যদি মূল্য হ্রাস পায় তা হলে বিনিময় হার অপরিবর্তিত থাকতে পারে। এমনকি নিম্নগামী হতে পারে। মোটকথা বাণিজ্য শর্ত, অর্থাৎ আমদানি ও রপ্তানি দ্রব্যেও তুলনামূলক মূল্যের হেরফের বিনিময় হারকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

ঘ. সুদের হার

সুদের হার বহুলাংশে বিনিময় হারকে প্রভাবিত করে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টস্ এবং বিনিময় হার অনুকূলে রাখার জন্য অনেক দেশই স্বপ্রণোদিতভাবে সুদের হার উচ্চ পর্যায়ে রেখে থাকে। অধিকতর সুদ অর্জনের লক্ষ্যে সে সব দেশে বিদেশি তহবিলের অন্তঃপ্রবাহ ঘটে। এর ফলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টস্ এর উপর অনুকূল প্রভাব পড়ে এবং বিনিময় হার উচ্চস্তরে ঠেলে দেয়।

ঙ. মনস্তাত্ত্বিক কারণ

প্রত্যাশা ও মনস্তাত্ত্বিক বিনিময় হারের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। স্বল্প মেয়াদে এ প্রভাব অনেক সময় মারাত্মক হয়ে দেখা দিতে পারে। যেমন, কোনো মুদ্রার সরবরাহ ও চাহিদার পরিবর্তনের কারণে তার বিনিময় হারে পরিবর্তন আসে। কিন্তু পরিবর্তনের মাত্রা নির্ভর করে মার্কেটের মতিগতির উপর। অনেক সময় বিনিময় হারে তেমন চাঞ্চল্য ছাড়াই মার্কেট কোনো মুদ্রার বাড়তি সরবরাহ সহজেই বরণ করে নেয়; অন্য সময় তা বিনিময় হারে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।

চ. টেকনিক্যাল কারণ

ওপেন পজিশন সংরক্ষণের বিষয়ে ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় হারের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থাৎ অবমূল্যায়ন হবার সম্ভাবনা রয়েছে এমন সব কারেন্সির বিষয়ে ডিলাররা খুব স্পর্শকাতর। লেনদেন সমাপনান্তে দিনের শেষে, বিশেষ করে সপ্তাহান্তে, তারা এ সব কারেন্সিতে হয় স্কয়ার অথবা শর্ট পজিশনরাখতে সচেষ্ট থাকে। উল্টোটা ঘটে সে সমস্ত কারেন্সির ক্ষেত্রে যেগুলোর বিনিময় হার বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ধরনের অবস্থানে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ডিলাররা যে সব লেনদেন করে তা বিনিময় হারকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সঞ্চরণশীল (Floating) বিনিময় হার ব্যবস্থা

বাংলাদেশ টাকার বিনিময় হার পর্যালোচনা করলে যে সাধারণ চিত্র পাওয়া যায় তা হচ্ছে ১৯৭২ সালে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হার থেকে ধাপে ধাপে টাকার বিনিময় হার ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে বাজারমুখীকরণ এবং পরিশেষে ২০০৩ সালে ফ্লোট করা হয়।

ফ্লোট করার অর্থ টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হয় মার্কেটের উপর-যোগান ও চাহিদার উপর। ফলে টাকার বিনিময় হার কোন্ পর্যায়ে রাখতে হবে সে সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোন ফরমান দেয়া হয় না; যোগান-চাহিদার টানাপোড়েনের মাধ্যমে অথরাইজড ডিলাররা নিজেরাই তাদের দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য কী  বিনিময় হার হবে তা নির্ণয় করে যার যার শাখাগুলোকে জানিয়ে দেয়।

২০০৩ সালে ফ্লোট করার দু’বছর নাগাদ টাকার বিনিময় হার মোটামুটি স্থির থাকলেও ২০০৫ সালের মাঝামাঝি অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি, ধাপে ধাপে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিজনিত কারণে একদিকে যেমন টাকার মূল্য অন্যদিকে ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ হ্রাস পেতে থাকে। এ অবস্থাকে ডলার ক্রাইসিস নামে অভিহিত করা হয়। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়। একই সঙ্গে ফরোয়ার্ড এক্সচেঞ্জ লেনদেনের উপর বিভিন্ন ধরনের বাঁধা-নিষেধ আরোপ করে। ফলে, কয়েকদিনের ব্যবধানে টাকার মূল্য ডলারে ৬০-৬১ থেকে প্রায় ৭০ টাকায় দাঁড়ায়। এর ফলে আমদানি-রপ্তানি কতটা হ্রাস-বৃদ্ধি হয়েছে বলা না গেলেও, প্রবাসীদের প্রেরিত ফরেন এক্সচেঞ্জের অন্তঃপ্রবাহ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। সে সঙ্গে ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভও বৃদ্ধি পেয়েছে।

টাকা ফ্লোট করা হলেও তার বিনিময় হার সম্পূর্ণভাবে মার্কেট তথা চাহিদা-যোগানের উপর ছেড়ে দেয়া হয়নি। পরোক্ষভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনিটারী পলিসির মাধ্যমে পণ্য ও সেবার চাহিদা তথা ফরেন এক্সচেঞ্জ চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া, বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষ করে সোনালী কিংবা সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকের মাধ্যমে ফরেন এক্সচেঞ্জের চহিদা যোগান হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার প্রয়াস পায়।

আগামী দিনগুলোতে টাকার বিনিময় হার কোন ধারায় প্রবাহিত হবে তা নির্ভর করবে কর্তৃপক্ষের রাজস্ব ও মুদ্রানীতি এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে উত্থিত শক্কীভাবে সামাল দেয়া হবে তার উপর।

১. ব্যালেন্স অব পেমেন্টস্‌ (Balance of Payments)

ব্যালেন্স অব পেমেন্টস্ হচ্ছে একটি দেশের সাথে বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর মধ্যে সংঘটিত আর্থিক লেনদেনের হিসাবরক্ষণ। পণ্য ও সেবা আমদানি–রপ্তানির বিপরীতে পরিশোধিত অর্থ, আর্থিক মূলধন এবং তহবিল স্থানান্তর এই হিসাবের মধ্যে অর্ন্তভুক্ত । ব্যালেন্স অব পেমেন্টস্ হিসাবসমূহ কোন দেশের একটি নির্দিষ্ট সময়ের, সাধারণত: এক বছরের, আন্তর্জাতিক লেনদেনের সারসংক্ষেপ এবং এটি একটি একক মুদ্রায়, সাধারণত সেই দেশের স্থানীয় মুদ্রায় প্রকাশ করা হয়। একটি দেশের তহবিলের উৎসসমূহ, যেমন রপ্তানি আয় বা বৈদেশিক ঋণ এবং বিনিয়োগ ইত্যাদি ধনাত্মক বা উদ্বৃত্ত উপাদান হিসেবে হিসাবভুক্ত হয়। তহবিলের ব্যবহার, যেমন আমদানি ব্যয় বা অন্যদেশে বিনিয়োগ ঋণাত্মক বা ঘাটতি উপাদান হিসেবে হিসাবভুক্ত হয়।

২. ব্যালেন্স অব ট্রেড (Balance of Trade)

যখন কোন দেশ পণ্য আমদানির চেয়ে পণ্য রপ্তানি বেশি করে অর্থাৎ ব্যালেন্স অব ট্রেড যখন উদ্বৃত্ত থাকে। উল্লেখ্য, কোনো দেশের কেবল দৃশ্যমান দ্রব্যসামগ্রীর আমদানি ও রপ্তানি মূল্যের পার্থক্যকে ব্যালেন্স অব ট্রেড বলা হয়।

৩. ওপেন, লং, শর্ট ও স্কয়ার পজিশন (Open, Long, Short and Square Position)

বিভিন্ন কারেন্সি ক্রয়-বিক্রয়ের ফলে বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যাংকের যে নীট অবস্থা সৃষ্টি হয় তাকে এক্সচেঞ্জ পজিশন অথবা ওপেন পজিশন বলে। ডিলাররা বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করে থাকে। এক পর্যায়ে হয়ত দেখা গেল কোনো কারেন্সি যথেষ্ট পরিমাণ বিক্রি করা হয়েছে কিংবা বিক্রি করার জন্য চুক্তি করা হয়েছে এবং একই সময়ে অন্য এক ফরেন কারেন্সি বেশি পরিমাণ কেনা হয়ে গেছে। বিভিন্ন কারেন্সি ক্রয়-বিক্রয়ের অবস্থা অবলোকনের জন্য ব্যাংকে যে বই রাখা তার নাম পজিশন বুক। সময়ের পরিসরে প্রতি স্তরে বিভিন্ন কারেন্সি ক্রয়-বিক্রয়ের যে নীট ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত থাকে তাকে বলে এক্সচেঞ্জ পজিশন। বাংলাদেশে অবশ্য এ পজিশন হিসাব করা হয় দিনের শেষে নীট স্থিতি বিবেচনায় রেখে।

যখন স্থিতিসহ কোনো কারেন্সি ক্রয়ের চেয়ে বিক্রয় বেশি হয় তখন ব্যাংক সে কারেন্সিতে short অথবা oversold অবস্থায় থাকে। আবার যদি স্পট এবং ফরোয়ার্ড ভিত্তিতে মোট বিক্রীত অংকের চেয়ে ক্রীত অংক বেশি থাকে তাহলে ব্যাংক long অথবা overbought অবস্থায় থাকে। ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে সমতা থাকলে তাকে বলে square position। বিনিময় হারের তারতম্যজনিত ঝুঁকি এড়ানোর লক্ষ্যে ব্যাংক সাধারণত square position রক্ষণের জন্য সচেষ্ট থাকে।

৪. ফরোয়ার্ড এক্সচেঞ্জ (Forward Exchange)

ভবিষ্যতের  কোনো নির্দিষ্ট তারিখে অথবা নির্দিষ্ট সময়ের পরিসরে চুক্তিবদ্ধ বিনিময় হারে কোনো ফরেন কারেন্সির বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা অথবা অন্য কোনো ফরেন কারেন্সি ডেলিভারীর শর্তে ব্যাংকের সাথে তার গ্রাহকের অথবা অন্য ব্যাংকের সাথে যে চুক্তি হয় তাকে ফরোয়ার্ড এক্সচেঞ্জ লেনদেন বলে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে ফরোয়ার্ড এক্সচেঞ্জ লেনদেনের অংক, ভ্যালুডেট অর্থাৎ কোন্ তারিখে লেনদেন সংঘটিত হবে এবং তা কোন্ বিনিময় হারে নিষ্পন্ন হবে এ সব বিষয়াদি আগেভাগেই স্থির করা হয়। তবে, নিষ্পত্তির তারিখের পূর্বে টাকা-পয়সার লেনদেন হয় না। এ ব্যবস্থার আওতায় লেনদেন ভবিষ্যতে যে তারিখে সংঘটিত হবে বলে নির্ধারণ করা হয়, সে তারিখে বিনিময় হার যাই থাক না কেন তা চুক্তিবদ্ধ হারেই সম্পন্ন হবে।

যুগ্ম পরিচালক, গভর্নর সচিবালয় | বাংলাদেশ ব্যাংক

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন:১৯৯৯-২০০০

মো: মঞ্জুরুল ইসলাম

প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০