fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

পাঁচ

ভেরোনিকা আবার যখন চোখ মেললো সে বুঝতে পারলো তাকে আগের জায়গা থেকে সরিয়ে একটা বড় ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হয়েছে। তার হাতে এখনো স্যালাইনের নল ঝুলছে, কিন্তু অন্যান্য তার ও সুঁই সরিয়ে ফেলা হয়েছে।  

একজন লম্বাকৃতির, কালো রং করা চুল আর দাড়ির তীক্ষ্ন দৃষ্টির ডাক্তার প্রথাগত সাদা কোট পরে তার বিছানার পা’য়ের দিকটায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার পাশেই একজন কম বয়স্ক ডাক্তার একটা ক্লিপ বোর্ড হাতে নোট নিচ্ছেন।

“আমি কতক্ষণ হলো এখানে আছি?,” সে জিজ্ঞেস করলো; ভেরোনিকা খেয়াল করলো তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।

“তুমি পাঁচ দিন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কাটানোর পর এই ওয়ার্ডে দুই সপ্তাহ ধরে আছো,” বয়স্ক ডাক্তারটি বললেন, “তোমার কপাল ভালো যে, তুমি এখনো এখানে আছো।”

তরুণ ডাক্তারের চেহারায় একটা বিস্মিত ভাব ফুটে উঠলো যেন শেষ মন্তব্যটি এ বিষয়ে মানানসই নয়। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ভেরোনিকার ভাবনা অন্য দিকে মোড় নিলো। সে কি এখানে যতটা মনে করেছিলো তার চেয়েও বেশি দিন যাবৎ আছে? সে কি এখনো আগের মতো ঝুঁকিতে রয়েছে? সে তার সামনের মানুষ দু’জনের প্রতিটা ইশারা, নড়াচড়া লক্ষ্য করতে লাগলো। সে জানে প্রশ্ন করা অর্থহীন কারণ এরা তাকে কখনো সত্যটা বলবে না। কিন্তু বুদ্ধিমান হলে সে এমনিই বুঝতে পারবে কী ঘটছে।

“তোমার নাম, ঠিকানা, বিবাহিত না অবিবাহিত এবং তোমার জন্মতারিখ আমাকে বলো,” বয়স্ক লোকটি বললো। নাম, বিবাহিত না অবিবাহিত, আর জন্ম তারিখ ভেরোনিকার জানা আছে; কিন্তু সে লক্ষ্য করলো তার স্মৃতিতে কিছু ধোঁয়াটে অংশ রয়েছে, সে তার ঠিকানা একদমই মনে করতে পারছে না।

ডাক্তার তার চোখে আলো ফেলে দীর্ঘ সময় নিরবে পরীক্ষা করলো। তরুণ ডাক্তারটিও একই কাজ করলো। তারা একে অন্যের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলো যা থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছিলো না।

“আপনি কি রাতে ডিউটিরত নার্সকে বলেছেন যে, আমরা আপনার মনের ভেতর কী ঘটছে তা বুঝতে পারছি না?,” তরুণ ডাক্তারটি জানতে চাইলো।

ভেরোনিকা কিছুই মনে করতে পারছে না। সে ঠিক বুঝতেও পারছে না যে, সে কে এবং এখানে সে কী করছে।

“তোমাকে চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে কৃত্রিমভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিলো, আর তাই তোমার স্মৃতিশক্তিতে তার কিছু প্রভাব পড়েছে। তবে তুমি চেষ্টা করো আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে,” বয়স্ক ডাক্তারটি বললেন।

এর পর ডাক্তাররা কিছু ফালতু প্রশ্ন করা শুরু করলেন। ল্যুবল্জানা’র প্রধান পত্রিকার নাম কী, মূল স্কয়ারে যে কবির ভাষ্কর্য রয়েছে তাঁর নাম কী (আহ্ এ নামটা সে কখনো ভুলতে পারবে না, প্রত্যেক স্লোভেন কবি প্রিজেরেন-এর প্রতিমূর্তি তার অন্তরে খোদাই করে রেখেছে), তার মা’র চুলের রং কী, তার কলিগদের নাম কী এবং তার লাইব্রেরির সবচেয়ে জনপ্রিয় বইগুলোর শিরোনাম কী।

প্রথম দিকে ভেরোনিকার উত্তর দিতে কষ্ট হচ্ছিলো, সে ঠিক মনে করতে পারছিলো না। তবে প্রশ্নোত্তর পর্ব এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অনেক কিছুই স্মৃতিতে ফিরে আসছিলো। একটা সময় তার মনে পড়লো যে, সে এখন মানসিক হাসপাতালে রয়েছে আর একজন পাগল প্রশ্নের সামঞ্জস্যপূর্ণ উত্তর দিতে বাধ্য নয়। কিন্তু তার নিজের ভালোর জন্য এবং ডাক্তারদের তার প্রতি সহানুভূতিশীল রাখতে, অন্ততঃ নিজের অবস্থা সম্পর্কে আরো কিছু জানতে সে প্রশ্নের বিপরীতে সাড়া দিতে সর্বোচ্চ মানসিক চেষ্টা চালিয়ে গেলো। বিভিন্ন নাম ও বিষয়গুলো বলতে পারার মাধ্যমে সে শুধু তার স্মৃতি নয়, তার ব্যক্তিত্ব, তার আকাঙ্ক্ষা, তার জীবনদর্শনকে পুনরুদ্ধার করছিলো। আত্মহত্যা করার অভিলাষটা যেটা সেদিন সকালে মনে হয়েছিলো যে কয়েক স্তর চেতনানাশক-এর নীচে চাঁপা পড়েছে, সেটা আবার জেগে উঠলো।

“চমৎকার,” বয়স্ক লোকটি প্রশ্নোত্তর এর শেষে বলে উঠলো।

“আমাকে কত দিন এখানে থাকতে হবে?”

তরুণ ডাক্তারটি দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। তার মনে হচ্ছিলো সবকিছু যেন বাতাসে আটকে আছে; যেন এ প্রশ্নের উত্তরের সাথে সাথে তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় লেখা হবে এবং কেউ সেটা আর পরিবর্তন করতে পারবে না।

“তুমি ওকে বলতে পারো,” বয়স্ক লোকটি বললো। “অন্য অনেক রোগীরাই এর মধ্যে অনেক কথা শুনে ফেলেছে, এবং ও-ও কোন না কোন ভাবে এক সময় জানবে। এখানে গোপনীয়তা রাখা প্রায় অসম্ভব।”

তরুণ ডাক্তারটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আসলে আপনি তো আপনার ভবিষ্যৎ নিজেই ঠিক করে রেখেছেন।” কথা বলার সময় ডাক্তারটি প্রতিটা শব্দ জোর দিয়ে উচ্চারণ করছিলেন। “কাজেই আপনার কর্মকাণ্ডের ফল কী তা আপনিই ভালো বুঝবেন। ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে আপনি যে কোমাতে চলে গিয়েছিলেন, সেটা আপনার হার্টের মারাত্মক ক্ষতি করেছে। আপনার হার্টের ফাঁপা অংশটাতে পচন-”

“সহজভাবে বলো,” বয়স্ক ডাক্তারটি বাঁধা দিয়ে বললো, “মূল কথায় আসো।”

“আপনার হার্টের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, আর তাতে আপনার হার্টবিট খুব দ্রুতই থেমে যাবে,” তরুণ ডাক্তারটি থামলো।

“এর মানে কী?” সে ভীতস্বরে প্রশ্ন করলো।

“আপনার হার্টবিট থেমে যাওয়ার একটাই অর্থ, মৃত্যু। আমি জানি না আপনার কোন ধর্ম বিশ্বাস রয়েছে কি না, কিন্তু-”

“আমার হার্টবিট কখন বন্ধ হতে যাচ্ছে?” ভেরোনিকা তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো।

“পাঁচ দিনের মধ্যে, অথবা সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের মধ্যে।”

ভেরোনিকার মনে হচ্ছিলো পেশাগত চেহারা ও ব্যবহারের পেছনে, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আচরণের মুখোশে তরুণ ডাক্তারটি যেন এ কথা বলে পরম পুলক অনুভব করছে; যেন এ শাস্তি তার প্রাপ্য এবং এটা অন্যদের জন্যও একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।

ভেরোনিকা তার জীবনভর দেখেছে প্রচুর লোকজন অন্যের জীবনের ভীতিকর বিষয়গুলো এমন ভাবে বলেন যেন তারা সত্যিই তাদের সহযোগিতা করতে চান; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা অন্যের দুঃখ-কষ্টে আনন্দ পান কারণ অন্যের দুঃখ কষ্ট দেখে তারা বুঝতে পারেন যে, তারা সুখী এবং তাদের জীবন নিঃস্বার্থ। সে এ ধরনের মানুষকে ঘৃণা করে এবং সে এই তরুণকে এ ধরনের সুখ পাওয়ার সুযোগ দিতে চায় না।

সে তার দিকে স্থির তাকিয়ে একটু হাসলো এবং বললো, “তাহলে তো আমি সফল হয়েছি।”

“হ্যাঁ,” তরুণটি উত্তর দিলো। কিন্তু এবারে তার চেহারা থেকে তাকে এই দুঃখজনক খবর দেয়ার আনন্দটা মিলিয়ে গেলো।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০