fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

বারো

সে আমাকে কী করে এটা জিজ্ঞেস করতে পারলো? আমি কেন কাঁদছিলাম সে কি তা বুঝতে চায়? সে কি বুঝতে পারেনি যে আমি পুরোপুরি স্বাভাবিক একজন মানুষ, প্রত্যেকের মতো আমারও কিছু ইচ্ছা ও ভীতি রয়েছে? আর এ ধরনের একটা প্রশ্ন তো আমাকে আতঙ্কিত করতে পারে, না কি?

ওয়ার্ডের মতোই একটা ক্ষীণ আলোর বাতি জ্বালানো করিডোরটাতে। করিডোর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ভেরোনিকা বুঝতে পারছিলো যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে, সে এখন আর তার ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।

আমার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। আমি এমন ব্যক্তি যে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারি, যে কোন বিষয়ের স্বরূপ বুঝতে পারি। ভেরোনিকা নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করছিলো।

এটা সত্য যে তার জীবনে সে অনেক জিনিসের চূড়ান্ত রূপ দেখেছে; তবে কেবলমাত্র কম গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের। যেমন, কোন ঝগড়া টেনে নিয়ে যাওয়া যেটা হয়তো একটা ক্ষমা চাওয়াতেই শেষ করে ফেলা যায়; অথবা ভালো লাগার কোন মানুষকে ফোন না দেয়া শুধুমাত্র এ কারণে যে তার মনে হয়েছে এ ধরনের সম্পর্কের কোন গন্তব্য নেই। নিজেকে মজবুত ও সবার থেকে আলাদা প্রমাণ করতে সে সহজ জিনিসের বিষয়ে একরোখা ছিলো। অথচ সত্যিকার অর্থে সে খুবই দুর্বল একটা মেয়ে যে কি না কখনোই ভালো ছাত্রী ছিলো না, খেলাধুলায় কখনো অতিমাত্রায় কিছু করেনি, এবং বাড়িতে শান্তি বজায় রাখতে কিছুই করেনি।

সে তার মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আড়াল করতে ছোটখাটো খুঁতগুলোকে উতরে এসেছে। সে নিজেকে স্বাধীনভাবে তুলে ধরতে চেয়েছে যখন তার সত্যিকার অর্থেই বন্ধুত্বের প্রয়োজন ছিলো। সে যখন রুমে ঢুকতো প্রত্যেকে তার দিকে ঘুরে তাকাতো কিন্তু আশ্রমে তার রাত পার হতো একা টিভি দেখে। সে তার বন্ধু-বান্ধবের মাঝে এই অনুভূতি তৈরি করতে পেরেছিলো যে তাকে ঈর্ষা করা যায়, এবং সে নিজের মাঝে নিজের যে ইমেজ তৈরি করেছে সে মতো আচরণ করতেই তার সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে ফেলেছে।

ফলে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট মনের জোর তার ছিলো না; এমন একটা মানুষ হতে যে কি না পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে ভালোবাসবে, এবং অন্যদের সুখী করবে। কিন্তু চারপাশের লোকজনও সহজ না। তারা ধারণাতীত উপায়ে প্রতিক্রিয়া করে, তারা সব সময় নিজেদের চারপাশে একটা প্রতিরক্ষা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখে, তারাও তার মতোই আচরণ করে যেন তারা কোন কিছুর তোয়াক্কা করে না। কেউ যদি খুব অকপটে নিজেকে প্রকাশ করে, তখন হয় তাদের থেকে দূরে থাকে অথবা তাদেরকে দুর্বল ভেবে ঝামেলায় ফেলে।

ভেরোনিকা হয়তো তার সামর্থ ও দৃঢ়তা দিয়ে অনেককে মোহিত করেছে, কিন্তু এটা তাকে কোথায় নিয়ে গেছে? শূন্যতায় ও চরম একাকীত্বে, ভিলেট-এ, মৃত্যুর উপকক্ষে।

আত্মহত্যা প্রচেষ্টার কারণে তীব্র অনুশোচনা ভেরোনিকার মনের তলে ভেসে উঠছিলো, সে সেটাকে জোর করে চাপিয়ে রাখলো। এই মুহূর্তে সে যেটা অনুভব করছে সেটা কখনোই নিজের মধ্যে স্থান দেয়নি: তা হচ্ছে বিদ্বেষ।

বিদ্বেষ। প্রাচীর, পিয়ানো আর নার্সের মতোই বাস্তবিক। সে তার শরীর নিঃসৃত ধ্বংসাত্মক শক্তিকে যেন স্পর্শ করতে পারছে। সেটা ভালো না খারাপ তা বিবেচনা না নিয়েই ভেরোনিকা চাচ্ছিলো এটা বের হয়ে আসুক; সে আত্ম-নিয়ন্ত্রণে, মুখোশ পরে থাকতে, এবং যথার্থ আচরণ করতে ক্লান্তি বোধ করে। ভেরোনিকা তার অবশিষ্ট দুই কি তিন দিন, সে যেমন নয় তেমন করে যদি দিন কাটাতে পারতো!

এই অনুভূতিটা শুরু হয়েছে বৃদ্ধ লোকটির গালে চড় মারা থেকে, এরপর সে নার্সের সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। সে অন্যের প্রতি সদয় হয়নি; আবার যখন তার একা থাকতে ইচ্ছে হয়েছে তখন যে অন্যদের সাথে আলাপ করতে গিয়েছে। এখন সে তার মনটাকে বিদ্বেষে পূর্ণ করে ফেলতে পারছে। তাই বলে সে তার চারপাশের সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলছে না, বরং তার জীবনকে চেতনানাশক ওষুধের নিচে চাঁপা দিয়ে ও ওয়ার্ডের বিছানায় ফেলে কাটানোর ঝুঁকি নিচ্ছে।

এ মুহূর্তে সে সব কিছুকে ঘৃণা করে: নিজেকে, পৃথিবীকে, তার সামনের চেয়ারটাকে, করিডোরের ভেঙ্গে যাওয়া রেডিয়েটরকে, নিখুঁত ব্যক্তিকে, অপরাধীকে। সে একটা মানসিক হাসপাতালে আছে, আর তাই সে স্বাধীনভাবে এমন অনুভূতি অনুভব করতে পারে যেটা অন্যরা লুকিয়ে রাখে। আমরা সবাই বেড়ে উঠেছি শুধুমাত্র ভালোবাসতে, মেনে নিতে, চারপাশের বিভিন্ন জিনিসের খোঁজ করতে, সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতে। ভেরোনিকা সব কিছুই ঘৃণা করে, তবে সবচেয়ে বেশি করে তার বেঁচে থাকার ধরণটাকে। এই মুহূর্তে তার ভেতরের হাজারো ভেরোনিকাকে খুঁজে পেতে তার কোন আপত্তি নেই যে কি না চিত্তাকর্ষক, উন্মাদ, কৌতুহলী, সাহসী ও দৃঢ়।

এরপরই তার বিদ্বেষ গিয়ে পড়লো এমন ব্যক্তির প্রতি যাকে সে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, সে হচ্ছে তার মা। সে একজন চমৎকার স্ত্রী যে সারা দিন সংসারের কাজ করে এবং রাতে বাসন ধোয়। আর নিজের জীবনকে সে এমন ভাবে বিলিয়ে দিয়েছে শুধুমাত্র তার মেয়েকে ভালো পড়ালেখা করাতে, চমৎকার পিয়ানো ও বেহালা বাজানো শেখাতে, রাজকন্যার মতো পোশাক পরাতে, চলতি ফ্যাশনের জিন্স-জুতো পরাতে; তার পরিবর্তে সে বছরের পর বছর ছিড়ে যাওয়া একই পুরনো জামা ব্যবহার করে এসেছে।

আমি এমন একজনকে কীভাবে ঘৃণা করছি যে আমাকে শুধু ভালোবাসাই দিয়ে গেছে? ভেরোনিকা ভাবছিলো। সে খুবই বিভ্রান্ত হয়ে নিজের অনুভূতিগুলো যাচাই-এর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, তার বিদ্বেষ লাগাম ছেড়ে দিয়েছে; সে তার নিজস্ব নরকের জগতটার দরজা খুলে দিয়েছে। সে তার পাওয়া ভালোবাসাকে ঘেন্না করে কারণ এটা শুধু দিয়েই গেছে পরিবর্তে কিছু চায়নি কখনো; এটা বানোয়াট, কপট ও প্রকৃতিবিরুদ্ধ।

অফেরতযোগ্য ভালোবাসা তাকে অপরাধবোধে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো আর অন্যের আশা পূরণের আকাঙ্ক্ষায় মন পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিলো যেন নিজের সমস্ত স্বপ্নও সে জলাঞ্জলি দিতে পারে এ জন্য। এটা এমন এক ভালোবাসা যার অস্তিত্ব তার কাছে ঢাকা ছিলো। কোন একদিন সে এটা খুঁজে পাবে ও এর বিরুদ্ধে পুরোপুরি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে – এ বিষয়টাই সে এড়িয়ে গিয়েছিলো।

আর তার বাবা? সে তার বাবাকেও ঘৃণা করে। তার মা’র মতো সেও সারা দিন কাজ করে ও কীভাবে জীবন ধারণ করতে হয় তা জানে; তাকে বারে ও থিয়েটারে নিয়ে যায়, একসাথে মজা করে। ছোটকালে সে তার বাবাকে গোপনে ভালোবাসতো শুধু বাবা হিসেবে নয়, একজন পুরুষ হিসেবে। সে তার বাবাকে ঘৃণা করে কারণ তার বাবা সবার সাথেই খুব উৎফুল্ল ও অকপট একমাত্র তার মা ছাড়া অথচ যে প্রকৃতভাবেই এর যোগ্য।

সে সব কিছুকেই ঘৃণা করে। বই ভর্তি লাইব্রেরিকে সে ঘৃণা করে যেটা জীবন সম্পর্কে যাবতীয় ব্যাখ্যা ধারণ করে; সে স্কুলটাকে ঘৃণা করে যেটা তাকে সমস্ত সন্ধ্যা বীজগণিতের মতো বিষয় শিখতে বাধ্য করেছে যেখানে সে তার সারা জীবনে একমাত্র শিক্ষক ও গণিতবিদ ছাড়া আর একটা লোক পায়নি যার বীজগণিত শিখে আনন্দ লাভের প্রয়োজন। কেন তাদের এতো বীজগণিত অথবা জ্যামিতি অথবা অন্য পাহাড়সম অপ্রয়োজনীয় জিনিস শেখানো হয়েছে?

ভেরোনিকা দরজা ঠেলে লিভিং রুমে ঢুকে পিয়ানোর সামনে গিয়ে বসলো। লিড খুলে তার সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে পিয়ানোতে চাপ দিলো। তারের একটা উন্মাদ, কর্কশ, বেসুরো প্রতিধ্বনি ফাঁকা রুমটাতে ছড়িয়ে পড়লো, এবং রুমের দেয়ালগুলোতে ধাক্কা খেয়ে তার কাছে একটা তীক্ষ্ন সুরের আবরণে ফিরে আসলো; মনে হচ্ছিলো যেন তার আত্মার আর্তনাদ। সত্যিই বোধ হয় তার এ মুহূর্তের আত্মার চিত্র ফুটে উঠলো এতে।

সে বারে বারে পিয়ানোর চাবিতে চাপ দিতে লাগলো আর বেসুরো তরঙ্গ তার চারদিকে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলো।

“আমি তো পাগল। আমি এটা করতেই পারি। আমি ঘৃণা করতে পারি, আমি পিয়ানোতে যেমন তেমন সুর তুলতে পারি। একজন মানসিক রোগী হয়ে আমি কী করে পিয়ানোতে সঠিক সুর তুলবো?,” ভেরোনিকা নিজের মনেই বলছিলো।

সে বার বার পিয়ানো চেপে যেতে লাগলো, একবার, দু’বার, দশবার, বিশবার; যতবার সে এটা করছিলো ততবার তার বিদ্বেষ ভাবটা কমে আসছিলো। সে এটা পুরোপুরি মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত পিয়ানো চেপে গেলো।

তারপর আরো একবার এক গভীর প্রশান্তির বন্যা বয়ে গেলো তার ভেতরে। ভেরোনিকা আবার তারা ভরা কিশোরী চাঁদের আকাশের দিকে চাইলো, তার খুব ভালো লাগার আকাশ; মনে হচ্ছিলো যেন রুমটা হালকা আলোয় পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। অসীম ও অনন্তকাল পরষ্পর যেন হাতে হাত ধরে হাঁটছে এমন অনুভূতি জাগলো মনে; মনে হলো কেউ যেন এদের একজনকে – সীমাহীন মহাবিশ্বকে – খুঁজে বেড়াচ্ছে আর একজনকে অনুভব করতে। এখানে সময় অসীম ও স্থির, রয়েছে শুধু বর্তমান যা জীবনের সব গোপনীয়তার আধার। ওয়ার্ড থেকে সে যখন এ রুমে আসছিলো তখন সে এমন নিখুঁত বিদ্বেষ দ্বারা পূর্ণ হয়েছিলো যে তার হৃদয়ে এর চেয়ে বেশি হিংসা বলতে কিছু ছিলো না। সে তার মনের তলে নেতিবাচক অনুভূতি ভেসে উঠতে দিয়েছিলো যেটা বহু বছর তার আত্মায় চাপা পড়ে ছিলো। সত্যিকার অর্থেই সে এ অনুভূতি অনুভব করেছে; এদের আর প্রয়োজন নেই; এ অনুভূতিগুলো ত্যাগ করা যায়।

সে নিরবে একা বসে থেকে মূহুর্তটা উপভোগ করছিলো, বিদ্বেষের ফেলে যাওয়া ফাঁকা স্থানটা ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ হওয়াটা সে উপভোগ করছিলো। যখন তার মনে হলো মূহুর্তটা উপস্থিত সে চাঁদটার দিকে তাকালো এবং চাঁদকে উদ্দেশ্য করে একটা সুর বাজালো। ভেবে নিলো যে চাঁদটা সুরটা শুনছে আর গর্ব বোধ করছে এই ভেবে যে এটা তারাগুলোকে ঈর্ষান্বিত করবে। এরপর সে তারাদের উদ্দেশ্যে, বাগানের উদ্দেশ্যে, পাহাড়ের উদ্দেশ্যে সুর তুললো; অন্ধকার রাতে কাউকে দেখা না গেলেও সে জানতো এরা রয়েছে।

যখন সে বাগানের উদ্দেশ্যে সুর বাজাচ্ছিলো তখন আর এক বিকারগ্রস্ত যুবক সেখানে হাজির হলো: এডোয়ার্ড, একজন সিজোফ্রেনিক যার রোগ ছিলো চিকিৎসার অতীত। তাকে দেখে ভেরোনিকা ভয় পেলো না, বরং সে একটু হাসি দিলো; এবং তাকে অবাক করে দিয়ে এডোয়ার্ডও হাসি ফেরত দিলো।

ভেরোনিকার বাজানো সুর এডোয়ার্ড-এর দূর জগতকে বিদ্ধ করে গেছে যেটা হয়তো চাঁদের থেকেও দূরে; এমন কি হয়তো বিস্ময়ও জাগিয়েছে।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০