fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

এক

১১ নভেম্বর ১৯৯৭ তারিখে ভেরোনিকা সিদ্ধান্তে আসলো যে, নিজেকে শেষ করার মূহুর্ত চলে এসেছে অবশেষে! সে খুব যত্ন করে আশ্রমে তার ভাড়া করা ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করলো, হিটারটা বন্ধ করলো এবং দাঁত ব্রাশ করে শুতে গেলো।

বেড সাইড টেবিল থেকে ভেরোনিকা চার প্যাকেট ঘুমের ওষুধ তুলে নিলো। ওষুধগুলো গুড়ো করে পানিতে মিশিয়ে না খেয়ে সে একটা একটা করে গিলে খাবে বলে ঠিক করেছে। কেননা কোন সংকল্প করা আর তা বাস্তবায়ন করার মধ্যে সব সময়ই একটা ব্যবধান থাকে, আর সে কারণে মাঝপথে গিয়ে ফিরে আসার পথটাও সে খোলা রাখতে চায়। তবে প্রতিটা বড়ি গিলে ফেলার সাথে সাথে সে আরো উদ্দিপ্ত হচ্ছিলো; ফলে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্যাকেটগুলো খালি হয়ে গেলো।

চেতনা হারাতে কত সময় লাগবে জানা না থাকায় ভেরোনিকা সময় কাটাতে ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিন Homme-এর ঐ মাসের সংখ্যাটা নিয়ে বিছানায় গেলো। সংখ্যাটা সে যে লাইব্রেরিতে কাজ করে সেখানে মাত্র এসেছে। কম্পিউটার সায়েন্সের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই, তবু পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে কম্পিউটার গেম সম্পর্কিত একটি আর্টিকেল-এর পাতায় এসে পড়লো। গেমটা ব্রাজিলিয়ান লেখক পাওলো কোয়েলহোর তৈরি। গ্রান্ড ইউনিয়ন হোটেলের ক্যাফেতে লেখকের একটা বক্তৃতায় ভেরোনিকার লেখকের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়েছিলো। তাদের মধ্যে কিছু আলাপ হয়েছিলো এবং তাঁর প্রকাশক তাঁদের সাথে রাতের খাবারের নিমন্ত্রণও দিয়েছিলেন ভেরোনিকাকে। সেখানে অনেক লোকজন থাকায় আর বেশি কিছু আলাপের সুযোগ হয়নি।

লেখকের সাথে দেখা হওয়ার পর ভেরোনিকার মনে হয়েছিলো তিনি তারই জগতের লোক, আর এ কারণেই তাঁর লেখা পড়ে সময় কাটানো যেতে পারে বলে মনে হলো। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভেরোনিকা কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে পড়তে শুরু করলো যে বিষয়ে তার ন্যূনতম কোন আগ্রহ নেই। তারপরও সে এ কাজটা করলো কেননা সারা জীবনই সে সবচেয়ে সহজ উপায়টাই বেছে নিয়েছে, যেমন এখন সময় কাটাতে ম্যাগাজিনটা বেছে নিলো।

অবাক করা বিষয় লেখাটার প্রথম লাইনটিই তার স্বাভাবিক অসাড়তায় আলোড়ন তুললো (ঘুমের ওষুধ তখনো ভেরোনিকার পাকস্থলীতে মেশেনি, সে স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা অসাড় হয়ে ছিলো); এবং জীবনে প্রথম বারের মতো তার এ কথাটা সত্য বলে ভাবতে মন চাইলো যেটা তার বন্ধু-বান্ধবরা প্রায়ই ঢং করে বলে থাকে – “জগতের কোন কিছুই কারণ ছাড়া ঘটে না।”

যখন সে মরে যেতে বসেছে তখনই এই প্রথম লাইনটা এতো নিখুঁতভাবে কী করে আসলো? ঠিক কাকতালীয় নয়, কী একটা যেন গোপন বার্তা তার সামনে বলে যাচ্ছিলো এটা?

কম্পিউটার গেমের ব্যাখ্যার নীচে সাংবাদিক আর্টিকেলটা শুরু করেছেন এ লাইন দিয়ে – “স্লোভেনিয়া দেশটি কোথায়?”

ভেরোনিকা ভাবছে, “সত্যিই কেউ জানে না স্লোভেনিয়া কোথায়!”

অথচ স্লোভেনিয়া রয়েছে; এটা রয়েছে বাইরে, ভেতরে, তার চারপাশের পাহাড়ে, এবং যে স্কোয়ারটার দিকে সে তাকিয়ে আছে সেখানে। স্লোভেনিয়া তার দেশ।  

সে ম্যাগাজিনটা এক পাশে সরিয়ে রাখলো। যে পৃথিবী স্লোভানিজদের সম্পর্কে একদমই কিছু জানে না, এই মুহূর্তে তাদের উপর ক্ষুব্ধ হওয়ার কোন কারণ নেই; কেননা তার জাতির সম্মান তার কাছে এখন খুব বেশি কিছু না। তার বরং এখন এটা ভেবে নিজেকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে যে, সে চূড়ান্তভাবে জীবন ত্যাগ করার মতো সাহস দেখাতে পারছে। কী আনন্দের ব্যাপার এটা! শুধু তাই নয়, যেমনটা সে স্বপ্ন দেখেছিলো ঠিক তেমনটাই কোন ধরনের চিহ্ন না রেখে ঘুমের ওষুধ খেয়ে সে এটা সফল করতে পারছে!

ভেরোনিকার প্রায় ছয় মাস লেগেছে এই ওষুধগুলো জোগাড় করতে। ওষুধগুলো কখনো জোগাড় করতে পারবে না ভেবে এমনও চিন্তা করেছিলো, সে তার হাতটা ছুরি দিয়ে চিরে ফেলবে। এতে অবশ্য তার রুমটা রক্তে ভেসে যেতো এবং আশ্রমের সন্ন্যাসিনীরা কিছু বিব্রতকর ও ঝামেলাদায়ক অবস্থার মুখোমুখি হতো। সেটা কোন ব্যাপার ছিলো না, কেননা আত্মহত্যার ক্ষেত্রে আত্মহত্যাকারী প্রথমে অন্যের কথা ভাবে না, নিজের কথাটা ভাবে। সে অবশ্য তার মৃত্যু যেন খুব কম ঝামেলাদায়ক হয় সে বিষয়ে যা করা সম্ভব তাই করতে প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু যদি হাত চিরে ফেলাটাই তার একমাত্র উপায় হতো তাহলে এটা করতে সে একটুও দ্বিধা করতো না। সেরকম অবস্থায় সন্ন্যাসিনীরা হয়তো তার রুমটা পরিষ্কার করে খুব দ্রুতই এ কাহিনী ভুলে যেতো, নয়তো এ ঘরটা তারা আবার ভাড়া দিতে পারবে না। এটা বিংশ শতাব্দির শেষ হলেও মানুষ এখনো ভূতকে মন থেকে তাড়াতে পারেনি।

সে চাইলে ল্যুবল্জানা শহরের সুউচ্চ কোন দালান থেকে ঝাপ দিতে পারতো, কিন্তু এতো উঁচু ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ার ফলে তার মা-বাবা কী কষ্টই না পেতো! তাদের মেয়ে মারা গিয়েছে এ ধাক্কা সামলিয়েও তাদেরকে তার ছিন্নভিন্ন শবদেহ শনাক্ত করতে হতো। না, এটা রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। কেননা এটা হয়তো দু’জন ব্যক্তি যারা তার সবচেয়ে ভালোটা চাইতেন তাদের মনে একটা অমোচনীয় দাগ কেটে রেখে যেতো। তারা হয়তো তাদের মেয়ের মৃত্যুটা একদিন ভুলে যেতে পারতেন, কিন্তু একটা ছিন্নভিন্ন মস্তকের স্মৃতি ভুলে যাওয়া তো অসম্ভব!

গুলিবিদ্ধ হওয়া, উঁচু ভবন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া, দড়িতে ফাঁস নেয়া এগুলো কোনটাই আসলে তার মেয়েলি স্বভাবের সাথে যাচ্ছিলো না। মেয়েরা সত্যিকার অর্থে আত্মহত্যা করলেও একটু রোমান্টিক পথই বেছে নেয় – যেমন, হাত কেটে ফেলা বা অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়া। বখে যাওয়া রাজকুমারী কিংবা হলিউডের অভিনেত্রী যাই হোক না কেন আত্মহত্যায় এ ধরনের প্রচুর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়।

ভেরোনিকা জানে যে জীবনটা হচ্ছে সঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করার একটি অপেক্ষা মাত্র। এটা সে প্রমাণ করেছে। সে সারা রাত ঘুমাতে পারছে না জেনে তারই দু’ বন্ধু প্রত্যেকে তাকে দু’ প্যাকেট শক্তিশালী ঘুমের ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, যেগুলো নাইটক্লাবের মিউজিশিয়ানরা সেবন করে থাকে। ভেরোনিকা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে এবং মানুষ যাকে জীবন বলে, তাকে ভাবাবেগশূন্য ভাবে বিদায় জানাতে ঐ চারটি প্যাকেট তার বেড সাইড টেবিলে এক সপ্তাহ ফেলে রেখেছিলো।

শেষ পর্যন্ত কাজটা সে করতে পারছে, আর এটা ভেবেও ভালো লাগছে যে, সে বিদায় হতে পারছে। কিন্তু শেষ সময়ে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত কী করবে এই ভেবে তার কিছুটা বিরক্ত লাগছে এখন।

কিছুক্ষণ আগে পড়া অর্থহীন প্রশ্নটা নিয়ে সে আবার ভাবতে বসলো। কী করে কম্পিউটারের মতো একটা আর্টিকেল এরকম একটা নির্বোধ প্রশ্ন দিয়ে শুরু হতে পারে – “স্লোভেনিয়া দেশটি কোথায়?”

ভালো লাগার মতো আর কোন কিছু করার না থাকায় ভেরোনিকা সম্পূর্ণ আর্টিকেলটা পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। আর্টিকেলটা পড়ে সে যেটা জানতে পারলো, যে কম্পিউটার গেমটির কথা হচ্ছিলো সেটা তৈরি হয়েছে স্লোভেনিয়ায় – এটা এমন একটা অদ্ভুত দেশ যার অবস্থান এর অধিবাসী ছাড়া অন্য কেউ ভালোভাবে বলতে পারবে বলে মনে হয় না। এটা এখানে তৈরি হওয়ার একটি কারণ হচ্ছে এখানকার সস্তা শ্রম। কয়েক মাস আগে যখন পণ্যটি বাজারে আনা হয় তখন এর ফরাসি প্রস্তুতকারক সারা বিশ্বের সাংবাদিকদের নিয়ে ‘ভেল্দ’ দুর্গে একটি পার্টির আয়োজন করেছিলো।

ভেরোনিকার মনে হচ্ছে এ পার্টির ব্যাপারে সে কোথাও পড়েছে এর আগে। এটা শহরের একটা আলোচিত ইভেন্ট ছিলো যেটা শুধুমাত্র ভেল্দ দুর্গটি নতুন করে সাজানোর কারণেই না, বরং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমদের সাথেও এ বিষয়ে একটা বিরোধ ছিলো বলে তার মনে পড়ে। ঐ পার্টিতে জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি ও স্পেনের সাংবাদিকরা নিমন্ত্রণ  পেয়েছিলেন, শুধু স্লোভেনিয়ার কোন সাংবাদিক ছিলেন না।   

Homme-এর প্রতিনিধি – যিনি স্লোভেনিয়ায় প্রথমবারের মতো এসেছিলেন এবং নিঃসন্দেহে তা আয়োজকদের খরচে – তিনি তার সফরে অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে গালগপ্প করতে করতে এবং মাগনা খাবার আর পানীয় খেতে খেতে নিশ্চয়ই তার আর্টিকেলটা এমন একটা মজার কথা দিয়ে শুরুর বিষয় ভেবে রেখেছিলেন যেটা তার দেশের বুদ্ধিজীবীদের নাড়া দিয়ে যাবে। তিনি হয়তো তার ম্যাগাজিনের সঙ্গী সাংবাদিকদের স্থানীয় রীতিনীতি নিয়ে অনেক ফালতু গল্প বলে বেড়িয়েছেন এবং হয়তো স্লোভেন মেয়েরা কত বাজে ভাবে সাজগোজ করে সেটাও গল্প করেছেন।

এটা অবশ্য সাংবাদিকের সমস্যা। ভেরোনিকা মরতে যাচ্ছে। এখন এগুলো ছাড়া তার আরো অন্য চিন্তা রয়েছে। যেমন, তার সন্দেহ হচ্ছে মৃত্যুর পর আদৌ কোন জীবন রয়েছে কি না অথবা তার দেহ কেউ খুঁজে পাবে কি না। তবে কোন কারণ ছাড়াই হোক বা খুব নির্দিষ্ট কারণেই হোক সে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বুঝতে পারলো যে, আর্টিকেলটা তার একটা মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভেরোনিকা আশ্রমের জানালা দিয়ে বাইরে ল্যুবল্জানার ছোট্ট স্কয়ারটার দিকে তাকালো। মানুষ যদি না-ই জানে স্লোভেনিয়া কোথায় তাহলে ল্যুবল্জানা নিশ্চয় একটা অতিগল্প, সে ভাবছিলো। অনেকটা আটলান্টিস অথবা লিমুরিয়া অথবা অন্য হারিয়ে যাওয়া মহাদেশের মতো যেটা মানুষ শুধু কল্পনাতেই ধরে রেখেছে। পৃথিবীর কোন প্রান্তের কেউ যদি কোন দিন নাও গিয়ে থাকে, তবুও একটা আর্টিকেল শুরু করতে কেউ এ প্রশ্ন করতে পারে না যে, এভারেস্ট পর্বত কোথায়। তারপরও ইউরোপের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাগাজিনের সাংবাদিক এ প্রশ্ন করতে একটুও লজ্জা বোধ করলেন না। কারণ তিনি জানেন যে, তার পাঠকদের অধিকাংশই স্লোভেনিয়া দেশটির কথা জানেন না, আর এর রাজধানী ল্যুবল্জানা’র কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।   

এমন সময় কী করে সময় কাটানো যায় তার একটা উপায় ভেরোনিকার মাথায় আসলো। দশ মিনিট সময় পার হয়ে গেলেও সে তার শরীরে কোন পরিবর্তনই বুঝতে পারছে না। সে ঠিক করলো যে, তার জীবনের শেষ কাজ হবে ঐ ম্যাগাজিনে একটা চিঠি লিখে জানানো যে, স্লোভেনিয়া হচ্ছে যুগোশ্লাভিয়া ভেঙ্গে টুকরো হওয়া পাঁচটি প্রজাতন্ত্রের একটি।

এই চিঠিই হবে তার স্যুইসাইড নোট। সে সেখানে তার মৃত্যুর আসল কোন কারণ উল্লেখ করবে না।

তার শবদেহ খুঁজে পেলে লোকজন বুঝে নিবে যে, একটা ম্যাগাজিন তার দেশের অবস্থান ঠিকভাবে বলতে না পারায় সে তার জীবনের অবসান ঘটিয়েছে। পত্র পত্রিকায় তাকে নিয়ে যে সব পরষ্পর বিরোধী খবর ছাপা হবে তখন তা কল্পনা করেই তার হাসি পাচ্ছিলো – কিছু হয়তো তার পক্ষে যাবে, কিছু তার বিপক্ষে এবং কেউ হয়তো এমন লিখবে, সে তার দেশের সম্মানের তাগিদে আত্মহত্যা করেছে। কত দ্রুত নিজের মনের পরিবর্তন হচ্ছে এটা ভেবে ভেরোনিকা অবাক হচ্ছিলো অথচ কিছুক্ষণ আগেই সে এর বিপরীতটা ভাবছিলো যে, বিশ্ব ও অন্যান্য ভৌগলিক সমস্যা নিয়ে তার দুর্ভাবনার কিছু নেই।

সে তার চিঠি লিখতে বসলো। মনটা ভালো থাকায় এক মুহূর্তের জন্য মৃত্যুটা আসলেই প্রয়োজন ছিলো কি না সেটা নিয়ে সে একটু ভাবলো। কিন্তু সে ওষুধগুলো খেয়ে ফেলেছে; তাই ফিরে আসার যথেষ্ট সময় আর নেই।

তবে ফিরে আসার অনেক মূহুর্ত তার ছিলো। তাছাড়া সে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে এ কারণে না যে, সে দুঃখী, ত্যক্ত-বিরক্ত একজন তরুণী অথবা ক্রমাগত বিষণ্ন একজন মানুষ। অনেক বিকাল তার কেটেছে ল্যুবল্জানার পথে পথে আনন্দের সাথে ঘুরে বেড়িয়ে অথবা আশ্রমে তার রুমের জানালা দিয়ে এক দৃষ্টিতে স্কয়ারে কবির ভাস্কর্যটায় বরফ পড়া দেখতে দেখতে। একবার তো প্রায় এক মাস যাবৎ তার মনে হয়েছে সে যেন আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে যখন একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তি ঐ স্কয়ারের মাঝে তাকে একটা ফুল উপহার দিয়ে বসেছিলো।

একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি হিসেবে নিজের প্রতি তার বিশ্বাস রয়েছে। খুব সাধারণ দু’ টা কারণ ছিলো তার মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে এবং সে নিশ্চিত ছিলো এ কারণগুলো যদি সে একটা নোটে ব্যাখ্যা করে যেতে পারতো তাহলে অনেকেই তার সাথে একমত হতো।

প্রথম কারণ হচ্ছে তার জীবনের সব কিছু বৈচিত্রহীন। এভাবে যদি তার যৌবন চলে যায় তাহলে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে অপরিবর্তনীয় কিছু ছাড়াই তার জীবন অস্তাচলে ঢলে পড়বে, রোগব্যাধি দেখা দিবে, বন্ধু-বান্ধবহীন হয়ে পড়বে। বেঁচে থাকার কোন রসদই তার থাকবে না হয়তো; সত্যি কথা বলতে হয়তো শুধু যন্ত্রণাই বেড়ে চলবে।

দ্বিতীয় কারণটি অবশ্য কিছুটা দার্শনিক কারণ। ভেরোনিকা খবরের কাগজ পড়ে, টিভি দেখে এবং বিশ্বে কী ঘটছে সে বিষয়ে সে দৃষ্টি রাখছে। চারদিকে ঘটে যাওয়া প্রতিটি জিনিসই তার কাছে ভুল মনে হয় এবং এ ভুল জিনিসগুলোকে সংশোধন করার কোন ক্ষমতা তার নেই – এটা তার মাঝে সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীনের একটা অসহায় অনুভূতির জন্ম দেয়।

যাই হোক, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তার জীবনের চরম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে যেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন  একটি অভিজ্ঞতা: মৃত্যু। সে ম্যাগাজিনে লেখা চিঠিটা শেষ করলো। তারপর এসব বাদ দিয়ে অন্য আরো কিছু বিষয়ের দিকে সে মনোযোগী হলো যেটা তার বেঁচে থাকা অথবা মরে যাওয়ার জন্য বেশি উপযুক্ত।

সে কল্পনা করতে চেষ্টা করছে মরে যাওয়াটা কেমন হবে, কিন্তু এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না।

তাছাড়া অল্প সময়ের মধ্যেই সে বুঝতে পারলো যে এ বিষয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

আর কত মিনিট?

তার জানা নেই। কিন্তু একটা ভাবনা সে উপভোগ করছে যে, সে একটা প্রশ্নের উত্তরের খুব কাছাকাছি যেটা সবাই নিজেকে করে থাকে। প্রশ্নটা হচ্ছে – ঈশ্বর কি রয়েছেন?

অন্যান্য অনেকের মতো তার জীবনে এটা নিয়ে মনের গভীরে কোন বিতর্ক নেই। পুরনো সমাজতন্ত্রের যুগে স্কুলগুলোতে এটাই শেখানো হতো যে, মৃত্যুই জীবনের শেষ এবং সে নিজেও এ ধারণা নিয়েই অভ্যস্ত। অন্যদিকে, তার মা-বাবা বা তার পূর্ব পুরুষরা গির্জায় গিয়েছে, প্রার্থনা করেছে, তীর্থে গিয়েছে এবং মনে মনে বিশ্বাস করেছে যে, ঈশ্বর তাদের কথা শুনছেন।

এই চব্বিশ বছর বয়সী জীবনের অভিজ্ঞতায় – যেটা খুব একটা কম অর্জনও নয় – ভেরোনিকা প্রায় নিশ্চিত যে, সব কিছুই মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়। এ কারণেই সে আত্মহত্যাকে বেছে নিয়েছে, এটাই হবে শেষ মুক্তি; শাশ্বত বিস্মৃতি।

তার অন্তরের অন্তঃস্থলে ঈশ্বর রয়েছেন কি না এ বিষয়ে এখনো কিছু সন্দেহ রয়েছে। হাজার বছরের সভ্যতা আত্মহত্যাকে একটি নীতিবিরুদ্ধ কাজ হিসেবে বিবেচনা করেছে সব সময় এবং সব ধর্ম মতেই এটা অবমাননাকর। কেননা মানুষ টিকে থাকার যুদ্ধ করে, পরাজিত হতে চায় না। মানবকুলকে জন্ম দিতে হবে, কেননা সমাজের জন্য কর্মী প্রয়োজন। তাই একটি দম্পতির মধ্যে ভালোবাসার অস্তিত্ব না থাকলেও তাদের একসাথে থাকতে হয়, এবং একটি দেশের সৈন্য, রাজনীতিবিদ ও কলাকুশলীর প্রয়োজন হয়।

যদি ঈশ্বর থাকেন এবং তিনি আছেন এটা যদি আমি বিশ্বাস না করি, তবে তিনি জানবেন যে মানুষের বোধবুদ্ধির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দারিদ্র্য, অন্যায়, লোভ ও একাকীত্ব দিয়ে তিনিই এ দ্বিধার সৃষ্টি করেছেন। তাঁর নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ভালো সংকল্পই ছিলো কিন্তু এর ফল হয়েছে সর্বনাশা; যদি ঈশ্বর থেকে থাকেন তবে তিনি তার যেসকল সৃষ্টি আগেই পৃথিবী ছেড়ে গেছে তাদের প্রতি দয়ালু হবেন, এবং তিনি হয়তো আমাদের এখানকার জীবন দানের জন্য দুঃখ প্রকাশও করবেন।    

এসব ভাবতে ভাবতে ভেরোনিকার মনে হলো নিষেধ আর কুসংষ্কার জাহান্নামে যাক! তার ধর্মপ্রাণ মা বলতেন, “ঈশ্বর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব জানেন”। তাই যদি হয় তবে সে আত্মহত্যা করবে জেনেই ঈশ্বর তাকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, এবং তার এই কাজে তিনি নিশ্চয়ই মনক্ষুণ্ন হবেন না।

ভেরোনিকার কিছুটা বিতৃষ্ণা বোধ হচ্ছিলো যেটা খুব দ্রুতই প্রকট হয়ে উঠলো।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তার জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা বাইরের স্কয়ারটার দিকে মনোযোগ হারিয়ে ফেললো। সে জানতো এটা শীতকাল, বিকাল চারটার মতো হয়তো বাজে, সূর্য খুব দ্রুতই অস্ত যাবে। সে জানতো চারপাশের এ লোকজনগুলো বেঁচে থাকবে। এ সময় একজন যুবক তার জানালার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। যুবকটা জানে না ভেরোনিকা মারা যাচ্ছে, তবু সে একবার ভেরোনিকার দিকে তাকালো। এক দল বলিভিয়ান (বলিভিয়া দেশটি কোথায়? আর্টিকেলটি এ প্রশ্নটি কেন করলো না?) মিউজিশিয়ান মহান স্লোভেনিয়ান কবি ফ্রেন্স প্রিজেরেন-এর ভাস্কর্যের সামনে বাদ্য বাজাচ্ছিলো; স্লোভেনিয়ান কবি ফ্রেন্স প্রিজেরেন মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব রেখে গিয়েছেন।

স্কয়ার থেকে ভেসে আসা এ সুর শেষ পর্যন্ত শুনতে সে কি বেঁচে থাকবে? এগুলো কি তার জীবনের একটা সুখস্মৃতি হয়ে থাকবে? – এই পড়ন্ত বিকাল, বিশ্বের অন্য কোন প্রান্তের একটি দেশের স্বপ্নমাখা সুর, এই উষ্ণ আরামদায়ক ঘর, তাকে অতিক্রম করে যাওয়া জীবনের আলো ঝলমলে সুদর্শন যুবক যে কি না ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিলো। ভেরোনিকা বুঝতে পারছে ওষুধের কাজ শুরু হয়েছে এবং এ যুবকটিই হয়তো শেষ ব্যক্তি যে তাকে দেখতে পেলো।  

ছেলেটি হাসছে। সেও একটা হাসি ফিরিয়ে দিলো – কেননা তার আর হারাবার কিছু নেই। ছেলেটি এবার হাত নাড়লো; সে এমন ভাব করলো যেন সে অন্য কিছুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে; যুবকটি দূরে সরে যাচ্ছে। কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেটি জানালার চেহারাটি চিরদিনের জন্যে ভুলে গিয়ে তার পথে হেঁটে চলে গেলো।

শেষ বারের মতো কারো কৌতুহলের কারণ হতে পেরে ভেরোনিকার ভালোই লাগছে। ভালোবাসা না পেয়ে সে নিজের জীবন শেষ করে দিচ্ছে এমন নয়। এমনও নয় যে, তার পরিবার তাকে ভালোবাসেনি কিংবা তার অর্থনৈতিক চরম সমস্যা রয়েছে অথবা কোন দুরারোগ্য ব্যাধি রয়েছে।

স্কয়ারে বলিভিয়ান বাজনার স্মৃতি, আর জানালার সামনে দিয়ে অতিক্রমকারী যুবকের স্মৃতি নিয়ে ভেরোনিকা ল্যুবল্জানার এই চমৎকার বিকালে মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবং সে যা দেখতে ও শুনতে পাচ্ছে তা নিয়েই সে আনন্দিত। এটা ভেবেও তার ভালো লাগছে যে, আরো ত্রিশ, চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ বছর তাকে এই একঘেয়েমি দেখতে হবে না; কেননা বছরের পর বছর এ জিনিসগুলো ক্রমাগত এর প্রকৃত সত্ত্বা হারাবে এবং জীবনের শোকাবহ ঘটনায় রূপ নেবে, যেখানে প্রতিটি জিনিস ও দিন হুবহু একই রকম।       

এই মুহূর্তে তার পেট গুলাচ্ছে এবং সে সত্যিকার অর্থেই অসুস্থতা বোধ করছে। খারাপ লাগছে, সে ভাবছিলো, আমি ভেবেছিলাম ঘুমের ওষুধ অতিরিক্ত খেলে সেটা সোজা ঘুম পাড়িয়ে দিবে। কিন্তু তার কানে অদ্ভুত গুঞ্জন হচ্ছে এবং বমির ভাব হচ্ছে।

বমি করে দিলে আমি মরবো না। ভেরোনিকা ভাবছিলো।

সে তার পেটের ব্যথা নিয়ে ভাবতে চাচ্ছে না; বরং মনোযোগ দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করছে দ্রুত ঘনিয়ে আসা রাতটার কথা, বলিভিয়ান দলটার কথা, যারা দ্রুত দোকানগুলো বন্ধ করে বাড়ি চলে যাচ্ছে তাদের কথা। তার কানের ভেতরের গুঞ্জন তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে এবং ওষুধগুলো খাওয়ার পর প্রথমবারের মতো ভেরোনিকার ভীতির সঞ্চার হলো, অজানা ভয়ঙ্কর ভীতি!

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০