fbpx

পুঁজিবাদ, কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা ও এগ্রিবিজনেসের বা কৃষি ব্যবসার দায় || রবার্ট ওয়ালেস

অনুবাদকের ভূমিকা: রব ওয়ালেস একজন মার্ক্সীয় বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী। তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে “বিগ ফার্মস মেইক বিগ ফ্লু”। বর্তমানে তিনি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় পরামর্শক হিসাবে কর্মরত আছেন। নতুন করোনাভাইরাস পুরো পৃথিবীকে একটা সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। করোনাভাইরাস পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। অনেক রাষ্ট্র বাধ্য হয়ে সবার জন্য আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, সেই সাথে বাড়ছে বেকারত্ব। কোন কোন রাষ্ট্র আবার এই ভাইরাসকে জন-নজরদারি ও ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার হাতিয়ার হিসাবে দেখছে। তবে যাই হোক, করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব কোনদিকে এগুবে সেটা আপাতত সময়ের হাতে তোলা থাকুক।

করোনাভাইরাস পৃথিবীকে একটা ধাক্কা দিয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এই মহামারীর কাঠামোগত কারণগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিবর্তে বরং জরুরি অবস্থার দিকে মনোনিবেশ করেছে। কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা, কৃষি ব্যবসার দায় এবং সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে টেকসই সমাধান নিয়ে জীব বিবর্তনবাদী রব ওয়ালেসের সাথে আলাপ নিচে উপস্থাপন করা হল।

(সম্প্রতি জার্মান সমাজবাদী ম্যাগাজিন মার্ক্স২১ কে সাক্ষাতকার দেন তিনি। মার্ক্স২১ এর পক্ষে ইয়াক পাবস্ত সাক্ষাতকারটি নেন।)

Pic 1
 রব ওয়ালেস 

ইয়াক পাবস্ত: নতুন করোনাভাইরাস কেমন বিপদজনক?

রব: এটা নির্ভর করে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণের মাত্রার উপর। এটা কি শুরুর দিকে আছে, সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে গেছে নাকি শেষের দিকে আছে? জনস্বাস্থ্যের প্রতিক্রিয়া কেমন? আপনার এলাকার জনমিতি (জনসংখ্যা, ঘনত্ব) কেমন? আপনার বয়স কত? আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কি আপসকামী? আপনার শরীরের ভিতরের অবস্থা কেমন? কিংবা উত্তর দেয়া যায় না এমন কিছু প্রশ্ন যেমন আপনার ইমিউনোজেনেটিক্স, রোগ প্রতিরোধক্ষম জেনেটিক্স এই ভাইরাস রোধ করতে সক্ষম কিনা?

ইয়াক পাবস্ত: এই যে করোনাভাইরাস নিয়ে এতো উদ্বিগ্নতা, এটা কি ভয় পাইয়ে দেয়ার কৌশল?

রব: বিষয়টা আসলে একদমই তা নয়। ভাইরাসটি উহানে প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে মৃত্যুহার ছিল ৪%  থেকে ৫%। উহানের বাইরে এই হারটা ছিল ১% বা তারও কম। কিন্তু ইতালি, আমেরিকার মত অনেক জায়গায় এই সংক্রমণের মাত্রা ভয়াবহ। এই হারটা হয়ত সার্স (মৃত্যুহার ১০%), ১৯১৮ সালে ঘটা ইনফ্লুয়েঞ্জা (৫-২০%), বায়বীয় ইনফ্লুয়েঞ্জা (মৃত্যুহার ৬০%) অথবা ইবোলার (মৃত্যুহার ৯০%) সাথে তুলনা করলে তেমন কিছুই না। কিন্তু এটা মৌসুমি ফ্লুয়ের (মৃত্যুহার ০.১%) চেয়ে বেশি। যাইহোক, শুধুমাত্র মৃত্যু হারটাই ভয়ের কারণ না। আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে যেটাকে সেটা হল এর ভেদনক্ষমতা অথবা সামাজিক সংক্রমণের হার অর্থাৎ বৈশ্বিক জনসংখ্যার কতজন এই প্রাদুর্ভাবের শিকার।

ইয়াক পাবস্তঃ আপনি কি আরোও সুনির্দিষ্টভাবে বলবেন?

রব: বৈশ্বিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এখন রেকর্ড মাত্রায় যুক্ত। এই ভাইরাসের কোনধরনের ভ্যাক্সিন কিংবা সুনির্দিষ্ট এন্টি ভাইরাল ছাড়া, অথবা কোন হার্ড ইম্যুনিটি (Herd Immunity) তৈরি না হলে, মাত্র ১% মৃত্যুহারও বিপদজনক হতে পারে। সুপ্ত অবস্থায় দুই সপ্তাহ থাকায় ও আমাদের হাতে থাকা বেশ কিছু প্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে – রোগাক্রান্ত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এটা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম, মনে হবে যেন অল্প কিছু এলাকা সংক্রমণ মুক্ত। ধরা যাক, কোভিড-১৯ এ মৃত্যুহার ১%, সে হিসাবে ৪০০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হলে, মারা যাবে ৪ কোটি মানুষ। কারণ একটা অনেক বড় সংখ্যার আপাত ছোট অংশও আসলে বড় সংখ্যা।

ইয়াক পাবস্ত: আপাতদৃষ্টিতে কম সংক্রামক জীবাণু হিসেবে এখন প্রাপ্ত সংখ্যাটা যথেষ্ট ভয়ঙ্কর…

রব: অবশ্যই। আমরা কিন্তু প্রাদুর্ভাবের একেবারেই শুরুর দিকে আছি। এটা বোঝা জরুরি যে অনেক নতুন জীবাণুর সংক্রমণের ধরন মহামারীর সময়কালে পরিবর্তিত হয়। একদিকে যেমন  সংক্রমণের মাত্রা কমে যেতে পারে। অন্যদিকে সংক্রমণের মাত্রা বেড়েও যেতে পারে। ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের মাত্রা প্রথম ধাপে (First Wave) তুলনামুলকভাবে কম ছিল। কিন্তু ১৯১৯ সালে এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে (Second and Third Wave) লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়।

ইয়াক পাবস্ত: এই মহামারী নিয়ে সংশয়বাদীরা প্রশ্ন তুলেছেন যে সাধারণ মৌসুমি ফ্লুয়ের চেয়ে এর সংক্রমণের মাত্রা এবং মৃত্যু হার কম। আপনি বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন?

রব: মহামারী নিয়ে আশংকা ভুল প্রমাণিত হলে আমি সবার আগে এটা উপভোগ করতাম। কিন্তু অন্যান্য প্রাণঘাতী ভাইরাসের সাথে করোনাভাইরাসের তুলনা আসলে এর ভয়াবহতাকে খাটো করে দেখার প্রচেষ্টা মাত্র। বিশেষ করে ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রসঙ্গ টেনে আনাটা একটা কুতর্ক।

PIc 2
আর্টওয়ার্কঃ করোনাভাইরাস লকডাউন
আর্টিস্টঃ নিমো 
সোর্সঃ কার্টুন মুভমেন্ট

ইয়াক পাবস্ত: তাহলে মৌসুমি ফ্লুয়ের সাথে তুলনা খোঁড়া যুক্তি মাত্র …

রব: দেখুন, দুইটা ভিন্ন রোগকে তাদের ভিন্ন ভিন্ন এপিকার্ভে তুলনা করাটা কোন কাজের কথা না। এটা ঠিক যে সারা পৃথিবীতে মৌসুমি ফ্লুতে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে সংখ্যাটা প্রতিবছর প্রায় ছয় লক্ষ পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি। কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ কেবল শুরু হল। অন্যান্য ইনফ্লুয়েঞ্জার মত এর কোন ভ্যাক্সিন কিংবা হার্ড ইম্যুনিটি নেই, যাতে করে সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীর মধ্যে এর সংক্রমণের মাত্রাটা কমানো যায়।

ইয়াক পাবস্ত: যদি তুলনাটা ভুলও হয়, এই দুইটা রোগের কারণ- ভাইরাস, সুনির্দিষ্ট করে বললে আরএনএ (RNA) ভাইরাস। এরা মুখ এবং গলার স্থানগুলোতে আক্রমণ করে, মাঝেমধ্যে ফুসফুসকেও। দুইটাই খুবই ছোঁয়াচে।

রব: এইগুলো আসলে বাইরের দিকের কিছু মিল। এই বাইরের দিকের কিছু মিল খুঁজতে গিয়ে আমরা এই দুই ভাইরাসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পার্থক্য, সেটাকে এড়িয়ে যাচ্ছি। আমরা ইনফ্লুয়েঞ্জার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। কিন্তু আমরা কোভিড-১৯ সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। এই ভাইরাস সম্পর্কে এখনো অনেক বিষয় অজানা। এমনকি, আমরা যদি কোভিড-১৯ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেও থাকি, এর সংক্রমণ পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনেক বিষয়ই অজানা থেকে যাবে। একইসাথে, এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে এটা প্রকৃতপক্ষে কোভিড-১৯ বনাম ইনফ্লুয়েঞ্জা না। এটা কোভিড-১৯ এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা।

একাধিক জীবাণু যেকোন মুহূর্তে মহামারীতে রূপ নিতে এবং একইসাথে জনগোষ্ঠীতে আঘাত হানতে সক্ষম। এটা অবশ্যই আমাদের প্রধান চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত।

ইয়াক পাবস্ত: আপনি তো অনেক বছর ধরে মহামারী এবং তার পিছনের কারণগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন। আপনার “Big farms Make Big Flu” বইয়ে কৃষির শিল্পায়ন, জৈব কৃষি (organic farming) এবং ভাইরাসজনিত মহামারীর মধ্যে একটা সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করেছেন। এইগুলো নিয়ে আপনার উপলব্ধি কী?

রব: প্রতিটা নতুন প্রাদুর্ভাবের আসল ভয়টা হল একে ভালভাবে বুঝতে ব্যর্থ হওয়া। আরো ভালভাবে বললে নতুন কোভিড–১৯ কে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়া। ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পিছনে খাদ্য উৎপাদন এবং বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর মুনাফার একটা গভীর সংযোগ রয়েছে। কেউ যদি বুঝতে চায় ভাইরাসগুলো কেন ক্রমশ আরো বিপদজনক হয়ে উঠছে তাকে অবশ্যই কৃষির শিল্পায়নের মডেলগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। আরো ভালভাবে বললে প্রাণীর খামারগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমানে এই বিষয় নিয়ে গুটিকয়েক সরকার, গবেষক কাজ করতে আগ্রহী।

যখন সংক্রমণ হঠাৎ বেড়ে যায়, সরকার, মিডিয়া এমনকি বেশিরভাগ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো জরুরি অবস্থার দিকে এতোটাই মনোযোগ দেয় যে তারা মহামারীর কাঠামোগত দিকগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে রাতারাতি একেকটি মহামারীকে তারকা খ্যাতির বিষয়ে পরিণত করে।

Pic 3
এগ্রিবিজনেস

ইয়াক পাবস্ত: কারা দায়ী?

রব: আমি বলেছিলাম কৃষির শিল্পায়ন। বিষয়টা আসলে আরও অনেক বেশি প্রসারিত। সারা দুনিয়াব্যাপি প্রাথমিক বন এবং ক্ষুদ্র মূলধনে পরিচালিত খামারের জমিগুলো দখলে নেতৃত্ব দিচ্ছে পুঁজিবাদ। এই বিনিয়োগগুলো একদিকে বনকে উজাড় করছে অন্যদিকে রোগের বিকাশ ঘটাচ্ছে। এই বিশাল বনের প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যকরী বৈচিত্র্য এবং জটিলতাকে এমনভাবে প্রবাহিত করা হচ্ছে যে এই বনের মধ্যে থাকা জীবাণুগুলো স্থানীয় প্রাণী এবং মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। সংক্ষেপে, মূল কেন্দ্রগুলো যেমন লন্ডন, নিউ ইয়র্ক এবং হংকংয়ের মত জায়গাগুলোকে আমাদের প্রাথমিক রোগের হটস্পট হিসাবে বিবেচনা করা উচিত।

ইয়াক পাবস্ত: ঠিক কোন রোগের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য?

রব: এই মুহূর্তে এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ শহর পাওয়া যাবে না যেটা জীবাণু থেকে মুক্ত। এমনকি অনেক দূরবর্তী এলাকাগুলোও এর দ্বারা আক্রান্ত। ইবোলা, জাইকা, করোনাভাইরাস, ইয়েলো ফিভার (yellow fever), বিভিন্ন এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (avian influenza), আফ্রিকান সোয়াইন ফিভার (swine fever)-এর মত বহুল প্রচলিত রোগজীবাণুগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলি থেকে বেরিয়ে পেরি-আরবান লুপ (peri-urban loop), আঞ্চলিক রাজধানীর মধ্য দিয়ে একটা বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে। ফলে কঙ্গোর বাদুড় থেকে মায়ামি বিচে সূর্যস্নানে থাকা মানুষদের দেহে কোন রোগ ছড়ানো মাত্র কয়েক সপ্তাহের বিষয়।

ইয়াক পাবস্ত: এই ক্ষেত্রে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ভূমিকা কী?

রব: বায়োমাস এবং আবাদি জমি উভয়দিক থেকে বলা যায় পৃথিবী একটা বিশাল খামার গ্রহে পরিণত হয়েছে। 

কৃষি ব্যবসার লক্ষ্যই হচ্ছে প্রচলিত বাজারকে কোণঠাসা করা। উদার নৈতিক প্রকল্পগুলো উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে অবস্থিত সংস্থাগুলোর সাহায্যে দুর্বল রাষ্ট্রের জমি এবং সম্পদ লুট করার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন হয়। যার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে বনের প্রতিবেশে (ecology) লুকিয়ে থাকা নতুন নতুন রোগজীবাণুগুলো মুক্ত হয়ে পড়ছে এবং গোটা দুনিয়াকে চোখ রাঙাচ্ছে।

ইয়াক পাবস্ত: কৃষি ব্যবসায় উৎপাদন পদ্ধতির উপর এর প্রভাব কী?

রব: প্রাকৃতিক প্রতিবেশকে (ecology) প্রতিস্থাপনকারী মুনাফাভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। যার ফলস্বরূপ রোগজীবাণুগুলো বিবর্তিত হয়ে আরো ভয়ানক হয়ে উঠছে। মারাত্মক রোগ তৈরির  জন্য এর চেয়ে ভালো কোন ব্যবস্থা আপনি কল্পনাই করতে পারেন না।

ইয়াক পাবস্ত: সেটা কীভাবে?

রব: গৃহপালিত প্রাণীর বর্ধিত জিনগত মনোকালচার (monoculture) সংক্রমণকে প্রশমিত করে না। বৃহৎ জনসংখ্যা এবং ঘনত্ব সংক্রমণের হার বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য জনসংখ্যার এই অবস্থা আশাব্যাঞ্জক না। উৎপাদনের শিল্পকরণের একটি অংশ ভাইরাসের বিবর্তনে ক্রমাগত জ্বালানি জুগিয়েছে।

ইয়াক পাবস্ত: কী!?

রব: এই কোম্পানিগুলো তাদের অর্থ দিয়ে যেকোন মহামারীকে বিপদজনক রূপ দিতে পারে। প্রাণী থেকে শুরু করে ভোক্তা, খামারের কর্মচারী, স্থানীয় পরিবেশ এবং সরকার এর আওতার মধ্যে পড়ে। এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এতো বেশি যে, আমরা যদি কৃষি ব্যবসার কাছে এর ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারতাম এই ব্যবসা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যেত। কোন প্রতিষ্ঠান কৃষি ব্যবসার এই চাপিয়ে দেয়া কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করতে পারে না। 

ইয়াক পাবস্ত: অনেক সংবাদ মাধ্যম দাবি করছে যে ভাইরাসটি উহানের একটা বাজার থেকে ছড়িয়েছে এই দাবিটি কি সঠিক?

রব: বিষয়টা সত্য হতে পারে আবার নাও হতে পারে। তবে দাবিটি একেবারে খারিজ করে দেয়ার মত না। ভাইরাস ছড়ানোর সাথে উহানের সামুদ্রিক বাজার- যেখানে বন্য প্রাণী বিক্রি হত, সেটার একটা সংযোগ আছে। এনভায়ারমেন্টাল স্যামপ্লিংগুলো পশ্চিমের দিকে যেখানে বন্যপ্রাণী কেনাবেচা হতো সেইদিকটা নির্দেশ করে।

কিন্তু আমরা কতদূর পিছনে গিয়ে এবং কতটা ব্যাপকভাবে বিষয়টা খতিয়ে দেখছি? জরুরি অবস্থা কখন শুরু হয়েছিল? আমরা যদি বাজারের উপর বেশি মনযোগী হই সেক্ষেত্রে বন্য চাষাবাদের উৎস এবং ক্রমবর্ধমান মুনাফার বিষয়টা হারিয়ে ফেলব। বিশ্বব্যাপী এবং চীনে বন্য খাদ্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হিসাবে আরো আনুষ্ঠানিক হয়ে উঠছে। কিন্তু কৃষির শিল্পায়নের সাথে এর সম্পর্ক কিছু টাকার ব্যাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শূকর উৎপাদনের ক্ষেত্র বনের দিকে প্রসারিত হচ্ছে। ফলে খামারিরা বনের আরও ভিতরে প্রবেশ করছে। যার ফলে কোভিড-১৯ এর মত জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।

ইয়াক পাবস্ত: চীনে কোভিড১৯ই একমাত্র ভাইরাস না যার খবর সরকার আড়াল করতে চেয়েছে

রব: হ্যাঁ। তবে শুধু চীনই যে এর ব্যাতিক্রম তা কিন্তু না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। সম্প্রতি তাদের উদার ঔপনিবেশিক চিন্তাধারায় পরিচালিত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর উদ্ভাবিত H1N1 (2009) এবং H5N2 ভাইরাস পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা এবং ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের উত্থানের জন্য কাজ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা মূলত সেটাই আড়াল করতে H1N1 (2009) এবং H5N2 ভাইরাস উদ্ভাবন করেছিল।

ইয়াক পাবস্ত: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আন্তর্জাতিক উদ্বেগকে মাথায় রেখে এখন স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে তাদের এই পদক্ষেপ কি ঠিক আছে?

রব: হ্যাঁ। এই রোগজীবাণুর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এতো বেশি যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে পরিসংখ্যানগত ঝুঁকির বিষয়ে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এই জীবাণুর প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে সেই ব্যাপারে আমাদের কোন ধারণাই নেই। আমরা এমন একটা মহামারীর মধ্যে আছি যেটা কিনা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটা বাজার থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। জীবাণুটি আপনাআপনি নিঃশেষ হয়ে গেলে, বিষয়টা দারুণ হবে। কিন্তু আমরা জানি না এটা ঘটবে কিনা। ভালোভাবে প্রস্তুতি নিলে হয়ত সংক্রমণের গতি রোধ করা যাবে। 

আমি মনে করি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই ঘোষণাটি মহামারী নাটকের একটি অংশ। নিষ্ক্রিয়তার মুখে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মৃত্যু ঘটেছে। লীগ অফ নেশনসের কথা এই মুহূর্তে মাথায় আসছে। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলো তার গ্রহণযোগ্যতা, শক্তি এবং তহবিল নিয়ে সবসময়ই উদ্বিগ্ন থেকেছে। তবে এই ধরনের পদক্ষেপ কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ কমাতে প্রস্তুতি ও প্রতিরোধের দিকে বিশ্বকে এগুতে সহায়তা করবে।

Pic 4
আর্টওয়ার্কঃ কোভিড-১৯ ও বিশ্ব
আর্টিস্টঃ স্লুকা
সোর্সঃ কার্টুন মুভমেন্ট


ইয়াক পাবস্ত: উদারনৈতিক রাষ্ট্র কাঠামোর স্বাস্থ্যখাতের পুনর্গঠন গবেষণা ও রোগীদের সেবা প্রদানকে আরও সংকুচিত করেছে। হাসপাতালগুলোর দিকে তাকালে পরিস্থিতি আঁচ করা যায়। এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বাস্থ্যখাতে আরও বেশি বরাদ্দ দেয়া কি কোন পার্থক্য তৈরি করে?

রব: আপনাকে তাহলে একটা ভীতিকর ঘটনা বলি। মায়ামির মেডিকেল ডিভাইস প্রস্তুতকারক কোম্পানির এক কর্মচারী চীন থেকে ফ্লুয়ের লক্ষণ নিয়ে দেশে আসেন। এরপর তিনি তার পরিবার ও প্রতিবে শী দের সাথে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তার শরীরে ফ্লুয়ের লক্ষণ বাড়তে থাকায় তিনি স্থানীয় একটি হাসপাতালকে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করতে বলেন। তিনি চিন্তিত ছিলেন যে তার স্বাস্থ্যবীমা দিয়ে এই পরীক্ষার ব্যয় বহন করা সম্ভব না। তার এই চিন্তা সঠিক ছিল।  

এই পরীক্ষা করাতে তার খরচ হয় ৩২৭০ মার্কিন ডলার। এই আমেরিকান দাবিটি জরুরি ভিত্তিতে পাশ হওয়া দরকার যে সংক্রমণের টেস্ট করা থেকে শুরু করে হাসপাতালের যাবতীয় সকল চিকিৎসার ব্যয় ফেডারেল সরকার বহন করবে।

অনেক মানুষ এই চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে পারবে না। আমরা সেসব মানুষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে চাই যাতে তাঁরা লুকিয়ে না থাকে এবং অন্যকে সংক্রমিত না করে। এর সুস্পষ্ট সমাধান হল একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা তৈরি করা, যেটা জরুরি অবস্থায় যেকোন সম্প্রদায়কে সেবাদানে সক্ষম। যাতে করে মানুষজন চিকিৎসা থেকে দূরে থাকার মত কোন উদ্ভট পরিস্থিতিতে না পড়ে। 

ইয়াক পাবস্ত:  একটি রাষ্ট্রে এই ভাইরাসটি শনাক্ত হওয়া শুরু হতে না হতেই সরকার বিভিন্ন জায়গায় স্বৈরাচারী আচরণ করা শুরু করে দিয়েছে। মানুষজনকে বল প্রয়োগ করে কোয়ারেন্টিনে থাকতে বাধ্য করছে। এই জাতীয় কঠোর পদক্ষেপ কি যৌক্তিক?

রব: মহামারী নিয়ন্ত্রণের নামে কর্তৃত্ববাদী আচরণ আসলে পুঁজিবাদের অসারতা প্রমাণ করে। জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে বিবেচনা করলে আমি মানুষের বিশ্বাস এবং মমত্ববোধের উপর জোর দিবো। এই দুইটি বিষয় মহামারীর দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আমাদের পারস্পরিক সংহতি ও সম্মান বজায় রাখা জরুরি। সেলফ কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষদের সহায়তা করার জন্য প্রশিক্ষিত প্রতিবেশীদের সমন্বয়ে ভলান্টিয়ার টিম গঠন করা, বাসাবাড়িতে খাদ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা এবং বেকার ভাতা প্রদান সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করবে। তাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছানো যে, আমরা একত্রিত আছি।

Pic 5
আর্টওয়ার্কঃ  নজরদারি
আর্টিস্টঃ শিলভ
সোর্সঃ কার্টুন মুভমেন্ট 


ইয়াক পাবস্ত: আপনি হয়ত জানেন জার্মানিতে নাৎসি পার্টির আদলে একটা রাজনৈতিক দল আছে যাদের সংসদে ৯৪ টা সিট আছে কট্টর নাৎসি ধারার দলটি এবং তার সাথে আরও কিছু রাজনৈতিক দল করোনাভাইরাস ঘিরে সৃষ্ট সংকটকে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে তারা করোনাভাইরাসকে ঘিরে বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করছে সরকারকে আরও কর্তৃত্ববাদী আচরণ করার দাবি জানাচ্ছেতারা চাচ্ছে অভিবাসীরা যেন দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সীমান্তগুলো যেন বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সেইসাথে অভিবাসীদেরকে যাতে জোর পূর্বক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়

রব: ভ্রমণ নিষিদ্ধকরণ এবং সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার মত র‍্যাডিকেল দাবিগুলো বৈশ্বিক রোগগুলোর মত বর্ণবাদের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এই দাবিগুলো অবশ্যই বাজে। ভাইরাস ইতোমধ্যে সবজায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের যেটা করণীয়, সেটা হল আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যাবস্থাকে ঢেলে সাজানো। আমাদের এইটা দেখা জরুরি না – কে আক্রান্ত হয়েছে আর কে হয়নি। আক্রান্ত ব্যাক্তির যথাযথ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করাটা জরুরি। আর অবশ্যই এই ধরনের জীবাণু যাতে না ছড়াতে পারে সেজন্য নির্বিচারে বিভিন্ন দেশের জমি দখল বন্ধ করতে হবে।       

ইয়াক পাবস্ত: টেকসই পরিবর্তনগুলো কী কী হতে পারে?

রব: নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আমাদের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করতে হবে। সংক্রমণের বিস্তার রোধে কৃষকদের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে এবং এই সেক্টরকে একটা শক্তিশালী পাবলিক সেক্টরে পরিণত করতে হবে। খামার এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সঞ্চয়, ফসল এবং উৎপাদনের কৌশলের সাথে কৃষকদের পরিচয় করাতে হবে। কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎসাহ প্রদানের জন্য ভোক্তাদের খাদ্য ক্রয়ে এবং দ্রব্য মূল্যে ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক পর্যায়ে চাপিয়ে দেয়া নিয়মকানুন প্রত্যাহার করতে হবে। পুঁজির নেতৃত্বাধীন কৃষির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের সকল চেষ্টা রোধ করতে হবে।

Pic 6
ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই সোর্সঃ চায়না ডেইলি

ইয়াক পাবস্ত: ক্রমবর্ধমান মহামারীর মত পরিস্থিতিতে সমাজবাদীদের (socialist) ভূমিকা কী হতে পারে?

রব: জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় সামাজিক পুনরুৎপাদনের কৃষি ব্যবসা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। উচ্চ মুনাফাভিত্তিক খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো মানবতাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। এই ব্যবস্থা মারাত্মক মহামারীর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। আমাদের এমন একটি সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থার দাবি জানাতে হবে, যেটা রোগজীবাণু সংক্রমণের পথ বন্ধ করে দিবে। সর্বপ্রথম গ্রামের মানুষদের জন্য খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে কৃষিভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতির প্রচলন, যা আমাদের পরিবেশ এবং ফসল উৎপাদনকারি কৃষকদেরকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে। বৃহৎভাবে বললে অর্থনীতি থেকে প্রতিবেশকে পৃথককারি বিপাকীয় ফাটলগুলো দূর করতে হবে। পরিশেষে, আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহকে জয় করতে হবে।

আলাপের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।


সোর্সঃ https://www.marx21.de/coronavirus-agribusiness-would-risk-millions-of-deaths/

অনুবাদকঃ ইকরামুল হক

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৫ -১৬

ইকরামুল হক

সেশনঃ ২০১৫ -১৬