fbpx

ডিসেম্বর ৫, ২০২৪

বাংলা কবিতার ছন্দ

আজকাল অনেকেই বাংলা কবিতার ‘ছন্দ’ বলতে বোঝেন দুটি লাইনের শেষ শব্দ দুটির মিলকে। যেমন, ‘মালা’র সাথে ‘জ্বালা’, ‘বৃষ্টি’র সাথে ‘দৃষ্টি’ – এ রকম মিল (যাকে বলা হয় ‘অন্ত্যমিল’) থাকলেই ছন্দের কবিতা হয়েছে বলে এরা মনে করেন। কিন্তু, ছন্দ বলতে এই অন্ত্যমিলকে বোঝায় না, প্রত্যেক লাইনের প্রত্যেক অংশের তালটাই হচ্ছে ছন্দ। আমার এ লেখাটি কবিতার ছন্দ বা তাল নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। বিস্তারিত জানতে চাইলে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা ‘কবিতার ক্লাস’ বইটির সাহায্য নেয়া যেতে পারে, আমি নিজে যে বইটি পড়ে ছন্দ শিখেছি।

গদ্য-কবিদের কেউ কেউ মনে করেন, ছন্দ শেখার প্রয়োজন নেই। এটা ভুল ধারণা। ছন্দের জ্ঞান থাকলে গদ্য-কবিতা লেখার সময়ও সেরা বিন্যাসে সেরা শব্দগুলি বসানো যায়।

পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের ‘কবর’ কবিতার প্রথম দু’লাইন দিয়ে আলোচনা শুরু করছি:

এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

যদিও এটা ছড়া নয়, তারপরও ছন্দ বোঝার প্রয়োজনে একটু তালের সাথে উপরের লাইন দুটি পড়ুন। দেখবেন, আপনি মনের অজান্তেই লাইন দুটিকে ভাগ করেছেন এভাবে:

এইখানে তোর/ দাদীর কবর/ ডালিম গাছের/ তলে,
তিরিশ বছর/ ভিজায়ে রেখেছি/ দুই নয়নের/ জলে।

প্রত্যেক ভাগ বা অংশকে বলা হয় পর্ব। ‘কবর’ কবিতার প্রত্যেক লাইনে তিনটি পর্ব ও একটি ‘ভাঙা পর্ব’ আছে। লক্ষ্য করুন, প্রত্যেক পর্বে ছয়টি অক্ষর এবং ভাঙা পর্বে দুটি অক্ষর রয়েছে। কবিদের ভাষায়, এই কবিতায় প্রত্যেক পর্বে ছয় ‘মাত্রা’। এটা মনে করা ঠিক হবে না যে, জসীম উদ্‌দীন মাত্রা গুনে গুনে কবিতা লিখেছেন। বড় কবিদের তালজ্ঞান সহজাত। ব্যাকরণ হলো আমাদের মতো আমজনতার জন্য।

অক্ষর ও মাত্রা পুরোপুরি সমার্থক নয়। যুক্তাক্ষর থাকলে তাকে ভেঙে মাত্রা গণনা করতে হবে। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতার প্রথম দু’লাইন পড়ে দেখুন:

ভূতের মতন/ চেহারা যেমন/ নির্বোধ অতি/ ঘোর,
যা কিছু হারায়/ গিন্নী বলেন/ কেষ্টা ব্যাটাই/ চোর।

এই কবিতায়ও প্রত্যেক পর্বে ছয় মাত্রা। প্রথম লাইনের ‘নির্বোধ অতি’কে আমরা পড়ি ‘নির্‌-বোধ অতি’। তেমনি দ্বিতীয় লাইনে ‘গিন্‌-নী বলেন’ বা ‘কেষ্‌-টা ব্যাটাই’ পড়তে ছয় মাত্রাই দরকার হচ্ছে।

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল। শব্দের প্রথমে যুক্তাক্ষর থাকলে সেটাকে ভাঙা যায় না, তাই সেটা এক মাত্রাই পায়। নিচের দু’লাইন পড়ে দেখুন:

ক্রয়ের চাইতে/ বিক্রয়ে বেশি/ টাকা,
তবু ধীরে ধীরে/ হচ্ছে পকেট/ ফাঁকা।

এখানে ‘ক্রয়ের চাইতে’ পর্বটিতে ‘ক্র’ যুক্তাক্ষর হলেও শব্দের প্রথমে হওয়ায় একে ভাঙা যাচ্ছে না। তাই এখানে ‘ক্র’ এক মাত্রা পাচ্ছে। কিন্তু, ‘বিক্রয়ে বেশি’ পর্বে ‘ক্র’ দুই মাত্রা পাচ্ছে, কারণ আমরা পড়ছি ‘বিক্‌-রয়ে বেশি’।

যুক্তাক্ষর না হলেও ‘ঐ’ (উচ্চারণ ‘ওই’) বা ঐ-কারযুক্ত অক্ষর সাধারণত দুই মাত্রা পায়। ‘ঔ’ বা ঔ-কারযুক্ত অক্ষরের বেলায়ও তাই। যেমন:

খালের ওপারে/ ঐ জামরুল/ গাছে,
মৌটুসি এক/ চুপচাপ বসে/ আছে।

এখানে ‘ঐ জামরুল’ পর্বে ‘ঐ’ দুই মাত্রা পাওয়ায় পর্বটির মোট মাত্রা ছয়। তেমনি, ‘মৌটুসি এক’ পড়তে গিয়ে আমরা ‘মউটুসি এক’ পড়ি বলে এখানেও ‘মৌ’ দুই মাত্রা পাচ্ছে। ‘মৌটুসি’র বদলে যদি ‘চড়ুই’ লেখা হতো, তাহলে ছন্দ বা তাল ঠিক রাখতে লিখতে হতো ‘চড়ুই একটি’।

সংক্ষেপে বলা যায়, শব্দের বানানের বদলে উচ্চারণের উপর ভিত্তি করে মাত্রা নির্ধারিত হয় এবং একটি লাইনের প্রত্যেক পর্বে সমান সংখ্যক মাত্রা থাকে।

উপরের সব কয়টি উদাহরণে প্রত্যেক পর্বে ছয়টি করে মাত্রা রয়েছে। এই সংখ্যাটি ছয় না হয়ে চার, পাঁচ বা সাতও হতে পারে। ‘ছন্দের যাদুকর’ বলে পরিচিত সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘দূরের পাল্লা’ ছড়াটির প্রথম দু’লাইন পড়ে দেখুন:

ছিপখান/ তিন-দাঁড়,/ তিনজন/ মাল্লা,
চৌপর/ দিন-ভোর/ দ্যায় দূর/ পাল্লা।

এই ছড়াটির প্রতি পর্বে চার মাত্রা। ভাঙা পর্ব (‘মাল্লা’ আর ‘পাল্লা’) তিন মাত্রার। এবার পাঁচ মাত্রা  ব্যবহার করে দু’লাইন লেখা যাক:

চলার পথে/ তোমার পেলে/ দেখা
ভিড়ের মাঝে/ হঠাৎ লাগে/ একা।

এবার সাত মাত্রার একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করা যাক:

বেতন নেমে গেছে/ অর্ধেকে,
শান্তি পালিয়েছে/ ঘর থেকে,
মাসের শুরুতেই/ ধার-দেনা –
ক্লান্ত মন আর/ পারছে না।

এই কবিতার প্রতি লাইনে একটি পর্ব ও একটি ভাঙা পর্ব। পর্বটি সাত মাত্রার এবং ভাঙা পর্বটি চার মাত্রার।

এ পর্যন্ত যে ধরণের ছন্দ নিয়ে আলোচনা হয়েছে, একে বলে ‘মাত্রাবৃত্ত’ ছন্দ, কারণ প্রতিটি পর্বে নির্দিষ্ট সংখ্যক মাত্রা থাকে। আমরা দেখেছি, মাত্রার সংখ্যা ৪, ৫, ৬ বা ৭ হতে পারে। বাংলা কবিতার ছন্দ আরও দু ধরণের হতে পারে: ‘অক্ষরবৃত্ত’ আর ‘স্বরবৃত্ত’।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দে প্রতি পর্বে সমান সংখ্যক অক্ষর থাকে (সাধারণ অক্ষর বা যুক্তাক্ষর যাই হোক না কেন)। কবিতা পড়ার সময় যুক্তাক্ষর ও সাধারণ অক্ষর সমান গুরুত্ব পায়। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর দুটি লাইন এখানে উল্লেখ্য:

ওই শোনো সাড়ম্বরে / প্রচন্ড দাপটে
মহোল্লাসে লক্ষ লক্ষ / ঢোল বেজে যায়।

প্রত্যেক লাইনে আট অক্ষরের পর্ব ও ছয় অক্ষরের ভাঙা পর্ব। পুরানো দিনের অধিকাংশ পদ্য অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। এ ধরণের কবিতার একটি চরণে কত বেশি সংখ্যক যুক্তাক্ষর ব্যবহার করা যায়, সেটা দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:

দুর্দান্ত পান্ডিত্যপূর্ণ / দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত।

এখানে উল্লেখ্য যে, ‘দুঃ’ কে এক অক্ষর (ও এক মাত্রা) ধরা হয়।

‘স্বরবৃত্ত’ ছন্দ বুঝতে হলে প্রথমে বুঝে নিতে হবে ‘সিলেবল’। শব্দের সবচেয়ে ছোট যে অংশ একবারে উচ্চারিত হয়, তাকে বলে সিলেবল। ‘কারসাজি’ শব্দটিতে তিনটি সিলেবল – কার,  সা আর জি। এদের মধ্যে ‘কার’ সিলেবলের উচ্চারণ ‘কার্‌’ হওয়াতে (অর্থাৎ, উচ্চারণ হসন্ত দিয়ে শেষ হওয়াতে) এটা ‘ক্লোজড’ সিলেবল। বাকি দুটি সিলেব্‌লের উচ্চারণ হসন্ত দিয়ে শেষ হয়নি বলে এগুলো ‘ওপেন’ সিলেবল।

স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রত্যেক পর্বে চারটি সিলেবল থাকে। তবে, তিনটি ক্লোজড সিলেবল থাকলে চতুর্থ সিলেবলটি (ক্লোজড বা ওপেন যাই হোক) আর খাটানো যায় না। যেমন, আমার ছেলেকে (ওর নাম ‘তুল্য’) নিয়ে লেখা নিচের ছড়াটি পড়ে দেখুন:

দিনটি শুরু/ তিনটি পাখির/ ডাকে,
পলাশ ফুলের/ গন্ধ এলো/ নাকে,
তিন-চার বার/ ডাকলো এসে/ মা –
তুল্য তবু/ চোখটি খোলে/ না।

ছড়াটির প্রত্যেক পর্বে চারটি সিলেবল। শুধুমাত্র ‘তিন-চার বার’ পর্বে তিনটি ক্লোজড সিলেবল থাকায় চতুর্থ সিলেবল ছাড়াই অন্য পর্বগুলির সমতুল্য হয়েছে।

সংক্ষেপে বাংলা কবিতার তিন ধরণের ছন্দ আলোচনা করা হলো। এখন দুটি মজার বিষয় উল্লেখ করতে চাই। প্রথমটি হলো, কখনও কখনও কবিতার মান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কবি (সচেতনভাবে) ছন্দের নিয়ম ভাঙেন। যেমন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছড়া থেকে নিচের দু’লাইন পড়ে দেখুন:

টুকটুক/ তুলতুল/ গা ভেজা/ শিশিরে,
বুলবুল/ মশগুল/ কার গান/ গাহি রে।

ছড়াটি চার মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা হলেও ‘গা ভেজা’ পর্বটিতে তিন মাত্রা। কিন্তু, ‘গা’ শব্দটি একটু টেনে পড়লে মাত্রা চার হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, একটু যাচাই করে দেখুন, গা শব্দটি টেনে পড়লে ছড়াটির মান বেড়ে যায়। তবে, নতুন ছড়াকার বা কবিদের ছন্দের নিয়ম ভাঙার চেষ্টা না করাই ভাল।

এবার সম্পূর্ণ উল্টো কথা। কখনও কখনও নিয়ম মানাটাই যথেষ্ট নয়। এটা আমি শিখেছি কবি আল মুজাহিদীর কাছ থেকে। কীভাবে শিখেছি সেটাও পাঠকের সাথে শেয়ার করতে চাই।

‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার ‘কচি কাঁচার আসর’ এর সম্পাদক রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) যখন ইন্তেকাল করলেন (১৯৯৯ সালে), আমি তখন তার লেখা ‘বাক বাকুম পায়রা’ ছড়ার উপর ভিত্তি করে ‘কে পরাবে টায়রা’ নামের একটি ছড়া লিখলাম। পুরো ছড়াটি এখানে তুলে দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না:

বাক বাকুম পায়রা
কালকে নাকি       বউ সাজবে
কে পরাবে টায়রা?
তাকাই বামে ডাইনে,
সেই পাকা চুল      লোকটাকে তো
কোথাও দেখতে পাইনে!
খুঁজি সারা বঙ্গে,
দাদাভাই কি    হারিয়ে গেছেন
হিমেল হাওয়ার সঙ্গে?
হঠাৎ ভাবি, তাইতো!
নিজের ঘরেই    রেখে তাকে
খোঁজার মানে নাইতো!
ছড়া, গানের ছন্দে
আছেন তিনি     সবার মাঝে
সকল ভাল মন্দে।

ছড়াটি স্বরবৃত্ত ছন্দের, অর্থাৎ, প্রত্যেক পর্বে চারটি করে সিলেবল‌। ব্যতিক্রম শুধু এক জায়গায়। ‘বাক বাকুম’ পর্বটিতে তিনটি সিলেবল‌, তবে দাদাভাইয়ের মূল ছড়ার মত ‘বাক’ শব্দটি টেনে ‘বাআক’ এর মত করে পড়া হয় বলে ছন্দ ঠিক থাকে।

ছড়াটি ইত্তেফাক অফিসে নিয়ে গেলাম ‘কচি কাঁচার আসর’এ ছাপানোর উদ্দেশ্যে। দাদাভাইয়ের মৃত্যুর পর আল মুজাহিদী এ বিভাগটির হাল ধরেছেন। আমার সৌভাগ্য, তিনি অফিসে ছিলেন এবং তার হাতেই ছড়াটি দিতে পারলাম।

আল মুজাহিদী মনোযোগ দিয়ে ছড়াটি পড়লেন। আমার দিকে তাকিয়ে ছড়াটির ছয় নম্বর লাইনটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘এখানে একটু দেখুন তো। গ্রামার ঠিক আছে, কিন্তু একটু কানে লাগছে।’ আমি ছড়াটি হাতে নিলাম, ৫ম ও ৬ষ্ঠ লাইন দুটি বার বার পড়ে বুঝতে পারলাম তিনি কী বলেছেন। তারপর ৬ষ্ঠ লাইনের দুটো শব্দের জায়গা বদল করলাম। ‘কোথাও দেখতে পাইনে’ হয়ে গেল ‘দেখতে কোথাও পাইনে’।

আল মুজাহিদী খুশি হয়ে বললেন, ‘এবার ঠিক আছে। ছড়াটি ছাপা হবে।’ কাগজটিতে ডাবল টিক চিহ্ন দিয়ে স্বাক্ষর করে তিনি তার সহকারীকে দিলেন।

ছড়াটি প্রকাশিত হওয়ায় আমি যতটা খুশি হয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম ছন্দের ব্যাকরণের চেয়ে বেশি কিছু জানতে পেরে।

(শেষ)

IMG 6678

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪