fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

পনেরো

ভেরোনিকা এখন ডা. ইগোর-এর কনসাল্টিং রুমে একটা পরিষ্কার ধবধবে বিছানায় একটা চাদরে ঢাকা অবস্থায় শুয়ে আছে।

ডা. ইগোর তার হার্টবিট শুনছেন। ভেরোনিকাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনো ঘুমে, কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে তার ভেতরে কিছু পরিবর্তন আসলো।

“চিন্তা করো না। তোমার স্বাস্থ্যের যে অবস্থা তাতে তুমি একশ বছর বাঁচবে।”

ভেরোনিকা চোখ মেললো। কেউ তার পরনের কাপড় খুলে নিয়েছে। কে? তার মানে কি ডাক্তার তাকে নগ্ন অবস্থায় দেখেছে? তার মাথা ঠিকভাবে কাজ করছিলো না।

“আপনি কী বললেন?”

“আমি বললাম দুশ্চিন্তার কিছু নেই।”

“না, আপনি বললেন যে আমি একশ বছর বাঁচতে পারি।”

ডাক্তার তার টেবিলে গিয়ে বসলেন।

“আপনি বলছেন আমি একশ বছর বাঁচতে পারি!” ভেরোনিকা আবার জানতে চাইলো।

“চিকিৎসা শাস্ত্রে নির্দিষ্ট বলে কিছু নেই,” ডা. ইগোর বিষয়টি চাঁপা দিতে দিতে বললেন। “যে কোন কিছুই সম্ভব।”

“আমার হার্টের অবস্থা কী?”

“একই রকম।”

তার আর কিছু জানার নেই। কোন সিরিয়াস কেসের মুখোমুখি হলে ডাক্তাররা সব সময়ই বলে থাকেন: “তুমি একশ বছর বাঁচবে,” অথবা “তোমার গুরুতর কিছু হয়নি,” অথবা “তোমার হার্ট আর রক্তচাপ একেবারে বাচ্চাদের মতো সতেজ রয়েছে,” কিংবা “আমাদের টেস্টগুলো আবার করতে হবে।” তারা হয়তো ভয় পায় যে রোগী প্রকৃত অবস্থা শুনলে কনসাল্টিং রুমেই প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।

সে উঠে বসার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না; সমস্ত রুম তার মাথায় চক্কর দিতে লাগলো।

“আর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকো যতক্ষণ না তুমি ভালো বোধ করছো। সমস্যা নেই, তুমি আমাকে জ্বালাতন করছো না।”

ও ঈশ্বর! ভেরোনিকা ভাবছিলো। আমি যদি জ্বালাতন করতে পারতাম!

একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে ডা. ইগোর তার টেবিলের কাগজপত্র পড়ার ভান করে কিছুক্ষণ নিঃশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন। যখন অন্য লোকজন থাকে এবং কোন কথাবার্তা হয় না তখন পরিস্থিতি আস্তে আস্তে বিরক্তিকর, চাপা উত্তেজনাপূর্ণ ও অসহনীয় হয়ে উঠে। ডা. ইগোর আশা করছেন মেয়েটি কথা বলা শুরু করবে যাতে করে তিনি বিকারগ্রস্ততা ও সুস্থতা বিষয়ে যে গবেষণাপত্র লিখছেন তার জন্য আরো কিছু তথ্য পেতে পারেন।

কিন্তু ভেরোনিকা কোন কথাই বলছে না। সে খুব সম্ভবত এখনো উচ্চ মাত্রার ভিট্রিওল বিষে ভুগছে, ডা. ইগোর ভাবছিলেন। তিনি নিরবতা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলেন, কেননা এটা আস্তে আস্তে চাপা উত্তেজনাপূর্ণ, বিরক্তিকর ও অসহনীয় হয়ে উঠছিলো।

“আচ্ছা, তুমি তো পিয়ানো বাজাতে পছন্দ করো,” যতটা সম্ভব নির্লিপ্ত কণ্ঠে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।

“পাগলরাও এটা উপভোগ করে। গতকাল একজন আমার পিয়ানো বাজানো শুনছিলো, মনে হচ্ছিলো এটা তার অন্তরে গিয়ে বিঁধেছে।”

“হ্যাঁ, এডোয়ার্ড। সে কয়েকজনকে বলেছে পিয়ানো বাজানোটা সে খুব উপভোগ করেছে। কে জানে সে হয়তো এ কারণে স্বাভাবিক ভাবে খাওয়া শুরু করবে।”

“একজন সিজোফ্রেনিক মিউজিক পছন্দ করছে? এটা আবার সে অন্যকে বলছেও?,” ভেরোনিকা একটু বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।

“হ্যাঁ। আমার মনে হয় তুমি কী বলছো সে সম্পর্কে তোমার কোন ধারণাই নেই।”

ডাক্তার – রং করা কালো চুলে যাকে রোগী বলে মনে  হয় – তিনি ঠিকই বলছিলেন। ভেরোনিকা হয়তো প্রায়ই ‘সিজোফ্রেনিক’ শব্দটি শুনে থাকবে, কিন্তু এর মানে সম্পর্কে কোন ধারণা তার নেই।

“এটা কি তাহলে সেরে যায়?” সিজোফ্রেনিক সম্পর্কে আরো কিছু জানার আশায় সে জিজ্ঞেস করলো।

“এটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বিকারগ্রস্তের জগতে কী ঘটে তা এখনো আমরা জানি না। সবকিছুই এখনো নতুন আর চিকিৎসা পদ্ধতিও প্রতি দশকেই পরিবর্তন হচ্ছে। একজন সিজোফ্রেনিক হচ্ছে এমন ব্যক্তি যে বাস্তব পৃথিবী থেকে নিজের অস্তিত্বকে মুছে ফেলার প্রবণতা ধারণ করে, যতক্ষণ না অন্য কোন কারণ – একেক জনের অবস্থার উপর নির্ভর করে কখনো গুরুত্বপূর্ণ, কখনো বা সামান্য কোন কারণ – তাকে তার নিজস্ব বাস্তবতা তৈরিতে বাধ্য করে। এটা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার একটা অবস্থা তৈরি করে যাকে আমরা বলি ক্যাটাটোনিয়া। তবে কখনো কখনো এ সমস্যা সেরে যায়, অন্ততঃ কাজ করার ও নিয়মিত জীবন যাপনের কাছাকাছি অবস্থায় রোগী পৌঁছাতে পারে। এর সব কিছুই নির্ভর করে একটা জিনিসের উপর, সেটা হচ্ছে পরিবেশ।”

“আপনি বলছেন তারা তাদের নিজস্ব বাস্তবতা তৈরি করে,” ভেরোনিকা জানতে চাইলো, “কিন্তু বাস্তবতা কী?”

“অধিকাংশ লোক কোন কিছু যেমন হওয়ার চিন্তা করে তেমন হওয়াটাই বাস্তবতা। এটা যে সবচেয়ে ভালো বা সবচেয়ে যৌক্তিক হতে হবে তা না, কিন্তু এটা এমন হতে হবে যেটা সার্বিক ভাবে সমাজের আকাঙ্ক্ষা পূরণকে সমর্থন করে। তুমি কী দেখতে পাচ্ছো আমার ঘাড়ের চারদিকে এটা কী?”

“আপনি কি টাই-এর কথা বলছেন?”

“ঠিক। তোমার উত্তর যৌক্তিক, একেবারে সামঞ্জস্যপূর্ণ, একজন সম্পূর্ণ সাধারণ ব্যক্তি যে উত্তর দিতো তা-ই: এটা একটা টাই! একজন পাগল এক্ষেত্রে বলবে আমার ঘাড় পেচিয়ে একটা হাস্যকর, অপ্রয়োজনীয় রঙিন কাপড়ের টুকরো যথেষ্ট জটিল ভাবে রেখে দেয়া হয়েছে যেটা আমার ফুসফুসে বাতাস প্রবেশে বাধা দিচ্ছে এবং আমার ঘাড় ঘুরানোটা কঠিন করে ফেলেছে। এ জন্য কোন ফ্যানের কাছাকাছি গেলে আমাকে সাবধান থাকতে হবে যেন এই কাপড়ের টুকরো আমার শ্বাসরোধের কারণ না হয়।

“একজন পাগল যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে এই টাই-এর কাজ কী, আমাকে বলতে হবে ‘কিছুই না’। এটা শুধু সাজসজ্জারই বস্তু না, বর্তমান কালে এটা একটা দাসত্ব, ক্ষমতা ও ব্যবধানের প্রতীক। টাই-এর একমাত্র বাস্তব ব্যবহারিক উদ্দেশ্য হচ্ছে মুক্তির আস্বাদ পাওয়া যখন তুমি বাসায় এসে এটা খুলে ফেলবে; যেন তুমি কোন কিছু থেকে নিজেকে মুক্ত করছো এমন অনুভূতি হবে তোমার, যদিও তুমি জানো না আসলেই তাই কি না।

“কিন্তু সেই মুক্তির আস্বাদ কি টাই-এর অস্তিত্বকে প্রমাণ করে? না। তারপরও যদি একজন বিকারগ্রস্ত ও বিকারহীন ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হয় এটা কী, তখন বিকারহীন ব্যক্তি বলবে ‘এটা টাই’। এটা এক্ষেত্রে ব্যাপার না যে কে সঠিক বা কোন বিষয়টি ঠিক,” ডা. ইগোর থামলেন।

“তাই যেহেতু আমি এক টুকরো রঙিন কাপড়ের সঠিক নাম বলতে পেরেছি, তাই আপনি সিদ্ধান্তে এসেছেন আমি পাগল নই,” ভেরোনিকা বললো।

না, তুমি পাগল নও, ডা. ইগোর ভাবছিলেন, যিনি এ বিষয়ে মূল কর্তৃপক্ষ এবং যার বিভিন্ন সার্টিফিকেট কনসাল্টিং রুমের দেয়ালে ঝুলছিলো। তুমি যে নিজের জীবন শেষ করে দিতে গিয়েছিলে তা মানুষ হিসেবে স্বাভাবিক। তিনি এমন অনেক মানুষকে চেনেন যারার এমন কাজ করতে গিয়েছেন এবং এখন হাসপাতালের বাইরের পৃথিবীতে বসবাস করছেন। তারা নিরীহ ও স্বাভাবিক একটা কপটাচারীর মুখোশ পরে রয়েছেন; শুধুমাত্র এ কারণে যে তারা আত্মহত্যার মতো মানহানিকর পন্থা বেছে নিতে চাননি। তারা নিজেদেরকে তিলে তিলে শেষ করে ফেলছেন বিষক্রিয়ার মাধ্যমে যে বিষকে ডা. ইগোর ‘ভিট্রিওল’ নাম দিয়েছেন।

ভিট্রিওল একটা বিষাক্ত উপাদান যার লক্ষণ ডা. ইগোর বিভিন্ন নারী-পুরুষদের সাথে আলাপকালে লক্ষ্য করেছেন। এখন তিনি এর উপর একটা গবেষণাপত্র লিখছেন যেটা তিনি স্লোভেনিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স-এ উপস্থাপন করবেন। এটা বিকারগ্রস্তের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা পদক্ষেপ হতে পারে যেহেতু ডা. পিনেল-এর নির্দেশনা রয়েছে যে রোগীদের মুক্তি দেয়া উচিত; যাতে করে চিকিৎসা জগতকে এ ধারণা দিয়ে বিস্মিত করা যায় যে, বিকারগ্রস্তদেরও সুস্থ করে তোলা যায়।

যৌন তাড়নার মতো – অর্থাৎ যৌনাকাঙ্ক্ষার জন্য দায়ী রাসায়নিক বিক্রিয়া যেটা ড. ফ্রয়েড চিহ্নিত করেছিলেন যদিও কোন গবেষণাগারে তা পৃথক করা সম্ভব হয়নি – ভিট্রিওল মানবঅঙ্গ দ্বারা মুক্ত হয় যখন কেউ নিজে চরম ভীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়; যদিও এটা এখনো কোন স্পেকট্রোগ্রাফিক টেস্টে তুলে আনা হয়নি। এর স্বাদ দ্বারা এটাকে সহজেই চিনতে পারা যায় যা মিষ্টিও না, নোনতাও না – তীক্ত স্বাদযুক্ত। ডা. ইগোর, এ মারাত্মক উপাদানের এখন-পর্যন্ত-অশনাক্তকৃত আবিষ্কারক, এর নাম দিয়েছেন এমন একটা বিষের নামে যেটা আগেকার দিনে সম্রাট, রাজা ও প্রেমিক-প্রেমিকারা সকল বাধার মুখে নিজেদেরকে মুক্ত করতে ব্যবহার করতো।

সে স্বর্ণালি সময়ে – রাজা ও সম্রাটদের যুগে – যে কেউ অনেক রোমান্টিক ভাবে বাঁচতে ও মরতে পারতো। হত্যাকারী ভিকটিমকে কোন জমকালো রাতের আয়োজনে নিমন্ত্রণ করতো। চাকররা দু’ টা চমৎকার গ্লাসে পানীয় বিতরণ করতো এবং যার  একটাতে ভিট্রিওল মেশানো থাকতো। ভিকটিমের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি – প্রতিটি চুমুক, প্রতিটি বাক্য – উত্তেজনা তৈরি করতো। গ্লাসগুলো যেন পরম সুস্বাদু পানীয় দিয়ে পূর্ণ, এ পানীয় আকণ্ঠ পান করে অতিথি এক সময় নিমন্ত্রণ কর্তার শেষ চকিত দৃষ্টি দেখতে দেখতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়তো।

কিন্তু সে বিষ এখন অনেক ব্যয়বহুল এবং পাওয়াও কষ্টসাধ্য। বর্তমান যুগে সেগুলো আরো বিধ্বংসী নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে যেমন, রিভলবার, ব্যাকটেরিয়া এবং এমন আরো অনেক কিছু। একজন প্রাকৃতিক রোমান্টিক চিকিৎসক ডা. ইগোর অন্ধকার থেকে এ নামকে পুনরুদ্ধার করে তার নির্ণয় করা আত্মার এ অসুখকে উৎসর্গ করেছেন এবং যে আবিষ্কার খুব শীঘ্রিই বিশ্বকে তাক্ লাগিয়ে দিবে।

এটা একটু অবাক করা বিষয় যে এখন পর্যন্ত ভিট্রিওলকে কেউ মরণঘাতি বিষ হিসেবে বর্ণনা করেনি যদিও আক্রান্ত অনেকেই এর স্বাদ বুঝতে পেরেছে এবং তারা এ ধরনের বিষক্রিয়াকে তিক্ততার সাথে তুলনা করেছেন। কম বেশি সবারই অঙ্গপ্রতঙ্গে কিছু তিক্ততা রয়েছে, যেমন আমরা সবাই যক্ষ্মার জীবাণু বহন করি। কিন্তু এ দু’টা রোগই তখনই আক্রমণ করে যখন রোগী বলহীন অবস্থায় থাকে। তিক্ততার ক্ষেত্রে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সঠিক সময় তখনই যখন একজন ব্যক্তি তথাকথিত বাস্তবতার ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে।

কিছু মানুষ বহিঃ হুমকি প্রতিহতকারী জগৎ তৈরির আগ্রহ থেকে বাইরের জগতের বিরুদ্ধে, নতুন লোকজনের, নতুন স্থানের, বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে নিজের ভেতর অতিরিক্ত শক্ত প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে এবং তাদের অন্তর্জগতকে একেবারে ফাঁকা করে ফেলে। তখন সেখানে তিক্ততার জন্ম হয় যা আর পরিবর্তন করা যায় না।

ইচ্ছাশক্তি হচ্ছে তিক্ততার (অথবা ভিট্রিওল, যে নামে ডা. ইগোর একে ডাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন) মূল লক্ষ্য। মানুষ এ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তার সমস্ত আকাঙ্ক্ষা হারাতে শুরু করে এবং কয়েক বছরের মধ্যে তারা তাদের জগত থেকে বের হয়ে আসতে অসামর্থ হয়ে পড়ে। এ জগতটাতে সুউচ্চ প্রাচীর দিকে তারা তাদের বিপুল শক্তির আধার গড়ে তোলে যেখানে তারা তাদের পছন্দ মতো বাস্তবতা তৈরি করে নেয়।

বাইরের জগতের আক্রমণকে এড়াতে তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই অন্তর্জগতের প্রসারকে সীমিত করে ফেলে। তারা কাজে যায়, টিভি দেখে, বাচ্চা-কাচ্চা নেয়, রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ে অভিযোগ করে কিন্তু এ সবই স্বয়ংক্রিয় ভাবে ঘটে। এর সাথে কোন নির্দিষ্ট আবেগের যোগসূত্র নেই, কেননা সবই চলে নিয়ন্ত্রিতভাবে।

তিক্ততা দ্বারা বিষক্রিয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বিভিন্ন আবেগ – বিদ্বেষ, ভালোবাসা, হতাশা, উদ্যম, কৌতুহল – এগুলোও তাদের সুস্পষ্ট প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। কিছু দিনের মধ্যে তিক্ততায় আক্রান্ত ব্যক্তির কোন কিছুর প্রতিই আর কোন আকাক্সক্ষা থাকে না। সে বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া যে কোন কিছুরই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, আর সেটাই হচ্ছে সমস্যা।

এ কারণে তিক্ততায় আক্রান্ত লোকেরা বীর ও পাগলদের প্রতি সব সময়ই আকর্ষণ বোধ করে। বীর ও পাগলরাই বিপদে উদাসীন এবং অন্যরা কী বললো তার তোয়াক্কা না করে যে কোন পথে এগিয়ে যেতে পারে। পাগলেরা আত্মহত্যা করে আর বীরেরা কোন কারণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে কারণ উভয়েই মরতে চায়। আর তিক্ততায় পূর্ণ ব্যক্তিটি এই অর্থহীনতা বা গৌরব উভয়ের চিন্তায় অনেক দিন ও রাত পার করে দেয়। একজন তিক্ততায় আক্রান্ত ব্যক্তি তার মনের প্রতিরক্ষা প্রাচীর বেয়ে যখন বহিঃ জগতটাকে দেখে তখন তার হাত-পা ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং সে আবারো তার নিয়মিত জীবনে ফিরে যায়।

সময়ের সাথে সাথে তিক্ততায় আক্রান্ত ব্যক্তি সপ্তাহে মাত্র একদিন তার অসুস্থতা দেখতে পায়, হয়তো রবিবার বিকালে। এরপর আর কোন কাজে বা নিয়মিত জীবনে লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় তার কাছে কিছু বিষয় বেশ সমস্যা বলে মনে হয়, কেননা সে তখন বিকালের নিত্য শান্তির মাঝে নারকীয়তা খুঁজে পায় এবং অবিরাম একটা তীক্ষ্ন বিরক্তি বোধ করতে থাকে।

এরপর সোমবার আসলে সে তার লক্ষণগুলো ভুলে যায়, যদিও সে তখনো এ বলে আক্ষেপ করতে থাকে যে, সে বিশ্রাম নেয়ার সময়ই পায়নি এবং ছুটির দিনটা দ্রুতই শেষ হয়ে গেলো।

সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ রোগের একমাত্র সুবিধা হচ্ছে এটা নিয়মে পরিণত হয় এবং সব ক্ষেত্রে অন্তরণের প্রয়োজন পড়ে না যদি না বিষক্রিয়ার প্রভাব এতোটা মারাত্মক হয় যে রোগীর আচরণ অন্যদের উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে। তিক্ততায় আক্রান্ত বেশির ভাগ লোকই সমাজের বা অন্য কারো জন্য কোন হুমকি না হয়ে বাইরেই বসবাস করতে থাকে। কারণ তারা তাদের মনের সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা নিজেদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখে যেটা বহিঃ জগত থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন, যদিও তাদের দেখলে মনে হয় তারা বহিঃ জগতে অংশগ্রহণ করতে চায়।

ড. সিগমন্ড ফ্রয়েড যৌন তাড়না উদ্ভাবন করেছিলেন এবং একটা মনোবিশ্লেষণের আকারে এ সমস্যার পেছনের কারণ নিরাময় করেছিলেন। ভিট্রিওল-এর উদ্ভাবন ছাড়াও ডা. ইগোরকে প্রমাণ করতে হবে যে, এটার নিরাময়ও সম্ভব। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে তার নাম লিখে রেখে যেতে চান, যদিও এ ধারণা প্রকাশের ক্ষেত্রে উনাকে যে সব বাঁধার মুখোমুখি হতে হবে সে বিষয়ে উনার কোন বিভ্রান্তি ছিলো না। যেমন, ‘স্বাভাবিক’ মানুষ তাদের জীবন নিয়ে চলে এবং তারা নিজেদের জীবনে কোন অসুস্থতার অস্তিত্ব মানবেন না; আবার ‘অসুস্থ’ মানুষ দিয়ে মানসিক হাসপাতাল, গবেষণাগার, কনফারেন্স এবং এমন আরো অনেক স্থান পূর্ণ।

আমি জানি এ বিশ্ব আমার প্রচেষ্টাটা বুঝতেই পারবে না, ভুল বোঝাবুঝির শিকার হওয়ার গর্বে তিনি নিজে নিজেই বলছিলেন। কী আর করা, সব জিনিয়াসকে এভাবেই মূল্য দিতে হয়। ডা. ইগোর ভাবছিলেন।

“ডা. ইগোর, কোন সমস্যা?” মেয়েটি বললো। “আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে রোগীদের জগতে আপনি ভেসে যাচ্ছেন।”

ডা. ইগোর এ অসম্মানজনক মন্তব্যকে গা করলেন না।

“তুমি এখন যেতে পারো,” তিনি ভেরোনিকাকে বললেন।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০