fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

চব্বিশ

এডোয়ার্ড সে ভূমির ঘ্রাণ পাচ্ছে। গ্রীষ্মকাল; সে তার নাকে ধুলোর স্পর্শ পাচ্ছে যেটা তাকে আনন্দ দিচ্ছে, কারণ মাটির গন্ধ বাঁচার অনুভূতি দেয়। সে একটা আমদানিকৃত বাইসাইকেলে। তার বয়স সতেরো এবং সে মাত্র ব্রাজিলের আমেরিকান কলেজ থেকে বেরিয়েছে যেখানে সব কুটনীতিকদের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করে।

ব্রাজিল তার ভালো লাগে না, তবে সে ব্রাজিলিয়ানদের ভালোবাসে। তার বাবাব দু’ বছর আগে এখানে যুগোশ্লাভিয়ার অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন যে সময় তাদের দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। মিলোসেভিচ তখনো ক্ষমতায়; নারী পুরুষ তাদের মধ্যকার বিভাজন নিয়ে বসবাস করছে এবং আঞ্চলিক বিবাদগুলোর পেরিয়ে একটা ছন্দ খোঁজার চেষ্টা করছে।

তার বাবার প্রথম পোস্টিং ছিলো ব্রাজিলে। এডোয়ার্ড বীচ, কার্নিভাল, ফুটবল আর মিউজিক-এর স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু তারা থাকতো ব্রাজিলিয়ান রাজধানীতে, সমুদ্র সৈকত থেকে অনেক দূরে। শহরটি ছিলো শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ, আমলা, কুটনীতিক আর তাদের ছেলেমেয়েদের আশ্রয়স্থল যারা জানতো না কী করতে হবে এবং সব কিছুর মধ্যে গিয়ে আটকে থাকতো।

এডোয়ার্ডের এখানে থাকতে ভালো লাগতো না। সে তার পড়ালেখায় ডুবে সময় কাটাতো, অন্ততঃ চেষ্টা করতো – কিন্তু পারতো না; তার সহপাঠীদের সাথে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করতো-কিন্তু পারতো না; শুধু গাড়ি, আধুনিক জুতা, নতুন ডিজাইনের জামা এগুলো কেবল মাত্র আলোচনার বিষয় ছিলো যে আলোচনায় সে অংশ নিতে পারতো না।

যখন তখন সেখানে পার্টি হতো। পার্টিতে ছেলেরা ঘরের এক পাশে মাতাল হয়ে থাকতো আর মেয়েরা অন্য পাশে নিজেদের আলাদা করে তুলে ধরার ভান করতো। সব জায়গায় মাদকের ছড়াছড়ি ছিলো এবং এডোয়ার্ড প্রায় সব ধরনের মাদকের স্বাদ নিয়ে দেখেছে কোনটার প্রতিই তার কোন আগ্রহ জন্মেনি। সে হয় খুব উত্তেজিত হয়ে যেতো নয় তো তার খুব ঘুম পেতো এবং তার চারপাশের সব কিছুর প্রতি তার আগ্রহ দ্রুত হারিয়ে যেতো।

তার পরিবার দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। তারা চাইতো এডোয়ার্ড তার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করুক। তাছাড়া তার এ বিষয়ে সমস্ত গুণাবলীও ছিলো – তার পড়ালেখার আগ্রহ আছে, ভালো শৈল্পিক পছন্দ রয়েছে, ভাষা শেখার সুযোগ রয়েছে, রাজনীতির প্রতি কৌতুহল রয়েছে; কিন্তু কুটনীতিক হওয়ার পথে তার একটা গুণের অভাব ছিলো: সে অন্য লোকদের সাথে কথা বলতে চাইতো না।

তার মা-বাবা তাকে বিভিন্ন পার্টিতে নিয়ে যেতো এবং তাকে বলতো তার বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় নিয়ে আসতে। তাকে যথেষ্ট পরিমাণ হাত খরচ দেয়া হতো কিন্তু এডোয়ার্ড কারো সাথে তেমন মিশতে পারতো না। একদিন তার মা তাকে জিজ্ঞেস করলো কেন সে তার কোন বন্ধুকে বাসায় নিমন্ত্রণ করে না।

“আমি প্রত্যেক জুতার ব্রান্ড চিনি এবং যে সব মেয়ে সহজেই বিছানায় যেতে পারে তাদের সবার নাম জানি। এর পর তো তাদের সাথে আলাপের আর কিছু নেই; তারা তো এ ছাড়া আর কোন আলোচনা করে না।”

এক সময় এক ব্রাজিলিয়ান মেয়ের আবির্ভাব হলো। অ্যাম্বাসেডর দম্পতি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন যে, তাদের ছেলে অন্ততঃ কারো সাথে মেলামেশা করছে এবং রাত করে বাড়ি ফিরছে। কোন এক রাতের আগে তারা কেউই জানতেন না এ মেয়ে কোথা থেকে এসেছে। এক রাতে এডোয়ার্ড মেয়েটাকে বাসায় নিমন্ত্রণ করলো। মেয়েটা বেশ ভালো পরিবেশে বড় হয়েছে জেনে তার মা-বাব সন্তুষ্ট হলেন; তাদের ছেলে শেষ পর্যন্ত অন্য লোকজনের সাথে সম্পর্ক তৈরি করার পরিপক্কতা অর্জন করেছে। উপরন্তু, তাদের মনে হলো – যদিও কেউই এ ব্যাপারে কিছুই বললেন না – মেয়েটার অস্তিত্ব একটা বড় দুশ্চিন্তা দূর করেছে যে, তাদের ছেলে সমকামী নয়। 

তারা মারিয়ার (এটাই মেয়েটার নাম ছিলো) সাথে তাদের ভবিষ্যৎ পুত্রবধূর মতো আচরণ করতেন যদিও তারা জানতেন যে দু’ বছরের মতো তারা অন্য কোথাও বদলী হয়ে যাবেন এবং তাদের ছেলেকে একটা উদ্ভট দেশের কোন মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে তাদের ন্যূনতম ইচ্ছা নেই। তাদের পরিকল্পনা ছিলো তাদের ছেলে ফ্রান্স বা জার্মানির কোন একটা চমৎকার মেয়ের সাথে পরিচিত হবে যে অ্যাম্বাসেডর বাবা যেভাবে ছেলেকে মেধাবী কুটনীতিক পেশার জন্য প্রস্তুত করছেন তেমনি ছেলের মর্যাদাপূর্ণ সঙ্গী হবে।

এডোয়ার্ডকে দেখে মনে হচ্ছিলো আরো বেশি প্রেমে ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছে। চিন্তিত মা একদিন স্বামীকে এ কথা বললেন।

“কুটনীতির শিল্প হচ্ছে অপর পক্ষকে অপেক্ষায় রাখা,” অ্যাম্বাসেডর বললেন। “তুমি প্রথম প্রেম উৎরে যেতে না পারলে এটা সবসময়ই শেষ হয়ে যায়।”

কিন্তু এডোয়ার্ড সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যেতে লাগলো। সে অদ্ভুত সব বই বাসায় আনতে লাগলো এবং তার রুমে সে একটা পিরামিড বানালো। মারিয়া আর সে প্রতি রাতে ধুপ-ধুনা পুড়াতে লাগলো এবং ঘন্টার পর ঘন্টা দেয়ালে ঝুলানো অদ্ভুত নকশার দিকে তাকিয়ে থাকতো। স্কুলে এডোয়ার্ড-এর নম্বর খারাপ হওয়া শুরু করলো।

তার মা পর্তুগিজ বুঝতো না, কিন্তু সে বই-এর মলাটে ক্রুশ, অগ্নুৎসব, ঝুলানো ডাইনি, উদ্ভট সব চিহ্ন দেখতে পেতেন।

“আমাদের ছেলে কিছু ভয়ঙ্কর জিনিসপত্র পড়ছে।”

“ভয়ঙ্কর? বলকানে যা ঘটছে তা কি ভয়ঙ্কর?” অ্যাম্বাসেডর বললেন। “গুজব ছড়াচ্ছে যে স্লোভেনিয়া স্বাধীনতা চাচ্ছে, আর আমরা যুদ্ধের খুব কাছাকাছি।”

এডোয়ার্ড-এর মা’র রাজনীতির প্রতি কোন আগ্রহ নেই; সে শুধু বুঝতে চায় তার ছেলের কী হয়েছে।

“ধুপ-ধুনা পোড়ানো কোন ধরনের রোগ?”

“এটা মারিজুয়ানা’র গন্ধ আড়াল করতে করা হয়,” অ্যাম্বাসেডর বললেন। “আমাদের ছেলে পড়ালেখায় যথেষ্ট ভালো; সে হয়তো বিশ্বাস করে এই গন্ধযুক্ত কাঠিগুলো মনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।”

“আমার ছেলে মাদকাসক্ত?”

“এটা কিছু না। আমি নিজেও অল্প বয়সে মারিজুয়ানা খেয়েছি; এটা কিছুদিনের মধ্যেই বিরক্তিকর হয়ে যায়, আমারও হয়েছিলো।”

তার স্ত্রী গর্ব বোধ করলেন এবং পুনঃ নিশ্চিত হলেন যে তার স্বামী একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি, সে মাদকের রাজ্যে প্রবেশ করেও কোন সমস্যা ছাড়াই বের হয়ে এসেছেন। এ ধরনের মানসিক শক্তি নিয়ে যে কোন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

একদিন এডোয়ার্ড মা-বাবার কাছে জানতে চাইলো সে একটা বাইসাইকেল পেতে পারে কি না।

“আমাদের তো শোফার ও মার্সিডিজ বেঞ্জ রয়েছে। তুমি বাইসাইকেল চাচ্ছো কেন?”

“প্রকৃতির আরো কাছে যেতে। মারিয়া আর আমি একট দশ দিনের ট্রিপে যাচ্ছি,” এডোয়ার্ড বললো। “এখানে কাছেই একটা জায়গা রয়েছে যেখানে অনেক ক্রিস্টাল জমা আছে, আর মারিয়া বলেছে এসব ক্রিস্টাল পজিটিভ এনার্জি দেয়।”

তার বাবা ও মা একটা সমাজতান্ত্রিক রাজ্যে বড় হয়েছেন। তাদের কাছে ক্রিস্টাল মানে কেবলমাত্র কিছু পরমাণু নিয়ে গঠিত একটা পদার্থ এবং কোন ধরনের শক্তি দেয় না, পজিটিভও না নেগেটিভও না। তারা খোঁজ নিয়ে দেখলেন এবং আবিষ্কার করলেন যে এ ধরনের ‘ক্রিস্টাল শক্তি’র ধারণার একটা রীতি ব্রাজিলে চালু হয়েছে।

তাদের ছেলে যদি কোন অফিসিয়াল পার্টিতে এ ধরনের জিনিসের আলাপ করে তাহলে সেটা অন্যদের কাছে একটা হাস্যকর ব্যাপারে পরিণত হবে। প্রথমবারের মতো অ্যাম্বাসেডর মহোদয়ের কাছে মনে হলো ব্যাপার মারাত্মক। ব্রাজিল একটা গুজবের জায়গা। যখনই অ্যাম্বাসিতে তার প্রতিপক্ষ জানতে পারবে যে এডোয়ার্ড এ ধরনের কুসংষ্কারে বিশ্বাস করে তাহলে তারা ধরে নিবে এডোয়ার্ড এ সকল বিশ্বাস তার মা-বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। আর যাই হোক, কুননীতি তো শুধু অপেক্ষা করানোর শিল্প না, এটা সব পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকতার মুখোশ পরে থাকারও শিল্প। 

“বাবা, এভাবে তো চলতে পারে না,” তার বাবা বললো। “যুগোশ্লাভিয়ার পররাষ্ট্র দপ্তরে আমার বন্ধু-বান্ধব রয়েছে। তোমার সামনে কুটনীতিক হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আর তোমার তো বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া শিখতে হবে।”

এ আলোচনার পর এডোয়ার্ড বাসা থেকে বের হয়ে গেলো এবং ঐ রাতে সে আর বাসায় ফিরলো না। তারা মা-বাবা মারিয়ার বাসায় ফোন করলেন, শহরের সব হাসপাতাল ও মর্গে ফোন করলেন, কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলো না। তার মা পরিবারের প্রধান হিসেবে তার বাবার প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করলেন যদিও সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির সাথে তিনি যত ভালো সমঝোতা করতে পারুক না কেন।

পরদিন এডোয়ার্ড ক্ষুধার্ত ও নির্ঘুম অবস্থায় ফিরে এলো। সে খেয়ে তার রুমে গেলো, তার ধুপের কাঠি জ্বাললো এবং তার মন্ত্র পড়ে বাকি সন্ধ্যা ও রাত ঘুমিয়ে কাটালো। জেগে উঠে এডোয়ার্ড দেখলো একটা ব্রান্ড নিউ বাইসাইকেল তার জন্য অপেক্ষা করছে।

“যাও তোমার ক্রিস্টাল দেখে এসো,” তার মা বললেন। “আমি তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বললো।”

সেই গ্রীষ্মের বিকালে এডোয়ার্ড আনন্দে মারিয়ার বাড়ির দিকে সাইকেল চালিয়ে যেতে লাগলো। শহরটা চমৎকার নকশা করা (স্থপতিদের মতে) অথবা খুবই বাজে ভাবে নকশা করা (এডোয়ার্ড-এর মতে), এমন যে কোন বাঁক নেই; সে শুধু সোজা হাই স্পীড লেন ধরে যাচ্ছিলো। যেতে যেতে তার চোখে পড়ছিলো বৃষ্টিহীন পুরো আকাশটা, সীমাহীন আকাশটা দেখে তার নিজেকে অস্বাভাবিক গতিতে আকাশের দিকে উড়ে যেতে মন চাইলো। আর তখনই সে রাস্তার উপর আছড়ে পড়লো।

আমি অ্যাকসিডেন্ট করেছি। এডোয়ার্ড বুঝতে পারছিলো কিন্তু নড়তে পারছিলো না।

সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু তার মুখটা রাস্তাতে চাপা পড়েছিলো। সে বুঝতে পারছিলো যে, তার নিজের শরীরের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সে গাড়ির কর্কশ ব্রেক এর শব্দ শুনছিলো, মানুষজনের আতঙ্কিত কথাবার্তা শুনছিলো, কেউ তাকে ধরতে আসতে চেষ্টা করতে একজন চিৎকার করে বলে উঠলো: “ওকে নাড়িয়ো না! কেউ ওকে নড়াতে গেলে ও জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারে!”

খুব ধীরে সময় যাচ্ছিলো এবং এডোয়ার্ড-এর ভয় লাগছিলো। তার মা-বাবার মতোই সে ঈশ্বর ও পরকালে বিশ্বাস করে, কিন্তু তবুও মাত্র সতেরো বছর বয়সে মাটিতে চাপা পড়ে এই ভিনদেশে মরতে যাওয়াটা একেবারেই মেনে নেয়ার মতো না।

“তুমি ঠিক আছো?” সে কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো।

না, সে ঠিক নেই; সে নড়তে পারছে না, সে কিছু বলতেও পারছে না। সবচেয়ে খারাপ জিনিস যেটা সেটা হচ্ছে সে জ্ঞান হারায় নি; সে বুঝতে পারছিলো কী ঘটছে এবং তার কী অবস্থা। সে কেন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে না? ঠিক যে সময় সে সব কিছু ও সবাইকে বাদ দিয়ে একাগ্র চিত্তে ঈশ্বরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে সময় তার প্রতি ঈশ্বরের কোন দয়া হচ্ছে না।

“ডাক্তার আসছেন,” কেউ একজন তার হাত ধরে ফিসফিস করে বললো। “আমি বুঝতে পারছি না তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো কি না, কিন্তু শান্ত থাকো। তেমন কিছু হয়নি।”

হ্যাঁ, সে শুনতে পারছে। লোকটাকে তার পছন্দ হলো যে তার সাথে কথা বলছিলো, তাকে আশ্বাস দিচ্ছিলো যে তার গুরুতর কিছু হয়নি, এমন কি সে এটা বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স তার হয়েছে যে মানুষ তখনই এমনভাবে বলে যখন আসলে পরিস্থিতি সত্যিই গুরুতর। সে মারিয়ার কথা ভাবছিলো, পজিটিভ শক্তি পূর্ণ ক্রিস্টালের পাহাড়ের কথা ভাবছিলো যেটা ব্রাজিলের মতো চরম নেগেটিভ শক্তির জায়গা নয়, এমন কি তার ধ্যানেও নয়।

সেকেন্ড এক সময় মিনিট হলো। লোকজন তাকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঘটনা ঘটার পর এই প্রথম সে ব্যথা অনুভব করতে লাগলো। ঠিক তার মাথার মধ্য থেকে ব্যথা শুরু হয়ে তার সারা শরীকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।

“এই যে, ওরা চলে এসেছে,” যে লোকটি তার হাত ধরে ছিলো সে বললো। “কাল থেকে তুমি আবারও সাইকেল চালাতে পারবে।”   

কিন্তু পরদিন এডোয়ার্ড হাসপাতালে দুই পা ও এক হাত ঝুলিয়ে পড়ে রইলো কমপক্ষে এক মাসের জন্য। পড়ে থেকে সে শুনতে পাচ্ছিলো তার মা’র ক্রমাগত ফোঁপানি, তার বাবার চিন্তিত ফোনালাপ আর চিকিৎসকের বারংবার নিশ্চয়তা ও প্রতি পাঁচ মিনিটে বিরক্তিকর বক্তব্য যে ক্রিটিক্যাল চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে এবং তার মাথায় কোন গুরুতর আঘাত নেই।

তার পরিবার আমেরিকান অ্যাম্বেসিতে ফোন দিলো যারা স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসার প্রতি কখনোই আস্থা রাখে না এবং যাদের নিজস্ব একটি অত্যাধুনিক জরুরি সেবা রয়েছে যেখানে একটি নির্দিষ্ট ব্রাজিলিয়ান ডাক্তারের তালিকা রয়েছে যাদেরকে তারা মনে করে তাদের নিজস্ব কুটনীতিকদের চিকিৎসা করতে একমাত্র সক্ষম চিকিৎসক। যখন তখন ‘ভালো প্রতিবেশী নীতিমালা’র আলোকে এ সেবা অন্যান্য কুটনীতিকরাও নিতে পারেন।

আমেরিকানরা তাদের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে আসলো এবং তার আরো নানা রকম টেস্ট ও পরীক্ষা করে একটা সিদ্ধান্তে আসলো যে সিদ্ধান্তে তারা সব সময়ই আসে: স্থানীয় চিকিৎসকরা ঠিক ভাবেই সমস্যা চিহ্নিত করেছেন এবং ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।

স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকরা ভালো হতে পারেন কিন্তু ব্রাজিলের টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের মতো বাজে অনুষ্ঠান বোধ হয় পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এডোয়ার্ড-এর কিছুই করা নেই হাসপাতালে। মারিয়াও হাসপাতালে আসা আস্তে আস্তে কমিয়ে দিলো; সম্ভবতঃ সে ক্রিস্টাল পাহাড়ে যেতে অন্য কোন সঙ্গী পেয়েছে।

তার বান্ধবীর অনিয়মিত যাতায়াতের বিপরীতে অ্যাম্বাসেডর মহোদয় ও তার স্ত্রী নিয়মিত তাদের ছেলেকে দেখতে যেতেন কিন্তু বাড়িতে থাকা কোন পর্তুগিজ বই তার জন্য নিয়ে যেতেন না। কারণ হিসেবে বলতেন যে, তারা শীঘ্রিই বদলী হয়ে যাবেন, কাজেই যে ভাষা কখনো আর কাজে লাগবে না সেটা শেখার কোন প্রয়োজন নেই। এডোয়ার্ড এরপর অন্যান্য রোগীদের সাথে গল্প করাতে মনোযোগী হলো। সে নার্সদের সাথে ফুটবল নিয়ে আলাপ করতো এবং তার হাতের কাছে কোন ম্যাগাজিন থাকলে তাই গিলতো। 

এরপর একদিন একজন নার্স তাকে একটা বই এনে দিলো কিন্তু সে দেখলো এটা একটা ‘পেট মোটা’ বই। ঠিক এ সময়েই এডোয়ার্ড-এর জীবন এক অদ্ভুত পথে চলতে শুরু করলো যে পথ তাকে ভিলেট নিয়ে এসেছে এবং বাস্তব থেকে তাকে অপসারণ করেছে যেটা তাকে তার বয়সী অন্য ছেলেদের থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে সরিয়ে ফেললো।

বইটি ছিলো সম্পূর্ণ কাল্পনিক যার ধারণাগুলো জগতটা কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। এটা ছিলো এমন কিছু মানুষের পার্থিব স্বর্গের স্বপ্ন নিয়ে যাদের প্রত্যেকের একটা ভাবনা রয়েছে এবং তারা তাদের এই ভাবনাগুলো অন্যের সাথে আলোচনা করে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। সেখানে যীশু যেমন ছিলো তেমনি ডারউইন ও তার তত্ত্ব মানুষ বানর থেকে এসেছে তা-ও ছিলো; সেখানে ছিলো ফ্রয়েড তার স্বপ্নের গুরুত্ব নিয়ে; ছিলো কলম্বাস রাণীর মুক্তো বেঁধে নিয়ে নতুন মহাদেশের খোঁজে; ছিলো মার্ক্স প্রত্যেকের সমতার বিশ্বাস নিয়ে। 

সেখানে ইগনেশাস লয়োলা’র মতো সাধু আছেন; একজন বাস্ক সৈন্য আছেন যিনি অনেক মহিলার সাথে বিছানায় গিয়েছেন আবার যুদ্ধে অনেক শত্রæকে হত্যা করেছেন যতক্ষণ না পাম্পলোনায় আহত হয়ে বিছানায় শুয়ে জগতটাকে বুঝতে পেরেছেন এবং সেখানেই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আভিলা’র তেরেসা আছেন যিনি ঈশ্বরকে পাওয়ার উপায় খুঁজে পেতে চেয়েছেন এবং যিনি একটা করিডোর দিয়ে যেতে হঠাৎ-ই থেমে গিয়ে একটা হাতে আঁকা ছবির দিকে স্থির হয়ে গিয়েছিলেন। অ্যান্থনি যিনি তার জীবনের প্রতি ক্লান্ত হয়ে মরুভূমিতে নির্বাসন নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেখানে তিনি দশ বছর কাটিয়েছেন বিভিন্ন অপদেবতার সাথে এবং প্রতিটি কল্পনাসাধ্য প্রলোভন তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো। আসিসি’র ফ্রান্সিস যে ঠিক করেছিলো পাখিদের সাথে কথা বলবে এবং তার মা-বাবা তার জীবন সাজাতে যে চিন্তা করেছিলো তা পেছনে ফেলে ছুটেছিলো।

আর কিছু করার না থাকায় সে এই ‘পেট মোটা বই’টা সেদিন বিকাল থেকে সে পড়তে লাগলো। মাঝরাতে একজন নার্স তার ঘরের বাতি জ্বালানো দেখে এসে জানতে চাইলো তার কিছু লাগবে কি না। সে বই থেকে চোখ না তুলেই তাকে ইশারা করে চলে যেতে বললো।

যে নারী পুরুষরা পৃথিবী নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তারা সাধারণ নারী-পুরুষ, এডোয়ার্ড-এর মতো, তার বাবার মতো, তার বান্ধবী যাকে সে হারাতে বসেছে তার মতো। তারা সবাই-ই একই সন্দেহ ও দুশ্চিন্তায় অস্থির যে সব মানুষই নিয়মিত রুটিনের মধ্যে থাকে। তারা এমন মানুষ যাদের ধর্মের প্রতি বা ঈশ্বরের প্রতি কোন বিশেষ কৌতুহল নেই। তারা তাদের মনকে বিস্তৃত করে একটা চেতনার স্তরে পৌঁছেছে যতদিন না তাদের মনে হয়েছে যে তারা সবকিছু পরিবর্তন করে ফেলবে। বইটার সবচেয়ে মজার বিষয় যেটা সেটা হচ্ছে এখানে বলা হয়েছে তারা প্রত্যেকে কীভাবে জীবন যাপন করতো। তাদের জীবনের একটা জাদুকরী মুহূর্ত রয়েছে যেখান থেকে তারা তাদের নিজস্ব ‘অপার্থিব স্বপ্ন’-এর খোঁজ করতে বেরিয়ে যায়।

তারা এমন মানুষ যারা তাদের জীবনকে সাধারণভাবে কাটাতে বেঁচে থাকেনি এবং তারা তা-ই অর্জন করেছে যেটা তারা চেয়েছে। প্রয়োজনে তারা ভিক্ষা করেছে অথবা রাজদরবারের মুখোমুখি হয়েছে, কুটনীতি বা ক্ষমতা ব্যবহার করেছে, আইন ভেঙ্গেছে বা ক্ষমতার কোপে পড়েছে, কিন্তু কখনোই লক্ষ্য থেকে সরে যায়নি। তারা সব সময়ই যে অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছে তার সুবিধা খুঁজে নিয়েছে।

পরদিন এডোয়ার্ড তার সোনার ঘড়িটা খুলে নার্সকে দিলো আর বললো এটা বিক্রি করে এ ধরনের যত বই পাওয়া যায় কিনে নিয়ে আসতে। এ ধরনের আর কোন বই ছিলো না। সে চেষ্টা করলো এই স্বপ্নবাজদের জীবনী পড়ার, কিন্তু সবার জীবনীই এমন ভাবে লেখা যে মনে হচ্ছিলো তারা আগে থেকেই পছন্দনীয়, অনুপ্রাণিত এবং তারা অন্যদের মতো সাধারণ ব্যক্তি নন, কেননা সাধারণ ব্যক্তিদের তাদের চিন্তার কথা বলতে লড়াই করতে হয়।

এডোয়ার্ড এ বই পড়ে এতোটাই প্রভাবিত হলো যে সে একজন সাধু হওয়ার কথা গুরুত্ব সহকারে ভাবতে বসলো এবং তার দুর্ঘটনাকে জীবনের মোড় ঘোরানো সুযোগ হিসেবে মনে করতে লাগলো। কিন্তু তার পা দু’ টা ভাঙ্গা এবং হাসপাতালে থাকা অবস্থায় তার কোন স্বপ্ন ছিলো না। মনকে নাড়িয়ে দেয়া কোন চিত্রকর্ম দেখে সে দাঁড়ায়নি, বা তার কোন বন্ধুও নেই যে ব্রাজিলের মাটিতে তাকে একটা উপাসনাগার বানিয়ে দিবে, এবং মরুভূমিও অনেক দূরে ও রাজনীতি দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত। সে একটা কাজই করতে পারতো: সে ছবি আঁকা শিখতে পারতো এবং সেটা দিয়ে পৃথিবীর সামনে সে সব নারী পুরুষের স্বপ্নকে তুলে ধরার চেষ্টা করতে পারতো।

এডোয়ার্ড যখন বাড়ি ফিরে আসলো তখন অন্যান্য কুটনীতিকদের কাছ থেকে যতটা একজন অ্যাম্বাসেডর-এর সন্তান আশা করতে পারে তার সবই পেলো – সেবা যত্ন, মনোযোগ সব। সে তার মাকে বললো সে পেইন্টিং কোর্সে ভর্তি হতে পারে কি না।

তার মা বললো সে ইতিমধ্যেই আমেরিকান স্কুলে অনেক ক্লাস মিস করেছে এবং সেগুলো তাকে বাড়তি ক্লাস দিয়ে পূরণ করতে হবে। এডোয়ার্ড স্কুলে যেতে রাজি হলো না। তার ভূগোল বা বিজ্ঞান পড়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই; সে একজন চিত্রশিল্পী হতে চায়। একটা মুহূর্তে সে ব্যাখ্যা করে বললো: “আমি ‘অপার্থিব স্বপ্ন’ দৃশ্য আঁকতে চাই।”

তার মা কিছুই বললো না, কিন্তু কথা দিলো সে তার বান্ধবীদের সাথে কথা বলে দেখবে শহরের সবচেয়ে ভালো পেইন্টিং কোর্স কোথায় করায়।

সন্ধ্যায় অ্যাম্বাসেডর মহোদয় বাড়ি ফিরে দেখেন তার স্ত্রী শোবার ঘরে কাঁদছেন। 

“আমাদের ছেলে তো পাগল হয়ে গেছে,” সে বললো। তার মুখ চোখের পানিতে ভিজে গিয়েছিলো। “একসিডেন্ট তার ব্রেনে প্রভাব ফেলেছে”।

“অসম্ভব” কুটনীতিক ক্ষুব্ধ হয়ে উত্তর দিলেন। “তাকে ডাক্তাররা ভালো ভাবে পরীক্ষা করেছে, বিশেষ করে আমেরিকানদের বাছাই করা ডাক্তাররা।”

তাদের ছেলে কী বলছে সে সম্পর্কে তার স্ত্রী তাকে বললো।

“এটা তো অল্প বয়সী বিদ্রোহী মনোভাব। ধৈর্য ধরো, সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে, দেখো।”

কিন্তু এবার অপেক্ষা ভালো কিছু দিলো না, কারণ এডোয়ার্ড বেঁচে উঠতে খুব তাড়াহুড়ো করছিলো। দুই দিন পর, তার মা’র বন্ধুরা কখন জানাবে এ ব্যাপারে আর ধৈর্য রাখতে না পেরে সে নিজেই আর্ট কোর্সে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিলো। সে রং ও পটভূমি সম্পর্কে শিখতে শুরু করলো এবং এমন মানুষদের সাথে পরিচিত হতো শুরু করলো যারা কখনো নতুন ডিজাইনের জুতো আর গাড়ি নিয়ে কথা বলে না।

“সে একজন চিত্রশিল্পী হয়ে বাঁচতে চায়!” তার মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে অ্যাম্বাসেডরকে বললো।

“আহ্, ছেলেটাকে একা থাকতে দাও,” অ্যাম্বাসেডর বললেন। “সে কিছুদিনের মধ্যে এটা নিয়ে বিরক্ত হয়ে যাবে, যেমন এর আগে বান্ধবী নিয়ে হয়েছে, ক্রিস্টাল, পিরামিড, ধুপ-ধুনা আর মারিজুয়ানা নিয়ে হয়েছে।”

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এডোয়ার্ডের রুমটা একটা স্টুডিও হয়ে উঠতে লাগলো, চারদিকে পেইন্টিং-এ ভর্তি যেটা তাদের মা-বাবাকে হতবুদ্ধি করে ফেলছিলো: উদ্ভট রং আর আদিম চিহ্ন মিলে মিশে লোকজনদের প্রার্থনার দেহভঙ্গিমা ফুটে উঠছিলো তাতে।

এডোয়ার্ড, একাকী বালক, যে ব্রাজিলে দুই বছর থেকে কোন দিন কোন বন্ধুকে বাসায় নিয়ে আসেনি, তার বাসায় উদ্ভট লোকজন এসে ভীড় করতে লাগলো, এদের সবাই অপরিপাটি চুলের বাজে কাপড়চোপর পরা লোকজন যারা জোরে জোরে ভয়ঙ্কর সব মিউজিক শুনতো – বিরামহীন পান করতো আর সিগারেট খেতো এবং সাধারণ ভালো ব্যবহারের প্রতি সম্পূর্ণ অশ্রদ্ধার ভাব নিয়ে চলতো। একদিন আমেরিকান স্কুলের পরিচালক এডোয়ার্ড-এর মাকে ডেকে পাঠালেন।

“আমার মনে হয় আপনার ছেলে মাদকাসক্ত,” পরিচালক বললেন। “তার স্কুলের নাম্বার গড় নাম্বার থেকে কম এবং যে যদি এরকমই ফলাফল করে তাহলে আমরা তাকে স্কুলে রাখতে পারবো না।”

তার মা সরাসরি অ্যাম্বাসেডর-এর অফিসে গেলেন এবং পরিচালক কী বলেছেন তা তাকে জানালেন।

“তুমি সব সময় বলে এসেছো সময়ের সাথে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে!” সে হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো চিৎকার করতে লাগলো। “তোমার এই উন্মাদ, মাদকাসক্ত ছেলে নিশ্চয়ই মারাত্মক কোন ব্রেন ইনজুরিতে ভুগছে এবং তুমি এদিকে খেয়াল না করে মেতে আছো ককটেইল পার্টি আর সামাজিক অনুষ্ঠান নিয়ে।”

“আস্তে কথা বলো,” সে বললো।

“না, আমি বলবো না এবং আমি আর কখনোই বলবো না যদি না তুমি কিছু করো। ছেলেটার সাহায্যের দরকার, বুঝতে পারছো না তুমি? চিকিৎসার দরকার। কিছু একটা করো!”

তার স্টাফদের সামনে তার স্ত্রী তাকে যেভাবে বিব্রত করলো তাতে অ্যাম্বাসেডর মহোদয় এডোয়ার্ডের পেইন্টিং-এর আগ্রহ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এটা যেহেতু প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সময় ধরে ঝেঁকে রয়েছে তাই অ্যাম্বাসেডর, একজন বাস্তবসম্মত ব্যক্তি যিনি সবকিছুর সঠিক পন্থা জানেন, তিনি একটা আক্রমণের ছক তৈরি করলেন। 

প্রথমে তিনি আমেরিকান অ্যাম্বেসিতে তার কলিগকে ফোন করলেন এবং খুব ভদ্রভাবে জানতে চাইলেন যে তিনি কি অ্যাম্বেসির স্বাস্থ্য সেবা আবার নিতে পারবেন কি না। তার অনুরোধ রাখা হলো।

তিনি সেই চিহ্নিত চিকিৎসকদের কাছে গেলেন, তাদের পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললেন এবং অনুরোধ করলেন আগের সব টেস্ট আর একবার করতে। ডাক্তাররা মামলার ভয়ে যেভাবে বলা হলো ঠিক সেভাবেই সব করলেন এবং জানালেন যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কুটনীতিক চলে যাওয়ার আগে তারা অনুরোধ করলেন যে তাদের ডকুমেন্টে একটা স্বাক্ষর করে যেতে যাতে আমেরিকান অ্যাম্বেসি তাকে তাদের কাছে পাঠানোর সকল দায়িত্ব থেকে মুক্তি পায়।

অ্যাম্বাসেডর সাথে সাথে যে হাসপাতালে এডোয়ার্ড ছিলো সেখানে গেলেন। তিনি হাসপাতালের পরিচালককে সকল সমস্যা খুলে বললেন এবং অনুরোধ করলেন যে সাধারণ রুটিন চেক আপ-এর পাশাপাশি তার যেন একটা রক্ত পরীক্ষা করা হয় সে মাদকাসক্ত কি না সেটা নিশ্চিত হতে। 

তারা রক্ত পরীক্ষা করলো এবং কোন মাদকের চিহ্ন পেলো না।

এরপর তৃতীয় ও সর্বশেষ ধাপ বাকি ছিলো: এডোয়ার্ডের সাথে নিজে কথা বলা এবং খুঁজে বের করা আসলে কী ঘটছে। সব বিষয় জানতে পারলে এটার একটা সঠিক সমাধান বের করতে পারবেন বলে তিনি আশা করছিলেন।

পিতা-পুত্র লিভিং রুমে বসলেন।

“তোমার মা তোমাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত,” অ্যাম্বাসেডর বললেন। “তোমার পরীক্ষার নাম্বার খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং সবচেয়ে বিপদের কথা তোমাকে স্কুলে নাও রাখতে পারে।”

“কিন্তু আর্ট স্কুলে তো আমার নাম্বার ভালো হচ্ছে, বাবা।”

“আর্টের বিষয়ে তোমার আগ্রহকে আমি খুশি মনেই দেখছি, কিন্তু তোমার সামনে তো সেটা করার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে। এই মুহূর্তে তোমার প্রধান কাজ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করা যাতে আমি তোমাকে কুটনীতি পেশায় আসার পথটা তৈরি করে দিয়ে যেতে পারি।”

এডোয়ার্ড অনেকক্ষণ ভাবলো এবং কিছু বলার আগে শুনলো। সে তার দুর্ঘটনা সম্পর্কে ভাবছিলো, স্বপ্নবাজদের বই সম্পর্কে ভাবছিলো যেটা তার সত্যিকারের পেশা খুঁজে পাওয়ার একমাত্র অজুহাত এবং সে মারিয়া’র কথা ভাবছিলো যার কাছ থেকে সে আর কোন ফোনই পায়নি। সে একটু দ্বিধা করে শেষে বললো, “আমি কুটনীতিক হতে চাই না, আমি চিত্রশিল্পী হতে চাই।”

তার বাবা এ জবাবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং জানেন যে কী করতে হবে।

“তুমি একজন চিত্রশিল্পী হতে চাও, তাহলে প্রথমে তোমার পড়ালেখা শেষ করো। আমরা বেলগ্রেডে, জাগরেবে, ল্যুবল্জানা’য় ও সারাইভোতে তোমার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দিবো। আমার প্রভাব রয়েছে, আমি সাহায্য করতে পারবো, কিন্তু তোমাকে তো পড়ালেখা শেষ করতে হবে।”

“আমাকে যদি সেটা করতে হয়, তাহলে আমি সহজ পথে যেতে চাই। আমি এমন বিষয়ে পড়ে ডিগ্রি নিতে চাই যেটা আমার আগ্রহের বিষয় না হলেও আমাকে আয় রোজগার করে খেতে সাহায্য করবে। এর পেছনে পেইন্টিং চালিয়ে যাবো। আমি আমার পেইন্টিং দিয়ে কিছু একটা করে আয় রোজগার করবো।”

অ্যাম্বাসেডর বিরক্ত হতে শুরু করলো।

“বাবা, তুমি তো সব পেয়েছো, একটা পরিবার পেয়েছো যে তোমাকে ভালোবাসে, একটা বাড়ি, টাকাপয়সা, সামাজিক অবস্থান সব, কিন্তু তুমি জানো যে আমাদের দেশ একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এবং সেখানে গৃহযুদ্ধের গুজব চলছে। এমনও হতে পারে আগামীকাল আমি আর তোমাকে সাহায্য করার অবস্থায় থাকবো না।”

“আমি আমার নিজেকে সাহায্য করতে পারবো। বিশ্বাস করো। একদিন আমি ‘অপার্থিব স্বপ্ন’ শিরোনামে একটা ধারাবাহিক চিত্রকর্ম আঁকবো। এ চিত্রকর্ম আগে নারীপুরুষরা তাদের অন্তরে কী অনুভব করতো তার ধারাবাহিক ইতিহাস ফুটিয়ে তুলবে।”

অ্যাম্বাসেডর তার ছেলের সংকল্পের প্রশংসা করলেন, একটা হাসি দিয়ে আলাপের সমাপ্তি টানলেন। তাকে আরো এক মাসের সময় দিলেন; কেননা কুটনীতি সিদ্ধান্ত স্থগিত করারও একটা শিল্প যতক্ষণ সমস্যা নিজে থেকেই সমাধান হওয়ার সুযোগ থাকে। 

এক মাস পার হয়ে গেলো এবং এডোয়ার্ড সারাক্ষণ পেইন্টিং নিয়ে পড়ে থাকলো, সাথে তার অদ্ভুদ বন্ধুবান্ধব এবং কিছু মিউজিক নিয়ে যেটা আপাতদৃষ্টিতে কিছু মানসিক ভারসাম্যহীনতাকে প্ররোচিত করতে পারে বলে মনে হয়। ব্যাপার আরো খারাপ হয়ে গেলো যখন সে একজন শিক্ষকের সাথে সাধুদের অস্তিত্ব নিয়ে তর্ক করে আমেরিকান স্কুল থেকে বহিষ্কার হলো।

যেহেতু সিদ্ধান্তের জন্য আর বেশি দিন অপেক্ষা করা যাচ্ছিলো না, তাই অ্যাম্বাসেডর শেষ চেষ্টা হিসেবে ছেলের সাথে মুখোমুখি কথা বলতে ডেকে পাঠালেন।

“এডোয়ার্ড, তুমি এখন তোমার নিজের জীবনের দায়িত্ব নেয়ার মতো বয়সে পৌঁছেছো। তোমার ব্যাপারটা নিয়ে আমরা অনেক দিন ঝুলে রয়েছি যত দিন আমরা পেরেছি। কিন্তু এখন তোমাকে চিত্রশিল্পী হওয়ার মতো ফালতু চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে এবং তোমার ভবিষ্যৎ পেশার পরিকল্পনা নিয়ে কিছু ভাবতে হবে।”

“কিন্তু বাবা, চিত্রশিল্পী হওয়াই তো আামার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।”

“তাহলে তোমার প্রতি যে আমাদের ভালোবাসা, তোমাকে ভালো পড়ালেখা করানোর আমাদের সব প্রচেষ্টা এগুলোর কী হবে। তুমি তো কখনো এমন ছিলে না। আমার তো মনে হয় তোমার দুর্ঘটনার কারণেই এরকম হচ্ছে।”

“দেখো, আমি তোমাদের দু’ জনকেই পৃথিবীর যে কোন কিছু বা যে কারো চেয়ে বেশি ভালোবাসি।”

অ্যাম্বাসেডর তার গলা পরিষ্কার করলেন। তিনি আবেগের এমন স্পষ্ট প্রকাশের সাথে অভ্যস্ত নন। 

“তাহলে আমাদের প্রতি তোমার যে ভালোবাসার কথা বলছো তার দোহাই লাগে, তোমার মা যেমন চান তুমি তাই করো। তোমার আঁকাআঁকির সব কিছু এখনই বন্ধ করো, তোমার সামাজিক অবস্থানের সাথে খাপ খায় এমন কিছু বন্ধুবান্ধব যোগাড় করো এবং পড়ালেখায় ফিরে যাও।”

“তুমি আমাকে ভালোবাসো, বাবা। তুমি আমাকে এমন বলতে পারো না। কারণ তুমি তো আমাকে সব সময় একটা ভালো উদাহরণ হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছো, এমন জিনিসের প্রতি লড়াই করা যেটা আমি চাই। তুমি তো এটা চাইতে পারো না যে আমি এমন একটা মানুষ হই যার নিজের কোন চাওয়া নেই।”

“আমি তো বলেছি ‘ভালোবাসার দোহাই’। আমি আগে কখনোই তোমাকে এভাবে বলিনি, কিন্তু এখন বলছি। সে ভালোবাসার জন্য যেটা তুমি আমাদের জন্য তোমার মনে যত্ন করে রেখেছো, সে ভালোবাসার জন্য যেটা আমরা তোমার জন্য রেখেছি। আমি এটা শুধু বলার জন্য বলছি না, সত্যিই এটা বোঝাতে চাচ্ছি। বাস্তব থেকে পালিয়ে তুমি তোমাকে ধোঁকা দিচ্ছো।

“তোমার জন্মের সময় থেকে আমরা আমাদের স্বপ্ন বুনেছি আমাদের জীবন কেমন হবে। তুমিই তো আমাদের সবকিছু, আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের অতীত। তোমার পিতৃপুরুষ সরকারি কর্মচারি ছিলেন, এবং আমাকে সিংহের মতো লড়াই করতে হয়েছে কুটনীতিক চাকরিতে ঢুকতে ও আমার উপরে উঠার সিঁড়ি তৈরি করতে। আর আমি এ সব কিছু তৈরি করেছি শুধুমাত্র তোমার জন্য কিছু জায়গা প্রস্তুত করতে, তোমার জন্য সব কিছু সহজ করতে। একজন অ্যাম্বাসেডর হিসেবে আমার প্রথম স্বাক্ষর করা কলমটি আমি যত্ন করে তুলে রেখেছি শুধুমাত্র তোমাকে দেয়ার জন্য যেদিন তুমি একই কাজ করতে যাবে।

“আমাদের অসম্মান করো না, বাবা। আমরা তো চিরদিন বেঁচে থাকবো না, আমরা শান্তিতে মরতে চাই অন্ততঃ এটুকু জেনে যে আমরা তোমার জীবনে সঠিক পথটা ঠিক করে দিতে পেরেছি।

“তুমি যদি আমাদের সত্যিই ভালোবাসো, তাহলে আমি যেমন বলছি তেমন করো। তুমি যদি আমাদের ভালো না বাসো তাহলে তুমি যেমন আছো তেমনি থাকো।”

এডোয়ার্ড এক দৃষ্টিতে ব্রাজিলের আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইলো – মেঘগুলো নীল আকাশে ভেসে যাচ্ছে সে দেখতে পাচ্ছিলো। কী সুন্দর মেঘ, কিন্তু মধ্য ব্রাজিলের শুষ্ক মাটিকে ভেজাতে তাদের মধ্যে এক ফোঁটা জলও নেই। সেও ঠিক তাদের মতোই শূন্যতা অনুভব করছিলো।

সে যেমন আছে তেমনি যদি থাকে তবে তার মা হয়তো দুঃখে মারা যাবেন, তার বাবা হয়তো তার পেশায় যাবতীয় উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলবেন এবং তারা একে অন্যকে দোষারোপ করে যাবে তাদের একমাত্র সন্তানকে ঠিক ভাবে মানুষ না করতে পারায়। সে যদি সব কিছু ছেড়ে দেয় তাহলে তার ‘অপার্থিব স্বপ্ন’র ছবি আর কোন দিন আলোর মুখ দেখবে না; এবং পৃথিবীর আর কোন কিছুই তাকে এরকম আনন্দ ও সুখের অনুভূতি দিবে না।

সে তার চারপাশে তাকিয়ে তার পেইন্টিং গুলো দেখতে পেলো। সে তুলির প্রতিটা আঁচড়ে তার ভালোবাসা আর অর্থপূর্ণতা মনে করতে পারছিলো, এবং তার কাছে সবগুলো পেইন্টিং-ই মাঝারি মানের মনে হচ্ছিলো। সে একটা ভণ্ড, সে এমন কিছু চেয়েছে যার জন্য তাকে বেছে নেয়া হয়নি, যার মূল্য তার মা-বাবা’র কাছে শুধুই হতাশা।

‘অপার্থিব স্বপ্ন’ অল্প কিছু বাছাইকৃতদের জন্য যারা বই-এ এই প্রত্যয়ে বীর ও জীবন উৎসর্গীকৃত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন যা তারা বিশ্বাস করতেন – তারা শিশুকাল থেকেই জানতেন যে পৃথিবী তাদের কাছে কী চায়। এটাই তথাকথিত কারণ হিসেবে তার পড়া প্রথম একটা বই-এ গল্পকারের উদ্ভাবন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

রাতে খাবার সময় সে তার মা-বাবাকে বললো যে তারাই সঠিক; এটা আসলে একটা যৌবনের স্বপ্ন, তার পেইন্টিং-এর প্রতি উদ্যম চলে গিয়েছে। তার মা-বাবা খুশি হলেন, তার মা আনন্দে কাঁদছিলেন এবং ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে গেলো।

সেদিন রাতে অ্যাম্বাসেডর তার বিজয়কে গোপনে স্মরণীয় করে রাখতে একটা শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে বসে একাই শেষ করলেন। যখন তিনি বিছনায় গেলেন – তখন অনেক মাসের মধ্যে প্রথম বারের মতো – তার স্ত্রী ইতিমধ্যে প্রশান্তির ঘুম দিয়েছেন।

পরদিন তারা দেখলো এডোয়ার্ড-এর রুম পুরো বিভ্রান্তিকর অবস্থায় রয়েছে। তার পেইন্টিংগুলো ফালা ফালা করে কাটা, আর ছেলেটা রুমের একটা কোনায় বসে আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন তাকে উনি প্রচণ্ড ভালোবাসেন, কিন্তু এডোয়ার্ড কোন সাড়া দিলো না।

তার আর ভালোবাসার প্রয়োজন নেই; সে সম্পূর্ণ ব্যাপার নিয়ে হতাশ। সে ভেবেছিলো সে শুধু সব ছেড়ে দিয়ে তার বাবার উপদেশ মেনে চলবে, কিন্তু সে তার কাজটা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। তার সুগভীর হতাশায় তলিয়ে গিয়েছিলো যেটা একটা মানুষকে তার স্বপ্ন থেকে আলাদা করে ফেলে, আর এখন তার আর ফিরে আসার কোন পথ নেই। 

সে সামনে বা পিছনে কোন দিকেই যেতে পারছে না। সব চেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে মঞ্চ থেকে সরে দাঁড়ানো।

এডোয়ার্ড আরো পাঁচ মাস ব্রাজিলে থাকলো। বিশেষজ্ঞদের পরিচর্যায় যেটা তারা খুঁজে পেলেন সেটা হচ্ছে সে এক ধরনের ব্যতিক্রমী সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত যেটা খুব সম্ভবতঃ তার বাই সাইকেল অ্যাকসিডেন্টের কারণে। এর পর যুগোশ্লাভিয়ায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লো এবং অ্যাম্বাসেডরকে তাড়াহুড়া করে ডেকে পাঠানো হলো। এডোয়ার্ডের দেখাশোনা করা পরিবারের জন্য কঠিন হয়ে গেলো, এবং একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ালো তাকে নতুন খোলা হাসপাতাল ভিলেট-এ রেখে যাওয়া।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০