fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

দুই

ভেরোনিকা যখন চোখ মেললো তখন তার মনে হচ্ছিলো না এটা স্বর্গ। স্বর্গের রুম আলোকিত করতে নিশ্চয়ই ফ্লুরোসেন্ট বাতি ব্যবহৃত হয় না; তাছাড়া সেকেন্ড খানেক পর তার যে ব্যথা শুরু হলো তা একেবারে বাস্তব জগতের ব্যথা। আহ্! সেই একই রকম নির্ভুল বাস্তব জগতের ব্যথা!

সে নড়তে চেষ্টা করার সাথে সাথে ব্যথাটা বেড়ে গেলো। তার দৃষ্টিতে কিছু উজ্জ্বল বিন্দু ভাসতে লাগলো। ভেরোনিকা বুঝতে পারছে যে বিন্দুগুলো স্বর্গের তারা নয়, বরং সে ভেতরে ভেতরে যে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে তারই ফল এগুলো।

“ওর জ্ঞান ফিরছে,” ভেরোনিকা একটা নারীকণ্ঠ শুনতে পেলো। “তুমি তো নরকে আছড়ে পড়েছো, তুমি পুরো সফল হতে পারলে তোমার জন্য ভালো হতো।”

না, এটা সত্য হতে পারে না; ঐ কণ্ঠ তাকে ভোলানোর চেষ্টা করছে। এটা নরক না, কারণ তার সত্যিই খুব ঠান্ডা লাগছে। সে তার নাক ও মুখে কতগুলো প্লাস্টিক নলের অস্তিত্ব বুঝতে পারছে। নলগুলোর একটা তার গলা দিয়ে নেমে গেছে, তাতে তার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাচ্ছে।

সে এটা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেই বুঝতে পারলো তার হাতগুলো বাঁধা।

“আমি মজা করছিলাম, এটা নরক না,” আগের কণ্ঠটা বলে চললো, “তবে এটা নরকের চেয়েও খারাপ, যদিও আমি কখনো এখানে থাকিনি। তুমি ভিলেট-এ রয়েছো।”

ব্যথা ও দম্ বন্ধ ভাব সত্ত্বেও ভেরোনিকা তখনই বুঝতে পারলো যে কী ঘটেছে। সে আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিলো এবং কেউ একজন হয়তো সময় মতো তাকে রক্ষা করতে চলে এসেছিলো। সেই রক্ষাকর্তা হয়তো আশ্রমের কোন সন্ন্যাসিনী, হয়তো না বলে আসা কোন বন্ধু অথবা কোন ডেলিভারি ম্যান যার অর্ডার সে ভুলে গিয়েছিলো। মূল কথা হচ্ছে সে বেঁচে গিয়েছে এবং ভিলেট-এ রয়েছে।

ভিলেট হচ্ছে বিখ্যাত ও সবচেয়ে ভীতিকর মানসিক হাসপাতাল যেটা স্বাধীনতার বছর ১৯৯১ এ প্রতিষ্ঠিত। সে সময় ধারণা করা হচ্ছিলো যে পুরাতন যুগোশ্লাভিয়া খুব শান্তিপূর্ণভাবে ভেঙ্গে যাবে (স্লোভেনিয়া মাত্র এগারো দিনের যুদ্ধে পৃথক হয়ে গিয়েছিলো)। সে সময় একদল ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ী সৈন্যদের পুরাতন ব্যারাকে একটি মানসিক হাসপাতাল তৈরির অনুমোদন পেয়েছিলো। ব্যারাকটি রক্ষণাবেক্ষণের অতিব্যয়ের কারণে পরিত্যক্ত হয়েছিলো।

তার কিছু দিনের মধ্যেই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, প্রথমে ক্রোয়েশিয়ায়, তারপর বসনিয়ায়। যুদ্ধের কারণে হাসপাতালের অংশীদাররা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কেননা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে পুঁজিবাদীরা বিনিয়োগ করেছে যাদের অনেককে তারা চেনেনও না। সে ক্রান্তিকালে তাদের সাথে বসে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে বোঝানোর এবং ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ জানানোর কোন অবস্থা ছিলো না। তারা এ সমস্যার সমাধান করেছিলো এমন কিছু ব্যবস্থার মাধ্যমে যা একটি মানসিক হাসপাতালের জন্য এবং একটা অনুকূল সমাজতন্ত্র থেকে উদ্ভূত নতুন জাতির জন্য খুব প্রশংসনীয় ছিলো না। ভিলেট পুঁজিবাদের সকল বাজে বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ হাসপাতালে কাউকে ভর্তি হতে হলে সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে টাকা।

এখানে এমন লোকের অভাব নেই যারা হয়তো উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পরিবারের কলহপ্রিয় সদস্য থেকে (অথবা ঐ সদস্য সৃষ্ট বিব্রতকর কর্মকাণ্ড থেকে) মুক্তি পেতে চায়, অথবা কেউ হয়তো তাদের সমস্যাগ্রস্ত পিতা-মাতা বা সন্তানের জন্য বহুমূল্য দিয়ে একটা সার্টিফিকেট কিনতে চায়। আরো অনেকে আছে যারা বড় পরিমাণ দেনা থেকে রক্ষা পেতে কিংবা বিচারের আওতায় আসতে পারে এমন আচরণ থেকে রক্ষা পেতে কিছু দিন এই মানসিক হাসপাতালে কাটিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে ঐ দেনা ও আইনগত প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি পেয়ে যায়।

ভিলেট এমন একটা জায়গা যেখান থেকে কেউ কখনো পালায়নি। এখানে আদালত থেকে অথবা অন্য হাসপাতাল থেকে মানসিক রোগীদের পাঠানো হয়। এ লোকগুলো, যারা পাগলামির অভিযোগে অভিযুক্ত বা পাগলামির ধরন রয়েছে এমন আরো কিছু লোকজনদের সাথে এখানে থাকে। ফলাফল একদম বিভ্রান্তিকর, এবং বিভিন্ন পত্রিকা ক্রমাগত এর বাজে সেবা ও অনিয়মের গল্প প্রকাশ করছে; যদিও তারা ভিলেট-এর ভেতরে পরিদর্শনের অনুমতি কখনো পায়নি এবং জানেও না ভেতরে আসলে কী হচ্ছে। সরকার অবশ্য অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখে কিন্তু কখনোই অভিযোগের পক্ষে কোন প্রমাণ পায় না। বিনিয়োগকারীরা স্লোভেনিয়ায় বিদেশী বিনিয়োগ করা কঠিন এমন একটা গুজব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি সব সময়ই দিয়ে থাকে। আর তাই প্রতিষ্ঠানটি একই ভাবে চলছে; সত্যি কথা বলতে আরো শক্তিশালী হচ্ছে।

“আমার আন্টি কয়েক মাস আগে আত্মহত্যা করেছেন,” নারী কণ্ঠটি বলে যাচ্ছিলো। “প্রায় আট বছর ধরে সে তার রুম থেকে বের হতেও প্রচণ্ড ভয় পেতো; শুধুমাত্র খেয়ে মোটা হচ্ছিলো। সে ক্রমাগত ধুমপান করতো, ঘুমের ওষুধ খেতো আর দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুমাতো। তার দু’টা মেয়ে আর স্বামী ছিলো যারা তাকে ভালোও বাসতো।”

ভেরোনিকা চেষ্টা করেও তার মাথা বক্তার দিকে ঘোরাতে পারছিলো না।

“আমি ঐ অবস্থা থেকে একবারই তাকে ফিরে আসতে দেখেছিলাম যখন তার স্বামী অন্য একজন মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন। তখন সে একটা হইচই বাঁধিয়ে ফেললো, বেশ কিছু পাউন্ড খরচ করে ফেললো, কিছু গ্লাস ভেঙ্গে চুরমার করলো এবং কয়েক সপ্তাহ ধরে তার চিৎকার চেচামেচি প্রতিবেশীদের রাতে জাগিয়ে রাখলো। যদিও এটা ফালতু মনে হতে পারে, তবে আমার কাছে মনে হয়েছে সে সময়টা ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময়। তিনি কিছু একটার জন্য লড়াই করছিলেন; তিনি বেঁচে আছেন এবং তাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন বিষয়কে তিনি মোকাবেলা করতে সক্ষম, এটা তিনি অনুভব করতে পারছিলেন।”

এগুলোর সাথে আমার কী সম্পর্ক? ভেরোনিকা ভাবছিলো। ভেরোনিকা বলতে পারছিলো না, “আমি তোমার আন্টিও নই এবং আমার স্বামীও নেই”।

“অবশেষে অবশ্য উনার স্বামী তার প্রেমিকার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন,” মহিলাটি বললো, “এবং আমার আন্টি আবারো তার আগের অসাড় অবস্থায় ক্রমাগত ফিরে গিয়েছিলো। একদিন সে ফোন করে জানালো যে, সে তার জীবনকে পরিবর্তন করতে চায়, সে ধুমপান ছেড়ে দিয়েছে। একই সপ্তাহে সে ধুমপান ছেড়ে দেয়ায় আরো বেশি করে ঘুমের ওষুধ খাওয়া শুরু করলো; আর সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলো যে, সে নিজেকে শেষ করে দিবে।

“কেউ তার কথা বিশ্বাস করেনি। তারপর একদিন সকালে সে আমার মেসেজ মেশিনে একটা মেসেজ দিয়ে, বিদায় জানিয়ে নিজেকে স্থবির করে ফেলে। আমি বেশ কয়েকবার তার সে মেসেজ শুনেছি; তার এতো শান্ত ও অদৃষ্টের কাছে পরাজিত কণ্ঠস্বর আমি আর কখনো শুনিনি। সে বলেছিলো, সে সুখী বা অসুখী কোনটাই নয় এবং এ কারণেই জীবনটাকে সে আর চালিয়ে যেতে পারছিলো না।”

যে ভদ্রমহিলা এ কাহিনী বলছিলেন তার জন্য ভেরোনিকা কষ্ট পেলো। মনে হচ্ছিলো তিনি অন্ততঃ তার আন্টির মৃত্যুটা বুঝতে চাচ্ছিলেন। পৃথিবীতে যেখানে প্রত্যেকে যে কোন মূল্যে বেঁচে থাকার যুদ্ধ করে চলে সেখানে নিজেকে শেষ করে দিতে চাচ্ছে এমন লোককে নিয়ে ভাবার সময় কোথায় মানুষের?

কেউই ভাবে না। প্রত্যেক মানুষই তার নিজ দুর্দশার বিস্তৃতি অথবা নিজ জীবনের অর্থহীনতা জানে। ভেরোনিকা এ বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছিলো, কিন্তু তার মুখের টিউবটা তার দম্ বন্ধ করে দিচ্ছিলো বলে ভদ্রমহিলা তাকে সাহায্য করতে ছুটে আসলেন।

সে দেখলো ভদ্রমহিলা টিউব দিয়ে মোড়ানো তার শরীরের উপর ঝুঁকে পড়ে তাকে বিরত করলেন। সে স্পষ্টতঃই এগুলো খুলে ফেলতে চাচ্ছে। সে তার মাথা এদিক ওদিক করতে করতে চোখ দিয়ে অনুনয় করছিলো টিউবগুলো খুলে ফেলার এবং তাকে একটু শান্তিতে মরতে দেয়ার।

“তুমি খুব বিচলিত,” ভদ্রমহিলা বললেন। “আমি ঠিক জানি না তুমি তোমার কৃতকর্মের জন্য দুঃখিত কি না অথবা তুমি এখনো মরতে চাও কি না; তাতে আমার অবশ্য কোন আগ্রহও নেই। আমার আগ্রহ আমার কাজ নিয়ে। যদি রোগী বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে তবে নিয়মানুযায়ী আমি তাকে চেতনানাশক দিয়ে দেই।”

ভেরোনিকা তার লড়াই বন্ধ করলো, কিন্তু নার্স ততক্ষণে তার বাহুতে একটি ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছে। খুব তাড়াতাড়িই সে একটা স্বপ্নহীন জগতে ফিরে গেলো যেখানে সে শুধু একটা জিনিসই মনে করতে পারছিলো; সেটা হচ্ছে এই মাত্র দেখা ভদ্রমহিলার চেহারাটা – সবুজ চোখ জোড়া, বাদামি চুল এবং খুব দূরবর্তী একটা কণ্ঠ।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০