fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

একুশ

বাতি জ্বালিয়ে ডা. ইগোর বিস্মিত হয়ে দেখলেন তরুণীটি তার অফিসের বাইরে ওয়েটিং রুমে বসে আছে।

“এখন খুব সকাল। আর আমি আজ সারাদিন সম্পূর্ণ ব্যস্ত,” ডা. ইগোর বললেন।

“আমি জানি এখন খুব সকাল,” সে বললো। “তবে এখনো পুরো সকাল হয়নি। আমি সামান্য একটু কথা বলবো, অল্প একটু সময়। আমার আপনার সাহায্য দরকার।”

ভেরোনিকার চোখের নীচে কালি পড়েছে এবং চুলও এলোমেলো, রাতে না ঘুমানোর সাধারণতঃ লক্ষণ। ডা. ইগোর তার রুমে তার কথা শোনার সিদ্ধান্ত নিলেন।

তিনি তাকে বসতে বলে রুমের বাতি জ্বালালেন এবং পর্দা খুলে দিলেন। আর এক ঘন্টার মধ্যে সকাল হবে, তখন তিনি বিদ্যুৎ বাঁচাতে পারবেন; হাসপাতালের অংশীদাররা খরচের বিষয়ে খুব কঠিন।

তিনি দ্রুত তার ডায়েরিতে চোখ বুলিয়ে নিলেন। জেডকা তার সর্বশেষ ইনসুলিন শক্ নিয়েছে এবং ফলাফল ইতিবাচক; তার অর্থ সে অমানবিক চিকিৎসা পদ্ধতিটা উৎরে এসেছে। এটা বেশ ভালো খবর, কেননা এই নির্দিষ্ট কেসটার ক্ষেত্রে ডা. ইগোর হাসপাতাল কাউন্সিল থেকে, এর ফলাফলের বিষয়ে কাউন্সিল সমস্ত দায়িত্ব নিবে এমন প্রত্যয়ন পত্র চেয়েছিলেন।

তিনি অন্য কিছু প্রতিবেদন পড়তে শুরু করলেন। রাতে দুই তিন জন রোগী উন্মত্ত আচরণ করছে। নার্সদের প্রতিবেদন অনুযায়ী তাদের একজন এডোয়ার্ড। সে রাত চারটায় তার ওয়ার্ডে ফিরেছে এবং তার ঘুমের ওষুধ খেতে অস্বীকার করেছে। ডা. ইগোরকে ব্যবস্থা নিতে হবে। যাই হোক, ভিলেট ভেতরে ভেতরে স্বাধীন, তবে রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর ভাবমূর্তিটা অক্ষুণ্ন রাখা প্রয়োজন।

“আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো আপনার কাছে জানার,” ভেরোনিকা বললো।

ডা. ইগোর তাকে পাত্তা দিলেন না। স্টেথোস্কোপ নিয়ে তার হার্ট ও ফুসফুসের অবস্থা দেখতে লাগলেন। তিনি তার প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করলেন এবং ছোট ফ্ল্যাশলাইট দিয়ে তার রেটিনা পরীক্ষা করলেন। তিনি দেখলেন সেখানে ভিট্রিওল বিষক্রিয়ার কোন লক্ষণ নেই।

তিনি সাথে সাথে ফোন করে নার্সকে কিছু জটিল নামের ওষুধ আনতে বললেন।

“মনে হচ্ছে তুমি গত রাতে তোমার ইনজেকশন নাওনি,” তিনি বললেন।

“কিন্তু আমি তো ভালো বোধ করছি।”

“আমি এই মাত্র তোমার চেহারা দেখলাম: চোখের নীচে কালি পড়েছে, ক্লান্তি দেখা যাচ্ছে, দ্রুত রিফ্লেক্স-এর অভাব রয়েছে। যদি তুমি চাও তোমার বাকি অল্প ক’টা দিন ভালো কাটুক তাহলে আমি যেমন বলি তেমনটা করো।”

“ঠিক সে কারণেই আমি এখানে এসেছি। আমি আমার অল্প সময়টা কাজে লাগাতে চাই, কিন্তু আমার নিজের মতো করে। আমি আসলে কতটুকু সময় পাবো?”

ডা. ইগোর তার চশমার উপর দিয়ে সরু চোখে ভেরোনিকার দিকে তাকালেন।

“আপনি আমাকে বলতে পারেন,” সে বললো। “আমি ভয় পাবো না অথবা অস্বাভাবিক কোন আচরণ বা অন্য কোন কিছু করবো না। আমি বাঁচতে চাই, কিন্তু আমি জানি সেটা সম্ভব নয়, তাই আমি আমার ভাগ্যের উপর সব ছেড়ে দিয়েছি।”

“তুমি কী চাও তাহলে?”

নার্স ইনজেকশন নিয়ে ঢুকলো। ডা. ইগোর মাথা ঝাকালেন এবং নার্স খুব আলতো ভাবে ভেরোনিকার সোয়েটারের হাতা গোটালো।

“আমার হাতে আর কত সময় আছে?” ভেরোনিকা আবার জিজ্ঞেস করলো; এর মধ্যে নার্স তাকে ইনজেকশন দিয়ে দিলো।

“চব্বিশ ঘন্টা বা তার চেয়েও কম।”

এ কথা শুনে ভেরোনিকা মাথা নীচু করে ফেললো এবং ঠোঁট কামড়ে ধরলো, এরপর দ্রুত আত্মসংবরণ করলো।

“আপনি আমার দু’ টা উপকার করুন। প্রথমতঃ আপনি আমাকে এমন কোন ওষুধ বা ইনজেকশন দিন যাতে আমি জেগে থাকতে পারি এবং আমার জীবনের বাকি সময়টা উপভোগ করতে পারি। আমি খুবই ক্লান্ত, কিন্তু আমি ঘুমাতে চাই না। এমন অনেক কিছু আমার করার আছে যেটা আমি ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম, সে দিনগুলোতে যখন আমি ভাবতাম জীবন চিরদিনের। সে জিনিসগুলোতে আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম, কারণ আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে জীবনে বেঁচে থাকার কোন অর্থ নেই।”

“আর দ্বিতীয় উপকারটি কী?”

“আমি ভিলেট ছেড়ে যেতে চাই যেন আমি বাইরে গিয়ে মরতে পারি। আমি ল্যুবল্জানা দুর্গ দেখতে চাই। এটা এখানে থাকলেও আমি কখনো সেখানে যাওয়ার ও ভালো করে দেখার আগ্রহ পাইনি। আমার সেই মহিলার সাথে কথা বলা দরকার যে গ্রীষ্মকালে বাদাম আর শীতকালে ফুল বিক্রি করেন। আমি অনেক বার তার পাশ কাটিয়ে গিয়েছি, কিন্তু আমার কখনোই তাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি তিনি কেমন আছেন। আর আমি জ্যাকেট ছাড়া খালি পায়ে বরফের উপর হাঁটতে চাই। কারণ আমি চরম শীতটা অনুভব করতে চাই; আমি সব সময় ঠান্ডা লাগার ভয়ে নিজেকে খুব ভালো ভাবে মুড়িয়ে বাইরে বের হয়েছি, ঠান্ডাটা আমার অনুভব করা হয়নি।     

“মূল কথা, ডা. ইগোর, আমি বৃষ্টির স্পর্শ অনুভব করতে চাই, আমি যে যুবকটাকে অনুভব করি তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসতে চাই, আমি যে তরুণরা আমাকে কফি অফার করতে চায় তাদের সবার সাথে আমি কফি খেতে চাই, আমি আমার মাকে চুমু খেতে চাই, তাকে বলতে চাই যে, আমি তাকে ভালোবাসি, তার কোলে মাথা রেখে কাঁদতে চাই, আমি নির্লজ্জের মতো আমার অনুভূতিগুলো দেখাতে চাই, কারণ এতোদিন এ ইচ্ছাগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও আমি এদের লুকিয়ে রেখেছিলাম।

“আমি গির্জায় যেতে চাই, আর সেখানে ঐ মূর্তিগুলো দেখতে চাই যেগুলো আমার কাছে কোন অর্থ বহন করেনি কখনো এবং দেখতে চাই সেগুলো এখন আমাকে কিছু বলে কি না। কোন মজাদার লোক যদি আমাকে ক্লাবের বাইরে আমন্ত্রণ জানায় আমি তা গ্রহণ করতে চাই এবং ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমি সারা রাত নাচতে চাই। তারপর আমি তার সাথে বিছানায় যেতে চাই, তবে সেভাবে নয় যেভাবে অন্য সবার সাথে যাই; নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে যাবো যেন এসবে আমার কোন অনুভূতি নেই। আমি আমাকে সপে দিতে চাই একজন পুরুষের কাছে, এ শহরের কাছে, জীবন ও পরিবারের কাছে এবং মৃত্যুর কাছে।”

ভেরোনিকার কথা শেষ হলে একটা পিনপতন নিরবতা নেমে আসলো। ডাক্তার ও রোগী একজন আর একজনের চোখে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে রইলো, সম্ভবতঃ মাত্র চব্বিশ ঘন্টা কাটানোর জন্য এতো সব সম্ভাবনায় বিভ্রান্ত দু ’জনেই।

“আমি তোমাকে কিছু উত্তেজক ওষুধ দিতে পারি, কিন্তু সেগুলো না খাওয়ার পরামর্শ দিবো,” ডা. ইগোর সবশেষে বললেন। “সেগুলো তোমাকে জাগিয়ে রাখবে, কিন্তু সেগুলো তুমি যে অভিজ্ঞতাগুলো নিতে চাচ্ছো সে অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে তোমার সকল শান্তি কেড়ে নিবে।”

ভেরোনিকার শরীর খারাপ লাগতে শুরু করেছে; যখনই তাকে ঐ ইনজেকশন দেয়া হয় তখনই তার শরীরের ভেতর খারাপ লাগতে শুরু করে।

“তোমাকে খুব মলিন দেখাচ্ছে। ভালো হয় এখন তুমি বিছানায় গেলে, আমরা আগামীকাল কথা বলি।”

তার আরো একবার মনে হলো চিৎকার করে কাঁদতে, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিলো। 

“আগামীকাল তো আর নেই, আপনি জানেন; আমি ক্লান্ত ডা. ইগোর, খুব ক্লান্ত। এজন্য আমি ওষুধের কথা বললাম। আমি সারা রাত জেগে ছিলাম, কিছুটা বেপরোয়া আবার কিছুটা পরাজিত হয়ে। আমি গতকাল ভয়ে আর একটা হিস্টিরিক্যাল অ্যাটাক করতে পারতাম, কিন্ত তাতে কী? আমার হাতে এখনো চব্বিশ ঘন্টা সময় রয়েছে এবং আমার এখনো অনেক কিছু করার আছে; আমার মনে হয় হতাশাগুলো এক পাশে সরিয়ে রাখাই ভালো।

“প্লিজ, ডা. ইগোর, আমাকে আমার বাকি অল্প সময়টা বাঁচতে দিন, আমরা তো দু’ জনেই জানি আগামীকাল অনেক দেরি হয়ে যাবে।”

“ঘুমাতে যাও,” ডাক্তার বললেন, “আর দুপুরে এসো। তখন আমরা আবার কথা বলবো।”

ভেরোনিকা দেখলো আর কোন উপায় নেই।

“আমি ঘুমাতে যাবো এবং আবার ফিরে আসবো, কিন্তু তার আগে কি আমি আর কয়েক মিনিট কথা বলতে পারি?”

“কয়েক মিনিট হলে বলতে পারো, আমি আজ খুব ব্যস্ত।”

“আমি সরাসরিই বলি। গতরাতে আমি প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ নিঃসংকোচে নিজেকে কামোত্তেজিত করে তুলি। আমার মনে হয়েছে এটা আমি আগে কখনো সাহস করতাম না। যে কাজে আগে ভয় পেতাম বা যে কাজ থেকে বিরত থাকতাম সে কাজ করে আমি আনন্দ পেয়েছি।”

ডা. ইগোর তার পেশাগত পরিবেশ আশা করছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না এ আলোচনা কোন দিকে যাচ্ছে, এবং তিনি তার কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে কোন ঝামেলাও চাচ্ছিলেন না।

“এ থেকে আমার মনে হয়েছে আমি একজন বিকৃত কামুক ব্যক্তি; ডাক্তার, এটা কি আমার আত্মহত্যা করতে চাওয়ার পিছনে কোন কারণ হতে পারে, আমি জানতে চাই। আমি আসলে আমার নিজের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি না।”

আমাকে একে শুধু একটা উত্তর দিতে হবে, তিনি ভাবলেন। এখানে ভবিষ্যতে যৌন অসদাচরণের অভিযোগে মামলা এড়াতে কোন নার্সকে আলোচনার সাক্ষী হিসেবে ডাকার কোন প্রয়োজন নেই। এটুকু ভেবে ডা. ইগোর একটু স্বস্তি বোধ করলেন।

“আমরা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন জিনিস চাই,” তিনি উত্তর দিলেন। “আমাদের মা-বাবারাও এমনই। এতে সমস্যার কী আছে?

“আপনি আমাকে বলুন।”

“এটা নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে। কারণ যখন প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখে এবং তাদের মধ্যে মাত্র অল্প কয়জন তাদের স্বপ্নটাকে বুঝতে পারে বা অনুভব করতে পারে তখন আমরা সবাই তাদের দেখে ভীত হয়ে পড়ি।”

“যদি তাদের অল্প কয়েক জন ঠিক-ই করে থাকে?”

“যারা শক্তিশালী তারাই সঠিক। এই ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে, সাহসীরাই ভীত, কারণ তারা তাদের ধারণাকে সবার উপর চাপিয়ে দেয়।”

ডা. ইগোর আর এগোতে চাইলেন না।

“এখন, প্লিজ যাও এবং একটু বিশ্রাম নাও; আমার আরো রোগী দেখার আছে। তুমি যদি আমার কথা মতো চলো তাহলে তোমার দ্বিতীয় অনুরোধের বিষয়ে কী করা যায় আমি দেখবো।”

ভেরোনিকা রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ডাক্তারের পরের রোগী জেডকা, যে ছাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় আছে, কিন্তু ডা. ইগোর তাকে আর একটু অপেক্ষা করতে বললেন; তাকে এই মাত্র শেষ হওয়া আলাপের কিছু নোট নিতে হবে।

ভিট্রিওলের উপর তার গবেষণাপত্রে তাকে যৌনতা নিয়ে একটি লম্বা অধ্যায় যোগ করতে হবে। কেননা অনেক স্নায়বিক পীড়া ও মনোবৈকল্যের শুরুই হয় যৌনতা থেকে। তিনি বিশ্বাস করেন উদ্ভট কল্পনা হচ্ছে মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক ইমপাল্স এর ফল। আর এটা যদি বুঝতে পারা না যায় তখন এ শক্তি অন্য কোন ভাবে মুক্ত হয়।

চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার সময় ডা. ইগোর একটা চমৎকার গবেষণা পড়েছিলেন যেখানে যৌনতার রকমফের, ধর্ষকাম, মর্ষকাম, সমকাম, কোপরোফ্যাগি, কোপরোলালিয়া, পর্যবেক্ষণকাম – এ রকম হাজারটা প্রকারে উল্লেখ রয়েছে।

প্রথমে তিনি এগুলোকে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ কিছু লোকের বিভিন্ন রকমের আচরণের উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, যারা তাদের সঙ্গীদের সাথে একটা সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়নি। তবে সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে তার পেশাতে তিনি যত দেখেছেন এবং তার রোগীদের সাথে যত কথা বলেছেন, তিনি বুঝতে পেরেছেন যে প্রত্যেকেরই কিছু অসাধারণ গল্প রয়েছে। তার রোগীরা তার চেম্বারে একটা আরাম কেদারায় বসে এবং মেঝের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাদের নিজস্ব লম্বা গবেষণা বলতে থাকে যার উপর ভিত্তি করে তারা একে ‘অসুস্থতা’ বলেন (যেন তিনি একজন ডাক্তার নন যিনি অসুস্থতা কী বোঝেন); অথবা ‘বিকৃত আচরণ’ বলেন (যেন তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ  নন যিনি কোনটা বিকৃত আচরণ বা অবিকৃত আচরণ তা নির্ণয় করতে পারেন)।

একে একে এসব স্বাভাবিক লোক তাদের উদ্ভট কল্পনা বর্ণনা করতে থাকে যার সবগুলোই যৌন কামনা উদ্রেককারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিয়ে লেখা সেই বিখ্যাত গবেষণাপত্রে পাওয়া যায়। ঐ গবেষণা পত্র সত্যিকার অর্থে যতক্ষণ পর্যন্ত না সঙ্গীর অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যেককে তার পছন্দ মতো কামোত্তেজনার চরমে পৌঁছানোর অধিকার সংরক্ষণ করেছে।

সেখানে দেখা যায় যে, খ্রিস্টিয় আশ্রমে পড়ালেখা করা নারীরা যৌনাচারের শিকার হওয়ার স্বপ্ন দেখে; স্যুটেড-বুটেড অনেক উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা বলছে যে, তারা রোমানিয়ান পতিতালয়ে যান শুধুমাত্র পতিতাদেরকে উত্তেজিত অবস্থায় দেখতে। ছেলেরা ছেলেদের প্রেমে পড়ছে, মেয়েরা তাদের স্কুল বান্ধবীর প্রেমে পড়ছে। অনেক স্বামী তাদের স্ত্রীদের অপরিচিতি লোকের সাথে মিলিত হতে দেখতে চান। অনেক স্ত্রী আছেন তাদের স্বামীরা ব্যভিচার করেছেন জেনে নিজেই নিজেকে কামোত্তেজিত করেন। অনেক মহিলা আছেন যারা ডেলিভারি ম্যানের কাছে নিজেকে সপে দেয়ার তাড়না চেপে রাখেন, অনেক পুরুষ আছেন যারা সীমান্ত পার হয়ে আসা মেয়েলি পোশাক পরা পুরুষদের সাথে গোপন রোমান্স করতে চায়।

আর গুপ্ত উপাসনা। প্রত্যেকেই মনে হয় তার জীবনে একবার হলেও গুপ্ত উপাসনায় অংশ নিতে চায়।

ডা. ইগোর এক মুহূর্তের জন্য তার লেখা থামালেন এবং নিজের সম্পর্কে ভাবতে লাগলেন: তার নিজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কেমন? অবশ্যই তিনি পছন্দ করতেন। তিনি কল্পনা করলেন একটা গুপ্ত উপাসনা অবশ্যই সম্পূর্ণ অরাজক ও আনন্দদায়ক একটা বিষয় যেখানে অধিকারের অনুভূতি বলতে কিছু থাকে না, থাকে শুধু আনন্দ আর দ্বিধা।

তাহলে কি এতো লোকের তিক্ততার মতো বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কোন একটা প্রধান কারণ রয়েছে? বিয়ে হচ্ছে চাপিয়ে দেয়া একগামিতা। ডা. ইগোর-এর মেডিক্যাল লাইব্রেরিতে নিরাপদে যে গবেষণাগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে সেগুলোর মতে বিয়ের মাধ্যমে একত্রে বসবাস করার তৃতীয় বা চতুর্থ বছরে যৌনাকাঙ্ক্ষা তিরোহিত হয়। তারপর স্ত্রী নিজেকে বাতিল ভাবতে শুরু করেন আর স্বামী একটা ফাঁদে আটকা পড়েছেন বলে মনে করে এবং ভিট্রিওল বা তিক্ততা সব কিছু থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে তাদের গ্রাস করা শুরু করে।

মানুষ ধর্মীয় গুরুর তুলনায় মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে বেশি খোলামেলা কথা বলে কারণ চিকিৎসকরা তাদের নরকে যাওয়ার হুমকি দেন না। ডা. ইগোর মনোরোগ চিকিৎসক হিসেবে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় রোগীরা তাকে যা বলতে চেয়েছেন তার প্রায় সবই শুনেছেন।

তার কাছে যেভাবে বলেছে এমনটা তারা খুব কমই করেছে। এ পেশায় এতো বছর কাটানোর পরও তার মনে প্রশ্ন জাগে কেন তারা অন্যদের থেকে ভিন্ন হতে ভয় পায়।

যখনই তিনি এর উত্তর খুঁজতে গিয়েছেন তখন একটা সাধারণ উত্তরই এসেছে: “আমার স্বামী মনে করেন আমি একজন বেশ্যার মতো আচরণ করছি,” অথবা পুরুষদের ক্ষেত্রে: “আমার শ্রদ্ধাটা আমার স্ত্রী’র প্রাপ্য।”

আলোচনাটা সাধারণতঃ এখানেই থেমে যায়। এটা বলার আর কোন উপায় থাকে না যে, প্রত্যেক মানুষের ভিন্ন আঙ্গুলের ছাপের মতো ভিন্ন যৌন রূপরেখা রয়েছে; কেউই সেটা বিশ্বাস করতে চায় না। তবে বিছানায় সংস্কারমুক্ত হতে যাওয়াটা চরম বিপজ্জনক; এক্ষেত্রে একটা ভয় থাকে যে সঙ্গী তার পূর্বধারণা বশবর্তী হয়ে নিজেকে একজন ক্রীতদাস মনে করতে পারে।

আমি পৃথিবীটাকে পরিবর্তন করতে পারবো না, ডা. ইগোর নিজের কাছে হেরে যাওয়ার মতোই ভাবলেন; নার্সকে বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠা জেডকাকে পাঠাতে বলে ভাবছিলেন, কিন্তু অন্ততঃ আমি আমার গবেষণা পত্রে আমার চিন্তাগুলো উল্লেখ করতে পারি।

এডোয়ার্ড ভেরোনিকাকে ডা. ইগোর-এর কনাসাল্টিং রুম থেকে বের হয়ে ওয়ার্ডের দিকে যেতে দেখলো। তার মনে হচ্ছিলো এখনই মন খুলে সে তার গোপন কথাগুলো ভেরোনিকাকে বলে, একই সততা ও স্বাধীনতা নিয়ে যেমন সততা ও স্বাধীনতা নিয়ে গত রাতে সে তার শরীর মেলে দিয়েছিলো।

এটা তার জন্য সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলোর একটা, যখন থেকে সে এই ভিলেট-এ সিজোফ্রেনিক হিসেবে ভর্তি হয়ে আছে তখন থেকেই। সে নিজেকে থামালো। নিজেকে আটকাতে পেরে তার ভালো লাগছে। যদিও বাস্তব পৃথিবীতে ফেরার আকাঙ্ক্ষা তাকে অস্থির করে ফেলছে।

“সবাই জানে যে এই তরুণী এ সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত টিকবে না, কিন্তু সেটা কোন ব্যাপার না।”

অথবা সম্ভবতঃ ঠিক সে কারণেই তার সব গল্প তরুণীটিকে বলে ফেলাটাই ভালো। তিন বছর ধরে সে শুধুমাত্র মারি’র সাথে কথা বলে এসেছে, এমন কি সে নিশ্চিত না যে, মারি তাকে সম্পূর্ণ বুঝতে পেরেছে কি না; একজন মা হিসেবে মারি এটাই ভেবেছে যে এডোয়ার্ড-এর মা-বাবাই ঠিক ছিলেন। তারা তার সবচেয়ে ভালোটাই চেয়েছেন, আর তার ‘অপার্থিব স্বপ্ন’ বিষয়টা বাস্তব জগতের বাইরে সম্পূর্ণ বয়োসন্ধিকালের একটি বোকামি স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না।

‘অপার্থিব স্বপ্ন’। যেটা তাকে নরকের পাতালে নিয়ে গিয়েছে; তার পরিবারের সাথে অসংখ্য যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে, এমন একটা অপরাধ বোধের মাধ্যমে যে সে যা খুশি তাই করতে সক্ষম না এবং চূড়ান্তভাবে তাকে একটা অন্য জগতে আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে। মারি যদি এখানে না থাকতো, তাহলে তাকে সেই ভিন্ন বাস্তবতায় বাস করতে হতো। মারিকে ধন্যবাদ, তার জন্যই এডোয়ার্ড এখনো বুঝতে পারে তার চার পাশে কী ঘটছে।

কিছু দিন আগে তারই বয়সী এক তরুণী পিয়ানোতে মুনলাইট সোনাটা বাজাচ্ছিলো। এডোয়ার্ড আরো একবার তার ‘অপার্থিব স্বপ্ন’ নিয়ে সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলো এবং বলতে পারবে না কে এই সমস্যাটার মূলে পিয়ানোর সুর না কি তরুণী না চাঁদ না কি দীর্ঘ সময় যাবৎ তার ভিলেট-এ থাকা।

একজন নার্স বাঁধা না দেয়া পর্যন্ত এডোয়ার্ড ভেরোনিকাকে মহিলা ওয়ার্ড পর্যন্ত অনুসরণ করলো।

“এখানে আসা তোমার উচিত না, এডোয়ার্ড। তুমি বাগানে যাও, এখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। আজকের দিনটা একটা চমৎকার দিন হবে মনে হয়।”

ভেরোনিকা ঘুরে তাকালো।

“আমি একটু ঘুমাতে যাচ্ছি,” সে নরম স্বরে বললো। “ঘুম থেকে উঠলে আমরা আবার কথা বলবো।”

ভেরোনিকা জানে না কেন, তবে এ যুবক তার পৃথিবীর একটা অংশ হয়ে উঠেছে, না কি তার জীবনের অবশিষ্ট ছোট্ট অংশের। সে নিশ্চিত যে, এডোয়ার্ড তার বাজানো সুর বুঝতে পারে এবং তার প্রতিভার মূল্যায়ন করতে পারে; সে একটা শব্দ উচ্চারণ না করলেও তার চোখ সব কথা বলে। এখন যেমন এই ওয়ার্ডের দরজায় ঐ চোখগুলো অনেক কথা বলছে যেটা ভেরোনিকা শুনতে চায় না।

ঐ চোখের ভাষায় রয়েছে আবেগ, ভালোবাসা।

মানসিক রোগীদের সাথে থেকে আমি দ্রুত বিকারগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছি। সিজোফ্রেনিক এমন কিছু অনুভব করতে পারে না, কোন মানুষের প্রতি না। ভেরোনিকা ভাবছিলো।

ভেরোনিকার ফিরে গিয়ে তাকে একটা চুমু দিতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু সে তা করলো না। নার্সরা সেটা দেখতে পেয়ে ডা. ইগোরকে বলবেন, আর ডাক্তার নিশ্চয়ই এমন একটা মেয়েকে ভিলেট ছাড়তে দিবেন না যে একজন সিজোফ্রেনিককে চুমু দিয়ে বসেছে।

এডোয়ার্ড নার্সের দিকে তাকালো। সে যা ভেবেছিলো তরুণীটির প্রতি তার চেয়েও বেশি মোহ তার, কিন্তু সে নিজেকে সামলালো। সে মারি’র কাছে গিয়ে তার পরামর্শ নিবে, মারি-ই একমাত্র ব্যক্তি যার সাথে সে সব কিছু খুলে বলে। সে নিসন্দেহে সেটা বলবে যা সে শুনতে চাচ্ছে, এই যেমন এ ব্যাপারে প্রেম হচ্ছে বিপজ্জনক ও অর্থহীন উভয়ই। মারি তাকে হয়তো বলবে এসব বোকামি চিন্তা বাদ দিয়ে সাধারণ সিজোফ্রেনিক-এ ফিরে যেতে।

সে অন্য নিবাসীদের সাথে খাবার ঘরে যোগ দিলো, খাবার খেলো এবং বাগানের হাঁটতে বের হলো। বাইরে রোদ (আজকের তাপমাত্রা শূন্যের নীচে) পোহানোর সময় সে মারি’র কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে একা থাকতে চায়। মারি’র কিছু বলার দরকার হলো না, এডোয়ার্ড অন্যের একাকীত্বের চাহিদার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জানে।

একজন নতুন নিবাসী এডোয়ার্ড-এর কাছে আসলো, সে নিশ্চয়ই অন্য আর কাউকে চেনে না।

“ঈশ্বর মানুষকে শাস্তি দিচ্ছেন,” সে বললো। “সে শাস্তি দিচ্ছেন প্লেগ দিয়ে। যাই হোক, আমি তাকে স্বপ্নে দেখেছি, তিনি আমাকে বলেছেন এখানে আসতে এবং স্লোভেনিয়াকে রক্ষা করতে।”

এডোয়ার্ড অন্য দিকে সরে গেলো। লোকটি তখনো চিৎকার করে যাচ্ছিলো: “তোমার কি মনে হয় আমি উন্মাদ? তাহলে যিশুর উপদেশ বাণী পড়ো। ঈশ্বর তাঁর একমাত্র পুত্রকে পাঠিয়েছেন এবং তাঁর পুত্র পুনরুত্থিত হবেন।”

কিন্তু এডোয়ার্ড আর তাকে শুনতে পাচ্ছিলো না। সে পেছনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়েছিলো এবং ভাবছিলো কী হচ্ছে তার। কেন তার এ জায়গা ছেড়ে যেতে মন চাচ্ছে যেন দীর্ঘদিন যাবৎ সে যে প্রশান্তির খোঁজে ছিলো তা সে পেয়েছে? যখন পারিবারিক সমস্যাগুলো মিটে গেছে তখন সে কেন আবার তার পরিবারকে লজ্জায় ফেলতে চাচ্ছে? সে উত্তেজিত হয়ে উঠানামা করছিলো আর অপেক্ষা করছিলো মারি কখন তার নিরবতা ভেঙ্গে ফিরে আসবে যেন তার সাথে সে কথা বলতে পারে। কিন্তু মারিকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে আরো দূরে সরে যাচ্ছে।

এডোয়ার্ড ভিলেট থেকে পালানোর উপায় জানতো। এর নিরাপত্তা অনেক কড়া মনে হলেও এতে অনেক ফাঁক রয়েছে। এর কারণ অবশ্য সরল, ভিলেট-এ একবার কেউ আসলে সে আর ফিরে যেতে চায় না। ভিলেট-এর পশ্চিম পাশের একটা দেয়াল বেয়ে খুব সহজে উঠে যাওয়া যায়, দেয়ালটাতে পাদানির মতো পা রাখার জায়গা রয়েছে। কেউ এটা বেয়ে উঠতে চাইলে দেয়াল পার হলেই দেখবে সে একটা গ্রামীণ এলাকায় রয়েছে। সেখান থেকে পাঁচ মিনিট গেলেই একটা রাস্তা পড়বে যার উত্তরে ক্রোয়েশিয়া। যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে আর প্রতিবেশী ভাতৃত্ববোধ আগের থেকে বেড়েছে, তাই সীমান্ত আর আগের মতো পাহাড়া দেয়া হয় না; ভাগ্য ভালো হলে সে ছয় ঘন্টার মধ্যে বেলগ্রেড চলে যেতে পারবে।

এডোয়ার্ড এ রাস্তায় আগেও কয়েকবার গিয়েছে, কিন্তু সে সব সময়ই ফিরে এসেছে কারণ সামনে এগিয়ে যাওয়ার কোন সংকেত সে পায়নি। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন: শেষ পর্যন্ত তার এগিয়ে যাওয়ার সংকেত এসেছে সুবজ চোখ, বাদামী চুল আর চকিত চাহনীর তরুণী হয়ে যে কি না মনে করে সে কী চায় তা সে জানে।

এডোয়ার্ড দেয়াল বেয়ে উঠে যাওয়ার চিন্তা করছিলো। তারপর ভিলেট ছেড়ে চলে যাবে, আর কোন দিন  স্লোভেনিয়া ফিরে আসবে না। কিন্তু মেয়েটি তো ঘুমাচ্ছে, সে অন্ততঃ তাকে একবার বিদায় বলে যেতে চায় ।

সবাই ‘রোদ পোহানো’ শেষ করলে ভাতৃসংঘ লাউঞ্জে জড়ো হলো, এডোয়ার্ডও তাদের সাথে যোগ দিলো।

“এই পাগল এখানে কী করছে?” দলের সবচেয়ে বয়স্ক লোকটা জিজ্ঞেস করলো।

“বাদ দাও না,” মারি বললো, “তাছাড়া, আমরাও তো বিকারগ্রস্ত।”

তারা সবাই হেসে উঠলো এবং গতকালের বক্তৃতা নিয়ে আলাপ করতে শুরু করলো। প্রশ্ন উঠেছিলো: সুফি ধ্যান কি সত্যিই পৃথিবী পরিবর্তন করতে পারে? বিভিন্ন তত্ত্ব ও তার সাথে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হচ্ছিলো, পদ্ধতি, বিপরীত ধারণা, সমালোচনা, সমালোচনার বিপরীতে তা উত্তোরণের জন্য অনেক শত বছরের পরীক্ষা নিরীক্ষা এসব নিয়ে কথা হচ্ছিলো।

এসব আলোচনায় এডোয়ার্ড-এর বিরক্ত লাগছিলো। এসব লোকজন নিজেদের একটা মানসিক হাসপাতালে বন্দী করে রেখেছে; এবং আদৌ কোন ঝুঁকি না নিয়েই তারা পৃথিবীটাকে রক্ষা করতে চাচ্ছে। কারণ তারা জানে, তাদের অনেক ধারণা বাস্তবসম্মত হলেও বাইরের পৃথিবীতে তাদেরকে হাস্যকর বস্তু বলে মনে করা হতে পারে। প্রত্যেকেরই প্রতিটি বিষয়ে নিজস্ব তত্ত্ব রয়েছে, এবং তারা মনে করে তাদের সত্যটাই ব্যাপার অন্য কিছু নয়। তারা দিন, রাত, সপ্তাহ ও বছর পার করে ফেলে এ বিষয়ে কথা বলে কিন্তু কখনোই বুঝতে চেষ্টা করে না যে, ভালো হোক বা মন্দ হোক একটা ধারণা তখনই টিকে থাকে যখন এটাকে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়।

সুফি ধ্যান কী? ঈশ্বর কী? পরিত্রাণ কী, অর্থাৎ পৃথিবী রক্ষা করা কী? কিছুই না। যদি প্রত্যেকে এখানে এভাবেই থাকে – এবং ভিলেট-এর বাইরে লোকজনও তেমনি থাকে – যেভাবে জীবন চলছে সেভাবেই চলে এবং অন্যদের সেভাবেই চলতে দেয়, তাহলে ঈশ্বর প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটি সর্ষে দানাতে, প্রতিটি মেঘখন্ডে থাকবেন অর্থাৎ এক মুহূর্তের পর আর এক মুহূর্ত আসতেই থাকবে। ঈশ্বর রয়েছেন এবং মানুষ বিশ্বাস করে যে তাদের অবলোকন করা হচ্ছে, কেননা বিশ্বাসের উপরই জীবন চলে এ মত গ্রহণ করাটা সব চেয়ে সহজ মনে হয়।

সে যখন ভেরোনিকার পিয়ানোতে ফিরে আসার অপেক্ষা করছিলো তখন সুফি সম্রাট কী শেখাচ্ছিলেন তা তার মনে পড়লো: শুধু গোলাপটার দিকে তাকিয়ে থাকা, আর বেশি কিছুর দরকার নেই?

তারা গভীর ধ্যানের অভিজ্ঞতা নিয়ে, ‘অপার্থিব স্বপ্ন’-এর খুব কাছে চলে যাবার মতো অভিজ্ঞতা নিয়েও তারা তত্ত্বের আলোচনা, যুক্তি-তর্ক, সমালোচনা ও নতুন তত্ত্ব তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছে।

সে মারি’র চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু মারি অন্য দিকে তাকিয়ে। এডোয়ার্ড তখনই এ ব্যাপারটা শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলো; সে মারির কাছে গিয়ে তার হাত ধরে টানতে লাগলো।

“থামো, এডোয়ার্ড।”

এডোয়ার্ড বলতে পারতো: “আমার সাথে এসো।” কিন্তু সে সবার সামনে এমনটা করতে চায় না, কেননা তারা তার স্পষ্ট কথায় অবাক হয়ে যেতে পারে। এ কারণে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো এবং মিনতিপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।

এডোয়ার্ড-এর এই আচরণে ছেলে মেয়ে সবাই হেসে উঠলো।

“তুমি তার কাছে একজন সাধু হয়ে উঠেছো,” কেউ একজন মারিকে বললো, “এটা নিশ্চয়ই গতকালের ধ্যানের ফল।”

তবে এডোয়ার্ড-এর বছরের পর বছর নিরবতা তাকে চোখ দিয়ে কথা বলা শিখিয়েছিলো; সে তার সমস্ত শক্তি তাতে নিয়োগ করলো। সে যেমন একেবারে নিশ্চিত যে ভেরোনিকা তার আবেগ ও ভালোবাসা বুঝতে পেরেছে, তেমনি সে জানতো যে মারি’ও তার হতাশা বুঝতে পারবে, কেননা তার সত্যিই মারিকে দরকার।

মারি আর বেশিক্ষণ নিজেকে আটকাতে পারলো না, সে উঠে দাঁড়ালো এবং এডোয়ার্ড-এর হাত ধরে উঠালো।

“চলো আমরা হেঁটে আসি,” সে বললো, “তুমি মন খারাপ করে আছো।”

তারা আবার বাগানে আসলো। একটা নিরাপদ দূরত্বে যেখান থেকে কেউ তাদের কথা শুনতে পারবে না, আসা মাত্রই এডোয়ার্ড তার মুখ খুললো।

“আমি কয়েক বছর ধরে ভিলেট-এ রয়েছি,” সে বললো। “আমি আমার মা-বাবার বিব্রত হওয়া থেকে বিরত আছি, আমি আমার সমন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে এক পাশে সরিয়ে রেখেছি, কিন্তু তারপরও আমার ‘অপাথিব স্বপ্ন’ বিষয়টা আমার মাঝে রয়েই গেছে।”

“আমি জানি,” মারি বললো। “আমরা প্রায়ই এটা নিয়ে কথা বলি, এবং আমি এ-ও জানি তুমি কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছো: তোমার ভিলেট ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়েছে।”

এডোয়ার্ড আকাশের দিকে তাকালো; মারি কি তাহলে একই রকম মনে করছে?

“আর এটা ঐ মেয়েটার জন্য,” মারি বললো। “আমরা এখানে অনেককেই মারা যেতে দেখেছি, সব সময়ই অপ্রত্যাশিত সময়ে, এবং সাধারণতঃ জীবনের প্রতি তারা উদাসীন হয়ে যাওয়ার পর। কিন্তু এই প্রথম আমরা দেখছি এটা একজন তরুণ, সুন্দর, স্বাস্থ্যবান একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে যার বেঁচে থাকার অনেক কিছু রয়েছে। ভেরোনিকাই একমাত্র ব্যক্তি যে ভিলেট-এ চিরদিন থাকতে চায় না। আর এটা আমাদের মনেও নিজেদের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে: আমাদের ব্যাপারটা কী তাহলে? আমরা এখানে কী করছি?”

সে মাথা ঝাঁকালো।

“গত রাতে আমিও আমাকে জিজ্ঞেস করেছি আমি হাসপাতালে কী করছি? আর ভেবেছি ঐ নীচে স্কয়ারে থাকাটা কী চমৎকার, অথবা ঐ তিনটা ব্রীজে, থিয়েটারের উল্টোপাশের মার্কেটে, আপেল কিনতে কিংবা আজকের আবহাওয়া নিয়ে কথা বলতে। অবশ্যই আমাকে পুরনো ভুলে যাওয়া অনেক কিছু নিয়ে লড়াই করতে হবে, যেমন, অপরিশোধিত বিল, প্রতিবেশীদের নিয়ে সমস্যা, যারা আমাকে বুঝতে পারে না তাদের বিদ্রæপাত্মক দৃষ্টি, একাকীত্ব, আমার বাচ্চাদের অভিযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এসবই জীবনের অংশ বলে আমার মনে হয়; কিন্তু এই সামান্য সমস্যা নিয়ে চলতে তুমি যে মূল্য দিচ্ছো তার থেকে সমস্যাগুলো তোমার না মনে করে আরো বেশি মূল্য দিচ্ছো। আমি আজ রাতে আমার প্রাক্তন স্বামীর কাছে যেতে চাচ্ছি তাকে ধন্যবাদ দেবার জন্য। তুমি কি ভাবছো?”

“আমি জানি না। তোমার কি মনে হয় আমার মা-বাবার বাড়িতেই ফিরে যাওয়া উচিত এবং তাদের একই বিষয়ে আবার বলা উচিত?”

“সম্ভবতঃ। মূলতঃ আমাদের জীবনে প্রতিটি ঘটনাই আমাদের ভুল এবং শুধুমাত্র আমাদেরই। প্রচুর মানুষ আমাদের মতোই সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়, তবে তারা ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। আমরা সবচেয়ে সহজ উপায়টার খোঁজ করি: একটা ভিন্ন জগত খুঁজে বের করি।

এডোয়ার্ডের মনে হলো মারি ঠিক বলেছে।

“আমার আবার বেঁচে উঠতে মন চাচ্ছে এডোয়ার্ড। আমি সব সময় যে ভুলগুলো করতাম সেগুলো আবারও করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কখনোই এ সাহস হতো না, মনে হতো আতঙ্কের অনুভূতি যদি আবার চেপে বসে আমার উপর। কিন্তু কিসের চিন্তা আমাকে ক্লান্ত করে ফেলছে, এগুলো তো আমাকে মেরে বা অজ্ঞান করে ফেলবে না। আমি নতুন বন্ধু তৈরি করতে পারি, তাদের শেখাতে পারি জ্ঞানী হতে হলে কী করে বিকারগ্রস্ত হতে হয়। আমি তাদের বলবো সুআচরণের ব্যবহারবিধি অনুসরণ না করে তাদের নিজের জীবনকে, চাওয়াকে, অ্যাডভেঞ্চারকে আবিষ্কার করতে এবং বাঁচতে। আমি ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে ক্যাথলিকদের, কোরান থেকে মুসলিমদের, তাওরাত থেকে ইহুদিদের, এরিস্টেটল থেকে নিরীশ্বরবাদীদের পড়ে শোনাবো। আমি আবারো কোন আইনজীবী হবো না, কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতাকে নারী-পুরুষ সম্পর্কে লেকচার দিতে ব্যবহার করবো, যে নারী-পুরুষরা সত্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন এবং যাদের লেখা একটা শব্দতে গিয়ে মর্ম খুঁজে পেয়েছে: বাঁচা। যদি তুমি বেঁচে থাকো ঈশ্বর তোমার সাথে বাঁচবে। তুমি যদি তার ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকাকে ফিরিয়ে দাও, তাহলে সেও ঐ দূর স্বর্গে পালাবেন এবং তিনি হবেন একটা দার্শনিক ভাবনার বিষয়। প্রত্যেকেই এটা জানে, কিন্তু কেউ প্রথম পদক্ষেপটা নিতে চায় না, খুব সম্ভবতঃ পাগল নামে ডাকা হবে এই ভয়ে। অন্ততঃ আমাদের সেই ভয় নেই, এডোয়ার্ড। আমরা ইতিমধ্যেই ভিলেট নিবাসী।”

“একটা কাজ আমরা করতে পারবো না। আমরা প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারবো না। কেননা বিরোধী পক্ষ আমাদের অতীতের প্রমাণ খুঁজে বেড়াবে,” এডোয়ার্ড বললো।

মারি হেসে উঠলো এবং এডোয়ার্ড-এর সাথে একমত হলো।

“আমি জীবন নিয়ে ক্লান্ত। আমি জানি না আমি আমার ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারবো কি না, কিন্তু ভাতৃসংঘে, এই বাগানে, ভিলেট-এ বিকারগ্রস্ত সেজে জীবন কাটানো আমার যথেষ্ট হয়েছে।”

“যদি আমি বের হয়ে যাই, তুমিও কি যাবে?” এডোয়ার্ড জানতে চাইলো।

“তুমি তো বের হয়ে যেতে পারবে না।”

“কিছুক্ষণ আগে আমি প্রায় বের হয়ে গিয়েছিলাম।”

“আমি জানি না, আমি সব কিছু নিয়ে খুব ক্লান্ত, যদিও এসব নিয়ে আমি অভ্যস্তও।”

“আমি যখন এখানে আসলাম, আমার সিজোফ্রেনিয়া ধরা পড়লো, তুমি তখন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমার সাথে কথা বলেছো এবং এমন ভাবে কথা বলেছো যেন আমি একজন স্বাভাবিক মানুষ। আমি যে জীবনটা যাপন করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তাতে আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম; অন্য জগতে আমি আমাকে তৈরি করে নিতে পারতাম, কিন্তু তুমি আমাকে সেটা করতে দাওনি। আমি সে সময় তোমাকে ঘৃণা করতাম, কিন্তু এখন আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি চাই, মারি তুমি ভিলেট ছেড়ে যাও, যেমন আমি আমার ভিন্ন জগত ছেড়ে এসেছি।”

মারি কোন উত্তর না দিয়ে দূরে সরে গেলো।

ভিলেট-এর কখনো ব্যবহার না করা ছোট লাইব্রেরিতে এডোয়ার্ড কোরান বা এরিস্টেটল বা অন্য কোন দার্শনিক যাদের কথা মারি উল্লেখ করলো খুঁজে পেলো না। বরং সে খুঁজে পেলো একজন কবির কিছু পংক্তি:

মন বলছে বোকাদের যেমন হয়
আমারও কি তেমনি ঘটার ভয়…
নিজের পথে চলা, আনন্দতে খাওয়া
আর পান করা, নিয়ে পবিত্র হৃদয়।
ঈশ্বর নিবেন আপন করে তোমায়।
নিপাট চুল আর তোমার শুভ্র জামায়,
স্ত্রীকে নিয়ে থেকো ভালোবেসে
বাঁচো তুমি নিত্য সহর্ষে।
সারাটা দিন অহমিকার জীবন
দিয়েছেন উনি সূর্যালোকের নীচে,
সারাটা দিন তোমার অহমিকার
অংশ করে রয়েছো তো বেঁচে।
জীবন-শ্রম ও সূর্যের অধীন কঠোর অবিশ্রাম;
হৃদয় পথে হেঁটে, হেঁটে তোমার চোখের তারায়
জেনে রেখো তবু এ সবের পরিণাম
ঈশ্বর ঠিকই নিবেন তোমায় তাঁর বিচার-সভায়।

“ঈশ্বর আামকে বিচার-সভায় নিবেন,” এডোয়ার্ড জোরে জোরে বলছিলো, “এবং আমি তখন বলবো: “আমার জীবনে একটা সময় আমি বাতাসের জন্য তাকিয়েছিলাম, আমি রোপন করতে ভুলে গেছি, আমি আনন্দের সাথে বাঁচিনি, এমন কি যা পান করতে বলা হয়েছিলো তাও পান করিনি। কিন্তু একদিন আমি নিজেকে বিচার করলাম এবং কাজে ফিরে গেলাম। আমি মানুষকে আমার স্বর্গের দৃশ্য সম্পর্কে বললাম যেমন বলেছিলো ব’শ, ভ্যানগগ, ওয়াঙ্গার, বেটোভেন, আইনস্টাইন এবং আমার আগে এরকম আরো বিকারগ্রস্ত লোক।” ঠিক আছে, আমি তাকে বলবো যে, আমি হাসপাতাল ছেড়ে যাবো একজন তরুণীর মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখাটা এড়িয়ে যেতে। তরুণীটি তখন স্বর্গে থাকবে এবং সে আমার জন্য মিনতি করবে।”

লাইব্রেরির দায়িত্বে থাকা লোকটি জিজ্ঞেস করলো, “কী বলছো এ সব?”

“আমি ভিলেট ছেড়ে যেতে চাই,” এডোয়ার্ড স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু স্বরে বললো। “আমি এটাই করতে চাই।”

লাইব্রেরিয়ান একটা ঘন্টা বাজালো, এবং কিছুক্ষণের মধ্যে দু’জন নার্স এসে উপস্থিত হলো।

“আমি ছেড়ে যেতে চাই,” এডোয়ার্ড উত্তেজিত হয়ে আবার বললো। “আমি ঠিক আছি, আমি শুধু ডা. ইগোর এর সাথে কথা বলতে চাই।”

কিন্তু ততক্ষণে দু’ জন লোক দু’ পাশ থেকে তার দু’ বাহু ধরে ফেলেছে। কাজ হবে না জেনেও এডোয়ার্ড নার্সদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।

“তুমি একটু ঝামেলা তৈরি করছো; এখন শান্ত হও,” তাদের একজন বললো। “আমরা ব্যাপারটা দেখছি।”

এডোয়ার্ড ধস্তাধস্তি করতে লাগলো।

“আমাকে ডা. ইগোর-এর সাথে কথা বলতে দাও। তার কাছে আমার অনেক কিছু বলার আছে, আমি নিশ্চিত তিনি বুঝতে পারবেন।”

লোকগুলো ততক্ষণে তাকে ওয়ার্ডের দিকে টেনে নিয়ে গেলো।

“আমাকে ছেড়ে দাও!” সে আর্তনাদ করে বলতে লাগলো। “আমাকে শুধু এক মিনিট কথা বলতে দাও।”

ওয়ার্ডে যেতে হলে লিভিং রুমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় যেখানে অন্য সব নিবাসীরা ভীড় করে আছে। এডোয়ার্ড ধস্তাধস্তি করছিলো এবং ব্যাপারটা আরো বাজে হয়ে যাচ্ছিলো।

“ওকে যেতে দাও! ও তো পাগল!”

কেউ কেউ হেসে উঠলো, অন্যরা তাদের হাত দিয়ে চেয়ার, টেবিল শক্ত করে ধরে রাখলো।

“এটা একটা মানসিক হাসপাতাল। এখানে কেউ তোমার কথা মতো চলবে না।”

নার্সদের একজন ফিসফিস করে অন্যজনকে বললো, “এদের একটু ভয় দেখানোটা ভালো হবে, নয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”

“একটাই উপায় আছে।”

“ডা. ইগোর কিন্তু সেটা পছন্দ করবেন না।”

“এই পাগলের দল যদি তার প্রাণের হাসপাতালকে গুড়িয়ে দেয় সেটাও উনি পছন্দ করবেন না।”

ভেরোনিকা জেগে উঠতে লাগলো, তার শরীর জুড়ে শীতল ঘাম ঝরছে। বাইরে ভয়ঙ্কর গোলমাল হচ্ছে। তার ঘুমের জন্য একটু নিরবতার দরকার, কিন্তু কোলাহল চলছেই।

একটু মাথা ঘুরানো ভাব নিয়ে সে বিছানা থেকে নামলো এবং লিভিং রুমের দিকে গেলো। এ সময়ই সে দেখতে পেলো এডোয়ার্ডকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এমন সময় কয়েক জন নার্স ছুটে এসে এডোয়ার্ড-এর শরীরে একটা সিরিঞ্জ বসিয়ে দিলো।

“কী করছো তোমরা”? ভেরোনিকা চিৎকার দিয়ে উঠলো।

“ভেরোনিকা!”

সিজোফ্রেনিক তার সাথে কথা বলছে। সে তার নাম ধরে ডাকছে। বিস্ময় ও লজ্জার মিশেলে ভেরোনিকা এগিয়ে যেতে চেষ্টা করতেই একজন নার্স তাকে বাঁধা দিলো।

“কী করছো তুমি? আমি এখানে আছি এ কারণে না যে আমি পাগল। তুমি আমাকে সে রকম মনে করতে পারো না।”

সে নার্সকে ঠেলে সরিয়ে দিলো। এদিকে অন্যান্য নিবাসীরা চিৎকার করে পা দিয়ে মেঝেতে ঠুকতে লাগলো; তার কাছে মনে হলো এরা ভয়ঙ্কর ভাবে হৈ চৈ করছে। তার কি গিয়ে ডা. ইগোরকে খুঁজে নিয়ে আসা উচিত এবং এখান থেকে এখনই চলে যাওয়া উচিত?

“ভেরোনিকা!”

এডোয়ার্ড আবার তার নাম ধরে ডাকলো। এডোয়ার্ড অতিমানবীয় চেষ্টায় দু’ জন পুরুষ নার্সের কবল থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। তারপরও সে ছুটে পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, ঠিক গত রাতের মত স্থির হয়ে। যেন অসাড় করে দেয়ার মন্ত্রবলে সবাই থেমে গেলো, সবাই অপেক্ষা করছে এর পর কী হয় তার জন্য।

একজন নার্স এগিয়ে আসতেই এডোয়ার্ড তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তার দিকে তাকালো।

“আমি তোমাদের সাথে যাবে। আমি জানি আমাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো এবং এও জানি যে তোমরা চাও অন্যরাও জানুক। শুধু একটা মিনিট অপেক্ষা করো।”

নার্সের মনে হলো ঝুঁকিটা নেয়া যায়; কারণ সব কিছুর পর মনে হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

“আমার মনে হয়… আমার মনে হয় তুমি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ,” এডোয়ার্ড ভেরোনিকাকে বললো।

“তুমি তো কথা বলতে পারো না। তুমি তো এ জগতে বাস করো না, তোমার তো জানার কথা না আমার নাম ভেরোনিকা। এই তুমি তো কাল রাতে আমার সাথে ছিলে না; প্লিজ, বলো, এই তুমি তো ছিলে না।”

“আমিই ছিলাম।”

ভেরোনিকা এডোয়ার্ড-এর হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলো। পাগলেরা তখন সব চিৎকার করছে, হর্ষধ্বনি দিচ্ছে, কুৎসিত মন্তব্য করছে।

“ওরা তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?”

“চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাচ্ছে।”

“আমি যাবো তোমার সাথে।”

“এর প্রয়োজন নেই। তুমি ভয় পেয়ে যাবে। যদিও আমি তোমাকে শপথ করে বলতে পারি যে এতে কোন ব্যথা পাওয়া যায় না বা তুমি কোনকিছু অনুভবও করবে না। তবে এটা চেতনানাশকের চেয়ে ভালো, কারণ এতে তুমি তোমার সজ্ঞান অবস্থায় দ্রুত ফিরে পাবে।”

ভেরোনিকা বুঝতে পারছে না সে কী বলছে। এডোয়ার্ড-এর হাতটা ধরে তার অনুশোচনা হচ্ছে। লজ্জা লুকোতে তার এই মুহূর্তে এখান থেকে পালাতে ইচ্ছা করছে। আর কখনোই সে এ মানুষটার সামনে আসতে চায় না যে তার সবচেয়ে নোংরা বিষয়টার সাক্ষী এবং যে কখনোই তাকে আর আগের আবেগ নিয়ে দেখবে না।

কিন্তু তার আবারও মারি’র কথাগুলো মনে পড়লো: তার নিজের জীবনকে অন্যের কাছে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই, এমন কি তার সামনে যে যুবক দাঁড়িয়ে আছে তার কাছেও না।

“আমি যাবো তোমার সাথে।”

নার্সরাও ভাবলো এটাই ভালো হবে। সিজোফ্রেনিককে আর জোর করার দরকার হবে না, সে নিজে থেকেই যাবে।

তারা যখন ওয়ার্ডে পৌঁছালো, এডোয়ার্ড একটা বিছানায় শুয়ে পড়লো। সেখানো আরো দু’ জন লোক একটা অদ্ভুত যন্ত্র আর এক ব্যাগ টুকরো কাপড় নিয়ে অপেক্ষা করছিলো।

এডোয়ার্ড ভেরোনিকার দিকে ঘুরে তাকে বিছানায় বসতে বললো।

“অল্প কয়েক মিনিটের মধ্যে এ খবর পুরো ভিলেট ছড়িয়ে পড়বে, এবং সবাই আগের মতো শান্ত হয়ে যাবে, কারণ পাগলদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক উন্মাদও একে ভয় পায়। শুধুমাত্র যার এটার অভিজ্ঞতা রয়েছে সেই জানে এটা যতটা ভীতিকর মনে হয় ততটা ভয়ের না।”

নার্সরা তাদের আলাপ শুনছিলো এবং সিজোফ্রেনিক যা বলছে তার একটা শব্দও বিশ্বাস করেনি। এটা অবশ্যই ভয়ঙ্কর পীড়াদায়ক, কিন্তু কে জানে একটা পাগলের মাথায় কী ঘটে? একটা মাত্র সংবেদনশীল কথা যুবকটা বলেছে সেটা হচ্ছে ভীতি সম্পর্কে: এ কাহিনী দ্রুত ভিলেট-এ ছড়িয়ে পড়বে আর এরপর দ্রুতই শান্তি ফিরে আসবে।

“তুমি দ্রুত শুয়ে পড়েছো,” একজন নার্স বললো।

এডোয়ার্ড আবার উঠে পড়লো, আর একজন একটা রাবার শীট তার নীচে বিছিয়ে দিলো।

“এখন শুতে পারো।”

সে কথা শুনলো। সে একদম শান্ত হয়ে রয়েছে যেন যা ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়মিত ঘটনা।

নার্সরা কাপড়ের টুকরো দিয়ে এডোয়ার্ড-এর শরীরের কয়েকটা জায়গায় বেঁধে ফেললো এবং তার মুখে একটা রাবারের টুকরো ঢুকিয়ে দিলো।

“এটা দেয়া হচ্ছে যাতে ও দুর্ঘটনাবশতঃ জিহ্বায় কামড় দিয়ে না ফেলে,” একটা লোক ভেরোনিকাকে উদ্দেশ্য করে বললো। এরকম একটা কারিগরি তথ্যের মাধ্যমে একটা হুশিয়ারি দিয়ে সে যেন অতীব আনন্দ পেলো।

তারা অদ্ভুত যন্ত্রটা বিছানার পাশে একটা চেয়ারের উপর বসালো – যন্ত্রটা একটা জুতার বাক্স থেকে খুব বড় নয়, যার সাথে কয়েকটা বোতাম আর তিনটা ডায়াল নব রয়েছে। দুইটা তার উপরের অংশ থেকে বের হয়ে এসে এয়ারফোনের মতো দেখতে দু’টা জিনিসের সাথে যুক্ত হয়ে আছে।

একজন নার্স এই “এয়ারফোন” গুলো কপালের দুই দিকের রগের সাথে লাগালো। আর একজন মনে হচ্ছিলো যন্ত্রটা চালাবে, নবগুলো একবার বামে, একবার ডানে ঘুরাচ্ছিলো। মুখে রাবারের টুকরো থাকাতে এডোয়ার্ড কথা বলতে না পারলেও এক দৃষ্টিতে ভেরোনিকার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখ দু’ টা যেন বলছে, “চিন্তা করো না, ভয়ের কিছু নেই।”

“এটা ১৩০ ভোল্টে ০.৩ সেকেন্ডের জন্য সেট করা হয়েছে,” যে নার্সটি যন্ত্রটা চালাচ্ছে সে বললো। “চালু হচ্ছে।”

সে একটা বোতাম চেপে দিলো এবং যন্ত্রটা গুঞ্জন করে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যে এডোয়ার্ড-এর চোখটা কাঁচের মতো স্বচ্ছ হয়ে গেলো, তার শরীর চাবুকের মতো প্রচন্ড গতিতে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলো; কিন্তু কাপড়ের বাঁধনগুলো তাকে টেনে বিছানায় এমনভাবে আছড়ে ফেললো যে সে হয়তো তার শিরদাঁড়া ভেঙ্গে ফেলেছে। 

“বন্ধ করো!” ভেরোনিকা চিৎকার করে উঠলো।

“বন্ধ করেছি,” নার্সটি এডোয়ার্ড-এর কপাল থেকে ‘এয়ারফোন’ গুলো খুলতে খুলতে বললো। কিন্তু তখনো এডোয়ার্ড-এর শরীর মোচড়াচ্ছে আর তার মাথা এমন ভয়       ঙ্কর ভাবে এদিক ওদিক করছে যে একজন নার্স এসে তার মাথা শক্ত করে ধরে রইলো। অন্য নার্সটি যন্ত্রটি ব্যাগে ভরে বসে একটা সিগারেট ধরালো।

দৃশ্যটা অল্প কয়েক মুহূর্ত স্থায়ী হলো। এডোয়ার্ড-এর শরীর স্বাভাবিক হচ্ছে মনে হচ্ছিলো, কিন্তু আবার খিঁচুনি শুরু হলে একজন নার্স আগের থেকে দ্বিগুন শক্তিতে এডোয়ার্ড-এর মাথা চেপে ধরে রাখলো। কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁপুনি কমে এসে এক সময় সব থেমে গেলো। এডোয়ার্ডের চোখ দু’ টা খোলা ছিলো, একজন নার্স তার চোখ দু’ টা বন্ধ করে দিলো, মৃত মানুষের চোখ যেভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়।

তারপর সে এডোয়ার্ড-এর মুখ থেকে রাবারের টুকরোটা সরিয়ে নিয়ে বাঁধনগুলো খুলে দিলো। কাপড়ের টুকরোগুলো যন্ত্রের সাথে আনা ব্যাগটাতে রাখলো।

“বৈদ্যুতিক শক্-এর প্রভাব এক ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়,” সে মেয়েটিকে বললো যে অনেকক্ষণ ধরে কোন চিৎকার করছিলো না এবং সব কিছু দেখে সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলো। “সব ঠিক আছে, সে খুব শীঘ্রিই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে, এবং আগের থেকে শান্ত থাকবে।”

বৈদ্যুতিক শক্-এর প্রভাব শুরু হতেই এডোয়ার্ড পূর্বের মতো অনুভব করতে পারছিলো: তার সাধারণ দৃষ্টিশক্তি ক্রমে হ্রাস পাচ্ছিলো যেন কেউ পর্দা টেনে দিচ্ছে এবং এক সময় সবকিছু উধাও হয়ে গেলো। কোন ব্যথা বা কষ্ট ছিলো না, কিন্তু সে অন্যদের ক্ষেত্রে দেখেছে, কী বাজে অবস্থা হয়।

এডোয়ার্ড খুব প্রশান্তিতে আছে। যেন, মুহূর্ত খানেক আগে, তার হৃদয়ে এক নতুন অনুভূতি নড়াচড়া দিচ্ছিলো, যেন সে বুঝতে শুরু করেছে ভালোবাসার এক ভিন্ন মাত্রা রয়েছে যেটা তার মা-বাবা তাকে দিয়েছে সেটা ছাড়াও। বৈদ্যুতিক শক্ চিকিৎসা বা ইলেকট্রোকন্ভাল্সিভ থেরাপি (ইসিটি) যেটা বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, তাকে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে।

ইসিটি’র মূল প্রভাব হচ্ছে স্বল্পকালীন স্মৃতিকে ধ্বংস করে দেয়া। এডোয়ার্ড-এর কোন অসম্ভব স্বপ্ন পোষা ছিলো না। তার অস্তিত্বহীন কোন ভবিষ্যতের দিকে এগোনোর ছিলো না। তার শুধু অতীতের দিকে ফিরে যাবার ছিলো, অথবা তার আবার জীবনে ফিরে যাওয়াটা চাওয়ার ছিলো।

ঘন্টাখানেক পর জেডকা ওয়ার্ডে এসে দেখলো প্রায় সম্পূর্ণ খালি ওয়ার্ডের একটা বিছানায় একজন তরুণ শুয়ে রয়েছে আর তার পাশে চেয়ারে একজন তরুণী বসে আছে।

কাছে গিয়ে সে দেখলো তরুণীটি আবারো অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং তার ঝুঁকে থাকা মাথাটা হালকা ডানে কাত হয়ে আছে।

জেডকা তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যেতেই ভেরোনিকা তাকালো।

“ঠিক আছে,” সে বললো। “আামার আর একটা অ্যাটাক হয়েছে, কিন্তু এখন ঠিক আছি।”

জেডকা তাকে আস্তে করে ধরে দাঁড়াতে সাহায্য করলো এবং তাকে টয়লেটে নিয়ে গেলো।

“এটা তো ছেলেদের টয়লেট,” ভেরোনিকা বললো।

“অসুবিধা নেই, এখন এখানে কেউ নেই।”

সে ভেরোনিকার নোংরা সোয়েটারটা খুলে ধুয়ে দিলো, এরপর এটাকে রেডিয়েটর-এর উপর শুকাতে দিলো। তারপর সে তার উলের জামাটা খুলে ভেরোনিকাকে দিলো।

“এটা রাখো। আমি তোমাকে বিদায় জানাতে এসেছি।”

মেয়েটা অনেক দূরে চলে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছিলো যেন জীবনের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। জেডকা তাকে ধরে নিয়ে আগের চেয়ারটাতে বসিয়ে দিলো।

“এডোয়ার্ড শীঘ্রিই জেগে উঠবে। কী ঘটেছে তা হয়তো তার সহজে মনে পড়বে না, কিন্তু অল্প সময় পরই তার স্মৃতি ফিরে আসবে। ও যদি তোমাকে প্রথমে চিনতে না পারে তাহলে ভয় পেয়ে যেও না।”

“আমি ভয় পাবো না,” ভেরোনিকা বললো, “কারণ আমি আমাকেই চিনতে পারছি না।”

জেডকা একটা চেয়ার টেনে তার পাশে বসলো। সে ভিলেটে এতো লম্বা সময় ধরে রয়েছে যে ভেরোনিকাকে সঙ্গ দিতে আর কয়েক মিনিট কাটানো কোন সমস্যা না।

“আমাদের প্রথম দেখা হওয়াটা কি তোমার মনে আছে? আমি তোমাকে একটা গল্প বলেছিলাম এটা বোঝাতে যে, পৃথিবীটা ঠিক তেমনই যেমনটা আমরা দেখি। প্রত্যেকেই মনে করছিলো যে রাজা বিকারগ্রস্ত কারণ সে যে সব নির্দেশ চাপিয়ে দিচ্ছিলো তার কোন অস্তিত্বই তার প্রজাদের মনে ছিলো না।

“আমরা জীবনকে যেভাবেই দেখি না কেন, জীবনে এমন কিছু জিনিস আছে যা প্রত্যেকের জন্যই বৈধ। যেমন, প্রেম।”

জেডকা ভেরোনিকার চোখে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলো। সে বলে যেতে লাগলো।

“আমি বলবো কারো যদি স্বল্প সময়ের আয়ু থাকে এবং সে সিদ্ধান্ত নেয় যে জীবনের বাকি সময় সে একটা বিছানার পাশে বসে একটা ঘুমন্ত মানুষকে দেখে কাটাবে, তাহলে সেটা অবশ্যই প্রেম। আমি আরো বলবো: সে সময় যদি তার একটা হার্ট অ্যাটাক হয় তবুও সে নিঃশ্চুপ হয়ে বসে থাকে শুধু এ কারণে যে সে মানুষটার কাছাকাছি থাকতে পারবে, তবে আমি বলবো যে এমন প্রেম গভীরে যাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা।”

“এটা তো চরম হতাশাও হতে পারে,” ভেরোনিকা বললো। “হয়তো এটা প্রমাণের চেষ্টা যে এ সূর্যালোকের নীচে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। আমি এমন একটা মানুষের প্রেমে পড়তে পারি না যে অন্য জগতে বাস করে।”

“আমরা সবাই আমাদের নিজেদের জগতে বাস করি। কিন্তু তুমি ঐ তারা ভরা আকাশে তাকিয়ে দেখো ঐ সব জগত একত্রে নক্ষত্রপুঞ্জ, সৌরজগৎ ও ছায়াপথ গঠন করেছে।”

ভেরোনিকা উঠে দাঁড়ালো এবং এডোয়ার্ড-এর কাছে গেলো। সে খুব আবেগ নিয়ে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। কথা বলার একজন লোক পেয়ে তার ভালো লাগছিলো।

“অনেক আগে যখন আমি ছোট, আর আমার মা আমাকে জোর করে পিয়ানো শেখাতে নিয়ে গেলো, তখন আমি নিজেকে বলেছিলাম আমি এটা তখনই খুব ভালো বাজাতে পারবো যখন আমি কারো প্রেমে পড়বো। গত রাতে আমার জীবনে প্রথম বারের মতো আমি অনুভব করছিলাম যে, পিয়ানোর সুর তুলতে আমার আঙ্গুলগুলোর উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।

“কোন একটা অদৃশ্য শক্তি আমাকে দিয়ে সুর আর কর্ড গুলো তৈরি করে নিচ্ছিলো যেটা আমি কখনোই বাজাতে জানতাম না। আমি আমাকে পিয়ানোর কাছে সপে দিয়েছিলাম কারণ আমি নিজেকে এই মানুষটার কাছেও সপে দিয়েছি, এমন কি ওকে ছাড়া আমি নিজের একটা ক্ষতিও করতে পারবো না। গতকাল আমি একদমই নিজের মধ্যে ছিলাম না যখন আমি যৌনতায় ছেড়ে দিয়েছিলাম নিজেকে অথবা যখন পিয়ানো বাজাচ্ছিলাম তখনো না। আমার মনে হয় না আমি এখনো আমার মধ্যে রয়েছি।” ভেরোনিকা তার মাথা ঝাঁকালো। “আমি কোন কিছুই বুঝতে পারছি না।”

জেডকার মহাশূন্যে নানা আকৃতির ভেসে বেড়ানো ঐ সব সত্ত্বাগুলোর মুখোমুখি হওয়ার কথা মনে পড়ছিলো। সে ভেরোনিকাকে এ সম্পর্কে বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু ভয় হচ্ছে যে এতে সে তাকে আরো বিভ্রান্ত করে ফেলবে।

“তুমি মরতে যাচ্ছো এ কথা আবার বলার আগেই আমি তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা পুরো জীবন কাটিয়ে দেয় তোমার গতকালকে পাওয়া মুহূর্তটা পাওয়ার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু তারা কখনো সেটা পায় না। তাই যদি তুমি এখন মারাও যাও, তুমি তোমার হৃদয়কে ভালোবাসায় পূর্ণ করে মৃত্যুর দুয়ারে যাচ্ছো।”

জেডকা উঠে দাঁড়ালো।

“তোমার হারানোর কিছু নেই। অনেকেই নিজের প্রেমে পড়াটা মানতে পারে না। খুব নিঁখুত করে বলতে গেলে এক্ষেত্রে অনেক ঝুঁকি থাকে ভবিষ্যতের ও অতীতের। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বর্তমান আছে।”

সে উঠে এসে ভেরোনিকাকে একটা চুমু দিলো।

“আমি যদি এখানে আরো কিছুক্ষণ থাকি, তাহলে আমি আর এ জায়গা ছেড়ে যেতে পারবো না। আমি আমার বিষণœতা থেকে সেরে উঠেছি, কিন্তু ভিলেট-এ আমি আরো অন্য অনেক বিকারগ্রস্ততা দেখেছি। আমি ওগুলোকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই এবং জীবনকে আমার নিজের চোখে দেখতে চাই।

“যখন আমি এখানে আসি, আমি খুবই বিষণ্ন ছিলাম। কিন্তু এখন আমি গর্ব করে বলতে পারি যে আমি একটা উন্মাদ। বাইরে সবাই যেমন আচরণ করে আমিও তেমন করবো। আমি সুপার মার্কেটে কেনাকাটা করতে যাবো, ছোট খাটো বিষয় নিয়ে বন্ধুদের সাথে গল্প করবো, আমার মূল্যবান সময় আমি টেলিভিশন দেখে নষ্ট করবো। কিন্তু আমি জানি আমার আত্মা মুক্ত এবং আমি স্বপ্ন দেখতে পারি এবং অন্য জগতের সাথে কথা বলতে পারি যেটা আমি এখানে আসার আগে কল্পনাও করতে পারতাম না।

“আমি নিজেকে দিয়ে কিছু আলতু ফালতু কাজও করাবো, শুধুমাত্র এ কারণে যে লোকে বলুক: ‘ও তো ভিলেট থেকে মুক্তি পেয়ে এসেছে।’ কিন্তু আমি জানি যে, আমার আত্মা পূর্ণ কারণ আমার জীবন অর্থপূর্ণ। আমি সূর্যাস্ত দেখতে পারবো এবং বিশ্বাস করবো ঈশ্বর এর পেছনে আছেন। যখন কেউ আমাকে বিরক্ত করবে, আমি তাদের বলবো যে আমি তাদের কথা চিন্তা করি কিন্তু আমাকে নিয়ে কে কী ভাবছে তা নিয়ে চিন্তা করি না; কারণ লোকে বলুক: ‘ও তো ভিলেট থেকে মুক্তি পেয়ে এসেছে।’

“আমি রাস্তায় ছেলেদের চোখের দিকে তাকাবো এবং তাদের প্রতি কামনা অনুভব করে অনুশোচনা করবো। কিন্তু তার পর পরই আমি আমদানিকৃত পণ্যের বিক্রির দোকানে যাবো, আমার অর্থে যতটা কুলায় তা দিয়ে সবচেয়ে ভালো ওয়াইন কিনবো, এবং আমার পূজনীয় স্বামীর সাথে ওয়াইন পান করবো কেননা আমি তার সাথে আবারো আনন্দদায়ক সময় কাটাতে চাই।

“এবং সে হাসতে হাসতে বলবে: ‘পাগল!’ আমিও বলবো: ‘অবশ্যই। আমি ভিলেট-এ ছিলাম, মনে রেখো! আর পাগলামী আমাকে মুক্তি দিয়েছে। তাই প্রিয়, প্রতি বছর তোমার যে ছুটি আছে তাতে তুমি আমাকে বিপজ্জনক পাহাড় বাইতে নিয়ে যাবে, কেননা আমার বেঁচে থাকতে আমার চ্যালেঞ্জের পিছু নিতে হবে।”

“লোকে বলবে: ‘ও কিছু দিন হলো ভিলেট থেকে মুক্তি পেয়েছে, আর এখন ও ওর স্বামীকেও পাগল বানাচ্ছে।’ সে বুঝবে তারা ঠিকই বলছে, এবং সে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাবে কারণ আমাদের সংসারটা আবার শুরু হয়েছে। আর আমরা দু’ জনই উন্মাদ যেমন উন্মাদ থাকে প্রথম প্রেমে পড়া নরনারী।”

জেডকা ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে গেলো; আর একটা সুরের গুঞ্জন রেখে গেলো যেটা ভেরোনিকা আগে কখনো শোনেনি।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০