fbpx

পাঠ প্রতিক্রিয়া : দ্য বেল জার (সিলভিয়া প্লাথ)

একমাত্র মৃত্যুর মাধ্যমেই পৃথিবী নামক নরক থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব – এমনটা মনে করতেন সিলভিয়া প্লাথ। মৃত্যু নিয়ে তাই আমৃত্যু অবসেশনে ভুগেছেন সিলভিয়া প্লাথ। তাঁর বিখ্যাত ‘Lady Lazarus’ কবিতায় তিনি মৃত্যু নিয়ে লিখেছিলেন –

“Dying
Is an art, like everything else.
I do it exceptionally well.
I do it so it feels like hell.
I do it so it feels real.
I guess you could say I’ve a call.”

নিজের বিষণ্ণতার কথাগুলি এমন চমৎকার কবিতায় বলতে পারলে মন ভালো হয়ে যাবার একটা সুযোগ তৈরি হয়। একজন কবি বা লেখকের তার কাজের স্বীকৃতি নিজের জীবদ্দশায় দেখে যেতে চাওয়ার ইচ্ছা থাকে, উপভোগ করার ইচ্ছা থাকে। মৃত্যু নিয়ে যদি দারুণ কিছু লিখে ফেলা যায়, সেই রচনাটাও বেঁচে থাকার প্রেরণা দিতে পারে। হয়ত বিষণ্ণতা মন থেকে ঠাঁই করে নিতে পারে কাগজের পাতায়। ‘Lady Lazarus’ কবিতায় ক্লিনিকাল ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকা একজন সৃজনশীল মানুষের বেঁচে থাকার আকুতিই দেখেছি আমি। বেঁচে না থাকলে কে বলবে মর্মে মর্মে মরে যাওয়া একটা শিল্প?

লিখতে বসেছি সিলভিয়া প্লাথের একমাত্র উপন্যাস ‘The Bell Jar’ পড়ার প্রতিক্রিয়া। লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের ছায়া অবলম্বনে উপন্যাসটি লেখা, একে একধরনের আত্মজীবনীই বলা যায়, স্থান-কাল-পাত্রের পরিবর্তন করা হয়েছে এই যা। যেহেতু ‘The Bell Jar’ একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, তাই লেখকের সাইকোলজি আরও ভালো করে বুঝতে ‘Lady Lazurus’ কবিতাটির অবতারণা অবাঞ্ছনীয় মনে করছি না।

Sylvia Plath Photo

বইটি যারা পড়েননি/পড়বেন না তাদের জন্য এই উপন্যাসের প্লট সম্পর্কে কিছু বলা যাক। সিলভিয়া প্লাথ মূল চরিত্রের নাম দিয়েছেন এস্থার গ্রিনউড। এস্থার অসাধারণ মেধাবী, ভালো কবিতা লেখেন, তার একাডেমিক ফলাফল দুর্দান্ত, শিক্ষাজীবনে অনেক পুরস্কার জিতেছেন, বৃত্তি পেয়েছেন, শিক্ষকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। উপন্যাসের কাহিনী যখন শুরু হয় তখন সময়টা ১৯৫৩ সাল (তখন এস্থারের বয়স কত ছিল উল্লেখ নেই, তবে আমরা জানি সিলভিয়া প্লাথের জন্ম ১৯৩২ সালে), সোভিয়েতের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করা রোজেনবার্গ দম্পতির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের খবর তখন পত্রিকার শিরোনাম, ইলেকট্রিকিউশনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারটি এস্থারকে যথেষ্ট মানসিক পীড়া দিয়েছিল। এস্থার তখন নিউ ইয়র্কের একটা নামকরা ফ্যাশন ম্যাগাজিনে অতিথি সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। ভাল বেতন, বিলাসবহুল হোটেলে থাকার ব্যবস্থা, দামি পোশাক, জাঁকজমকপূর্ণ পার্টিতে যোগদানের সুযোগ – সমবয়সী বহু তরুণীর ঈর্ষা জাগানোর মত জীবন ছিল এস্থারের। তারপরও ফ্যাশন ম্যাগাজিনের দিনগুলিতে তিনি বিষণ্ণ ছিলেন, ঠিক করে উঠতে পারেননি তার জীবনের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত। এস্থারের স্মৃতিচারণায় পুরুষের সাথে তার ছোট-বড় বিভিন্ন সম্পর্কের কথা উঠে এসেছে। প্রেমিকের কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়া, লড়াই করে ধর্ষিত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে ফেরা – তার কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এস্থার তার বাবার অনুপস্থিতি অনুভব করেন, যাকে তিনি হারিয়েছেন নয় বছর বয়সে। কিন্তু কোন অজানা কারণে তার মাকে তিনি পছন্দ করেন না, মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করেন; যদিও এস্থারের মা আর দশটা সাধারণ মায়ের মতই সন্তানের প্রতি যত্নশীল, ভালবাসায় পরিপূর্ণ। একটা রাইটিং কোর্সে এস্থারের আবেদন নামঞ্জুর হলে তার বিষণ্ণতা প্রচণ্ড বেড়ে যায় এবং তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে যান। সময়ের পরিক্রমায় তার জায়গা হয় মানসিক হাসপাতালে। ক্লিনিকাল ডিপ্রেশনের কিছু চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হয়ে শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান এস্থার।

যারা আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষদের সাইকোলজি নিয়ে আগ্রহী বা তাদেরকে সাহায্য করতে চান, যারা প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে ভুগছেন এবং নিজেদেরকে আরও ভাল করে বুঝে এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে চান, স্বপ্নদেখা যেসব মেধাবী নারী বুঝতে পেরেছেন পৃথিবীটা তাদের স্বপ্নের মত আদর্শ জায়গা নয় – সেইসব মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করতে পারে এস্থার গ্রিনউডের জীবনকথা।

ব্যক্তি এস্থার গ্রিনউড ভালোলাগার আবেশ ছড়িয়ে দেওয়ার মত কোন চরিত্র নন। তার মধ্যে মেধাবী হওয়ার অহংকার আছে, তার মেজাজ খিটখিটে, মানুষের সাথে কারণে-অকারণে খারাপ ব্যবহার করার সহজাত প্রবণতা আছে। এমন আরও কিছু খারাপ গুণাবলিতে দুষ্ট এস্থার গ্রিনউডের চরিত্র। কিন্তু তারপরও এস্থারের প্রতি বিরক্তির বদলে ভালোলাগা তৈরি হতে হয় বা হতে পারে, কারণ তার সততা, অকপটে নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতা। এস্থারের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের কারণে তার প্রতি সমবেদনা জাগাটাও অস্বাভাবিক নয়। অল্প বয়সে বাবাকে হারানোর মত ঘটনা ঘটলেও এস্থারের জীবনটা বিষাদে ভরে গেছে পরিণত বয়সে এসে। বড় হওয়ার পর তিনি বুঝতে পেরেছেন পৃথিবীর নিয়মের সাথে খাপ খাওয়ানোর উপযুক্ত তিনি নন।

“The trouble was, I had been inadequate all along, I simply hadn’t thought about it. The one thing I was good at was winning scholarships and prizes, and that era was coming to an end.

I felt like a racehorse in a world without racetracks or a champion college footballer suddenly confronted by Wall Street and a business suit…”

একসময় যাদের আনন্দময় কৈশোর কেটেছিল, যৌবনে পদার্পণ করার পর তাদের অনেকেই বুঝতে পারেন পৃথিবী জায়গাটাকে যতটা মজার ভাবা হয়েছিল ঠিক ততটা মজার জায়গা এটা নয়। চোখের সামনে তখন একে একে মৃত্যু ঘটতে থাকে মনের মাঝে সযত্নে লালন করা বড় বড় স্বপ্নগুলির। উপন্যাসের সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত ‘Fig Tree’ অনুচ্ছেদে মানুষের স্বপ্নপূরণের সীমাবদ্ধতার অনবদ্য বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। একটু খুলে বলা যাক, একটা কাল্পনিক ডুমুর গাছ (Fig Tree) যাতে অসংখ্য শাখা আছে, প্রতিটি শাখার শীর্ষে আছে একটা করে ডুমুর। প্রতিটি ডুমুর একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জীবনকে নির্দেশ করে। যেমন একটা ডুমুর নির্দেশ করে স্বামী-সন্তানসহ সুখী পরিবার, একটা ডুমুর নির্দেশ করে বিখ্যাত কবি, একটা ডুমুর সফল অধ্যাপকের প্রতীক, একটা ডুমুর লেখকের প্রতীক, একটা সম্পাদকের প্রতীক, একটা ইউরোপ বা আফ্রিকায় রোমাঞ্চকর জীবনের ডুমুর, এমন আরও অসংখ্য ভবিষ্যতের ডুমুর আছে। এখন সমস্যা হচ্ছে শুধুমাত্র একটা ডুমুর বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে। বাকিগুলির আশা ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয়।

“I saw myself sitting in the crotch of this fig tree, starving to death, just because I couldn’t make up my mind which of the figs I would choose. I wanted each and every one of them, but choosing one meant losing all the rest, and, as I sat there, unable to decide, the figs began to wrinkle and go black, and, one by one, they plopped to the ground at my feet.”

কেন একটা ভবিষ্যৎ বেছে নিতে হবে? অন্তত দুটো কেন নয়? সফল কবি বা অধ্যাপক হলে কি সুখী পরিবারের আশা ছেড়ে দিতে হবে? উত্তর হচ্ছে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাধারণ নারীর পক্ষে একসাথে দুটো ভবিষ্যত চিন্তা করা সহজ ছিল না। কারণ নারীরা ছিল পুরুষের সঙ্গী, আর পুরুষরা ছিল নারীদের ত্রাণকর্তা। তাই এস্থার গ্রিনউডের মত স্বাধীনচেতা নারীরা তাদের পুরুষ সঙ্গীদের কাছ থেকে কবি-অধ্যাপক-সম্পাদক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার সমর্থন হয়ত পেতেন না।

“… I also remembered Buddy Willard saying in a sinister, knowing way that after I had children I would feel differently, I wouldn’t want to write poems any more. So I began to think maybe it was true that when you were married and had children it was like being brainwashed, and afterward you went about numb as a slave in some private, totalitarian state.”

এস্থার গ্রিনউডের সবচেয়ে প্রাণঘাতী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার ইগো বা অহংবোধ। তিনি পরাজয়, সীমাবদ্ধতা, বৈষম্য মেনে নেওয়ার মানুষ নন, লড়াই করার মানুষ তিনি নন, জীবনের ইতিবাচক দিকগুলিতে আলোকপাত করার মানুষও তিনি নন। যার ফলশ্রুতিতে তার জীবনে এসেছে দম বন্ধ করা বিষণ্ণতা, যেন তার প্রাণ বন্দী হয়ে আছে একটা ঘণ্টাকৃতির বয়ামের (Bell Jar) ভেতরে। তাই তিনি ইহজীবনের পাওয়া না পাওয়াকে  মধ্যাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ভাবা শুরু করলেন কীভাবে আত্মহত্যা করা যায়। গলায় ফাঁস নেওয়া তার হয়ে ওঠে নি। কোন একজন রোমান দার্শনিক আত্মহত্যার একটা উপায় বলেছিলেন, একটা বাথটাব ভর্তি কুসুম গরম পানিতে শুয়ে হাতের রগ কেটে ফেলতে হবে, রক্তিম পপি ফুলের মতো পানিতে ছড়িয়ে যাবে রক্ত, নিচে পড়ে থাকবে শবদেহ- আত্মহত্যার এই উপায়টিও সহজ নয়। পিস্তল দিয়ে নিজেকে গুলি করাতেও রিস্ক আছে, অনেকে ভুল জায়গায় গুলি করার কারণে না মরে নার্ভাস সিস্টেমের ক্ষতি করে, শেষ পর্যন্ত প্যারালাইজড হয়ে বেঁচে থাকে। সমুদ্রে একটানা সাঁতরে একপর্যায়ে নিজেকে ক্লান্ত করে ডুবে মরা যেতে পারে। যাইহোক, এস্থার আত্মহত্যার শক্তি সঞ্চয় করতে পারেন নি। নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। তারপর হুট করে একদিন পঞ্চাশটা স্লিপিং পিল খেয়ে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করেছেন এস্থার গ্রিনউড। আচ্ছা এখানকার কিছুটা অংশ কেমন সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের “হেমলক সোসাইটি” মুভির মত লাগছে, তাই না? সেজন্যই আত্মহত্যা নিয়ে এটুকু বাড়তি কথা লেখা।

কাল্পনিক চরিত্রের আড়ালে এস্থার গ্রিনউড রক্ত-মাংসের সিলভিয়া প্লাথকে রিপ্রেজেন্ট করেন। বেল জারের মধ্যে আটকে পড়ে দমবন্ধ হওয়া মানুষটি সিলভিয়া প্লাথ। একজন বন্ধুকে তিনি বলেছিলেন, এই উপন্যাসটি তিনি লিখছেন তার অতীতের দুঃসহ স্মৃতি থেকে মুক্তি পেতে। হয়তো বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা থেকে। সিলভিয়া প্লাথ বাঁচেননি, ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। ‘The Bell Jar’ প্রকাশিত হয়েছিল তার একমাস আগে।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী | প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন: ২০১১-১২

নূর সিদ্দিকী

সেশন: ২০১১-১২