fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

মূল: পাওলো কোয়েলহো

অনুবাদ: রোকনুজ্জামান

[ব্রাজিলিয়ান লেখক পাওলো কোয়েলহো’র উপন্যাস ‘ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌ টু ডাই’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। উপন্যাসটি ভেরোনিকা নামক চব্বিশ বছর বয়সী একজন স্লোভেনিয়ান তরুণীকে কেন্দ্র করে লেখা যেখানে তরুণীটির আত্মহত্যা প্রচেষ্টার মাধ্যমে বেঁচে থাকার মূল্যবোধকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ‘ভিলেট’ নামক একটি মানসিক হাসপাতাল এবং তার পরিচালক ডা. ইগোর কর্তৃক মানবচিন্তার বিভিন্ন মনোস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পাঠকদের কৌতুহলের জন্ম দিতে পারে। উপন্যাসটির তৃতীয় পরিচ্ছেদে উপন্যাস রচনার প্রেক্ষিত সম্পর্কে বলা হয়েছে যেটা অনেকটা উপন্যাসের ভূমিকা’র মতো। তাই বর্তমান অনুবাদটির ক্ষেত্রে ‘তিন’ নাম্বার পরিচ্ছেদটিকে শুরুতে নিয়ে আসা হয়েছে যা পাঠকদের উপন্যাসটি পড়তে ও কৌতুহল ধরে রাখতে সহায়ক হবে বলে মনে হয়। ‘ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্ টু ডাই’ উপন্যাসটি বাংলাদেশে দি স্কাই পাবলিশার্স কর্তৃক জনাব মামুন রশীদ এর অনুবাদ হিসেবে ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তবে বর্তমান অনুবাদের ক্ষেত্রে উক্ত অনুবাদক থেকে কোন অংশ/শব্দ/বাক্য গ্রহণ করা হয়নি। এখানে প্যাপাইরাস-এর যে সকল পাঠক মনোস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের প্রতি কৌতুহলী তারা উপন্যাসটি পড়ে আনন্দ পাবেন বলে আশা করা যায়।]

তিন

পাওলো কোয়েলহো ভেরোনিকার কাহিনী জানতে পারেন তিন মাস পর, যখন তিনি প্যারিসে একটা আলজেরিয়ান রেস্তোরায় একজন স্লোভেনিয়ান বন্ধুর সাথে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। তাঁর স্লোভেনিয়ান বন্ধুর নামও ভেরোনিকা যিনি ভিলেট হাসপাতালের চার্জে থাকা চিকিৎসকের মেয়ে।  

পরে, তিনি যখন এ বিষয়ে একটা বই লিখতে যান, তখন তিনি বন্ধুর নাম পরিবর্তন করে দেয়ার কথা ভেবেছিলেন যেন পাঠকরা বিভ্রান্ত না হন। ভেবেছিলেন তার নাম দিবেন ব্লাসকা বা অ্যাডুইনা বা মারিয়েতজা, অথবা অন্য কোন স্লোভেনিয়ান নাম, কিন্তু পরে তার আসল নামই রেখে দিয়েছেন। যখন তিনি তাঁর বন্ধু ভেরোনিকাকে বোঝাবেন তখন তিনি ‘তাঁর বন্ধু ভেরোনিকা’ বলবেন। আর যখন তিনি অন্য ভেরোনিকাকে বোঝাবেন, তখন তাকে আদৌ আলাদা ভাবে কিছু দিয়ে বোঝানোর প্রয়োজন নেই কারণ সে-ই উপন্যাসের মূল চরিত্র। তাছাড়া পাঠকরাও বিরক্ত হয়ে যাবেন যদি তাদেরকে সব সময় পড়তে হয় ‘ভেরোনিকা নামের পাগলটি’ অথবা ‘ভেরোনিকা যে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলো’। কেননা তিনি ও তাঁর বন্ধু ভেরোনিকা এ উপন্যাসের খুব অল্প একটা অংশ জুড়ে রয়েছেন।

তাঁর বন্ধু ভেরোনিকা আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলেন তার বাবার কাণ্ড জেনে, বিশেষ করে এটা মনে করে যে তার বাবা একটা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক-এর মতো একটা শ্রদ্ধাপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। তিনি নিজে একটা গবেষণার কাজ করছিলেন যেটা গতানুগতিক একাডেমিক কমিউনিটি কর্তৃক যাচাই করা হবে।

“আপনি কি জানেন ‘Asylum’ (পাগলা-গারদ/অনাথাশ্রম) শব্দটি কোথা থেকে এসেছে?” তাঁর বান্ধবী জিজ্ঞেস করলেন। “এর কাহিনী মধ্যযুগেরও আগের, গির্জা বা অন্য পবিত্র স্থানে একজন ব্যক্তির আশ্রয় খোঁজার অধিকার থেকে। ‘পাগলা-গারদ বা অনাথাশ্রমের অধিকার’ এমন একটা জিনিস যেটা একজন সভ্য ব্যক্তি ভালোই বুঝতে পারেন। সেখানে আমার বাবা, একটা পাগলা-গারদ এর পরিচালক হয়ে কী করে কারো সাথে এরকম আচরণ করতে পারেন?”

পাওলো কোয়েলহো কী ঘটেছিলো তার বিস্তারিত জানতে চান, কেননা ভেরোনিকার কাহিনী খোঁজার ব্যাপারে তাঁর প্রকৃত কারণ ছিলো। কারণটা ছিলো এমন:

তিনি নিজে একটা পাগলা-গারদে, বা মানসিক হাসপাতালে – যে নামে এগুলো সুপরিচিত – ছিলেন। আর সেটা একবার না, তিনবার ছিলেন – ১৯৬৫, ১৯৬৬ এবং ১৯৬৭ সালে। তিনি ছিলেন রিও ডি জেনেরিও ’র ডা. এরিয়াস স্যানাটোরিয়াম-এ।

ঠিক কী কারণে তাঁকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিলো, সেটা এখন পর্যন্ত তাঁর কাছে এক বিস্ময়। সম্ভবতঃ তাঁর মা-বাবা তাঁর আচরণে বিভ্রান্ত ছিলেন। আধা লাজুক, আধা মিশুক হিসেবে তাঁর স্বপ্ন ছিলো একজন ‘চিত্রশিল্পী’ হওয়ার। তাঁর এ ইচ্ছাটা পরিবারের কাছে মনে হলো সামাজিক ভাবে একঘরে হওয়ার এবং দারিদ্র্যে মৃত্যুবরণ করার এক নিশ্চিত পন্থা।

পাওলো কোয়েলহো যখন এটা নিয়ে ভাবছিলেন – বলা বাহুল্য, তিনি তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি – তখন তাঁকে একটা আস্ত পাগল হিসেবে বিবেচনা করা হলো। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো যিনি তাঁকে যুক্তিহীন কারণে হাসপাতালে ভর্তি করলেন। (প্রত্যেক পরিবারেই অন্যকে দোষারোপ করার প্রবণতা সব সময়ই থাকে, এবং অনমনীয়ভাবে এটা বলার প্রবণতা থাকে যে, মা-বাবা বুঝতে পারছে না তারা কী করছে, যখন তারা তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়।)

পাওলো হেসে উঠলেন যখন তিনি খবরের কাগজকে লেখা ভেরোনিকার ফেলে যাওয়া অদ্ভুত চিঠিটার কথা জানলেন। যে চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছিলো যে, একটা গুরুত্বপূর্ণ ফরাসি ম্যাগাজিন জানেই না স্লোভেনিয়ান কোথায়।

“কেউ নিজেকে এ কারণে মেরে ফেলতে চায় না।”

“এ কারণেই ঐ চিঠির কোন গুরুত্ব নেই,” তাঁর বন্ধু ভেরোনিকা বিব্রত স্বরে বললেন। “গতকাল, যখন আমি হোটেলে চেক-ইন করছিলাম, তখন রিসেপশনিস্ট মনে করেছিলো স্লোভেনিয়ান জার্মানির একটা শহর।”

পাওলো এ অনুভূতির বিষয়টা জানেন। অনেক বিদেশি জানেন আর্জেন্টিনার শহর বুয়েন্স আয়ার্স ব্রাজিলের রাজধানী।  

এছাড়াও অনেক বিদেশি প্রফুল্ল চিত্তে তাকে অভিনন্দন জানান তাঁর দেশের রাজধানী শহরের সৌন্দর্যের কারণে (যেটা আসলে প্রতিবেশী দেশ আর্জেন্টিনায়)। পাওলো কোয়েলহো ভেরোনিকা প্রসঙ্গে এ বিষয়টা খুলে বললেন, যদিও এটা পুনরায় উল্লেখ করা অর্থহীন। তিনিও মানসিক হাসপাতালে ছিলেন এবং তাঁর প্রথম স্ত্রী একবার মন্তব্য করেছিলেন “তাঁর সেখান থেকে ছাড়া পাওয়া উচিত হয়নি।”

কিন্তু তিনি বের হয়ে এসেছিলেন। তিনি যখন স্যানাটোরিয়াম থেকে বের হয়ে আসেন, তখন সেখানে আর ফিরে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। তিনি দু’ টা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন: (ক) তিনি একদিন এ বিষয়ে লিখবেন, এবং (খ) লেখাটা জনসমক্ষে প্রকাশের জন্য তিনি তাঁর মা-বাবা উভয়ের মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন, কারণ তিনি তাঁর মা-বাবাকে কষ্ট দিতে চাননি; তাঁর মা-বাবা তাঁদের জীবনে বহু বছর তারা যা করেছিলেন তার জন্য একে-অন্যকে দোষারোপ করে গেছেন।

তাঁর মা ১৯৯৩ সালে মারা যান এবং কিন্তু তাঁর বাবা, যিনি ১৯৯৭ সালে চুরাশি বছর বয়সে পৌঁছান, তিনি বেঁচে আছেন। তাঁর বাবা কখনো ধুমপান না করলেও ফুসফুসজনিত সামান্য কিছু রোগে ভুগছেন এবং তার কিছু খামখেয়ালিপনার জন্য কোন হাউজকিপার না থাকায় ফ্রোজেন খাবারের উপরই নির্ভর করে আছেন। তা সত্ত্বেও তিনি মানসিক ও শারীরিক ভাবে পুরো নিজের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন।

তাই পাওলো কোয়েলহো যখন ভেরোনিকার কাহিনী শুনলেন তিনি তখন তাঁর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না করে এ বিষয়ে লেখার একটা পথ খুঁজে পেলেন। যদিও তিনি কখনো আত্মহত্যা করার কথা চিন্তাও করেননি, তাঁর মানসিক হাসপাতাল জগতে নিবাসী হিসেবে কিছু জ্ঞান ছিলো – চিকিৎসা পদ্ধতি, চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যকার সম্পর্ক এবং এ রকম স্থানে থাকার আরাম ও অস্বস্তি।

তো চলুন, পাওলো কোয়েলহো ও তাঁর বন্ধু ভেরোনিকাকে উপন্যাসটা ভালো কিছুর জন্য উপস্থাপন করতে দিই এবং আমরা মূল গল্পে চলে যাই। 

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০