fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

আটাশ

এডোয়ার্ড ও ভেরোনিকা ল্যুবল্জানা’র সবচেয়ে দামি রেস্তোরায় গিয়ে বসলো, সবচেয়ে ভালো খাবারটা অর্ডার করলো এবং ১৯৮৮’র তিন বোতল ওয়াইন পান করলো, যেটা শতাব্দির সেরা পানীয়ের একটি। পুরো খাবার সময় তারা একবারের জন্য হলেও ভিলেট, বা অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ -এর উল্লেখ করলো না।

“আমার সাপের গল্পটা পছন্দ হয়েছে,” এডোয়ার্ড তার গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে ঢালতে বললো। “কিন্তু তোমার দাদীর বয়স হয়েছে, তাই গল্পের ব্যাখ্যাটা ঠিক ভাবে বলতে পারেননি।”

“আমার দাদীর প্রতি কিছু সম্মান রাখো, প্লিজ!,” ভেরোনিকা মাতালের মতো প্রায় গর্জন করে উঠলো। রেস্তোরার সবাই সচকিত হয়ে উঠলো।

“এই তরুণীর দাদীকে উদ্দেশ্যে একটা টোস্ট হোক!” এডোয়ার্ড লাফিয়ে উঠে বললো। “আামার পাশে বসা এ পাগলীর দাদীর উদ্দেশ্যে একটা টোস্ট, যে কিনা ভিলেট-এর এক নির্ভীক পলাতক!”

লোকজন আবার তাদের খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো যেন কিছুই হয়নি।

“দাদীর উদ্দেশ্যে টোস্ট!” ভেরোনিকা বললো।

রেস্তোরার মালিক তাদের টেবিলে এসে দাঁড়ালো।

“একটু স্বাভাবিক আচরণ করুন, প্লিজ!”

তারা শান্ত হলো, কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্য। একটু পরই আবার তাদের উঁচু কণ্ঠস্বর, অচেতন মন্তব্য আর বেমানান আচরণ শুরু হলো। রেস্তোরার মালিক আবার তাদের টেবিলে গেলো এবং তাদের বললো যে তাদের বিল দিতে হবে না। কিন্তু এখনি রেস্তোরা থেকে বের হতে যেতে তিনি অনুরোধ করছেন।

“চিন্তা করে দেখো আমরা একই অত্যধিক দামী ওয়াইনের টাকাটা বাঁচাতে পারছি,” এডোয়ার্ড বললো। “চলো এই ভদ্রলোক তার মত পাল্টানোর আগেই পালাই এখান থেকে।”

কিন্তু ভদ্রলোক তার মত পাল্টালেন না। তিনি ইতিমধ্যে ভেরোনিকার চেয়ার টেনে ধরেছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যেন খুব ভদ্রভাবে তাকে যতটা সম্ভব দ্রæত রেস্তোরা থেকে বের হতে সাহায্য করছেন।

তারা শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ছোট্ট স্কয়ারটার মধ্যে হাঁটতে লাগলো। ভেরোনিকা তার আশ্রমের রুমটার দিকে তাকালো, সেদিকে তাকিয়ে তার মাতলামি দূর হয়ে গেলো। তার মনে পড়লো সে শীঘ্রি মরতে যাচ্ছে।

“চলো আরো কিছু ওয়াইন পান করি!” এডোয়ার্ড বললো।

কাছেই একটা বার ছিলো। এডোয়ার্ড দু বোতল ওয়াইন নিলো। তারা দু’ জনে বসে পান করতে লাগলো।

“ছবি সম্পর্কে আমার দাদীর ব্যাখ্যায় সমস্যা কী?” ভেরোনিকা প্রশ্ন করলো।

এডোয়ার্ড এতোটা মাতাল ছিলো যে রেস্তোরায় কী আলোচনা হয়েছিলো তা মনে করতে তার বেশ বেগ পেতে হলো, তবে শেষ পর্যন্ত সে মনে করতে পারলো।

“তোমার দাদী বলেছেন যে মহিলাটি সাপের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন কারণ ভালোবাসা, ভালো ও মন্দের উপর নিয়ন্ত্রণ করে। এটা একটা চমৎকার ও রোমান্টিক ব্যাখ্যা, কিন্তু এটা আসলে এমন না। আমি এ ছবি আগেও দেখেছি, এটা একটা স্বর্গ দৃশ্যের ছবি যেটা আমি আঁকবো বলে কল্পনা করেছিলাম। আমার ভাবতে অবাক লাগে তারা সব সময় কুমারী মেরিকে এভাবে কেন কল্পনা করে।”

“কেন করে?”

“কারণ কুমারী মেরি হচ্ছেন নারীশক্তির ও প্রভুর প্রতীক যেখানে সাপ হচ্ছে প্রজ্ঞার প্রতীক। তুমি যদি ডা. ইগোর-এর আঙটির দিকে লক্ষ্য করে থাকো তবে দেখবে যে এটা চিকিৎসকের চিহ্ন বহন করছে: দু’ টা সাপ একটা লাঠিকে পেঁচিয়ে রয়েছে। প্রেমের অবস্থান প্রজ্ঞার উপরে, ঠিক যেমন কুমারী মেরির অবস্থান সাপের উপরে। তিনি পুরোটাই একটা স্পৃহা। তাঁর জন্য সব কিছুই অনুপ্রেরণা। ভালো মন্দের বিচার করতে তিনি ব্যস্ত না।”

“তুমি কি আরো কিছু ব্যাপার জানো?” ভেরোনিকা বললো। “কুমারী মেরি, কখনো অন্যরা তাকে নিয়ে কী ভাবে তা লক্ষ্য করেন না। যেন প্রত্যেককে পবিত্র আত্মা সম্পর্কে বলে যাচ্ছেন। তিনি কিছুই ব্যাখ্যা করেন না, শুধু বলেন: ‘এটা এভাবেই ঘটে।’ আর তুমি কি জানো তখন অন্যরা কী বলে?”

“অবশ্যই। বলে যে, সে একজন বিকারগ্রস্ত।”

তারা দু’ জনেই হেসে উঠলো। ভেরোনিকা তার গ্লাস তুলে ধরলো।

“কন্গ্রাচুলেশনস্। তোমার অন্য কোন ‘অপার্থিব স্বপ্ন’ দৃশ্য আঁকা উচিত, আমরা এখন যেটা আলাপ করলাম সেটা বাদ দিয়ে।”

“আমি শুরু করবো,” এডোয়ার্ড বললো।

ছোট স্কয়ারটার পাশে ছোট একটা পাহাড় ছিলো, ঐ পাহাড়ের উপর একটা ছোট দুর্গ রয়েছে। ভেরোনিকা আর এডোয়ার্ড ঐ খাড়া পথ দিয়ে টেনে টেনে উঠছে, যেতে যেতে পথকে অভিসম্পাত দিচ্ছে আর হেসে উঠছে, বরফে পিছলে পড়ছে আর ক্লান্তিকে গালাগাল দিচ্ছে।

দুর্গটার পাশে একটা বিশাল হলুদ ক্রেন রয়েছে। কেউ যখন প্রথম ল্যুবল্জানা আসে তখন এই ক্রেন দেখে মনে করে যে দুর্গটার সংষ্কার কাজ চলছে এবং শীঘ্রিই এ কাজ শেষ হবে। তবে ল্যুবল্জানা’র অধিবাসীরা জানে যে এই ক্রেন অনেক বছর ধরেই এখানে পড়ে রয়েছে যদিও কেউ জানে না কেন। ভেরোনিকা এডোয়ার্ডকে বললো, যখন কিন্ডারগার্টেন-এর বাচ্চাদের ল্যুবল্জানা’র দুর্গের ছবি আঁকতে বলা হয়, তখন তারা সব সময়ই এ ক্রেন সহ দুর্গের ছবি আঁকে।

“কারণ, ক্রেনটা দুর্গের চেয়েও বেশি যত্ন করে রাখা হয়েছে।”

এডোয়ার্ড হাসছে।

“তোমার তো এতোক্ষণের মরে যাওয়ার কথা,” সে বললো। এডোয়ার্ড এখনো কিছুটা মাতাল অবস্থায় রয়েছে, তারপরও তার কণ্ঠ কিছুটা কাঁপা কাঁপা শোনা যাচ্ছিলো। “এটা বেয়ে উঠলে তোমার হার্টের টিকে থাকার কথা না।”

ভেরোনিকটা তাকে একটা দীর্ঘ গভীর চুমু দিলো।

“আমার দিকে তাকাও,” ভেরোনিকা বললো।

“এ সময়টাকে তোমার অন্তরের চোখে গভীর ভাবে মনে রেখো, যেন কোন একদিন তুমি এটা আবার কল্পনায় দেখতে পারো। তোমার ভালো লাগলে এটাই পথ চলার শুরু হতে পারে, কিন্তু তোমাকে আবার আঁকাআঁকিতে ফিরতে হবে। এটা আমার শেষ অনুরোধ। তুমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?”

“করি।”

“তাহলে তুমি ঈশ্বরের নামে প্রতিজ্ঞা করো যে তুমি বিশ্বাস করে যে আমাকে তুমি আঁকতে পারবে।”

“আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম।”

“আর আমাকে আঁকার পর তুমি আঁকাআঁকিতে ফিরে যাবে।”

“এটার কথা দিতে পারবো কি না আমি বলতে পারছি না।”

“পারবে। আর তোমাকে ধন্যবাদ যে তুমি আমাকে জীবনের অর্থ এনে দিয়েছো। আমি এ পৃথিবীতে এসেছিলাম শুধু চলে যাওয়ার জন্য: আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম, আমার হার্টকে নষ্ট করে ফেলেছি, তোমার সাথে দেখা হলো, আর এই দুর্গে এলাম তোমার হৃদয়ে আামর চেহারাটা খোদাই করে দিতে। এই একটা কারণেই আমি পৃথিবীতে এসেছি, তুমি যে পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলে সে পথে তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। তুমি আমাকে এটা ভাবতে বাধ্য করো না যে আমার জীবনটা বৃথা গেছে।”

“আমি জানি না যে এটা খুব তাড়াহড়া হচ্ছে না কি খুব দেরি, যেমনটা তুমি বলেছো আমাকে, তেমনি আমিও বলতে চাই আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে এটা বিশ্বাস করতে হবে না, এটা হয়তো শুধু আমার বোকামি, আমার একটা উদ্ভট আবেগ।”

ভেরোনিকা তাকে জড়িয়ে ধরলো এবং ঈশ্বরকে বললো, এ মুহূর্তটা যে ঈশ্বর তার জন্য রেখেছিলেন তা সে বিশ্বাসই করতে পারছে না।

ভেরোনিকা চোখ বুজে এডোয়ার্ডকে অনুভব করতে লাগলো। এক গভীর, স্বপ্নহীন ঘুম তাকে ঘিরে ধরলো। মৃত্যু সুখময়; এটা ওয়াইনের মতো গন্ধময় আর চুলে বিলি কাটার মতো প্রশান্তিময়।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০