fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

চৌদ্দ

“আমি তার সাথে দেখা করতে চাই না। আমি বাইরের জগতের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছি।”

লাউঞ্জে সবার সামনে এভাবে বলাটা কঠিন। কিন্তু নার্সও তেমন সর্তক ছিলো না। সে উচ্চ কণ্ঠেই বলেছিলো যে, তার মা তার সঙ্গে দেখা করতে চায় যেন দেখা করতে চাওয়াটা একটা সাধারণ ব্যাপার।

ভেরোনিকা তার মা’র সাথে দেখা করতে চায় না; এটা শুধুমাত্র দু’ জনের মন খারাপ করিয়ে দিবে। এটাই ভালো হবে যদি তার মা ভেবে নেয় সে মারা গেছে। বিদায় বলাটা ভেরোনিকা সব সময়ই অপছন্দ করে এসেছে।

লোকটা যেখান থেকে এসেছিলো সেখানে চলে গেলো, আর ভেরোনিকা তাকিয়ে পাহাড় দেখতে লাগলো। এক সপ্তাহ পর সূর্য ফিরে এসেছে। এ রকম কিছু ঘটবে এটা সে গত রাতেই জানতো কেননা গত রাতে পিয়ানো বাজানোর সময় চাঁদ তাকে বলে রেখেছিলো।

না, এটা পাগলামি। আমি আমার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি। ভেরোনিকা ভাবছিলো। গ্রহ-নক্ষত্র কথা বলতে পারে না, অথবা শুধুমাত্র জ্যোতিষীদের সাথে বলে। তবে চাঁদ যদি কারো সাথে কথা বলে থাকে, তো সেটা ঐ সিজোফ্রেনিক এর সাথে বলে থাকতে পারে।

এ কথা যখন সে ভাবছিলো সে সময়ই সে তার হার্টে একটা তীক্ষ্ন ব্যথা অনুভব করলো, এবং তার বাহু অসাড় হয়ে গেলো। ভেরোনিকা অনুভব করছিলো তার মাথা ঘুরছে। হার্ট অ্যাটাক!

সে একটা পরম পুলকিত অবস্থায় প্রবেশ করলো যেন মৃত্যু তাকে মরে যাওয়ার ভীতি থেকে মুক্তি দিয়েছে। সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে এ বোধ। তার হয়তো আরো কিছু যন্ত্রণা হবে, কিন্তু চিরস্থায়ী শান্তির পরিবর্তে পাঁচ মিনিটের যন্ত্রণা আর কী? এ যন্ত্রণায় সাড়া দেয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে চোখ বন্ধ করে ফেলা: সিনেমাতে তার সবচেয়ে অপছন্দের জিনিস হচ্ছে মৃত লোকদের স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখা।

কিন্তু হার্ট অ্যাটাক তো সে যেমন ভেবেছিলো তার থেকে ভিন্ন; তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, এবং এটা বুঝে ভেরোনিকা ভয়ে অস্থির হয়ে গেলো। সে ভীতির প্রায় সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে: তার দম্ বন্ধ হয়ে আসছে। সে মারা যাচ্ছে যেন তাকে জীবিত মাটি চাপা দেয়া হয়েছে অথবা হঠাৎ-ই তাকে সমুদ্রের গভীরে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে।

ভেরোনিকা পড়ে গিয়ে তার মুখে একটা তীক্ষ্ন বাতাসে ঝাঁপটা অনুভব করলো। সে শ্বাস নেয়ার খুব চেষ্টা করছে, কিন্তু ফুসফুসে বাতাস ঢুকছে না। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার যেটা সেটা হচ্ছে মৃত্যু আসছে না। তার চারপাশে কী ঘটছে সেটা সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। সে বিভিন্ন রং ও আকৃতি দেখতে পাচ্ছে, অন্যরা কী বলছে তা শুনতে তার কষ্ট হচ্ছিলো; দূর থেকে চিৎকার ও উল্লাস ধ্বনি শোনা যাচ্ছিলো যেন অন্য পৃথিবী থেকে শব্দ আসছে। এগুলোর বাইরে সব কিছুই বাস্তব; বাতাস তার ফুসফুসে ঢুকছে না, তার ফুসফুস ও মাংসপেশী কোন নির্দেশই মানছে না, এবং এখনো সে চেতনা হারাচ্ছে না।

ভেরোনিকা অনুভব করছিলো কেউ তাকে স্পর্শ করেছে এবং তাকে ঘুরিয়ে ধরেছে, কিন্তু এখন সে তার চোখের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। তার চোখ হিংস্রভাবে বিস্ফোরিত হয়ে তার মস্তিষ্কে শতশত নানা রকম ছবি পাঠাচ্ছে যেগুলোতে দম্ বন্ধ অনুভূতির সাথে সম্পূর্ণ দৃষ্টির বিভ্রান্তি যুক্ত হয়েছে। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই ছবিগুলো দূরে সরে গেলো। যখন যন্ত্রণা এর চরম সীমায় পৌঁছালো, ঠিক তখনই বাতাস তার ফুসফুসে প্রবেশ করলো। একটা ব্যাপক গোলমালের শব্দে সবাই ভয়ে নিথর হয়ে গেলো।

ভেরোনিকা প্রচুর পরিমাণে বমি করতে শুরু করলো। একবার যখন ট্র্যাজেডি শেষ হয়ে গেলো উন্মাদ লোকগুলো হাসতে শুরু করলো। তাদের এই হাসিতে সে অপমানিত, নিঃস্ব ও অসাড় বোধ করলো।

একজন নার্স ছুটে এসে তাকে একটা ইনজেকশন দিলো।

“সব ঠিক আছে, শান্ত হও, এটা এখনই শেষ হয়ে যাবে।”

“আমি মরিনি!” সে চিৎকার শুরু করলো এবং মেঝে ও আসবাবপত্র বমিতে ভাসিয়ে সে হামাগুড়ি দিয়ে অন্য রোগীদের দিকে এগিয়ে গেলো। “আমি এখনো এই মরার হাসপাতালে তোমাদের সাথে জোর করে বেঁচে আছি; এভাবে বেঁচে থেকে আমি প্রতি দিন, প্রতি রাতে হাজার বার মারা যাচ্ছি, অথচ একজনও আমার জন্য এক বিন্দু কষ্ট পাচ্ছো না।”

সে নার্সের দিকে ঘুরে তার হাত থেকে সিরিঞ্জ টেনে নিয়ে বাগানে ছুড়ে ফেললো।

“আর আপনি কী চান? আমার যখন মৃত্যুই হবে আপনি কেন আমার শরীরে বিষ প্রবেশ করাচ্ছেন না? আপনি এতো নির্দয় কী করে হোন?”

নিজেকে খুব বেশিক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সে আবার মেঝেতে বসে পড়লো। সে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁদতে শুরু করলো, চিৎকার করলো, শব্দ করে ফোঁপালো। এ সময় কিছু রোগী হাসছিলো আর তার নোংরা পোশাক নিয়ে মন্তব্য করছিলো।

“তাকে একটা চেতনানাশক দাও,” একজন ডাক্তার দ্রুত প্রবেশ করে বললো। “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসো।”

নার্স পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন এবং আবার দুইজন পুরুষ নার্স ও একটা সিরিঞ্জ নিয়ে প্রবেশ করলেন। নার্সরা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মেয়েটাকে টেনে রুমের মধ্যখানে নিয়ে আসলো। এ সময় ডাক্তার তার বমি মাখা হাতে চেতনানাশক ইনজেকশন বসিয়ে দিলেন।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০