fbpx

দ্য আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ

(১)

অমর একুশে হল ক্যান্টিন। সকাল দশটা।

নাস্তা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিলো রিয়াজ। সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, হাতে অখণ্ড অবসর। পরীক্ষার পরে অনেক আনন্দ করবে ভেবেছিলো ও। কিন্তু, কী করবে ভাবতে ভাবতে দিন চলে যাচ্ছে। নেট সার্ফিং ছাড়া আর কিছুই করা হচ্ছে না।

চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে অভ্যাস বশে মোবাইলটা হাতে নিলো রিয়াজ। Google আইকন টাচ করতেই প্রথমে চোখে পড়লো সংবাদ শিরোনাম ‘ঢাবি-বুয়েট-জাবি ছাড়াই কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত’।

বিস্তারিত পড়ার উৎসাহ পেলো না ও।

এর পরের শিরোনাম ‘সন্তানসহ সুন্দরী গৃহবধূর আত্মহত্যা’। সংবাদটি ছাপা হয়েছে প্রথম আলোতে। এরাও আজকাল ট্যাবলয়েড পত্রিকার রাস্তা ধরেছে, ভাবলো রিয়াজ। গৃহবধূটি ‘সুন্দরী’ ছিলেন, এটা কেন সংবাদ শিরোনাম হলো?

একটু পরে নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই পেয়ে গেল সে। সুন্দরী শব্দটি থাকাতেই ঘটনাটা কী জানতে ইচ্ছে হলো তার। মনোযোগ দিয়ে খবরটা পড়তে শুরু করলো সে:

“তিন বছর বয়সী ছেলেকে সাথে নিয়ে ছুটন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন এক নারী। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটায় কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় এই হৃদয়-বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে – ”

রিয়াজের ক্লাসমেট মালেক এসে ওর মুখোমুখি বসলো। ছেলেটা সাংঘাতিক প্যাঁচালো স্বভাবের। তার নাম ‘মালেক খান’ হলেও বিকৃত করে সবাই বলে ‘মাল একখান’। তবে, রিয়াজের লজিক খুব পরিষ্কার বলে ওকে সহজে ঘাঁটায় না মালেক।

কথা বলতে ইচ্ছে করছে না বলে আরও মনোযোগ দিয়ে ঘটনাটা পড়তে লাগলো রিয়াজ। প্রথম আলো সব তথ্য ঠিকমত দেয়নি বলে অন্যান্য নির্ভরযোগ্য পত্রিকায় এ সংক্রান্ত যা পেলো, পড়ে ফেললো ও।

নিহত গৃহবধূর নাম মিতা হক (৩৩)। তার স্বামী হারুন-অর-রশিদ (৩৮) কাপড়ের ব্যবসায়ী। গতকাল দুপুরে ব্যবসায়িক কাজে তিনি ময়মনসিংহ যান। বিকালে মিতা শিশুপুত্র সায়ানকে নিয়ে ঘুরতে বের হন। আত্মহত্যার মিনিট দশেক আগে তিনি তার বান্ধবী রুনা খন্দকারকে মেসেজ পাঠিয়েছেন, ‘সায়ানকে বাসায় রেখে তোর কাছে যাচ্ছি। জরুরী কথা আছে।’

ঘটনাস্থলের অদূরেই ফলবিক্রেতা লিয়াকত আলির (৫৫) দোকান। লিয়াকত ও তার দোকানের কর্মচারী মারুফ (১৫) ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তারা জানিয়েছেন, মিতা তার ছেলেকে কোলে নিয়ে ফলের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ট্রেন আসার পূর্ব-মুহূর্তে হঠাৎ করে রাস্তা ছেড়ে রেললাইনের উপর শুয়ে পড়েন তিনি। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সন্তানসহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার শরীর।

লিয়াকতের ফোন পেয়ে ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। মিতার হাতব্যাগ ও মোবাইল প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে তারা। এগুলো পরীক্ষা করে তারা নিশ্চিত হয়েছে, কোন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেনি। হাতব্যাগে তিন হাজারের বেশী টাকা পাওয়া গেছে। তাছাড়া, মিতার লাশ ক্ষত-বিক্ষত হলেও ধর্ষণের কোন আলামত পাওয়া যায়নি।

আত্মহত্যা নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ জানতে চেষ্টা করেছে, কে এর জন্য দায়ী। মিতা বা তার স্বামী হারুনের কোন পরকীয়ার কথা জানা যায়নি। তবে, মিতার বান্ধবী রুনা জানিয়েছেন, গত প্রায় এক মাস ধরে ফরহাদ (৩৫) নামের এক বখাটে মিতাকে উত্ত্যক্ত করেছে। মিতার মোবাইল নাম্বার ও ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লোকটা প্রায় প্রতিদিন আপত্তিকর মেসেজ ও ছবি পাঠাতো। একটা নাম্বার ব্লক করলে অন্য নাম্বার থেকে পাঠাতো। দুদিন আগে মিতা তাকে খুব কড়া একটি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে, ‘আপনি যদি আমার সাথে আর কখনও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন, বা আমাকে কোন ধরণের মেসেজ পাঠান, তাহলে আমি পুলিশের সাহায্য নিবো।’

মিতার সতর্কবার্তার পরও গতকাল সকালে ফরহাদ তাকে একটি অশালীন মেসেজ পাঠিয়েছে। পুলিশ লোকটাকে আজ সকালে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে।

রুনার ধারণা, ফরহাদের উৎপাত বন্ধ করার জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতেই ওর বাসায় গতকাল আসতে চেয়েছিলো মিতা। রগচটা স্বামীকে ফরহাদের কথা বলবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলো সে।

স্বামীর সাথে মিতার শেষ যোগাযোগ হয়েছে মৃত্যুর পাঁচ মিনিট আগে। মিতা মেসেজ পাঠিয়েছে, ‘তুমি (ময়মনসিংহ থেকে) কখন ফিরবা?’ হারুন উত্তর দিয়েছে, ‘রাত দশটা বেজে যাবে।’

(২)

মালেকও তার মোবাইলে আত্মহত্যার ঘটনাটি পড়ছিলো। সে হঠাৎ বলে উঠলো, ‘পুলিশের উচিত এই ফরহাদ শয়তানটাকে ভাল মতো শায়েস্তা করা। সব পত্রিকাই বলছে, এর কারণেই মিতা আত্মহত্যা করেছে।’

‘একজন ভদ্রমহিলাকে উত্ত্যক্ত করেছে, সে কারণে ফরহাদের অবশ্যই শাস্তি পাওয়া উচিত। কিন্তু, মিতা আত্মহত্যা করেনি।’

রিয়াজের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেল মালেকের। বললো, ‘পুলিশ বলছে আত্মহত্যা, সব পত্রিকা বলছে আত্মহত্যা – তুই হঠাৎ নতুন কথা বলছিস! ডিটেকটিভ হলি কবে? কোন্ ধরণের ডিটেকটিভ তুই, ঢাকায় বসে কিশোরগঞ্জের ঘটনা তদন্ত করিস –’ হে হে করে হাসতে শুরু করলো মালেক।

‘আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ,’ বললো রিয়াজ। মালেক ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে যোগ করলো, ‘যারা ঘটনাস্থলে না গিয়ে আরামকেদারায় বসে তথ্য বিশ্লেষণ করে রহস্য উদঘাটন করতে চেষ্টা করে, তাদেরকে বলে আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ।’

‘তুই তাহলে একজন আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ? যদিও তুই আর্মচেয়ারে বসে নেই, বসে আছিস হাতলবিহীন চেয়ারে।’ আবার হে হে করে হাসতে শুরু করলো মালেক।

‘চেষ্টা করলে ক্ষতি কী?’ মালেকের হাসিতে পিত্তি জ্বলে গেলেও নিজেকে শান্ত রাখলো রিয়াজ।

‘রহস্যের সমাধান কি করেই ফেলেছিস?’ মালেকের কণ্ঠে ব্যঙ্গ।

‘জটিল কোন রহস্য এখানে নেই। পুলিশ এখনও সমাধান করতে পারেনি, কারণ বখাটে লোকটাকে অ্যারেস্ট করেই এরা খুশি – জনগণকে দেখানোর কাজ শেষ। পত্রিকাগুলো এখনও কিছু বুঝতে পারেনি, কারণ কোন পত্রিকার কাছে সম্পূর্ণ তথ্য নেই। রিপোর্টাররা রিপোর্ট লেখার সময় আমার মতো সব পত্রিকা পড়তে পারেনি।’

‘আত্মহত্যা না হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই খুন,’ বললো মালেক। ‘তাহলে খুনী –’

‘খুনী ফলবিক্রেতা লিয়াকত আর মারুফ। আমার ধারণা, রেললাইনের পাশে দাঁড়ানো মিতাকে হঠাৎ ধাক্কা মেরে তারা ট্রেনের নিচে ফেলে দিয়েছে। যদি আগে অজ্ঞান করার সুযোগ পেতো, তাহলে রেললাইনের উপর হয়তো শুধু মিতাকে ফেলে রাখতো, বাচ্চাটাকে মরতে হতো না।’

‘খুনীদের মোটিভ কী?’ জানতে চাইলো মালেক। ‘মিতার টাকা-পয়সা তো খোয়া যায়নি।’

‘হোয়াই আর ইউ সো শিওর? ব্যাগে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা ছিলো কিনা, কে জানে? হয়তো তারা বেশীর ভাগ টাকা নিয়ে অল্প কিছু রেখে দিয়েছে, যাতে পুলিশ সন্দেহ না করে।’

‘হয়তো হয়তো বলছিস কেন? তুই কি শিওর না?’

‘খুন এরা দুজন করেছে, আমি শিওর। মোটিভ টাকা-পয়সা ছাড়া আর কী হবে?’

‘কিভাবে এত শিওর হচ্ছিস যে, এরা খুনী?’

‘একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, এটা আত্মহত্যা নয়। যেই মেয়ে দশ মিনিট পরে আত্মহত্যা করবে, সে তার বান্ধবীকে নিশ্চয়ই এমন মেসেজ দিবে না: “… তোর বাসায় আসছি। জরুরী কথা আছে।” হয় সে কোন মেসেজই দিবে না, না হয় বলবে, “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়” অথবা বলবে, “আমার মৃত্যুর জন্য অমুক লোক দায়ী।” তাছাড়া, একজন মহিলা কখন শিশু সন্তানসহ আত্মহত্যা করে? যদি তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায় বা পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। স্বামী যদি তেমন হয়, আত্মহত্যার পাঁচ মিনিট আগে কেউ মেসেজ দেয় না, “তুমি কখন আসবে?” যদি ধরে নেয়া হয় মিতা আত্মহত্যা করেনি, তাহলে লিয়াকত আর মারুফ নিশ্চয়ই মিথ্যা বলেছে। তারা দুজন বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে, কীভাবে মিতা আত্মহত্যা করেছে।’

মালেক কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। শেষমেশ বললো, ‘তোর থিওরি নিয়ে তুই থাক।’

(৩)

পরদিন পত্রিকা পড়ে জানা গেল, মিতা লিয়াকতের দোকান থেকে সব সময় ফল কিনতো। লিয়াকতকে সে এক লাখ টাকা ধার দিয়েছিলো ফলের ব্যবসাটা বড় করার জন্য। মিতার ছোট ভাই এ কথা জানতো (স্বামী রাগ করবে বলে তাকে কথাটা বলেনি সে)। টাকাটা ফেরত দেয়ার জন্য তাগাদা দেয়ায় মিতাকে মরতে হয়েছে।

‘আমি তাহলে সত্যিই একজন আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ,’ মনে মনে বললো রিয়াজ।

(শেষ)

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪

জাফর আহমেদ খান

প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪