জুলাই 12, 2025

অনলাইনে প্যাপাইরাসের ১ম বর্ষপূর্তি: প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি কতটুকু?

এই লেখাটি যে পত্রিকার পাঠকদের উদ্দেশ্যে লিখছি সেটা একটা সাহিত্য পত্রিকা এবং পত্রিকাটির নাম “প্যাপাইরাস”। পত্রিকাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিমাসে অনলাইনে প্রকাশ পায়। ঘটনাচক্রে আমি এই বিভাগে দীর্ঘ একটা সময় অতিবাহিত করায় কীভাবে কীভাবে যেন এই পত্রিকার সম্পাদনা পর্ষদে স্থান পেয়েছি। যেহেতু ওয়েবসাইট একটা উন্মুক্ত জায়গা, তাই এই পত্রিকাটিও একটা উন্মুক্ত পত্রিকা। অর্থাৎ যে কোনো ব্যক্তিই তার সাহিত্যকর্মের প্রসব এখানে ঘটাতে পারেন এবং সেগুলোর একধরনের ডকুমেন্টেশন রাখতে পারেন। আমার নিজের কাছে মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিমণ্ডলে ক্রমাগত চাপে থাকা মানুষজনের জন্য কিছুটা ভালো অনুভব করার খুবই প্রোডাক্টিভ একটা উপায় হলো মুক্ত সাহিত্যচর্চা। সাহিত্য তৈরি করে হোক কিংবা তা পড়ে তার থেকে রস আস্বাদন করে হোক – যেকোনো উপায়েই আনন্দ পাওয়া যায়। তাছাড়া কিছুটা আলোকিত হবারও সুযোগ থাকে ভালো সাহিত্যের সংস্পর্শে আসতে পারলে। তাই সাহিত্য চর্চা এবং এর ঘষামাজা করে কিছু লেখক এবং আলোকিত মানুষ তৈরি হবে – এই উদ্দেশ্যেই এই সাহিত্য পত্রিকার পথচলা।

একটা বিশেষ কারণে লেখাটি লিখতে বসা। এর কারণ হলো, অনলাইন দুনিয়ায় এই পত্রিকার এক বছর পূর্ণ হয়েছে এই এপ্রিল সংখ্যার মাধ্যমে। ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল বহু কাঠখড় পুড়িয়ে পত্রিকাটি অনলাইনে আলোর মুখ দেখে। তাই এই দীর্ঘ এক বছরে প্রতিমাসে নিয়মিতভিত্তিতে বারোটা সংখ্যা বের করার পর আসলেই পত্রিকাটিতে এখন কয়টা বাজছে সেটাই লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পৃথিবী নামের এই গ্রহে নভেল করোনাভাইরাস যেভাবে বারোটা বাজাচ্ছে তাতে বিশেষ কিছু লিখবার মনোযোগ দুষ্কর হয়ে উঠছে। তারপরেও সবাইকে এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।

প্যাপাইরাস পত্রিকা অনলাইনে আসার পূর্বে দীর্ঘদিন শর্টটার্ম-লংটার্ম বিরতি দিয়ে কাগজ বাঁধাই করে প্রেস হতে বের হতো। বিভিন্ন জায়গায় বিলি করা শেষে একটা অংশ বেঁচে গেলে পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত কারো কাছে অথবা বিভাগের অফিসে রাখা হতো। শেষবার আমার কাছে রাখা হয়েছিল এক বাক্স বেঁচে যাওয়া পত্রিকা। সেটা অক্ষতই ছিল বছর তিনেক, কিন্তু দেখতে দেখতে একটা সময় মনে হলো বিভাগে আমার ছুটির সময় চলে আসছে। তাই একটা লংটার্ম বিরতির পর আমি বিভাগের শিক্ষক – জাফর স্যারের (যিনি এই পত্রিকার প্রধান সম্পাদকও) সাথে দেখা করতে গেলাম – এই উদ্দেশ্যে যে বিভাগে আমার সময় যখন শেষ হয়েই আসছে, তখন এইসব কাগজ ভরা বাক্স-পেটরা নিয়ে আমি আর কোথায় যাবো! সেগুলোর একটা দফারফা করা দরকার। জাফর স্যারের কাছে গিয়ে বলার পর স্যার বললেন, কাগজ বেঁচে বাদাম খাওয়া ছাড়া বিশেষ আর কী উপায় আছে!? প্রস্তাব দিলাম, বিভাগের নতুন শিক্ষার্থীদেরকে ম্যাগাজিনগুলো দিয়ে দেয়া যায়। স্যার রাজি হলেন। বললেন বিলি করার ব্যবস্থা করতে। এমন সময় স্যার বললেন, “ম্যাগাজিনটা বন্ধ হয়ে গিয়ে একটা মনঃকষ্টের ব্যাপার হয়েই দাঁড়িয়েছে! লেখালেখি বন্ধ হয়ে আছে। আর বের করা যায় না ম্যাগাজিনটা!? আজকাল তো কতকিছুই চালাও তোমরা ইন্টারনেটে-অনলাইনে!” সেই মনঃকষ্ট আমার মধ্যেও কম ছিল না! অনলাইন ম্যাগাজিন বের করার একটা চেষ্টাচরিত করা যায় বলে সেদিন চলে এলাম। জাফর স্যারের সাথে আমার নিয়মিত বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগ হয় দেখে ব্যাপারটা নিয়ে কয়েকদিন পরেই আরেক দফা কথা হলো। এর মাঝে রোকনুজ্জামান ভাইয়ের সাথেও কথা হলো – যিনি পত্রিকাটির সম্পাদনা পর্ষদের সদস্য। নতুন করে শুরু করার ব্যাপারে একটু দোনামোনা করলেও রাজি হয়ে গেলেন তিনি। তবে তার আগে সবার প্রতিক্রিয়া কী এটা জানতে চাইলেন। সবাই যদি চায় – কেবল তবেই আবার যাত্রা শুরু করা যায়। আমাদের সবারই এটা জানা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এতবার মরে গিয়ে এতবার ফিরে আসলে একটা সময় ফিনিক্স পাখিও বিভ্রমে পড়ে যাবে!

এরপর টানা কিছুদিন বিভিন্নপ্রকার সমন্বয়ের কাজ করা হলো। যেহেতু বিভাগ থেকে প্রকাশ করা হয় এবং সম্পূর্ণ নতুন প্ল্যাটফর্ম – তাই প্রচুর কাজ নতুন করে করার ছিল। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও কিছু ছিল। আমাদের দেশে আনুষ্ঠানিক যেকোনো কিছুতেই দীর্ঘসূত্রিতা কাজ করে। কিন্তু দেখা গেলো, জাফর স্যার কিছুই বুঝতে দিলেন না আমাদের। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে যা করা লাগে করতে দিলেন। এর মাঝে ওয়েবসাইট বানানো নিয়ে রাউফুন আরেফিন রূপক ভাই আমাদের দলে যোগ দিলেন। তিনি পুরো ওয়েবসাইট বানিয়ে এবং আনুষঙ্গিক সব কাজ একাই করে ফেললেন। পুরনো সংখ্যার লেখাগুলো একদল ছাত্রছাত্রীর ভলান্টিয়ার গ্রুপ নতুন করে টাইপ করে তা ওয়েবসাইটে দেয়ার ব্যবস্থা করলো। ওয়েবসাইটের একটা ঠিকঠাক কাঠামো দাঁড়িয়ে গেলো। এই সময়ের মাঝে বহুদিন রুপক ভাইয়ের মিরপুর ডিওএইচএস-এর অফিসে গিয়ে আমরা কয়েকজন গভীর রাত অবধি বসে বসে পুরাতন-নতুন সব লেখা নিয়ে কাজ করলাম। ধীরে ধীরে নতুন লেখা আসতে শুরু করলো। সেই লেখাগুলো প্রকাশের জন্য প্রস্তুত করা হলো।ওয়েবসাইটে পুরাতন সংখ্যাগুলোর আর্কাইভ করা হলো। দেখতে দেখতে এপ্রিলের ১৮ তারিখ চলে এলো।

২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল পরিসংখ্যান বিভাগে একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্যাপাইরাস পত্রিকার উদ্বোধন করলেন বিভাগের চেয়ারম্যান আমাদের লুৎফর স্যার। অনলাইনে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে লুৎফর স্যার আমাদের বলেছিলেন – “যেটা ভালো মনে হয়, ওটাই করবা। কিন্তু ভালো যেন হয়!” আমরা বেশ সাহস নিয়েই পরবর্তী সকল কাজ করে গিয়েছি। আমাদেরকে বিভাগের অনেক শিক্ষক-কর্মচারী, বর্তমান-প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী, এমনকি বিভাগের বাইরের অনেকে পিঠ চাপড়ে দিয়ে সাহস যুগিয়েছেন, সাহায্য করেছেন। তাদের সবার প্রতিই কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়।

এই এক বছরে প্যাপাইরাস পত্রিকা এর প্রত্যাশার কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে, তা পাঠকরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে নতুন কিছু করার চেষ্টা তৎপর ছিল, এবং সামনেও এই চেষ্টা চলবে বলেই আশা রাখি। এছাড়া একটা সাহিত্য পত্রিকা কতটুকু সফল এবং সেই পত্রিকার ভবিষ্যৎ আছে কি না – তা মাত্র এক বছরে বলে দেয়া কঠিন। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, একটা সাহিত্য পত্রিকার ভবিষ্যৎ খুব তাড়াতাড়ি বলে দেয়া যায়না। অন্তত ছ’সাত বছর গেলে বলা যায় কিছু একটা। সুনীল তাঁর ‘কৃত্তিবাস পত্রিকা’ মোটামুটি ষাট বছর চালিয়েছেন। এখন তাঁর স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় চালাচ্ছেন। ‘কৃত্তিবাস’ আধুনিক বাংলা কবিতার জীবন্ত ইতিহাস হয়ে টিকে আছে। তাই সুনীলের কথার একটা দাম আছে বলতেই হয়। তবে এক বছরও কম কী! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এবং (এখন পর্যন্ত) একমাত্র অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে এই এক বছরের মাইলফলকও একটা বড় সাফল্য – তা বলাই যায়। তবে পত্রিকার মূলে যারা থাকেন সবসময়, তারা হলেন পত্রিকার পাঠক এবং লেখক – এটা আসলে তাদেরই সাফল্য। তাদেরকে জানাই শুভেচ্ছা!

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp

আরও লেখা সমূহ