fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

ষোল

ভেরোনিকা বুঝতে পারছিলো না এখন রাত না দিন। ডা. ইগোর অন্য সব সকালের মতোই বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। সে যখন করিডোরে এসে চাঁদ দেখলো, তখন বুঝতে পারলো যে যতটা ভেবেছিলো তার চেয়ে অনেক লম্বা সময় সে ঘুমিয়েছে।

ওয়ার্ডে যাওয়ার পথে দেয়ালে ঝুলানো একটা ছবি তার নজরে পড়লো। এটা ছিলো ল্যুবল্জানা’র মূল স্কয়ারের ছবি, ছবিতে কবি প্রিজেরেন-এর ভাস্কর্যের সামনের অংশটা তোলা হয়েছে; দম্পতিদের হেঁটে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে, খুব সম্ভবতঃ কোন এক রবিবারের ছবি।

সে ছবিটার তারিখের দিকে তাকালো: ১৯১০ এর গ্রীষ্মকাল।

১৯১০ এর গ্রীষ্মকাল। এসব লোকজন, তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনীরা মারা গিয়েছে, কিন্তু তাদের জীবনের একটা মূহুর্ত স্থির হয়ে রয়েছে। মহিলারা বড় বড় ঝোলানো পোশাক পরে আছেন আর পুরুষরা হ্যাট, জ্যাকেট, পায়ের গোড়ালি ঢাকা পট্টি, টাই (অথবা, “রঙিন কাপড়ের টুকরো” যেমনটা বিকারগ্রস্তরা বলে) পরে আছেন এবং বগলের নীচে ছাতা বহন করছেন।

কেমন গরম ছিলো তখন? গ্রীষ্মের আজকের দিনের মতো হয়তো তাপমাত্রা ছিলো তখন, প্রায় পঁচানব্বই ডিগ্রি ফারেনহাইট। ঐ ইংরেজ লোকটার পোশাক কি তাপমাত্রার সাথে বেশি মানানসই – বারমুডা হাফপ্যান্ট আর শার্টস্লিভ পরিহিত – তখন লোকজন কী ভাবতো?

“সে নিশ্চয়ই পাগল,” ভেরোনিকা ভাবছিলো।

ডা. ইগোর যা বুঝিয়েছেন সে তা পুরোপুরিই বুঝতে পেরেছে। সে বুঝেছে যদিও সবসময় নিজের প্রতি অন্যের ভালোবাসা ও সুরক্ষা অনুভব করেছে তবুও কিছু একটার অভাব ভালোবাসাকে আশীর্বাদে পরিণত করেছে। তার নিজেকে কিছুটা বিকারগ্রস্ত হিসেবে মেনে নেয়া উচিত।

তার মা-বাবা এখনো তাকে ভালোবাসে, কিন্তু তাদের কষ্ট দেয়া হবে এ ভয়ে নিজের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দেয়া ঠিক হবে না। তার স্বপ্ন তার স্মৃতির গভীরে চাপা পড়েছে, তবে মাঝে মধ্যে কোন কনসার্ট বা কোন সুন্দর রেকর্ড যেটা সে প্রায়ই শুনে – এ সবের কারণে স্বপ্নগুলো জেগে উঠতে চায়। যখনই এমনটা ঘটে তখন তার হতাশা বোধটা এতো তীব্র হয় যে সে তাৎক্ষণিকভাবে এটাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

ভেরোনিকা ছোট বেলা থেকেই জানতো, তার সত্যিকার ঝোঁক পিয়ানোবাদক হওয়া।

বারো বছর বয়সে তার যখন প্রথম হাতে খড়ি হয় তখনই এটা তার মনে হয়েছিলো। তার শিক্ষকও এটা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাকে একজন পেশাজীবী শিল্পী হতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কিন্তু তারপর একটা প্রতিযোগিতা জিতে খুশিতে সে তার মাকে যখন বললো যে, সে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পিয়ানো বাজানোতে মনোনিবেশ করতে চায়, তখন তার মা তার দিকে স্নেহের দৃষ্টি দিয়ে বললো, “কেউই পিয়ানো বাজিয়ে জীবন চালাতে পারে না, মা।”

“কিন্তু তুমিই তো চেয়েছিলো আমি পিয়ানো বাজাতে শিখি।”

“সেটা তো তোমার শিল্পী সত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলতে। একজন স্বামী তার স্ত্রীর মধ্যে এ ধরনের গুন থাকা পছন্দ করে; সে তাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করতে পারে। পিয়ানোবাদক হওয়ার বিষয়টা ভুলে গিয়ে তুমি আইন পড়ো, এটাই ভবিষ্যতের পেশা।”

ভেরোনিকা তার মা’র কথা মতোই কাজ করেছে, এ ব্যাপারে তার বিশ্বাস ছিলো যে, তার মা’র জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। সে তার পড়ালেখা শেষ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছে, একটা ভালো ডিগ্রী নিয়েছে এবং একজন লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ নিয়ে এর সমাপ্তি টেনেছে।

“আমার আরো পাগলামি করা উচিত ছিলো।” কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই যেমন ঘটে, তার মনে হলো অনেক দেরি হয়ে গেছে।

সে যখন করিডোরে তার পথ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া ধরলো তখনই কেউ একজন তার হাত ধরে টানলো। শক্তিশালী চেতনানাশক এখনো তার রক্তে; তাই যখন সেই সিজোফ্রেনিক এডোয়ার্ড তাকে খুব ভদ্রভাবে টেনে নিয়ে অন্য দিকে – লিভিং রুমের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো সে কোন বাঁধা দিতে পারলো না।

চাঁদ এখনো নতুন এবং ভেরোনিকা এডোয়ার্ড-এর নিরব অনুরোধে ততক্ষণে পিয়ানোর সামনে বসে পড়েছে। খাবার ঘর থেকে কারো কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, পুরোপুরি বিদেশি উচ্চারণে কথা বলছে। ভেরোনিকা ভিলেট-এ এই কণ্ঠস্বর এর আগে শুনেছে বলে মনে করতে পারছে না।

“আমার এখন পিয়ানো বাজাতে ইচ্ছা করছে না এডোয়ার্ড। আমি জানতে চাই পৃথিবীতে কী ঘটছে, তারা কী নিয়ে কথা বলছে, ঐ লোকটাই বা কে।”

এডোয়ার্ড হাসলো, খুব সম্ভবতঃ ভেরোনিকা যা বলেছে তার এক বর্ণ সে বোঝেনি। ভেরোনিকার ডা. ইগোরের কথাটা মনে পড়ে গেলো: সিজোফ্রেনিকরা তাদের ভিন্ন বাস্তবতায় যাতায়াত করতে পারে।

“আমি মারা যাচ্ছি,” ভেরোনিকা বলতে লাগলো। এবার তার কথা সে বুঝতে পারবে বলে মনে হয়। “আজকে মৃত্যু আমায় ছুঁয়ে গেছে এবং আগামীকাল যদি আমার দরজায় ধাক্কা নাও দেয় এরপর খুব শীঘ্রি দিবে। তাই আমার কাছ থেকে প্রতি রাতে পিয়ানো বাজানো শোনাটা তোমার জন্য খুব ভালো কাজ হবে না।”

“কারোরই কোন কিছুতে অভ্যস্ত হওয়া উচিত না, এডোয়ার্ড। আমাকে দেখো: আমি আবার রোদটাকে উপভোগ করতে শুরু করেছি, এই পাহাড়কে উপভোগ করতে শুরু করেছি, এমন কি জীবনের সমস্যাগুলোকেও। আমার জীবনের অর্থহীনতার জন্য আর কেউ নয় আমি-ই দায়ী এটা আমি মেনে নিতে শুরু করেছি। আমি ল্যুবল্জানা’র মূল স্কয়ারকে আবার দেখতে চাই, আবার বিদ্বেষ ও ভালোবাসা অনুভব করতে চাই, আবার হতাশা ও ক্লান্তি অনুভব করতে চাই। এ সব কিছুই খুব সাধারণ, অর্থহীন জিনিস প্রতি দিনকার জীবনে, কিন্তু এগুলো তোমাকে অস্তিত্বের আনন্দ দেয়। আমি যদি কোনদিন এ জায়গা থেকে বের হতে পারি, তাহলে আমি নিজেকে পাগল বলে মেনে নিবো। প্রত্যেকেই বিকারগ্রস্ত, কিন্তু সবচেয়ে বেশি বিকারগ্রস্ত তারা যারা নিজেরা জানে না যে, তারা বিকারগ্রস্ত; তারা অন্যরা যা বলে তাই করে যায়।

“কিন্তু এগুলো কিছুই সম্ভব নয়, বুঝতে পারছো? একই ভাবে, তোমারও সারাদিন রাতের জন্য অপেক্ষা করা উচিত না। অথবা এমন একজন রোগীর জন্য অপেক্ষা করা উচিত না যে তোমাকে পিয়ানো বাজিয়ে শোনাবে, কারণ সে দিনটা খুব শীঘ্রিই শেষ হয়ে আসবে। আমার আর তোমার পৃথিবী শেষ হওয়ার পথে।”

সে উঠে দাঁড়ালো, আলতো করে ছেলেটার মুখটা ছুঁয়ে দিলো, এরপর খাবার ঘরে চলে গেলো।

খাবার ঘরের দরজা খুলে ঢুকে সে একটা অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখলো। খাবার ঘরের টেবিল চেয়ারগুলো পেছনে দেয়ালের দিকে ঠেলে দিয়ে মাঝখানে একটা বড় জায়গা করা হয়েছে। সেখানে মেঝেতে বসে ভাতৃসংঘের সদস্যরা স্যুট টাই পড়া এক ভদ্রলোকের কথা শুনছে।

“… তারপর তারা সুফিজমের মহান গুরু নাসরুদ্দিনকে একটা বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানালো,” তিনি বলে যাচ্ছিলেন।

ভেরোনিকা দরজা খুলে ঢোকার সময় সবাই তার দিকে ঘুরে তাকালো। স্যুট টাই পরা ভদ্রলোকটি বললেন, “বসুন।”

সে সাদা চুলের সেই ভদ্রমহিলা, মারি’র পাশে মেঝেতে বসে পড়লো। তার সাথে মারি’র প্রথম সাক্ষাতে মারিকে বেশ আগ্রাসী মনে হয়েছিলো। ভেরোনিকা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো মারি তার দিকে তাকিয়ে একটা প্রশ্রয়ের হাসি দিলো।

স্যুট পরা ভদ্রলোক বলে যাচ্ছিলেন: “নাসরুদ্দিন বেলা দু’ টার সময় একটা বক্তৃতা দেয়ার আয়োজন করলেন, এবং এটা আয়োজকদের জন্য একটা বড় সাফল্য বলে মনে করা হচ্ছিলো। এক হাজার সিটের সবগুলোর টিকেট বিক্রি হয়ে গিয়েছিলো। এছাড়া আরো সাতশ’ লোক বাইরে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় বক্তৃতা দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

“ঠিক দু’ টার সময় নাসরুদ্দিনের একজন সহকারী এসে জানালেন যে, অনিবার্য কারণে বক্তৃতা শুরু হতে দেরি হবে। কেউ কেউ রুষ্ট হয়ে উঠে গেলেন, তাদের টিকেটের টাকা ফেরত চাইলেন এবং সব শেষে সভাস্থল ত্যাগ করে চলে গেলেন। এরপরও অনেক লোক সভাস্থলের ভেতরে ও বাইরে অপেক্ষা করছিলেন।

“বিকাল চারটা বেজে গেলো, কিন্তু সুফি সম্রাট তখনো উপস্থিত হলেন না। লোকজন আস্তে আস্তে টাকা ফেরত নিয়ে স্থান ত্যাগ করতে লাগলো। কার্যদিবস শেষ হয়ে গেলো; বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে আসলো। ছয়টা নাগাদ মূল সতেরশ’ দর্শকের সংখ্যা কমে একশ’ তে নেমে আসলো।

“এ সময় নাসরুদ্দিন প্রবেশ করলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো তিনি পাঁড় মাতাল এবং ঢুকেই তিনি প্রথম সারিতে বসা একজন সুন্দরী ভদ্রমহিলার সাথে প্রগল্ভতা শুরু করলেন।

“যারা অবশিষ্ট ছিলেন তারা এ আচরণে অবাক হয়ে গেলেন এবং রুষ্ট হয়ে উঠলেন। কী করে একজন লোক নিখুঁত চার ঘন্টা অপেক্ষা করানোর পর এমন আচরণ করতে পারেন? সভাস্থলে কিছু বৈরি গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো কিন্তু সুফি সম্রাটট সেটা পাত্তাই দিলেন না। তিনি আরো উচ্চ স্বরে বলে যেতে লাগলেন যে, এই তরুণী কতটা কামোত্তেজক, এবং তিনি তাকে তার সাথে ফ্রান্সে যাওয়ার আমন্ত্রণ দিলেন।

“কেমন শিক্ষক! ভেরোনিকা ভাবছিলো। আমি তো এটা বিশ্বাসই করতে পারছি না।

“যারা তার আচরণে আঙ্গুল তুলছিলো তিনি তাদের অভিশাপ দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে দরাম করে মেঝেতে পড়ে গেলেন। চরম বিরক্ত হয়ে আরো লোকজন সভাস্থল ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন আর বলতে লাগলেন, এ তো চরম ভণ্ডামি; তারা পত্রিকায় এর নিন্দা ও অধঃপতনের বিষয়টি ব্যাপক ভাবে বলবেন।

মাত্র নয়জন ব্যক্তি বসে রইলেন। যখনই চূড়ান্ত অত্যাচারিত দর্শক দল অবশিষ্ট থাকলো, তখনই নাসরুদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন। এখন তিনি সম্পূর্ণ ভদ্র, তার দৃষ্টিও উজ্জ্বল এবং তার নিজের উপর কর্তৃত্ব ও প্রজ্ঞার ছাপ দেখা যেতে লাগলো। “আপনাদের মধ্যে যারা রয়ে গেছেন, তারাই আমার কথা শুনবেন,” তিনি বললেন। “আপনারা আত্মিক যাত্রায় দু’ টা কঠিন পরীক্ষা উৎরে এসেছেন: সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ এবং সম্মুখ পরিস্থিতিতে হতাশ না হওয়ার সাহস প্রদর্শন। আপনাদেরকেই আমি শেখাবো।”

“এরপর নাসরুদ্দিন তাদের সাথে কিছু সুফি কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করলেন।”

ভদ্রলোক থামলেন এবং পকেট থেকে একটা অদ্ভুত বাঁশি বের করলেন।

“আসুন, আমরা একটা ছোট্ট বিরতি নেই, এরপর আমরা আমাদের ধ্যান করবো।”

দলের সদস্যরা উঠে দাঁড়ালো। ভেরোনিকা বুঝতে পারছিলো না কী করবে।

“তুমিও উঠো,” মারি তার হাত টেনে ধরে বললো। “আমাদের পাঁচ মিনিট বিরতি।”

“আমি চলে যাবো, আমি এখানে থাকতে চাই না,” ভেরোনিকা বলে উঠলো।

মারি তাকে এক কোনায় নিয়ে গেলো।

“তুমি মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়েও কিছু শিখোনি? সব সময় তুমি তোমার আশে পাশের মানুষকে বিরক্ত করছো – এটা ভাবা বন্ধ করো। লোকজন পছন্দ না করলে এমনিই অভিযোগ করবে। কিন্তু যদি তাদের অভিযোগ করার সাহস না থাকে তো সেটা তাদের সমস্যা।”

“ঐ দিন আমি যখন আপনার কাছে আসলাম, তখন আমি এমন কিছু করেছিলাম যেটা আমি আমার জীবনে কখনো করার সাহস দেখাইনি।”

“আর তুমি একটা পাগলের ঠাট্টায় ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলে। কেন তুমি শক্ত হয়ে প্রতিবাদ করলে না? তুমি হেরে গেলে কেন?”

“যেখানে আমি প্রত্যাশিত নই, সেখানে আমার সম্মানের কথা ভেবে আমি কিছু করতে পারিনি।”

“কিসের সম্মান? তুমি চাচ্ছিলে সবাই তোমাকে ভালো, সুসভ্য এবং ভালোবাসায় পূর্ণ মানুষ ভাবুক। তুমি প্রকৃতির প্রতি কিছু সম্মান রাখো, পশুপাখির কিছু সিনেমা দেখো, আর লক্ষ্য করো তারা কী করে নিজের অবস্থান তৈরি করতে লড়াই করে। তোমার সেদিনের চড় মারাকে কিন্তু আমরা মন থেকেই নিয়েছি।”

ভেরোনিকার অবস্থান তৈরি করে নেয়ার জন্য লড়াই-এর অবকাশ নেই। তাই সে প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলো ঐ স্যুট পরা ভদ্রলোকটি কে।

“তোমার উন্নতি হচ্ছে,” মারি হাসতে হাসতে বললো। “হঠকারিতা হচ্ছে কি না তা বিবেচনা না করেই তুমি এখন প্রশ্ন করছো। সে একজন সুফি সম্রাট।”

“‘সুফি’ মানে কী?”

“উল।”

ভেরোনিকা না বুঝে জিজ্ঞেস করলো, “উল?”

“সুফিবাদ হচ্ছে দরবেশদের একটি আত্মিক ঐতিহ্য। এর গুরুরা কখনো তাদের জ্ঞান প্রদর্শন করেন না, এবং তাদের অনুসারীরা তাদের সমাধিতে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করতে যায়।”

“এর অর্থ কী?”

“আমি ঠিক জানি না। তবে আমাদের দল সব নিষিদ্ধ অভিজ্ঞতা অনুসন্ধান করে সমাধান করতে চায়। সারা জীবন সরকার আমাদের শিখিয়েছে যে, জীবনের আত্মিক অর্থ খোঁজার একমাত্র উপায় হচ্ছে মানুষকে তাদের প্রকৃত সমস্যাকে ভুলিয়ে দেয়া। এখন তুমিই আমাকে বলো: তোমার কি মনে হয় না যে জীবনকে বোঝার চেষ্টা করাটা প্রকৃত সমস্যা?”

হ্যাঁ, তাই-ই হয়তো; যদিও ভেরোনিকা নিশ্চিত না ‘প্রকৃত’ শব্দের মানে কী।

বিরতি শেষে স্যুট পরা ভদ্রলোকটি – মারি’র ভাষ্যমতে একজন সুফি সম্রাট – তাদের সবাইকে বৃত্তাকারে বসতে বললো। একটা ফুলদানি থেকে সে একটা ফুল ছাড়া সব ফুল সরিয়ে ফেললো, এবং সেটা বৃত্তের কেন্দ্রে নিয়ে রাখলো।

“খেয়াল করেছো আমরা কত উন্নতি করেছি?” ভেরোনিকা মারিকে বললো। “কিছু বিকারগ্রস্ত মানুষ সিদ্ধান্ত নিলো শীতকালে গোলাপ চাষ করার, আর এখন সমস্ত ইউরোপ জুড়ে আমরা সারা বছর গোলাপ পাচ্ছি। তোমরা কি মনে হয় একজন সুফি সম্রাট তার সমস্ত জ্ঞান দিয়ে এটা করতে পারতো?”

মারি ভেরোনিকার ভাবনা অনুমান করতে পারছিলো।

“তোমার সমালোচনা জমিয়ে রাখো।”

“আমি চেষ্টা করবো। যদিও এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্যটুকুই রয়েছে।”

“সবার এমন সংক্ষিপ্তই থাকে। অবশ্য কোন কোন লোক আছে যারা অতীতের সবকিছু একত্র করতে পারে আবার কেউ কেউ ভবিষ্যতের জন্য একত্র করে রাখতে পারে। যাই হোক, বর্তমানের কথা বলছিলে, তুমি কি নিজেকে খুব বেশি কামোত্তেজিত করো?”

যদিও তার উপর চেতনানাশকের প্রভাব কাটেনি, ভেরোনিকা সাথে সাথে মনে করতে পারলো এই ভিলেট-এ তাকে প্রথম কোন কথাটা শুনতে হয়েছিলো।

“যখন আমাকে প্রথম এখানে আনা হয় এবং আমাকে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র দিয়ে টিউবের মাধ্যমে রেখে দেয়া হয়েছিলো তখন আমি স্পষ্ট শুনলাম কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি কামোত্তেজিত হতে চাই কি না। এগুলোর মানে কী? তোমাদের মতো লোকজন সব সময় এসব চিন্তা নিয়ে পড়ে থাকে কেন?

“বাইরেও তো একই রকম; এখানের ব্যাপার হচ্ছে এখানে কেউ কোন কিছু লুকিয়ে রাখে না।”

“তুমিই কি এটা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?”

“না, তবে আমার মনে হয় আনন্দ লাভ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তোমার যাচাই করা উচিত তুমি কত দূর যেতে পারো। তাহলে পরবর্তীতে তোমার সঙ্গীর দ্বারা পরিচালিত না হয়ে তুমি একটু ধৈর্য সহকারে সঙ্গীকে সে পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে। এমন কি তোমার জীবনের শেষ মূহুর্ত আসতে যদি আরো দু’ দিনও সময় থাকে আমার মনে হয় না তুমি কত দূর যেতে পারো এটা না জেনেই তোমার চলে যাওয়া উচিত।”

“আমার সঙ্গী তো কেবল একজন সিজোফ্রেনিক যে কি না আমার কাছ থেকে আবারো পিয়ানো শুনতে অপেক্ষা করছে।”

“সে কিন্তু দেখতে দারুন।”

স্যুট পরা ভদ্রলোকটি তাদের আলোচনায় বাঁধা দিলো এবং চুপ থাকতে বললো। সে তাদের সবাইকে গোলাপ ফুলটার দিকে মনোযোগ দিতে বললো এবং মনকে ফাঁকা করতে বললো।

“চিন্তা ফিরে আসবে, কিন্তু চেষ্টা করুন তাকে এক পাশে সরিয়ে রাখতে। আপনার হাতে দু’টা উপায় রয়েছে: মনকে নিয়ন্ত্রণ করা অথবা মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া। পরেরটার অভিজ্ঞতার বিষয়ে আপনারা পরিচিত; ভীতি, দুশ্চিন্তা, নিরাপত্তাহীনতার দ্বারা নিজেদের আক্রান্ত করে আমাদের মাঝে আত্ম-বিধ্বংসী প্রবণতার জন্ম হয়েছে।

“বিকারগ্রস্ততার সাথে নিয়ন্ত্রণহীনতার তালগোল পাকাবেন না। মনে রাখবেন সুফিবাদে সম্রাট নাসরুদ্দিনকে সবাই পাগল বলে জানতো। আসলেই তিনি তাই ছিলেন কারণ তার প্রতিবেশীরা তাকে বিকারগ্রস্ত হিসেবেই বিবেচনা করতো এ কারণে যে, নাসরুদ্দিন যেমন চাইতো তেমনই চিন্তা করতো ও বাস্তবেও তাই করতো। এরকম ছিলো মধ্যযুগে রাজসভার ভাঁড়েরা: তারা রাজাকে সতর্ক করতো এই বলে যে মন্ত্রীরা তাদের পদ হারানোর ভয়ে সব বিষয়ে মন্তব্য করার সাহস রাখেন না। 

“আপনার ক্ষেত্রেও এমনই হওয়া উচিত; বিকারগ্রস্ত হোন কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো আচরণ করুন। অন্যরকম হওয়ার ঝুঁকি নিন, কিন্তু মনোযোগ আকর্ষণ না করে কী করে তা করতে হয় তাও শিখুন। ফুলের দিকে মনোযোগ দিন এবং প্রকৃত ‘আমিত্ব’কে মুক্ত হতে দিন।”

“প্রকৃত ‘আমিত্ব’ কী?” ভেরোনিকা জানতে চাইলো। হয়তো এখানকার সবাই-ই জানে, কিন্তু তাতে কী। অন্যের বিরক্তিকে কম গুরুত্ব দেয়া তাকে শিখতে হবে।

ভদ্রলোকটি বাঁধা পেয়ে বিস্মিত হয়েছেন বলে মনে হলো, তবে তিনি ভেরোনিকার প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

“প্রকৃত ‘আমিত্ব’ হচ্ছে যেটা আপনি নিজে, অন্যরা যে ‘আপনাকে’ তৈরি করেছে সেটা না।”

ভেরোনিকা ধ্যানচর্চার সিদ্ধান্ত নিলো। সে কঠোরভাবে মনোযোগী হতে চেষ্টা করতে লাগলো যেন সে আবিষ্কার করতে পারে সে কে। ভিলেট-এর দিনগুলোতে সে কিছু জিনিস এতো তীব্র ভাবে অনুভব করেছে যেটা সে আগে কখনো করেনি – বিদ্বেষ, ভালোবাসা, ভীতি, কৌতুহল, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা। খুব সম্ভবতঃ মারিই ঠিক: সে কি সত্যিই জানে চরম কামোত্তেজনা কী? না কি সে শুধুমাত্র একজন পুরুষ তাকে নিয়ে যতটুকু আনন্দ পেতে চায় ততটুকুই কেবল উপভোগ করেছে?

ভদ্রলোকটি বাঁশি বাজাতে শুরু করলো। ক্রমেই তার মন শান্ত হয়ে এলো এবং সে গোলাপটির দিকে মনোযোগ দিতে পারলো। এটা চেতনানাশক ওষুধের প্রভাব হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে সে ডা. ইগোর-এর কনসাল্টিং রুম থেকে বের হওয়ার পর থেকে সে সুস্থ বোধ করছিলো।

সে তো জানে সে মারা যাচ্ছে, তাহলে ভয় কিসের? এটা তো তাকে কোন সাহায্য করতে পারবে না, এটা মারাত্মক হার্ট অ্যাটাকও আটকাতে পারবে না। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো কাজ হবে যে ঘন্টাগুলো ও দিনগুলোকে অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলো সে আগে কখনো যা করেনি তা করে উপভোগ করে যাওয়া।

খুব শান্ত বাজনা বেজে যাচ্ছে, আর খাবার ঘরের মৃদু আলোটা প্রায় একটা ধর্মীয় পরিবেশ তৈরি করেছে। সে কেন তার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করছে না এবং তার মত ও বিশ্বাস এর কতটুকু বাকি তা যাচাই করছে না?

সুরটা তাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছিলো: মনটা ফাঁকা করুন, অন্য সব কিছু চিন্তা থেকে বিরত থাকুন, শুধুমাত্র আপনি থাকুন। ভেরোনিকা নিজেকে দিয়ে অভিজ্ঞতা নিতে চাইলো; সে এক দৃষ্টিতে গোলাপের দিকে তাকিয়ে রইলো, নিজেকে দেখতে পেলো, ভালোও লাগলো। তবে তাড়াহুড়া করায় তার আক্ষেপও হলো।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০