fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

ঊনিশ

মারি কখনোই মরতে চায়নি। বরঞ্চ পাঁচ বছর আগে আজকের সেই সিনেমা হলে সে এল সালভেদর এর দারিদ্র্যের উপর একটা সিনেমা দেখতে গিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো এবং মনে হয়েছিলো তার জীবনটা কত গুরুত্বপূর্ণ। সে সময় – তার ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে এবং তাদের নিজেদের পেশায় ঢুকতে যাচ্ছে – এমন সময় সে কিছু মানবহিতৈষী প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তার একঘেঁয়েমিপূর্ণ আইনজীবীর পেশা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবছে। তখন দেশে গৃহযুদ্ধের জনরব সব সময় বেড়েই চলছিলো, যদিও মারি’র কাছে সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিলো না। এটা প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছিলো যে এই বিংশ শতাব্দির শেষ লগ্নে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার দ্বারপ্রান্তে একটা নতুন যুদ্ধকে অনুমোদন করবে।

অন্যদিকে পৃথিবীতে ট্র্যাজেডির শেষ নেই। এমনই এক ট্র্যাজেডি হলো এল সালভেদর যেখানে বাচ্চারা বাঁচার জন্য রাস্তায় পড়ে আছে আর পতিতালয়ের দিকে যাচ্ছে।

“ভয়ঙ্কর অবস্থা,” সিনেমা হলে তার পাশে বসা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে মারি বললো।

তার কথা শুনে তার স্বামী মাথা নাড়লো।

মারি মানবহিতৈষী সংস্থায় কাজ করার সিদ্ধান্তটা অনেক দিন এক পাশে সরিয়ে রেখেছিলো, কিন্তু সম্ভবতঃ এটা নিয়ে কথা বলার সময় হয়েছে। তাদেরকে তো জীবন সম্ভাব্য ভালো জিনিসগুলো দিয়েছে: বাড়ি, কাজ, সুন্দর সন্তান, পরিমিত স্বস্তি, কৌতুহল ও ঐতিহ্য। এর মূল্য পরিশোধের জন্য হলেও অন্যদের জন্য কিছু করা নয় কেন তবে? মারি এর আগে রেড ক্রসের সাথে যোগাযোগ করেছিলো, সে জানতো যে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এদের স্বেচ্ছাসেবীর প্রয়োজন হয়।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর আইন-কানুন নিয়ে লড়াই করে মারি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু যে সব মানুষ বছরের পর বছর তাদের নিজের চেষ্টায় জীবনের সমস্যাগুলো কোন সমাধান করতে পারেনি তাদের জন্য কোন সাহায্যই করতে পারেনি। রেড ক্রসের সাথে কাজ করে সে তাৎক্ষণিক ফল দেখতে পেয়েছিলো।

মারি ঠিক করলো যখন সিনেমা শেষে বের হবে তখন তার স্বামীর সাথে কফি খেতে খেতে এ বিষয়ে আলাপ করবে।

ঠিক যখন স্ক্রিনে সালভেদর এর একজন সরকারি কর্মকর্তা নতুন অত্যাচারগুলোর কিছু একঘেঁয়েমি ব্যাখ্যা দিতে হাজির হলো, তখনই হঠাৎ মারি লক্ষ্য করলো তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে।

সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে কিছু হয়নি। সম্ভবতঃ সিনেমা হলের বদ্ধ পরিবেশ তাকে পেয়ে বসেছে; কেননা লক্ষণ এমন যে তার মনে হচ্ছিলো সে যদি একটু বাইরে নির্মল বাতাসের মধ্যে যেতে পারতো।

কিন্তু ঘটনা তার নিজের গতিতে চলছিলো। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছিলো এবং তার সারা শরীরে শীতল ঘাম বেয়ে পড়তে লাগলো।

মারি’র ভয় করতে লাগলো। বাজে চিন্তা দূর করতে সে সিনেমাতে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করছিলো সে সময়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বুঝতে পারলো স্ক্রিনে কী হচ্ছে তার কিছুই সে লক্ষ্য করেনি। মারি তার সামনের স্ক্রিনে ছবি ও সাবটাইটেল দেখতে পাচ্ছিলো কিন্তু মনে হচ্ছে সে যেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন বাস্তবতার জগতে প্রবেশ করছে। এ জগতে তার চারপাশে ঘটা সবকিছুই খুব অদ্ভুত এবং বিশৃঙ্ক্ষল বলে মনে হচ্ছিলো যেন এ জগতটা তার অজানা।

“আমার ভালো লাগছে না,” সে তার স্বামীকে বললো।

সে যতক্ষণ সম্ভব কথা চেপে রেখেছিলো, কারণ এ রকম বলা মানেই কোন সমস্যা হচ্ছে বলে মেনে নেয়া। কিন্তু সে আর চেপে রাখতে পারলো না।

“চলো, বের হয়ে যাই,” তার স্বামী বললো।

যখন সে তার স্ত্রীকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে তার হাত ধরলো সে লক্ষ্য করলো তার স্ত্রীর হাত বরফশীতল হয়ে আছে।

“আমার মনে হচ্ছে আমি এতো দূর যেতে পারবো না। এ সব কী হচ্ছে আমার।”

এ কথায় তার স্বামীও ভয় পেয়ে গেলো। মারি’র চেহারায় ঘাম ঝরতে দেখা যাচ্ছে, এবং তার চোখে এক অদ্ভুত আলো খেলা করছে।

“শান্ত হও। আমি বাইরে গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনছি।”

মারি মরিয়া হয়ে স্বামীকে আঁকড়ে ধরলো। সে যা বলেছে সম্পূর্ণ বুঝেই বলছে, কিন্তু সবকিছু – সিনেমা হল, আধো আলো ছায়া, স্ক্রিনের সামনে সারিবদ্ধ ভাবে বসে থাকা মানুষগুলো – সব কিছুই খুব ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছিলো তার কাছে। সে নিশ্চিত সে বেঁচে আছে, এমন কি সে তার চারপাশের জীবনকেও স্পর্শ করতে পারছে, মনে হচ্ছে সবকিছু নিখুঁত। এ রকমটা কখনোই তার আগে হয়নি।

“কোন ভাবেই তুমি আমাকে এখানে একা ফেলে যাবে না। আমি উঠছি, তোমার সাথে যাবো। আমাকে আস্তে আস্তে নিয়ে চলো।”

তারা দু’ জন ঐ সারিতে বসা লোকজনদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বের হয়ে সিনেমা হলের দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। মারি’র হৃদস্পন্দন ভয়ঙ্কর ভাবে বৃদ্ধি পেলো; সে প্রায় নিশ্চিত যে সে এখান থেকে বের হতে পারবে না। সে কোন রকমে এক পা সামনে দিয়ে পিছনের পা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। সে তার স্বামীর বাহু আঁকড়ে ধরে আছে আর জোরে শ্বাস নিচ্ছে – মনে হচ্ছে যেন ইচ্ছাকৃত ভাবে সে ভয়ানক সতর্কতার সাথে শ্বাস নিচ্ছে।

মারি তার জীবনে এতো ভয় পায়নি কখনো। “আমি এ সিনেমা হলে, এখানেই মারা যাবো।”

তার মনে হচ্ছে সে বুঝতে পারছে তার কী ঘটতে যাচ্ছে। অনেক বছর আগে তার এক বন্ধু এভাবে সিনেমা হলে এসে সেরেব্রাল অ্যানুরিজম-এ মারা গিয়েছিলো।

সেরেব্রাল অ্যানুরিজম একটা টাইম বোমার মতো। ধমনীর পাশাপাশি কিছু ছোট স্ফীত শিরা থাকে – অনেকটা বেলুনের মতো ফুলে ছিড়ে যেতে পারে – এবং এগুলো পুরো জীবনে অচিহ্নিত অবস্থায় থাকতে পারে। কেউ জানে না কখন তার অ্যানুরিজম হবে, যদি না এটা দুর্ঘটনাবশতঃ হঠাৎ-ই উদ্ঘাটন হয়ে থাকে। যেমন, কোন কারণে ব্রেন স্ক্যান করলে তখন উদ্ঘাটন হতে পারে। অথবা যখন এটা কোন উত্তেজিত অবস্থায় ফেটে গিয়ে রক্তে ভাসিয়ে দেয় তখন চিহ্নিত হয়। এর ফলে একজন ব্যক্তি সাথে সাথে কোমায় চলে যেতে পারে যা সাধারণতঃ মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।

অন্ধকার হলের একপাশ দিয়ে নেমে আসতে আসতে মারি’র তার হারানো বন্ধুর কথা মনে পড়লো। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই অ্যানুরিজম-এর প্রভাব সে উপলব্ধি করতে পারছে। তার মনে হচ্ছে তাকে যেন অন্য কোন গ্রহে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেখানে সবকিছুই সে প্রথমবারের মতো দেখছে।

সেখানে ছিলো এক ভয়ঙ্কর ব্যাখ্যাতীত ভয় আর একা হয়ে যাওয়ার এক নির্ভেজাল আতঙ্ক: মৃত্যু।

আমাকে এ সব ভাবনা থামাতে হবে। আমার মনে করতে হবে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

সে স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করছিলো, এবং কয়েক সেকেন্ড এর মধ্যে তার অস্বস্তি কমে আসতে লাগলো। এই দুই মিনিট – প্রথম অনুভূতি মনে আসা থেকে তার স্বামীর হাত ধরে বাইরে আসা পর্যন্ত দুই মিনিট তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুই মিনিট।

যখন তারা বের হওয়ার করিডোরে উজ্জ্বল আলোর মধ্যে পৌঁছালো, তখন সব কিছু আবার আগের মতো শুরু হলো। চারদিকের ঝলমলে রঙ, তার চারপাশ থেকে ছুটে আসা রাস্তার হট্টগোল সবকিছু এবং সবকিছু অবাস্তব মনে হতে লাগলো। কিছু জিনিস যেন মারি প্রথমবারের মতো এতো গভীরে দেখতে পাচ্ছিলো যেটা আগে কখনো পারেনি।

মারি বুঝতে পারছিলো সে তার চারপাশে যা দেখতে পারছে সবই তার মস্তিষ্কের ভেতরে আকস্মিক বৈদ্যুতিক তাড়নার কারণে সৃষ্ট দৃশ্য, যেটা আলোক তরঙ্গ ব্যবহার করে চোখ তৈরি করে নিচ্ছে।

না, তাকে চিন্তা থামাতে হবে। নইলে সে বিকারগ্রস্ত হয়ে যাবে।

সে সময় নাগাদ তার অ্যানুরিজম-এর ভীতি কেটেছে; সে সিনেমা হল থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে এবং তখনও বেঁচে আছে। তার যে বন্ধু মারা গিয়েছিলো সে তার সিট থেকে উঠতে পর্যন্ত পারেনি।

“আমি একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি,” তার স্বামী বললো। সে দেখতে পেলো তার স্ত্রীর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে এবং ঠোঁটটা রক্তশূন্য হয়ে গেছে।

“একটা ট্যাক্সি ডাকো,” সে বললো। এ সময় সে তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো। মারি সচেতন ভাবেই তার ভোকাল কর্ডের কম্পন অনুভব করছে।

হাসপাতালে যাওয়া মানে এটা মেনে নেয়া যে, সে মারাত্মক ভাবে অসুস্থ। মারি সব কিছু স্বাভাবিক আছে এটা বোঝাতে তৎপর হয়ে ছিলো।

তারা বাইরে বের হয়ে এলো, বরফ শীতল বাতাস কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে হলো। মারি তার উপর কিছু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসতে পারছে যদিও তার ভেতর আতঙ্ক ও ভয়ের ব্যাখ্যাতীত অনুভূতি বজায় আছে। তার স্বামী যখন হন্যে হয়ে একটা ট্যাক্সি খুঁজছিলো তখন সে অপেক্ষায় বসে তার চারদিকের কোন কিছুতে দৃষ্টি না দেয়ার চেষ্টা করছিলো। চারদিকের খেলায় মত্ত বাচ্চারা, যানবাহন, কাছাকাছি রাস্তার মেলা থেকে ভেসে আসা মিউজিক – সব কিছুই নিখুঁত ভীতিকর মনে হচ্ছিলো তার কাছে।

শেষ পর্যন্ত ট্যাক্সি পৌঁছালো।

“হাসপাতালে যান,” স্ত্রীকে গাড়িতে উঠতে সাহায্য করতে করতে তার স্বামী ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললো।

“বাড়ি চলো, প্লিজ,” মারি অনেকটা অনুনয়ের সুরে স্বামীকে বললো। সে আর কোন নতুন জায়গায় যেতে চায় না; তার এখন সম্পূর্ণ পরিচিত জায়গায় যাওয়া প্রয়োজন, সাধারণ জিনিস তার ভীতির এই অনুভূতিকে কমাতে পারে।

যখন ট্যাক্সি বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো, তখন তার হৃদস্পন্দন ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছিলো এবং তাপমাত্রাও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।

“আমার ভালো লাগছে,” সে তার স্বামীকে বললো। “মনে হয় কোন খাবার খেয়ে এমন হয়েছে।”

যখন তারা বাড়ি পৌঁছালো, তখন পৃথিবীটা ছোটবেলা থেকে যেমন ছিলো তেমনই মনে হতে লাগলো মারি’র কাছে। তার স্বামী যখন ফোন করতে গেলো সে জানতে চাইলো কী করছে।

“আমি একজন ডাক্তার ডাকছি।”

“তার তো দরকার নেই। আমার দিকে তাকাও – আমি ভালো আছি।”

তার গালে রক্ত ফিরে এসেছে, তার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক হয়েছে এবং অনিয়ন্ত্রিত ভীতি পুরোপুরি দূর হয়েছে।

সে রাতে মারি’র গভীর ঘুম হলো এবং ঘুম ভাঙার পর মনে হলো আগের দিন সিনেমা হলে ঢোকার আগে তারা যে কফি খেয়েছিলো সেখানে কেউ কিছু মিশিয়েছে। এটা তো একটা ভয়ানক দুরভিসন্ধি ছিলো! সবশেষে সে পুরোপুরি প্রস্তুত হলো উকিলকে ফোন করতে এবং কোর্টে যেতে কে এর পেছনে দায়ী তা খুঁজে বের করার জন্য।

সেদিনও মারি অন্যান্য দিনের মতো কাজে গেলো। অফিসে সে কয়েকটি অনিষ্পন্নকৃত মামলা ঘেটে দেখছিলো এবং বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছিলো। বিগত দিনের অভিজ্ঞতা ভীতির একটা ক্ষুদ্র অংশ রেখে গেলেও সে নিজের কাছে প্রমাণ করতে চাইছিলো যে এটা আর কখনো ঘটবে না।

সে তার এক কলিগের সাথে এল সালভেদর এর সিনেমা নিয়ে গল্প করলো এবং কথায় কথায় বললো যে প্রতিদিনের একঘেয়েমি কাজ করে সে বিরক্ত: “খুব সম্ভবতঃ আমার অবসরের সময় হয়েছে।”

“আপনি আমাদের সবচেয়ে ভালো আইনজীবীদের একজন,” তার কলিগ বললো। “তাছাড়া আইন পেশা এমন একটা পেশা যেখানে বয়স কোন সমস্যা না। আপনি বরং একটা লম্বা ছুটি নিন? আমি নিশ্চিত এর পর আপনি আবার কাজে উদ্যোম ফিরে পাবেন।”

“আমি আমার জীবন নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু করতে চাই। আমি কিছু অ্যাডভেঞ্চার করতে চাই, অন্য লোকজনকে সহায়তা করতে চাই, এমন কিছু করতে চাই যেটা আমি এর আগে কখনোই করিনি।”

আলাপ সেখানেই থেমে গেলো। এরপর মারি বের হয়ে স্কয়ারে গেলো, সাধারণতঃ সব সময় যে সব রেস্তোরায় যায় তার চেয়ে একটু দামি রেস্তোরায় দুপুরের খাবার খেয়ে একটু আগে আগেই অফিসে ফিরে এলো। কে জানতো এ মুহূর্তটা তার কাজ থেকে অব্যাহতির শুরু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে!

অন্য স্টাফরা তখনো লাঞ্চ সেরে আসেনি। মারি এ ফাঁকে তার ডেস্কে জমে যাওয়া কাজগুলো দেখতে বসেছিলো। সে একটা পেন্সিল নিতে তার ড্রয়ারটা খুললো। যেখানে সে সব সময় তার পেন্সিলটা রাখে, সেখানে পেন্সিলটা পাওয়া গেলো না। এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের জন্য তার মনে হলো পেন্সিলটা সঠিক জায়গায় ফেরত আনতে না পারার ব্যর্থতার উদ্বেগ তার মাঝে সম্ভবতঃ একটা অস্বাভাবিকতা তৈরি করছে।

এটাই তার হৃদস্পন্দন দ্রুত করতে যথেষ্ট ছিলো এবং হঠাৎ করে গত রাতের আতঙ্ক পুরোপুরি ফিরে আসলো।

মারি যেখানে ছিলো সেখানেই অনড় হয়ে রইলো। জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে তার চারপাশের সব কিছু উজ্জ্বল করে তুলছিলো। কিন্তু তার আবারো এ অনুভূতি ফেরত আসছে যে, সে মারা যাচ্ছে। সব কিছু খুবই বিস্ময়কর মনে হচ্ছে; সে বুঝতে পারছে না অফিসে সে কী করছে?

আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, তবু ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করো।

আবারো তার শরীর বেয়ে শীতল ঘাম ঝরতে লাগলো; তার মনে হলো সে নিজের ভীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কেউ যদি এ সময় আসতো তাহলে তার আতঙ্কিত দৃষ্টি দেখতে পারতো এবং তাকে পুরোপুরি অচেতন অবস্থায় পেতো।

হিমেল বাতাস!

ঠান্ডা বাতাসে সে আগের দিন রাতে ভালো বোধ করেছিলো, কিন্তু এখন সে কী করে এতো দূরে রাস্তায় যাবে? তার কী ঘটছে তা সে আরো একবার খুব ভালো করে লক্ষ্য করছিলো – তার শ্বাস-প্রশ্বাস হার (কিছু সময় তার মনে হচ্ছে যে, যদি শ্বাস নিতে ও নিঃশ্বাস ফেলতে নিজে থেকে চেষ্টা না করে তাহলো এটা বোধ হয় আপনাআপনি হবে না), তার মাথার নড়াচড়া (বিভিন্ন ছবি এমন ভাবে একটার পর একটা আসছে মনে হচ্ছে মাথার ভেতরে টেলিভিশন ক্যামেরা ঘুরছে), তার হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুত হচ্ছে, তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে আর আঠালো ঘামে ভিজে যাচ্ছে।

আর এক ভীতিকর, সাংঘাতিক ব্যাখ্যাতীত আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরছিলো কোন কিছু করতে, এমন কি সে চেয়ার ছেড়ে উঠে এক পা ফেলতে ভয় পাচ্ছিলো সে।

আমি পারবো।

এর আগের বার সে এ অবস্থা পার করে এসেছে। কিন্তু এখন সে কাজে; সে কী করতে পারে? মারি ঘড়ির দিকে তাকালো, এবং তার মনে হলো এটা একটা ফালতু যন্ত্র যেটা দু’টা সুঁই-এর মতো হাত নিয়ে ক্রমাগত একটা বৃত্তে ঘুরে যাচ্ছে আর সময় নির্দেশ করছে যে সময়কে কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেনি এখনো। অন্যান্য সব মাপের মতো এটা দশ না হয়ে বারো কেন হলো?

আমার এ বিষয়গুলো ভাবা উচিত না, এগুলো আমাকে বিকারগ্রস্ত করে ফেলছে।

বিকারগ্রস্ত। সম্ভবতঃ এখন তার যে সমস্যা হচ্ছে তা বর্ণনা করতে এটাই সঠিক শব্দ। মারি সমস্ত ইচ্ছা শক্তি একত্র করে উঠে দাঁড়ালো এবং টয়লেটের দিকে এগিয়ে গেলো। সৌভাগ্যক্রমে অফিস পুরো ফাঁকা এবং টয়লেট অসীম দূরত্বে মনে হলেও সে সেখানে পৌঁছাতে পারলো। মুখে পানির ঝাঁপটা দিতে অদ্ভুত ভাবটা কমে আসলেও আতঙ্কটা রয়েই গেলো।

আমি অবশ্যই এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারবো, গতকাল যেমন পেরেছি। সে নিজেকে বোঝাতে লাগলো।

তার মনে পড়লো এর আগের দিন সমস্ত বিষয়টা প্রায় ত্রিশ মিনিট স্থায়ী ছিলো। সে একটা টয়লেটে ঢুকে টয়লেট সিটে বসে তার মাথাটা দু’ হাটুর মধ্যে গুজে রাখলো। এ অবস্থায় বসে তার হৃদস্পন্দনের শব্দ যেন আরো জোরে শোনা যাচ্ছে। মারি তাড়াতাড়ি বসে পড়লো।

এটা চলে যাবে।

মারি সেখানে বসে সে কে তা মনে করতে পারছিলো না, সে পুরোপুরি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলো। সে টয়লেটে মানুষের আসা যাওয়া শুনতে পাচ্ছিলো, কল ছাড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো; কেউ কেউ ফালতু বিষয় নিয়ে আলাপ করছে সেগুলো তার কানে আসছিলো। কয়েকবার কেউ তার কিউবিকল খোলার চেষ্টা করলো, এর পর কী সব বিড়বিড় করে বলতে বলতে চলে গেলো। তার মনে হচ্ছিলো এক একটা টয়লেটের ফ্ল্যাশ যেন প্রকৃতির এক প্রচণ্ড শক্তি, এটা যেন একটা পুরো বিল্ডিং-কে চুরমার করে দিতে পারে এবং সব কিছু ধুয়ে নরকে নিয়ে ফেলছে।

কিন্তু সে কল্পনা করতে পারছিলো যে ভয় কেটে গেছে এবং তার হৃদস্পন্দন আবার স্বাভাবিক হচ্ছে। এটাও মনে হলো তার যে তার সেক্রেটারি এতোটা অযোগ্য যে সে তার অনুপস্থিতি খেয়ালই করেনি; নয়তো এতোক্ষণে পুরো অফিস টয়লেটের সামনে চলে এসে জানতে চাইতো সে ঠিক আছে কি না।

মারি যখন বুঝতে পারলো যে সে তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে তখন সে কিউবিকলের দরজা খুলে বের হয়ে আসলো। দীর্ঘ সময় চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে সে তার টেবিলে ফিরে গেলো।

তাকে দেখে একজন শিক্ষানবীশ বললো, “আপনার তো কোন মেকাপ নেই দেখছি, আপনি চাইলে আমারটা ব্যবহার করতে পারেন।”

মারি এর উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। সে তার টেবিলে এসে তার হ্যান্ডব্যাগ আর ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তুলে নিলো। এরপর তার সেক্রেটারিকে বললো, বাকি দিনটা সে বাড়িতে কাটাবে।

তার সেক্রেটারি একটু আপত্তি করে বললো, “কিন্তু আপনার তো অ্যাপয়েন্টমেন্টের চাপ রয়েছে।”

“তুমি নির্দেশ দিতে পারো না, শুধু নিতে পারো। যা বললাম তাই করো, আজকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট সব বাতিল করো।”

সেক্রেটারি এক দৃষ্টিতে এই ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে রইলো যার সাথে সে তিন বছর যাবৎ কাজ করছে এবং এর আগে কখনই তাকে এতোটা কঠিন হতে দেখেনি। ভদ্রমহিলার কোন মারাত্মক সমস্যা হয়েছে নিশ্চয়ই; হয়তো কেউ তাকে বলেছে যে, তার স্বামী তার প্রেমিকাকে বাসায় নিয়ে উপস্থিত হয়েছে এবং সে তাদের হাতে নাতে ধরতে যাচ্ছে।

উনি একজন ভালো আইনজীবী, আর উনি জানেন উনি কী করছেন, মেয়েটি নিজে নিজে বললো। নিশ্চয়ই উনি আগামীকাল এসে তার কাছে ক্ষমা চাইবেন।

সেই আগামীকালটা আর আসেনি। ঐ রাতে মারি তার স্বামীর সাথে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করলো এবং তাকে তার অভিজ্ঞতার সমস্ত লক্ষণ খুলে বললো। দু’ জনে মিলে তারা যে সিদ্ধান্তে আসতে পারলো সেটা হচ্ছে দ্রুত হৃদস্পন্দন, শীতল ঘাম, স্থানচ্যুতির অনুভূতি, দুর্বলতা, নিয়ন্ত্রণহীনতা এ সব কিছু মিলে একটা অনুভূতিতে গিয়ে শেষ হয়, সেটা হচ্ছে আতঙ্ক। স্বামী-স্ত্রী দু’ জনে মিলে ভেবে দেখলো কী ঘটছে। তার স্বামীর কাছে মনে হলো এটা ব্রেন টিউমার হতে পারে, কিন্তু সে মারিকে কিছু বললো না। মারি ভাবলো এটা কোন ভয়ঙ্কর বিষয়ের পূর্বাভাস, কিন্তু সে-ও কিছু বললো না। তারা যুক্তিসঙ্গত, ন্যায়সঙ্গত ও পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির মতো কিছু সাধারণ বিষয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করলো।

“মনে হয় তোমার কিছু টেস্ট করানো দরকার।” মারি’র স্বামী বললো।

মারি একটা শর্তে রাজি হলো যে কেউ এ বিষয়ে কিছু জানতে পারবে না, এমন কি তাদের সন্তানরাও না।

পরদিন সে অফিস থেকে এক মাসের বিনা বেতনে ছুটির আবেদন করলো, ছুটি মঞ্জুরও হলো। তার স্বামী ভেবেছিলো তাকে অস্ট্রিয়াতে নিয়ে যাবে। অস্ট্রিয়াতে ব্রেন ডিসঅর্ডার এর উপর বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রয়েছেন, কিন্তু মারি বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হলো না; এ ধরনের আতঙ্ক হওয়ার বিষয়টি বারে বারে এবং বেশি সময়ের জন্য ঘটতে লাগলো।

মারি ঘুমের ওষুধের উপর চলছিলো। তারা দু’ জন মিলে অনেক কষ্টে ল্যুবল্জানায় দূরের একটা হাসপাতালে মারি’র ব্যাপক পরিমাণে টেস্ট করাতে পারলো। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই ধরা পড়লো না, এমন কি অ্যানুরিজম-ও না যেটা মারি’র বাকি জীবনের জন্য একটা বড় সান্তনা।

কিন্তু আতঙ্কগ্রস্ত হওয়াটা চললোই। তার স্বামী যখন প্রতিদিন বাজারে যেতো বা রান্না করতো তখন মারি খুব বেশি করে ঘরদোর পরিষ্কার করতো, যেন তার মন অন্যান্য বিষয়ে ব্যস্ত থাকে। সে যত সাইকিয়াট্রি বই পেলো পড়া শুরু করলো। বইগুলো রাখা মাত্র তার মনে হতো তার সে ধরনের অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ তা প্রত্যেকটা অসুস্থতার ক্ষেত্রেই বর্ণনা করা হয়েছে।

সবচেয়ে খারাপ যেটা সেটা হচ্ছে যদিও আতঙ্কগ্রস্ত হওয়াতে কোন নতুনত্ব ছিলো না, তবুও সে একই মাত্রায় আতঙ্ক বোধ করতো এবং বাস্তবতা থেকে একই রকম ভাবে বিচ্ছিন্নতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণহীনতা বোধ করতো। এর সাথে তার স্বামীর ব্যাপারে তার অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগলো, কেননা ঘরদোর পরিষ্কার করা ছাড়া বাকি সব কাজ তার স্বামীর করতে হতো।

সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় মারি বিরক্ত বোধ করতে লাগলো এবং তা প্রকাশও করতে লাগলো। সামান্য বিষয়ে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে লাগলো এবং সে চিৎকার চেচামেচি করে পরে হিস্টিরিয়াগ্রস্তদের মতো ফোঁপাতে লাগলো।

ত্রিশ দিন ছুটি শেষে হলে মারি’র একজন কলিগ আসলো তার সাথে দেখা করতে। সে প্রতিদিনই ফোন করতো, কিন্তু মারি ফোনে কোন কথা বলতো না কিংবা তার স্বামীকে দিয়ে বলাতো সে ব্যস্ত আছে। সেদিন বিকালে মারি’র কলিগ যখন বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে বেল চাপলো, মারি গিয়ে দরজা খুললো।

মারি’র কাছে তখনও সকাল। সে চা বানিয়ে আপ্যায়ন করলো। তাদের মধ্যে অফিস নিয়ে কিছু কথা হলো এবং এক সময় সে জানতে চাইলো যে মারি কাজে ফিরবে কি না।

“মনে হয় না,” মারি উত্তর দিলো।

ভদ্রলোকের অফিসে এল সালভেদর নিয়ে তাদের আলাপচারিতার কথা মনে পড়লো।

“আপনি সব সময়ই কঠোর পরিশ্রম করেছেন, আর আপনি কী করতে চান তা বেছে নেয়ার অধিকারও আপনার আছে,” বিরক্তিহীন কণ্ঠে তিনি বললেন। “কিন্তু একবার ভেবে দেখবেন এমন পরিস্থিতিতে কাজই কিন্তু সবচেয়ে ভালো ওষুধ। আপনি কিছুদিন বেড়িয়ে আসুন, পৃথিবীটাকে দেখে আসুন, যেখানে আপনি নিজেকে যোগ্য মনে করেন সেখানেই যেতে পারেন; তবে অফিসে আপনার জন্য সুযোগ সব সময়ই উন্মুক্ত থাকবে, অফিস আপনার ফেরার অপেক্ষায় থাকবে।”

মারি এ কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লো যেটা সে এখন খুব সহজে প্রায়ই করে থাকে।

তার কলিগ তাকে শান্ত হওয়ার সুযোগ দিলেন। একজন ভালো আইনজীবীর মতো তিনি কিছুই জানতে চাইলেন না; তিনি জানেন প্রশ্ন না করে নিরব থাকলেই তার প্রশ্নের উত্তর পাবার সম্ভাবনা বেশি।

আর তাই হলো। মারি তাকে সব খুলে বললো, সিনেমা হলে যা ঘটেছিলো সেখান থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালে তার স্বামীর উপর – যে তাকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়েছে – সে যে বিকারগ্রস্তের মতো আক্রমণ করেছে সে পর্যন্ত।

“আমি বিকারগ্রস্ত,” সে বললো।

“হতে পারে,” অনেকটা সবজান্তার মতো কিন্তু শান্ত স্বরে তিনি উত্তর দিলেন। “সেক্ষেত্রে আপনার হাতে দু’ টা উপায় রয়েছে: হয় আপনি কোন চিকিৎসা নিন অথবা অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকুন।”

“আমি যেমনটা আছি তার কোন চিকিৎসা নেই। আমার মানসিক অবস্থার উপর আমার সম্পূর্ণ দখল রয়েছে; তবুও আমি চিন্তিত এ কারণে যে এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। আমার পাগলামির সাধারণ কোন লক্ষণ নেই যেমন, বাস্তবতা থেকে অনুপস্থিতি, অনীহা অথবা অনিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন – আমার রয়েছে শুধু আতঙ্ক।”

“এটা কিন্তু সকল বিকারগ্রস্ত লোকই বলে যে আমি একেবারে স্বাভাবিক।”

দু’জনে হাসতে লাগলেন এবং সে তাকে আবার চা করে খাওয়ালেন। তারা আবহাওয়া নিয়ে কথা বললেন, স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতার সাফল্য নিয়ে কথা বললেন, ক্রোয়েশিয়া ও যুগোশ্লাভিয়ার মধ্যকার ক্রমবৃদ্ধিপ্রাপ্ত উত্তেজনা নিয়ে কথা বললেন। মারি সারাদিন টিভি দেখে সময় কাটায় এবং মোটামুটি এসব বিষয়ে ভালোই জানে।

বিদায় নেয়ার আগে তার কলিগ আবারো বিষয়টি তুললেন।

“শহরে একটা নতুন হাসপাতাল খোলা হয়েছে,” তিনি বললেন, “বিদেশি তহবিলে চলে এবং প্রথম শ্রেণির চিকিৎসা দিয়ে থাকে।”

“কিসের চিকিৎসা?”

“ভারসাম্যহীনতা, আমরা এমনই বলতে পারি। আর অতিরিক্ত আতঙ্ক তো এক ধরনের ভারসাম্যহীনতাই।”

মারি বিষয়টা ভেবে দেখার প্রতিশ্রুতি দিলো, কিন্তু তখন পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না। আরো এক মাস তার এ রকম আতঙ্কগ্রস্ততায় কাটলো। একটা সময় সে বুঝতে পারলো বিষয়টা শুধু তার ব্যক্তিগত জীবন নয়, তার সংসার ভেঙে দেয়ার উপক্রম করেছে। আবার সে আরো কিছু ঘুমের ওষুধের খোঁজ করলো এবং গত ষাট দিনের মধ্যে প্রথমবারের মতো ঘরের বাইরে পা রাখলো।

সে একটা ট্যাক্সি নিলো এবং নতুন হাসপাতালের দিকে রওনা দিলো। পথে ড্রাইভার তাকে জিজ্ঞেস করলো সে কারো সাথে দেখা করতে যাচ্ছে কি না।

“সবাই বলে যে হাসপাতালটা আরামদায়ক, কিন্তু সেখানে কিছু প্রকৃত উন্মাদও রয়েছে, আর হাসপাতালের চিকিৎসার মধ্যে বৈদ্যুতিক শক্ও রয়েছে,” ট্যাক্সি চালক বলছিলো।

“আমি একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি,” মারি বললো।

মাত্র এক ঘন্টার আলোচনা লাগলো মারি’র দু’ মাসের দুর্দশার বিষয়টা শেষ হতে। হাসপাতালের পরিচালক – রং করা চুলের একজন লম্বা ব্যক্তি যিনি ডা. ইগোর বলে তার পরিচয় দিলেন – ব্যাখ্যা করে বললেন যে, এটা শুধুমাত্র একটা প্যানিক ডিসওয়ার্ডার যেটা মনোরোগ বিশ্বের সাম্প্রতিককালের ঘটনাপঞ্জিতে অসুস্থতা বলে পরিচিতি পেয়েছে।

“এর মানে এই নয় যে এটা নতুন রোগ,” তিনি পরিষ্কার ব্যাখ্যা করে বলছিলেন।

“যেটা হয় আক্রান্ত লোকজন এটা প্রকাশ করতে চায় না এই ভয়ে যে তাদেরকে পাগল ভাবা হবে। এটা শুধুমাত্র শরীরের একটা রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা, অনেকটা বিষণ্নতার মতো”।

ডা. ইগোর তাকে একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে বাসায় ফিরে যেতে বললেন।

“আমি ফিরে যেতে চাই না,” মারি বললো। “আপনি সব কিছু বলার পরও আমি আসলে বাইরে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছি না। আমার সংসার নরকে পরিণত হয়েছে এবং আমার স্বামী এ কয়েক মাস যাবৎ আমাকে যেভাবে যত্ন নিয়েছেন তাতে তারও এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সময়ের প্রয়োজন।”

এ রকম ক্ষেত্রে সব সময় যা ঘটে – কারণ হাসপাতালের অংশীদাররা এটাকে এর পুরো ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী চালাতে চান – ডা. ইগোর একজন রোগী হিসেবে তাকে ভর্তি করলেন; যদিও এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো যে এর প্রয়োজন নেই।

মারি প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের পাশাপাশি যথাযথ মনোরোগ চিকিৎসা পেলো। দ্রুতই তার লক্ষণগুলো কমতে লাগলো এবং একসময়ে সব লক্ষণ পুরোপুরি দূর হয়ে গেলো।

তবে এর মধ্যে তার হাসপাতালে অন্তরণ থাকার কাহিনী ল্যুবলজানা’র ছোট শহরটার চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। তার কলিগ, যে সপ্তাহখানেক আগে তার বাসায় চা খেয়ে গিয়েছিলো, তারা দু’ জন এক সাথে কত আনন্দ ও উত্তেজনাপূর্ণ মূহুর্ত কাটিয়েছেন, সে একদিন ভিলেট-এ তার সাথে দেখা করতে আসলেন। তিনি তার পরামর্শ মেনে এখানে চিকিৎসা নিতে আসতে যে সাহস দেখিয়েছে তার প্রশংসা করলেন। তারপর তিনি তার আসার প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করলেন: “সম্ভবতঃ আপনার অবসরের সময় এসেছে।”

মারি জানে এ কথাগুলোর উদ্দেশ্য কী; কেউ-ই এমন আইনজীবীর প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না যিনি এক সময় মানসিক রোগী ছিলেন।

“আপনি তো বলেছিলেন কাজই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ওষুধ। আমার ফিরে যাওয়া উচিত, এমন কি অল্প সময়ের জন্য হলেও।”

সে একটা উত্তরের আশা করেছিলো, কিন্তু তিনি কোন উত্তর দিলেন না। মারি বলে গেলো: “আপনিই তো বলেছিলেন আমার চিকিৎসার প্রয়োজন। আমি যখন অবসরের কথা বিবেচনা করছিলাম, তখন আমার ইচ্ছা ছিলো শেষ পর্যন্ত, পরিপূর্ণভাবে, সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে আমি স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্ত নিবো। আমি এ রকম পরাজিত হয়ে আমার চাকরি ছাড়তে চাই না। অন্ততঃ আমার আত্মসম্মানবোধ ফিরে পাওয়ার একটা সুযোগ দিন; তারপর আমি অবসরে যাবার কথা ভাববো।”

আইনজীবী গলা পরিষ্কার করে বললেন, “আমি আপনাকে চিকিৎসা করাতে পরামর্শ দিয়েছি, কিন্তু হাসপাতালে আসার বিষয়ে কিছু বলিনি।”

“কিন্তু এটা তো টিকে থাকার প্রশ্ন। আমি রাস্তায় বের হতে ভয় পাই, আমার সংসার ভেঙে যাওয়ার অবস্থা।”

মারি জানে সে শুধু শুধু বাক্য বিনিময় করছে। উনাকে বোঝানোর মতো কিছুই তার নেই; তাছাড়া এটা অফিসের মান সম্মানের ব্যাপার যেটা ঝুঁকিতে পড়েছে। তারপরও সে আর একবার চেষ্টা করলো।

“এখানে আমি দুই ধরনের লোকের সাথে থাকি: এক শ্রেণির লোক যাদের সমাজে ফিরে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই এবং আর এক শ্রেণির লোক যারা জীবনের দায়িত্ব পালনের তুলনায় পাগল হয়ে থাকতেই পছন্দ করে। আমি চাই এবং আমার প্রয়োজনও রয়েছে আবার নিজেকে ভালোবাসতে শেখা। আমার নিজেকে বিশ্বাস করাতে হবে যে, আমি আমার নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারি। যে সিদ্ধান্ত আমার নয় তা আমি জোর করে মেনে নিতে পারি না।”

“আমরা জীবনের অনেক ভুলই অনুমোদন করতে পারি,” তার কলিগ বললো, “শুধুমাত্র যে ভুল আমাদের ধ্বংস করে ফেলে তা অনুমোদন করতে পারি না।”

এরপর আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আর কোন উপায় থাকলো না; তার মতে মারি একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে।

দুই দিন পরে ভিন্ন ঘরানার অন্য আর একজন আইনজীবী তার সাথে দেখা করতে আসলেন; তিনি এক সময় তার পুরাতন কলিগের বিরোধী পক্ষ ছিলেন। মারি কিছুটা উৎসাহিত বোধ করলো; খুব সম্ভবতঃ ভদ্রলোক জানেন যে সে এখন নতুন পদ নেয়ার জন্য ফ্রি আছে এবং পৃথিবীতে তার অবস্থান পুনরুদ্ধারের একটা সুযোগ তৈরি হলো।

আইনজীবী দর্শনার্থী রুমে এসে মারি’র উল্টো পাশে বসলেন এবং একটা হাসি দিয়ে জানতে চাইলেন সে আগের থেকে ভালো আছে কি না। এরপর তিনি ব্রিফকেস থেকে বিভিন্ন কাগজপত্র বের করলেন।

“আমি আপনার স্বামীর অনুরোধে এসেছি,” তিনি বললেন।

“এগুলো একটা ডিভোর্স আবেদন। তিনি অবশ্য আপনি যতদিন এখানে আছেন আপনার হাসপাতাল বিল দিয়ে যাবেন।”

এবারে মারি আর কোন তর্ক করার চেষ্টা করলো না। সে সব কিছুই স্বাক্ষর করে দিলো। যদিও সে তার আইনের পড়ালেখা ও অভিজ্ঞতায় জানে যে, সে চাইলে এ বিবাদ আজীবন চালিয়ে যাওয়া যেতো। সে এরপর সোজা ডা. ইগোর-এর সাথে দেখা করতে গেলো এবং বললো যে তার লক্ষণগুলো আবার ফিরে এসেছে।

ডা. ইগোর বুঝতে পারছিলেন যে, সে মিথ্যা বলছে; তবুও তিনি তার অবস্থানকাল অনির্দিষ্টকালের জন্য বৃদ্ধি করলেন।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০