fbpx

ডিসেম্বর ৫, ২০২৪

কাশ্মীর এক বিতর্কিত উত্তরাধিকার: ১৮৪৬-১৯৯০ (১ম খণ্ড : তৃতীয় অধ্যায়)

জম্মু ও কাশ্মীর এবং বৃটিশ ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা : উত্তর সীমান্ত অঞ্চলের সমস্যা

(পূর্ববর্তী সংখ্যায় প্রকাশের পর)

১৮৯৮ সালে ভারত সরকার একটি সীমান্ত রেখার বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। এ সীমান্ত শুরু হয়েছিলো পাভালো-ভিখোভস্কি চূড়ার পশ্চিম থেকে যেটা ছিলো ১৮৯৫ সালের রুশ-আফগান সীমান্তের সর্বশেষ সীমা এবং এর বিষয়ে বৃটিশ ও রুশ সরকার উভয়েই একমত ছিলো। এটা পরে তাঘদুম্বাশ পামিরকে দক্ষিণ-পূর্বে আড়াআড়িভাবে ভাগ করে ফেলে কারাচুকুর-এর (এ জলধারা তাশকুরঘান নদীতে গিয়ে পড়েছে এবং সেখান থেকে জিনঝিয়াং-এর তারিম বেসিন-এ পড়েছে) উজানভাগ অতিক্রম করে মিনটাকা পর্বতের ঠিক পশ্চিমে মূল কারাকোরাম জলবিভাজিকার সাথে যুক্ত হয়েছে। এটা মুল জলবিভাজিকা বরাবর পূর্বদিক দিয়ে শিমশাল পাস পর্যন্ত গিয়েছে যেখান থেকে এটি জলবিভাজিকার উত্তরে ঘুরে গিয়ে শিমশাল পাসের পূর্বদিকে দরওয়াজায় মূল আশ্রয়কেন্দ্রের কাছে কয়েক বর্গমাইল এলাকা ঘিরে ফেলেছে (তবে এক্ষেত্রে কৌশলগতভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু দুর্গম আজঘর সহ রাসকাম নদীর তীরবর্তী এলাকা বাইরে থেকে যায়।); এখান থেকে এটি আবার জলবিভাজিকা বরাবর ফিরে এসেছে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কারাকোরাম পাসের দিকে এগিয়ে গিয়ে এটি একটি রেখা বরাবর তিব্বত মালভূমির পশ্চিমাঞ্চলীয় কর্ণারকে অতিক্রম করেছে। আকসাই চিন ও লিংঝিটাং বেসিন-এর মধ্য দিয়ে লানাক পাসের পার্শ্ববর্তী লাদাখ-তিব্বত সীমান্ত পর্যন্ত না পৌঁছা অবধি এটি লকঝুং রেঞ্জ পর্যন্ত চলে গিয়েছে।

এই সরলরৈখিক ব্যবস্থা অনেকটা বাধ্য হয়েই মূল কারাকোরাম শৃঙ্গের উত্তরে একেবারে পশ্চিম পর্যন্ত গিয়েছে যেখানে এটি তাঘদুম্বাশ পামির-এর একটি অংশ অতিক্রম করেছে; এটি ছিলো ১৮৯৫ এর রুশ-আফগান সীমান্তের পূর্বাঞ্চলীয় সর্বশেষ সীমানার সাথে যোগসূত্র স্থাপনের সবচেয়ে সহজ পন্থা। এখান থেকে দরওয়াজার এদিক-ওদিকের সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া কারাকোরাম পাস না আসা পর্যন্ত এটি জলধারা বরাবর গিয়েছে। তবে যারা ১৮৯৮ এর প্রস্তবনা লিখেন তারা ঐ পাসের পূর্ব দিকের অবস্থা নিয়ে বিপাকে পড়ে যান। ভৌগলিক জ্ঞানে সে সময় কোন সাধারণ জলধারা বা চূড়ার অবস্থান ছিলো না; এমন কি উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত কোথাও গিয়ে শেষ হওয়া বাকি ছিলো। লিংঝিটাং ও আকসাই চিনের মধ্যবর্তী লকঝুং রেঞ্জকে বাছাই করে একটা নকশা নেয়া হয়েছিলো কিন্তু সেটা ছিলো কিছু সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে; এবং এটা কোন ধরনের ঐতিহাসিক দাবি বা প্রশাসনিক নজির এর বাইরে শুধুমাত্র যুক্তির উপর ভিত্তি করে গ্রহণ করা হয়েছিলো।

এই সীমান্ত প্রস্তাবনার বিষয়ে পিকিং-এ চাইনিজ সরকারের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিলো। বৃটিশ মন্ত্রী স্যার ক্লড ম্যাকডোনাল্ড ১৮৯৯ সালের ১৪ মার্চ পিকিং-কে দেয়া এক পত্রে লিখেন যে,

কানজুট… [হুনজা]… রাজ্যের সাথে চীনের সীমানা পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত নয় বলে মনে হয়… ভবিষ্যতের যে কোন বিতর্ক বা অনিশ্চয়তা এড়াতে এক্ষেত্রে ভারত সরকারের প্রস্তাব হচ্ছে সীমান্তবর্তী দুইটি রাজ্য ও চীনের সাথে একটি পরিষ্কার বোঝাপড়ায় আসা উচিত। পরিষ্কার বোঝাপড়ার জন্য চীনের উচিত কানজুট রাজ্যের উপর থেকে তার ছত্রচ্ছায়ার প্রভাব তুলে নেয়া। তার পরিবর্তে ভারত সরকার, কানজুটের পক্ষ থেকে তাঘদুম্বাশ ও রাসকাম জেলার অধিকাংশ অঞ্চলের দাবি প্রত্যাহার করবে।৪৭

সুঙলি ইয়ামেন (সে সময়ের চায়না পররাষ্ট্র দপ্তর) আনুষ্ঠানিকভাবে এ পত্রের কোন জবাব দেয়নি। এ থেকে মনে হয় যে, পত্রের বিষয় নিয়ে কাশগড়-এর রাজ্য কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিলো; কিন্তু কাশগড় বা পিকিং কেউ-ই এর শর্ত নিয়ে অস্বীকৃত ছিলো না।

১৮৯৯ এর শর্ত থাকা সত্ত্বেও এটা লক্ষ্যণীয় যে, রাসকামে চাষাবাদের বিষয়ে মির-কে বৃটিশরা কুটনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলো; চাইনিজরা বৃটিশদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়া পর্যন্ত এটা ছিলো বৃটিশদের একটা চাপ প্রয়োগের কৌশল।বিভিন্ন সময়ে পেত্রভস্কি’র দেয়া হুমকি বাস্তবায়ন করতে ১৯০১ এর ফেব্রুয়ারিতে রুশরা তাশকুরঘানে একটি সামরিক স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করে যেখানে একজন রুশ কর্মকর্তা, কাশঘরের রুশ কনস্যুলার গার্ড থেকে ৪ জন কোজাক এবং স্থানীয়ভাবে ৪ জন সৈন্য নিয়োগ দেয়া হয়। ভারত সরকার এটাকে রাসকাম সমস্যার অংশ হিসেবেই দেখছিলো, আর রুশরা মির-এর দাবির প্রতি বৃটিশ সমর্থনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলো।প্রকৃতপক্ষে এটা ছিলো ১৯০০ এর শেষের দিকে কাশঘরে রুশ-বিরোধী দাঙ্গার ফল; এ দাঙ্গার কারণে পেত্রভস্কি কাশঘর কনস্যুলেট ও রুশ ভূভাগের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরাপদ রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন।

মধ্য এশিয়ার বিষয়ে গভীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন লর্ড কার্জনের অধীনে ভারত সরকারের তখন আর কোন সন্দেহ রইলো না যে, তাশকুরঘান চৌকি স্থাপনের উদ্দেশ্যই ছিলো বৃটিশদের প্রতি রুশদের একটি সতর্ক বার্তা যেন কারাকোরাম চূড়ার উত্তরে মির-এর অধিকারকে নস্যাৎ করা না হয়।স্বাভাবিক ভাবে রুশদের ছাড় দিতে অনিচ্ছুক হলেও (যেটা তিব্বতে জার-এর ষড়যন্ত্রের বলিষ্ঠ উত্তর থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় এবং এর ফল ছিলো ১৯০৪ এ লাসাতে ইয়াংহাজবেন্ডের বিশেষ অভিযান) কার্জন চূড়ান্তভাবে কারাকোরামের চাইনিজ অংশের দিকে অগ্রসর হয়ে তেমন কিছু প্রাপ্তি হবে না বলে লর্ড অ্যালগিনের মতকেই গ্রহণ করেন।সহজাত প্রাথমিক রুশ-বিরোধী প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও ১৯০৪ নাগাদ তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, রাসকামে হুনজার দাবির সমর্থনে বৃটিশ কুটনৈতিক শক্তিক্ষয়ে প্রাপ্তি সামান্য।যেহেতু তাশকুরঘানে রুশ সামারিক চৌকি রয়েছে কাজেই বৃটিশদের এদের পাশাপাশি অবস্থানই মানিয়ে নিতে হবে।

বৃটিশদের করণীয় বিষয়ে কার্জন যেটা উপলব্ধি করলেন সেটা হচ্ছে হুনজা’র মির এবং চাইনিজদের সাথে সমস্ত সম্পর্কের সমাপ্তি টানা প্রয়োজন, এমন কি রাসকাম চাষাবাদ প্রক্রিয়া এবং তাঘদুম্বাশ পামির ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের অধিকার বা স্বার্থের বিষয়েও ছাড় দেয়া যায়। আর এ ক্ষতির জন্য মির ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে পারেন, কার্জনের মতে বছরে ৩,০০০ রুপি যথেষ্ট। চূড়ান্তভাবে:

আমরা এ মর্মে সুপারিশ করছি যে, চীনকে একটি আনুষ্ঠানিক নোটিশ প্রদান করা প্রয়োজন যে, চীন সরকার হুনজার মির-এর প্রতি [রাসকাম চাষাবাদ বিষয়ক…] তাদের প্রদানকৃত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারায়… বৃটিশ সরকারের পরামর্শাধীন রাজ্য চীনের সাথে সকল সম্পর্ক প্রত্যাহার করছে, ‍এবং এরপর থেকে রাজ্য শুধুমাত্র কাশ্মীর রাজ্য ও বৃটিশ সরকারের একক আধিপত্যের অধীন থাকবে। কাশ্মীর ও নতুন এলাকার সীমানার বিষয়ে আমাদের বলিষ্ঠ মতামত যেটা চীনের জানা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে ১৪ মার্চ ১৮৯৯ তারিখে স্যার ক্লড ম্যাকডোনাল্ড-এর উপস্থাপিত প্রতিবেদনের বিষয়ে যেহেতু তাঁদের কোন দ্বিমত পোষণ সংক্রান্ত বিষয় উত্থাপিত হয়নি, কাজেই আমরা এখন থেকে এটা বিবেচনা করবো যে, এ বিষয়ে চীন একমত এবং এ অনুযায়ী ব্যবস্থা গৃহীত হবে।৪৮

এটা যদি বাস্তবায়ন হতো তবে বৃটিশদের জন্য উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তে একটি সীমারেখা অর্জন করা খুবই সম্ভব ছিলো যার বিষয়ে চীনের সুস্পষ্ট অনুমোদন থাকতো; এবং সেক্ষেত্রে সম্ভবতঃ স্বাধীন ভারত প্রায় অর্ধশতক পর গণচীনের সাথে সর্বনাশা সংঘর্ষ পরিহার করতে পারতো।

আরো কিছু দিক বিবেচনায় লর্ড কার্জন ১৮৯৯ এর সীমান্ত নোটে দুইটি বিষয়ে বৃটিশদের বাস্তব আপত্তি রয়েছে বলে সিদ্ধান্তে আসেন। এক. প্রস্তাবিত রেখাটি ছিলো পাভালো-ভিখোভস্কি চূড়া থেকে; এবং এটা করার মাধ্যমে ১৮৯৫ সালের ইংরেজ-রুশ পামির চুক্তির একটি মূলনীতি ভঙ্গ করা হয়েছিলো যেখানে বলা ছিলো যে, বৃটিশ ও রুশ রাজ্যের মধ্যে আফগান ওয়াখান ও চাইনিজ তাঘদুম্বাশ পামিরকে নিয়ে একটি টুকরো ভূ-খন্ড সৃষ্টির প্রয়োজন হবে। ১৮৯৫ সালে মনে করা হয়েছিলো যে, দুটা রাজ্যের মিলিত হওয়া উচিত নয়। অথচ ১৮৯৯ সালের সীমারেখার প্রস্তাবে তাই করা হয়েছিলো। দুই. রাসকামে শিমসাল পাসের জিনঝিয়াং দিকে হুনজার পরপরই দারওয়াজার পাশে যে এলাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো তা বস্তুতঃ হুনজার জনগণের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই ছোট ছিলো।

১৯০৫ সালের আগস্টে লর্ড কার্জন নিজেই এ সমস্যাগুলো তুলে ধরেন।৪৯ তিনি প্রস্তাব করেন যে, জলধারার চাইনিজ অংশে হুনজা অঞ্চলের মিরের উচিত শিমসাল পাস দিয়ে আরো কয়েক বর্গমাইল এলাকা বৃদ্ধি করা, আর এটা করতে দারওয়াজা থেকে আপরাং ও সঙ্গম (বা মুজতাঘ) নদীর মিলনস্থল পর্যন্ত পূর্বদিকে সীমানা ঠেলে দেয়া। এরপরও আজঘরের মূল রাসকাম পর্বত, কোকতাশ ও বাশ আন্দিজান হুনজা অঞ্চলের বাইরে থাকবে। তিনি পাভালো-ভিখোভস্কি চূড়া থেকে যে বিন্দুতে মূল কারাকোরাম জলরাশি আফগান সীমান্তে মিলিত হয়েছে সে পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তরেখা ফিরিয়ে আনতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন।এর ফলে বৃটিশ উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তরেখা এবং রুশ-আফগান সীমান্তের মধ্যে ওয়াখান পর্বতের উত্তরাঞ্চল দিয়ে একটি ছোট্ট প্রলম্বিত চীন-আফগান সীমানা সৃষ্টি হতো যেটা ১৮৯৫ এর পামির চুক্তির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিলো।৫০

(চলবে)         

৪৭. এই নোটের বক্তব্য A. Lamb, The China-India Border: The Origins of the Disputed Boundaries, London 1964, Appendix II এ পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে।
১৮৯৯ সালের নোটের শর্ত ১৮৯০ সালের সিকিম-তিব্বত সমঝোতা চুক্তির শর্তের কথা মনে করিয়ে দেয়। সিকিম একটি ছোট্ট দেশ যার উপর চীন (তিব্বতের মাধ্যমে) প্রভাব বিস্তার করছিলো যা এক সময় তিব্বতের উপর অধিকার দাবির পর্যায়ে উপনীত হয়। সিকিমকে ভেঙ্গে ফেলা ও চীনের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সীমারেখা দিয়ে এর মীমাংসা হয়েছিলো যেটা তখন বৃটিশের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণাধীন হিসেবে পরিচিত ছিলো; এ সীমারেখা ছিলো তিব্বতের চুমবি উপত্যকা থেকে যেখানে বৃটিশদের শর্তাধীন নিয়ন্ত্রণ ছিলো (১৮৯৩ এর বাণিজ্য বিধি মোতাবেক যেটা ১৮৯০ এর সমঝোতা চুক্তি থেকে এসেছিলো) যেটা তিব্বতের উপর চীনের আধিপত্য পরিবর্তন করতে পারেনি। জর্জ ম্যাকার্টনি, যার দৃষ্টিভঙ্গি ১৮৯৯ এর নোটে বিষদভাবে উপস্থাপিত হয়েছিলো, ১৮৯০ এর সমঝোতা চুক্তির প্রাথমিক পর্যায়ের দর কষকষিতে ব্যাখ্যাদানকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন; এবং তিনি সন্দেহাতীত ভাবে হুনজা পরিস্থিতির পাশাপাশি সিকিমের অবস্থাও উপলব্ধি করছিলেন।

৪৮. Lamb, Ladakh, op. cit., p. 61 থেকে উদ্ধৃত।
৪৯. Lamb, Ladakh, op. cit., p. 62 দ্রষ্টব্য।
৫০. চীন-আফগান সীমান্তের এই প্রলম্বিত অংশের বিষয়ে গণচীন ও আফগানিস্তান ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর একমত হয়। Prescott, Mainland Asia, op. cit., pp. 238-240 দ্রষ্টব্য।
Rokonuzzaman
ব্যবস্থাপক | 

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন:১৯৯৯-২০০০