fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

তেরো

“আমাকে একটা নতুন চাবির রিং কিনতে হবে,” ডা. ইগোর ভিলেট-এ তার ছোট কনসাল্টিং রুমের দরজা খুলতে খুলতে ভাবছিলেন। আগের চাবির রিংটা ভেঙ্গে কয়েক টুকরো হয়ে গেছে, একটা ছোট সাজসজ্জা করা ধাতব টুকরো মেঝেতে পড়ে আছে।

ডা. ইগোর নিচু হয়ে টুকরোটা তুললেন। ল্যুবল্জানা’র পরিচয় চিহ্ন আঁকা এ ধাতব টুকরো বহন করে নিয়ে উনি কী করবেন? তিনি এটা ফেলে দিতে পারেন, চাইলে তিনি এটা মেরামত করে এদেরকে একটা নতুন চামড়ার ফিতে তৈরি করে দিতে বলতে পারেন, অথবা এটা তিনি তার ভাতিজাকে খেলতে দিতে পারেন। দু’ টা উপায়ই অর্থহীন। একটা চাবির রিং খুব মূল্যবান বস্তু না এবং তার ভাতিজার এ ধাতব টুকরোতে কোন আগ্রহও নেই; সে সারাক্ষণই টিভি দেখে অথবা ইতালি থেকে আমদানিকৃত ইলেকট্রিক খেলনা দিয়ে খেলে সময় কাটায়। তারপরও ডা. ইগোর-এর এটা ফেলে দিতে মন চাইলো না, পকেটে রেখে দিলেন। কী করা যায় এ ব্যাপারে পরে চিন্তা করবেন।

এ কারণেই তিনি হাসপাতালের পরিচালক, একজন রোগী নন। কেননা উনি কোন একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভালো করে ভাবেন।

তিনি বাতি জ্বালালেন। শীত চলে আসছে, তবুও ভোর হতে এখনো দেরি আছে। স্থানচ্যুতি, বিবাহ বিচ্ছেদ এবং আলোর অনুপস্থিতি বিষণ্নতার কেস সংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ। ডা. ইগোর আশা করছেন বসন্ত আগে আগে এসে তার আলোর সমস্যার অর্ধেক সমাধান করে দিবে।

তিনি তার দিনের ডায়েরি দেখলেন। তাকে এডোয়ার্ড-এর না খেয়ে মরার একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে; এডোয়ার্ড-এর সিজোফ্রেনিয়া তাকে অনিশ্চিত করে ফেলেছে, এবং সে এখন খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ডা. ইগোর অবশ্য এর মধ্যেই নল দিয়ে খাওয়ানোর জন্য প্রেসক্রাইব করেছেন, কিন্তু এটা তো স্থায়ী সমাধান না। এডোয়ার্ড আঠাশ বছর বয়সী শক্ত তরুণ হলেও নলের মাধ্যমে খাওয়াটা তাকে চূড়ান্তভাবে শেষ করে ফেলবে এবং তাকে আরো বেশি কংকালসার করে ফেলবে।

এডোয়ার্ড-এর বাবা কী ভাববেন কে জানে? তিনি নতুন স্লোভেন প্রজাতন্ত্রের একজন অতি পরিচিত কুটনীতিক। ১৯৯০ এর শুরুতে যুগোশ্লাভিয়ার সাথে মার্জিত সমঝোতার পেছনে অবদান রাখা ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি একজন। উপরন্তু তিনি বছরের পর বছর তার নিন্দুকের বিরুদ্ধে টিকে থেকে বেলগ্রেড সরকারের হয়ে কাজ করছেন, যে নিন্দুকেরা বলে বেড়াতো যে তিনি শত্রু পক্ষের হয়ে কাজ করেছেন। তিনি এখনো কুটনীতিক দলের অংশ হয়েই কাজ করছেন তবে অন্য দেশের প্রতিনিধি হিসেবে। তিনি একজন ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি যাকে সবাই-ই ভয় পায়।

ডা. ইগোর ক্ষণিকের জন্য চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন, একটু আগেই যেমন চাবির রিং-এর ধাতব টুকরোটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। তবে তিনি তাৎক্ষণিক এ দুশ্চিন্তা বাদ দিলেন। যতদিন ধরে অ্যাম্বাসেডর মহোদয় এ ব্যাপারটার সাথে আছেন তার ছেলের ভালো বা মন্দ থাকা তার কাছে কোন ব্যাপার না; তিনি যেসব স্থানে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে যান সেসব স্থানে এডোয়ার্ডকে তার সাথে নিয়ে যাবার বা কোন অফিসিয়াল অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবার কোন আগ্রহ বা ইচ্ছা কুটনীতিক মহোদয়ের নেই। এডোয়ার্ড ভিলেট-এ আছে এবং এখানেই চিরদিন থাকবে, অন্ততঃ যতদিন তার বাবা একটা ভালো রোজগার করেন।

ডা. ইগোর সিদ্ধান্ত নিলেন যে এডোয়ার্ড-এর নল দিয়ে খাওয়া বন্ধ করে দিবেন এবং ক্ষিদে অনুভব না করা পর্যন্ত তাকে কিছুটা হালকা হওয়ার সুযোগ দিবেন। যদি পরিস্থিতি খারাপ হয় তাহলে তিনি একটা প্রতিবেদন লিখে চিকিৎসক কাউন্সিলের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিবেন যারা ভিলেট পরিচালনা করেন। “ঝামেলা এড়ানোর সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে দায়িত্ব বণ্টন করা,” তার বাবা তাকে এ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনিও একজন চিকিৎসক ছিলেন; তবে তার হাতে অনেক মৃত্যু হলেও সেসব নিয়ে তাকে কখনোই কর্তৃপক্ষের সাথে ঝামেলা পোহাতে হয়নি।

ডা. ইগোর, এডোয়ার্ড-এর চিকিৎসার বিষয় শেষ করে পরের কেস নিয়ে বসলেন। প্রতিবেদন বলছে জেডকা মেন্ডেল তার চিকিৎসার কোর্স সম্পন্ন করে এখন ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য তৈরি। ডা. ইগোর নিজে তাকে একবার দেখবেন। কোন রোগী ভিলেট থেকে বাড়ি ফেরার পর রোগীর পরিবার থেকে পাওয়া অভিযোগকে একজন চিকিৎসক সবচেয়ে বেশি ভয় করেন; আর এটা প্রায় ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে কারণ একজন রোগীর জন্য মানসিক হাসপাতালে একটা সময় কাটিয়ে পুনরায় সাধারণ জীবন যাপনে মানিয়ে নেয়াটা খুব ব্যতিক্রম একটা ব্যাপার।

এটা হাসপাতালের সমস্যা নয়, বা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা কোন হাসপাতালের সমস্যা নয়; পুনরায় মানিয়ে নেয়ার সমস্যাটা সব জায়গায় একইরকম। ঠিক বন্দীশালা যেমন বন্দীকে সংশোধন করতে পারে না – কেবল আরো অপরাধ করতে শেখায় – তেমনি অবাস্তব পৃথিবীতে অভ্যস্ত রোগীর হাসপাতালে সবকিছুই করার অনুমোদন রয়েছে এবং কেউই তাদের ক্রিয়াকলাপের দায়িত্ব নেয় না।

পাগলামী সারানোর একটাই উপায় রয়েছে আর ডা. ইগোর সেটাতেই মনপ্রাণ দিয়ে লেগে আছেন। তিনি একটা গবেষণা পত্র তৈরি করছেন যেটা হয়তো মনোজাগতিক ক্ষেত্রে একটা বিপ্লব নিয়ে আসবে। মানসিক হাসপাতালে অস্থায়ী রোগীরা চিকিৎসার অতীত রোগীদের সাথে পাশাপাশি অবস্থান করে। ফলে একটা সামাজিক অধঃপতনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং একবার তা শুরু হলে থামানো অসম্ভব। জেডকা মেন্ডেল পুনরায় হাসপাতালেই ফিরে আসবে এবং নিজের ইচ্ছাতেই আসবে, কিছু অস্তিত্বহীন অসুস্থতা নিয়ে। এটা ঘটবে কারণ এখন তার কাছাকাছি যারা রয়েছে তারা বাইরের পৃথিবীর চেয়ে তাকে ভালো বোঝে বলে তার কাছে মনে হবে।

তবে তিনি যদি ভিট্রিওল-কে বাঁধা দেয়ার উপায় খুঁজে বের করতে পারেন যেটা ডা. ইগোরের মতে বিকারগ্রস্ততার কারণ, তাহলে তার নাম ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে এবং মানুষ জানবে স্লোভেনিয়া দেশটা কোথায়। এ সপ্তাহে তার হাতে একটা ঈশ্বর-প্রদত্ত সুযোগ এসেছে প্রায় হয়ে যাওয়া আত্মহত্যা হিসেবে; তিনি পৃথিবীর সমস্ত অর্থ দিলেও এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না।

ডা. ইগোর এ কারণে আনন্দিত। যদিও তাকে অর্থনৈতিক কারণে বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করতে বাধ্য হতে হয়। যেমন ইনসুলিন শক্-এর কথা বলা যায়; এটা অনেক আগেই চিকিৎসা পেশায় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে ভিলেট-এ নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে এর প্রয়োগকে প্ররোচিত করা হয়। ভিট্রিওল-এর উপর তার গবেষণা চালাতে সময় ও স্টাফের পাশাপাশি ভাতৃসংঘ নামক একটা দলকে অনুমোদনের বিষয়ে তাকে মালিক পক্ষ থেকে অনুমতি নিতে হয়। শেয়ার হোল্ডাররা এ প্রতিষ্ঠানে কঠোরভাবে প্রয়োজনীয় সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত সময় অন্তরণের বিষয়টি সহ্য করেন; এখানে লক্ষ্যণীয় ‘সহ্য’ করেন, ‘উৎসাহিত’ করেন না। তাদের মতে, মানবিক কারণে, সাম্প্রতিক কালে সুস্থ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দেয়া উচিত। তারাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, তাদের জন্য স্বাভাবিক পৃথিবীতে যোগ দেয়ার জন্য উৎকৃষ্ট সময় কোনটা। এর ফলে এক দল ভিলেট-এ থেকে যাওয়াটাই স্থির করে, অনেকটা হোটেল বা ক্লাব পছন্দের মতো যেখানে নিজেদের মতাদর্শী ও দৃষ্টিভঙ্গির লোক রয়েছে। এভাবে ডা. ইগোর বিকারগ্রস্ত ও বিকারহীন লোকদের একই স্থানে রাখার ব্যবস্থা করেছেন যাতে পরবর্তী দল প্রথম দলের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অধঃপতন ঠেকাতে এবং সুস্থদের উপর বিকারগ্রস্তদের নেতিবাচক প্রভাব প্রতিহত করতে ভাতৃসংঘের প্রতিটি সদস্যকে দিনে কমপক্ষে একবার হাসপাতাল ছেড়ে যেতে হয়।

ডা. ইগোর জানেন যে, সুস্থ লোকদের হাসপাতালে অবস্থানের পেছনে শেয়ারহোল্ডারদের দেখানো ‘মানবিক কারণ’ একটা অজুহাত মাত্র। তাদের ভয় যে, স্লোভেনিয়ার ছোট্ট কিন্তু মনোরম রাজধানী ল্যুবল্জানা এই ব্যয়বহুল ও আধুনিক হাসপাতাল টিকিয়ে রাখার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক ধনী বিকারগ্রস্ত রোগীর যোগান দিতে পারবে না। তাছাড়া সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আওতায় প্রথম শ্রেণির নিজস্ব মানসিক হাসপাতাল রয়েছে। আর সেটা মানসিক স্বাস্থ্য বাজারে ভিলেট-কে একটা অসুবিধাজনক অবস্থায় রেখেছে।

যখন শেয়ারহোল্ডাররা পুরনো ব্যারাককে হাসপাতালে রূপান্তর করেছিলো তখন তাদের লক্ষ্য ছিলো যুগোশ্লাভিয়ার সাথে যুদ্ধের কারণে যে সকল নারী-পুরুষ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন তারা। যুদ্ধ খুব সংক্ষিপ্ত হওয়ার পর শেয়ারহোল্ডারদের ধারণা ছিলো যুদ্ধ ফিরে আসবে, কিন্তু তা আর হয়নি।

উপরন্তু, সাম্প্রতিক গবেষণা বলে যুদ্ধকালীন সময়ে যত জন মানসিক বৈকল্যে ভুক্তভোগী হয়েছে তার চেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছে কষ্টকর পরিস্থিতি বা অশান্তি, একঘেয়েমি, জন্মগত রোগ, একাকীত্ব এবং প্রত্যাখ্যাত সংক্রান্ত সমস্যায়। যখন কোন সমাজের কোন বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় – যেমন, যুদ্ধ, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, অথবা প্লেগ – তখন সমাজে আত্মহত্যার সংখ্যা খুব সামান্য বৃদ্ধি পায় কিন্তু বিষণ্নতা, মানসিক বৈকল্য ও মনোব্যাধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পায়। এটা আবার স্বাভাবিক মাত্রায়ে আসে যখন সমস্যা উৎরে যায়। ডা. ইগোর-এর মতে এটা একটা বিষয় নির্দেশ করে যে, মানুষ নিজেদের মধ্যে বিকারগ্রস্ততার বিলাসিতা তখনই অনুমোদন করে যখন এরকম বিলাসিতা দেখানোর মতো অবস্থানে থাকে।

তার সামনে কানাডার সাম্প্রতিক একটা জরিপ প্রতিবেদন রয়েছে। একটা আমেরিকান পত্রিকার সাম্প্রতিক ভোটে কানাডা জীবন যাত্রার মানে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। ডা. ইগোর প্রতিবেদনটি পড়লেন। কানাডার পরিসংখ্যান হিসেবে ১৫-৩৪ বছর বয়সীদের ৪০%, ৩৫-৫৪ বছর বয়সীদের ৩৩% এবং ৫৫-৬৪ বছর বয়সীদের ২০% ইতিমধ্যে কোন ধরনের মানসিক রোগে ভুগছেন। গবেষণা মনে করছে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন কোন প্রকারের মানসিক বৈকল্যে ভুগছেন এবং প্রতি আট জন কানাডিয়ানের মধ্যে একজন তার জীবনের কোন এক সময় মানসিক সমস্যার কারণে একবারের জন্য হলেও হাসপাতালের শরণাপন্ন হয়েছেন।

আমাদের তুলনায় তাদের বাজার অনেক বড়, তিনি ভাবলেন। মানুষ যত সুখী, তারা তত অসুখীও বটে।

ডা. ইগোর আরো কিছু কেস দেখলেন এবং সাবধানে ভেবে দেখলেন কোনগুলো তাকে কাউন্সিল এর সাথে আলোচনা করতে হবে আর কোনগুলো উনি নিজেই সমাধান করতে পারবেন। তার কাজ শেষ হতে হতে দিনের আলো ফুটে উঠলো। তিনি বাতিটা বন্ধ করে দিলেন।

এরপরই তিনি তার প্রথম সাক্ষাৎকারপ্রার্থীকে ডেকে পাঠালেন। আজ তার সাক্ষাৎকারপ্রার্থী ছিলেন যে রোগীটি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলো তার মা।

“আমি ভেরোনিকার মা। আমার মেয়ে কেমন আছে?”

ডা. ইগোর ভাবছিলেন তার সত্যটা বলা উচিত হবে কি না। এতে করে ভদ্রমহিলাকে যে কোন অপ্রীতিকর বিস্ময় থেকে মুক্তি দেয়া হবে – তাছাড়া ডা. ইগোর-এর একই নামের একটা মেয়ে রয়েছে। কিন্তু তার কাছে মনে হলো এখন কিছু না বলাই ভালো।

“আমরা এখন কিছুই বলতে পারছি না,” তিনি মিথ্যাটাই বললেন। “আমাদের আরো এক সপ্তাহ লাগবে বুঝতে।”

“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ভেরোনিকা কেন এমনটা করলো,” ভদ্রমহিলা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন। “আমরা সব সময়ই তার প্রতি সহৃদয়বান মা-বাবা হিসেবে পাশে ছিলাম, তাকে বড় করে তুলতে সবচেয়ে ভালোটা দিতে আমরা সব সময়ই চেষ্টা করেছি। যদিও আমার স্বামী ও আমার ভালো-মন্দ সময় গিয়েছে, কিন্তু আমরা পরিবারকে সুসংহত রেখেছি সব সময়, যেমন বিপদে আমরা সব সময়ই ধৈর্যশীল। সে ভালো চাকরি করতো, সে দেখতে ভালো, তারপরও…”

“… হ্যাঁ, তারপরও সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো,” ডা. ইগোর বললেন। “এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই; এরকমই হয়। মানুষ সব সময়ই আনন্দকে গ্রহণ করতে পারে না। আপনি চাইলে এ ব্যাপারে আমি কানাডার পরিসংখ্যান দেখাতে পারি।”

“কানাডা?”

ভদ্রমহিলা সচকিত হয়ে উঠলেন। ডা. ইগোর দেখলেন যে, তিনি ভদ্রমহিলার মনোযোগ সরাতে পেরেছেন; তিনি বলে চললেন।

“দেখুন, আপনি এখানে আপনার মেয়ে কেমন আছে তা জানতে আসেননি, এসেছেন সে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলো সে ব্যাপারে ক্ষমা চাইতে। তার বয়স কত?”

“চব্বিশ।”

“তার মানে সে একজন পূর্ণবয়স্ক, অভিজ্ঞ ভদ্রমহিলা যে খুব ভালো ভাবে জানে সে কী চায় এবং সে তার নিজ সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরোপুরি সক্ষম। এখানে আপনার সংসারে কী হলো বা তার প্রতি আপনার ও আপনার স্বামীর কী অবদান তা কী যায় আসে? সে কত দিন হলো নিজের মতো করে আছে?”

“ছয় বছর।”

“আচ্ছা। তার মানে সে নিজ থেকেই স্বাবলম্বী। কিন্তু একজন অস্ট্রিয় চিকিৎসক – ডা. সিগমন্ড ফ্রয়েড, আমি নিশ্চিত আপনি তাঁর নাম শুনে থাকবেন – এর, এ সম্পর্কে যে লেখা যেখানে বলা হয়েছে মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যকার অসুস্থ সম্পর্কের কারণে অনেকে নিজেদেরকে এ বিষয়ে দায়ী করে থাকেন। আপনি কি কল্পনা করতে পারেন যে, ভারতীয়দের বিশ্বাস ছেলের খুনী হিসেবে বিবর্তনের পেছনে মা-বাবার সন্তান লালন-পালন পদ্ধতি দায়ী? বলুন।”

“আমার ন্যূনতম ধারণা নেই এ বিষয়ে,” ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন। তিনি ডাক্তারের আচরণে বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। খুব সম্ভবত তার রোগীদের দ্বারা তিনি প্রভাবিত।

“ঠিক আছে, আমি আপনাকে বলছি,” ডা. ইগোর বললেন। “ভারতীয়রা বিশ্বাস করে হত্যাকারী অপরাধী, সমাজ বা মা-বাবা, বা তার পূর্বপুরুষরা নয়। একজন জাপানি কি তার ছেলে মাদকাসক্ত হয়ে লোকজনকে গুলি করার কারণে কখনো আত্মহত্যা করেন? উত্তর একই: না! এবং আমরা এটাও জানি জাপানিরা যখন তখন আত্মহত্যা করে। সেদিন আমি পড়ছিলাম যে একজন জাপানি যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে না পারায় আত্মহত্যা করেছে।”

“আমি কি আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে পারি?” ভদ্রমহিলা জানতে চাইলেন, যিনি জাপানি, ভারতীয় কিংবা কানাডিয়ান নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না।

“অবশ্যই, অবশ্যই, একটু অপেক্ষা করুন,” ডা. ইগোর বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে একটু বিরক্তি প্রকাশ করলেন। “কিন্তু প্রথমে আমি একটা বিষয় আপনাকে বলতে চাই: সুনির্দিষ্ট কঠিন বিকারতত্ত্বীয় ঘটনা ছাড়া মানুষ তখনই বিকারগ্রস্ত হয় যখন সে নিয়মিত জীবন থেকে পালানোর চেষ্টা করে। বুঝতে পেরেছেন?”

“জ্বী,” ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন। “আর আপনি যদি মনে করেন যে, আমি তার দেখাশোনা করতে পারবো না, তবে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, আমি কখনোই আমার নিয়মিত জীবন পরিবর্তনের চেষ্টা করবো না।”

“খুব ভালো,” ডা. ইগোরকে ভারমুক্ত মনে হলো। “ধরুন এমন কি একটা পৃথিবী কল্পনা করা যায় যেখানে আমরা প্রতিদিন আমাদের জীবনে একই জিনিস বার বার করতে বাধ্য হই না? ধরা যাক, যদি এমন হয় যে, আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নেই যে শুধু ক্ষিদে লাগলেই আমরা খাবো, তাহলে গৃহিণীরা আর রেস্তোরাগুলো কী করবে?”

ক্ষিদে লাগলে মানুষ খাবে এটাই তো বেশি স্বাভাবিক, ভদ্রমহিলা ভাবছিলেন, কিন্তু কিছু বললেন না পাছে ভেরোনিকার সাথে কথা বলার সুযোগটা হাতছাড়া হয়।

“জ্বী, এটা ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে,” তিনি বললেন। “আমি নিজে একজন গৃহিণী এবং আমি জানি আমি কী নিয়ে কথা বলছি।”

“আমরা সকালে, দুপুরে ও রাতে খাই। আমরা দিনে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠি এবং সপ্তাহে এক দিন বিশ্রাম নেই। ক্রিসমাসে আমরা একে অন্যকে উপহার দেই, ইস্টার সানডে তে আমরা কয়েক দিন লেকে কাটাই। এমন যদি হয় আপনার স্বামী আকস্মিক আবেগের ঝোঁকে আপনার সাথে লিভিং রুমেই মিলিত হতে চাচ্ছেন, তাহলে কি সেটা আপনার ভালো লাগবে?”

ভদ্রমহিলা ভাবছিলেন: এ লোক কী সব বলছে! আমি এসেছি আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে।

“আমি বলবো এটা খুব হতাশাব্যঞ্জক ব্যাপার হবে,” সঠিক উত্তর দিচ্ছেন আশা করে ভদ্রমহিলা খুব সতর্কভাবে বললেন।

“চমৎকার,” ডা. ইগোর উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। “শোবার ঘর হচ্ছে মিলিত হওয়ার স্থান। যে কোন স্থানে মিলিত হতে চাওয়া হবে একটা বাজে উদাহরণ এবং এটা বিশৃঙ্খলাকে উৎসাহিত করবে।”

“আমি কি আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে পারি?” ভদ্রমহিলা আবার জানতে চাইলেন।

ডা. ইগোর থামলেন। এই চাষা কখনোই বুঝবে না তিনি কী সম্পর্কে বলছেন; এই মহিলা একটা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় একদমই আগ্রহী নন, যদিও তিনি জানেন যে তার মেয়ে একটা মারাত্মক আত্মহত্যা প্রচেষ্টা নিয়েছিলো এবং কোমাতে ছিলো। ড. ইগোর নিজের মনেই ভাবছিলেন।

তিনি বেল চেপে তার সেক্রেটারিকে ডাকলেন।

“সে তরুণীকে ডাকুন যে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো,” তিনি বললেন। “সে মেয়েটি, যে পত্রিকায় একটা চিঠি লিখেছিলো যে সে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে মানচিত্রে স্লোভেনিয়ার একটা স্থান করে দিতে।” 

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০