fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

নয়

জেডকা যেখানে ছিলো সেখান থেকে ওয়ার্ড আর বিছানাগুলো দেখা যাচ্ছিলো। একটা বিছানা ছাড়া সবগুলো খালি। একটা বিছানায় তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে আর তার পাশে একটা মেয়ে ভীত চোখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেয়েটি জানে না যে, বিছানায় শুইয়ে রাখা ব্যক্তিটি এখনো জীবিত; তার সমস্ত জৈবিক ক্রিয়া ঠিক ভাবেই চলছে। কিন্তু তার আত্মাটা উড়ে বেড়াচ্ছে, আত্মাটা একটা সুগভীর প্রশান্তি নিয়ে প্রায় ঘরের ছাদটা ছুঁয়ে আছে।

জেডকা নক্ষত্র জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো যেটা ছিলো তার প্রথম ইনসুলিন শক্-এর অভিজ্ঞতায় এক অপার বিস্ময়। এ সম্পর্কে সে কাউকেই বলেনি। বিষণ্নতা নিরাময়ের লক্ষ্যে সে হাসপাতালে রয়েছে এবং যত তাড়াতাড়ি সে ভালো হয়ে উঠবে তত তাড়াতাড়ি এ জায়গা ছেড়ে যেতে পারবে বলে সে আশা করছে। এখন যদি সে হাসপাতালকে বলে যে, তার আত্মা সাময়িকভাবে দেহত্যাগ করতে পারে তাহলে তারা ভাববে যে, সে ভিলেট-এ প্রবেশ করার সময় থেকে এখন আরো বেশি বিকারগ্রস্ত হয়েছে। তবে তার আত্মা শরীরে ফিরে আসলে সে দু’টা বিষয়ে পড়া শুরু করবে বলে প্রথমবার এ ঘটনা ঘটার পরই ঠিক করে রেখেছিলো: এক. ইনসুলিন শক্ এবং দুই. বায়ুমন্ডলে ভেসে বেড়ানোর অদ্ভুত অনুভূতি।

ইনসুলিন শক্-এর এ চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু লেখা পাওয়া যায়নি। এর প্রথম প্রয়োগ হয় ১৯৩০ সালে, কিন্তু মানসিক হাসপাতালগুলোতে এর প্রয়োগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয় রোগীর অপূরণীয় ক্ষতির সম্ভাবনার কারণে। এ রকমই একটা মহাজাগতিক ভ্রমণে জেডকা একবার ডা. ইগোর এর অফিসে ঘুরে এসেছিলো। সে সময় এ বিষয়ে হাসপাতাল মালিকদের একজনের সাথে ডা. ইগোর আলোচনা করছিলেন। “এটা তো একটা অপরাধ,” ডা. ইগোর বলছিলেন। “হ্যাঁ, কিন্তু এটা ব্যয় সাপেক্ষ ও দ্রুত করা যায়!” অন্য ব্যক্তিটি উত্তর দিলেন। “তাছাড়া, কে এই পাগলদের অধিকার নিয়ে মাথা ঘামায়? কেউই অভিযোগ করতে যাবে না।”

তবুও কিছু ডাক্তার এটাকে বিষণ্নতার দ্রুত নিরাময়ের পদ্ধতি হিসেবে দেখে থাকেন। জেডকা ইনসুলিন শক্ নিয়ে বিভিন্ন লেখার খোঁজ করে যাবতীয় লেখা যোগাড় করলো, বিশেষ করে অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত রোগীদের প্রাথমিক প্রতিবেদনসমূহ। সবার কাহিনীই মোটামুটি একই – ভীতিকর এবং চরম ভীতিকর; কিন্তু কেউই জেডকা এখন যে অবস্থার মধ্যে আছে এমন অভিজ্ঞতার কথা বলেনি।

সবশেষে সে সম্পূর্ণ সঠিকভাবে যেটা বুঝতে পেরেছে সেটা হচ্ছে ইনসুলিন এবং তার চেতনার দেহত্যাগের অনুভূতির মধ্যে আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে এ ধরনের চিকিৎসা রোগীর মানসিক সক্ষমতা হ্রাস করে।

এরপর জেডকা আত্মার অস্তিত্বের খোঁজে পড়ালেখা শুরু করলো, অতিপ্রাকৃত-এর উপর কিছু বই পড়লো এবং একদিন একটা বিশাল লেখার উপর সে থমকে দাঁড়ালো যেখানে ঠিক তার অভিজ্ঞতার বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। একে বলা হয় ‘মহাজাগতিক ভ্রমণ’ এবং অনেক ব্যক্তিরই ইতিমধ্যে এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। কেউ আছেন যারা তাদের অনুভূতি একদমই বলতে পারেননি, আবার কেউ এ অবস্থায় উদ্দীপ্ত হওয়ার পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছেন। জেডকা এখন মন থেকে ‘মহাজাগতিক ভ্রমণ’-এর নানা কৌশল জানে এবং প্রতি রাতেই সেগুলো ব্যবহার করে যেখানে খুশি সেখানে ঘুরে বেড়ায়।

এ সকল অভিজ্ঞতা ও কল্পনাশক্তি প্রতি ক্ষেত্রেই ভিন্ন, কিন্তু সবগুলোরই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে: আত্মার দেহত্যাগের অদ্ভুত ও অস্বস্তিকর শব্দ, একটা শক্, চেতনার দ্রুত বিলুপ্তি, এবং এরপর বাতাসে শান্তিপূর্ণ ও আনন্দদায়ক ভেসে বেড়ানো। এ সময় দেহটা একটা অদৃশ্য রূপালি সুতা দিয়ে জোড়া লেগে থাকে যে সুতা অসীম পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। তবে কিংবদন্তী রয়েছে (অবশ্যই বইগুলোতে) কোন ব্যক্তি যদি রূপালি সুতা ছিড়ে ফেলে তাহলে তার মৃত্যু হবে।

জেডকার নিজের অভিজ্ঞতা অবশ্য বলে সে যতদূর খুশি যেতে পারে, তাতে তার রূপালি সুতা ছিড়ে যায়নি। তবে সাধারণ ভাবে বলা যায় বইগুলো তার মহাজাগতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনেক কিছু শিখিয়েছে। যেমন, সে শিখেছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হলে তাকে ঠিক যে স্থানে যেতে চায়, তা কল্পনা করে নিজেকে বায়ুমন্ডলে প্রক্ষেপনে মনোযোগী হতে হবে। বিমানের যেমন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে উড়ে যেতে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় মহাজাগতিক ভ্রমণ তেমনি কিছু রহস্যময় টানেলের মধ্য দিয়ে হয়। একজন নিজেকে একটা স্থানে কল্পনা করে, তারপর সঠিক টানেলের মধ্য দিয়ে ভয়ঙ্কর গতিতে প্রবেশ করে অন্য স্থানে গিয়ে উপস্থিত হয়।

বই-এর মাধ্যমেই মহাশূন্যের অন্যান্য অধিবাসীর বিষয়ে তার ভীতি কেটেছে। আজ এই ওয়ার্ডে কেউ নেই। প্রথমবার যখন সে তার দেহত্যাগ করে গিয়েছিলো তখন সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো, অনেকেই তাকে দেখছে এই দেখে।

সে প্রথমে ভেবেছিলো এগুলো সব মৃত লোকজন, ভূত হয়ে হাসপাতালে হানা দিয়েছে। পরে বই পড়ে এবং নিজ অভিজ্ঞতায় সে বুঝতে পেরেছে যে, যদিও এখানে অনেক বিদেহী আত্মা বিচরণ করছে কিন্তু এখানে তার মতো জীবিত লোকও রয়েছে যারা হয় নিজেদের দেহত্যাগ করার কৌশল রপ্ত করেছে অথবা তারা জানেই না যে তাদের ক্ষেত্রে কী ঘটছে; কেননা তারা হয়তো পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে যখন তাদের আত্মা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আজ – ইনসুলিন দিয়ে এটাই তার শেষ মহাজাগতিক ভ্রমণ, কারণ সে এই মাত্র ডা. ইগোর-এর অফিস থেকে ঘুরে এসেছে এবং তাকে বলতে শুনেছে যে, তাকে আগামীকাল ছেড়ে দিতে উনি প্রস্তুত – জেডকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ভিলেট-এই থাকবে। জেডকা জানে একবার মূল ফটক দিয়ে বেড়িয়ে গেলে সে আর কখনো ফিরে আসতে পারবে না, এমন কি তার আত্মাও না; এবং তাকে বিদায়ই নিয়ে যেতে হবে।

বিদায় বলাটা সত্যিই খুব কঠিন। একবার কেউ মানসিক হাসপাতালে প্রবেশ করলে সে এমন এক স্বাধীনতায় বেড়ে উঠে যার অস্তিত্ব শুধুমাত্র বিকারগ্রস্ত জগতেই রয়েছে এবং সে এটার নেশায় পড়ে যায়। তখন কেউ আর দায়িত্বের মধ্যে আসতে পারে না, প্রতিদিনের উপার্জন করার দায়িত্ব, জাগতিক একঘেঁয়েমি কাজ তাকে বিরক্ত করে ফেলে। একটা ছবির দিকে তাকিয়ে কিংবা হিজিবিজি আঁকিবুকি করে সে সময় পার করতে পারে। সব কিছুই সহ্য করা হয় তখন কারণ ব্যক্তিটি মানসিকভাবে অসুস্থ। তার নিজেকে দিয়েই সে লক্ষ্য করেছে যে, একবার হাসপাতালে প্রবেশ করে তার আশে পাশের রোগীরা উন্নতি করেছে। তারা তাদের লক্ষণগুলো আর লুকিয়ে রাখে না, এবং একটা ‘পারিবারিক’ আবহ তাদেরকে তাদের স্নায়বিক পীড়া ও মনোব্যাধি মেনে নিতে সহায়তা করে।

শুরুর দিকে ভিলেট জেডকাকে মুগ্ধ করেছিলো এবং সুস্থ হলে ভাতৃসংঘে যোগ দিবে বলে সে ভেবে রেখেছিলো। কিন্তু তার মনে হয়েছিলো, সে সংবেদনশীল হলে বাইরে যা করে সে আনন্দ পেতো তার সবকিছুই সে অব্যাহত রাখতে পারতো এবং তত দিন পর্যন্ত নিত্য জীবনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে চলতে পারতো। একজন যেমন বলেছিলো, তোমাকে তোমার বিকারগ্রস্ততা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তুমি কাঁদতে পারবে, দুশ্চিন্তা করতে পারবে বা যে কোন স্বাভাবিক মানুষের সাথে রেগে উঠতে পারবে; কিন্তু সেটা ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ তোমার মন সমস্ত বিরূপ পরিস্থিতিতে গলা চড়িয়ে হাসতে পারবে।

সে খুব শীঘ্রি বাড়িতে তার স্বামী-সন্তানের কাছে ফিরতে পারবে এবং এটারও এক ধরনের আকর্ষণ শক্তি রয়েছে। তার জন্য অবশ্য কাজ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে; কেননা ল্যুবল্জানা’র মতো ছোট শহরে খবর খুব দ্রুত ছুটে এবং ভিলেট- এ তার অন্তরণ ইতিমধ্যে অনেকেরই জানা হয়ে গেছে। তবে তার স্বামী পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য বেশ ভালো আয় করে। তাই সে তার অবসর সময় মহাজাগতিক ভ্রমণ করে কাটাতে পারে. আর সেটা মারাত্মক ইনসুলিন প্রভাবের বাইরে থেকেই।

একটা জিনিসই সে আবার চায় না, যার কারণে তার এই ভিলেটে আসা: বিষণ্নতা।

ডাক্তাররা বলেন সাম্প্র্রতিককালে আবিষ্কৃত উপাদান সেরোটোনিন নামক যৌগ মানুষ কেমন আচরণ করবে তার জন্য দায়ী। সেরোটোনিন এর অভাব একজনকে তার কাজ, ঘুম, খাওয়া এবং জীবনের আনন্দকে উপভোগ করার মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতাকে দুর্বল করে ফেলে। যখন এই উপাদান সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকে, তখন একজন ব্যক্তি হতাশায়, নৈরাশ্যবাদে, নিরর্থকতায়, প্রচন্ড ক্লান্তিতে, দুশ্চিন্তায়, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে এবং সীমাহীন বিষণ্নতায় গিয়ে এর শেষ হয়; এসব কিছু একজনকে হয় জীবনের প্রতি চরম অনীহা অথবা আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়।

অন্য রক্ষণশীল ডাক্তাররা বলেন যে, জীবনে যে কোন ধরনের আকস্মিক পরিবর্তন – দেশান্তরে যাত্রা, খুব ভালোবাসার কাউকে হারানো, বিবাহবিচ্ছেদ, কর্মস্থল বা পরিবারের ক্রমাগত চাহিদা প্রভৃতি – বিষণ্নতার জন্ম দিতে পারে। কিছু আধুনিক গবেষণা শীত ও গ্রীষ্মে অন্তরণের উপর ভিত্তি করে এ কথাও বলে যে, সূর্যরশ্মির অভাবও বিষণ্নতার একটি কারণ।

কিন্তু জেডকার ক্ষেত্রে সন্দেহকৃত কারণগুলোর তুলনায় বিষণ্নতার কারণ একেবারে সাধারণ। অতীতের এক পুরুষ লুকিয়ে ছিলো তার মধ্যে, অথবা বলা যায়, অনেক পূর্বে পরিচিত এক পুরুষের সাথে সে এক অলীক কল্পনায় জড়িয়ে পড়েছিলো।

এটা আসলে চরম বোকামির পর্যায়ে পড়ে – একজন লোকের কারণে বিষণ্নতা ও বিকারগ্রস্ততার মধ্যে ঝাঁপ দেয়া যার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। কিন্তু এ লোকটিকেই সে যৌবনে অন্য সাধারণ একটা মেয়ের মতো পাগলের মতো ভালোবেসেছিলো। সে সময় জেডকা অসম্ভব এক ভালোবাসার পেছনে ছুটেছিলো।

জেডকা তার অন্য বন্ধুরা যারা এরকম অসম্ভব ভালোবাসার স্বপ্ন দেখতো তাদের চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে যেতে চেয়েছিলো; সে স্বপ্নটাকে সত্যি মনে করেছিলো। লোকটি থাকতো মহাসাগরের ওপারে এবং জেডকা তার সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়েছিলো তার কাছে পৌঁছানোর জন্য। লোকটি ছিলো বিবাহিত কিন্তু তারপরও তাকে গোপনে মনের মধ্যে স্বামীর আসন দিয়ে তার রক্ষিতার জায়গা সে গ্রহণ করেছিলো। লোকটির নিজের জন্যই যথেষ্ট সময় ছিলো না, তারপরও জেডকা একটা সস্তা হোটেল রুমে তার কদাচিৎ আসা ফোনের জন্য দিন রাত অপেক্ষা করেছিলো।

ভালোবাসার মোড়কে সবকিছু বিলিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার সত্ত্বেও সম্পর্কটি এগোয়নি। লোকটি কখনো সরাসরি কিছু না বললেও জেডকা এক দিন বুঝতে পারলো সে আর সমাদৃত নয়। এরপরই জেডকা স্লোভেনিয়া ফিরে আসে।

সে কয়েক মাস খুব সামান্য খাওয়াদাওয়া করতো। আর তাদের এক সাথে কাটানো প্রতিটা সেকেন্ড ভেবে ভেবে দিন কাটাতো। বিছানায় কাটানো তাদের আনন্দ আর সুখের মূহুর্তগুলো বার বার ভাবতে ভাবতে তাদের এ সম্পর্কটা ভবিষ্যতেও এমন থাকবে বলে সে বিশ্বাস করে ফেলতো। তার এ অবস্থা নিয়ে বন্ধু-বান্ধবরা দুশ্চিন্তায় পড়লেও জেডকার মন বলতো এটা চিন্তাগুলো শুধুমাত্র সময় কাটানোর উপাদান। ব্যক্তিগত সময়ের মূল্য রয়েছে এবং এভাবে সময় অতিবাহিত করাতে তার কোন অভিযোগও ছিলো না। এভাবেই চলছিলো এবং অনেক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো কোন এক সকালে সে বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো। সে স্বাদ করে খেলো এবং একটা চাকরির খোঁজে নামলো। অল্প দিনের মধ্যেই সে শুধু যে একটা চাকরিই যোগাড় করলো তাই না একজন সুদর্শন, মেধাবী যুবকের দৃষ্টিও আকর্ষণ করলো; আর এক বছর পর সে তাকে বিয়ে করলো।

জেডকা তার বান্ধবীদের মাঝে ব্যাপক ঈর্ষা ও অভিনন্দন জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলো। তারা দু’জনেই একটা আরামদায়ক বাড়িতে বসবাস করতে লাগলো যার বাগান থেকে ল্যুবল্জানা’র মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর ধারা দেখা যায়। তাদের সন্তান হলো। তারা গ্রীষ্মের ছুটিতে অস্ট্রিয়া বা ইতালিতে বেড়াতে যেতো।

স্লোভেনিয়া যখন যুগোশ্লাভিয়া থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তখন জেডকার স্বামী আর্মিতে যোগ দিলো। জেডকা ছিলো একজন সার্ব অর্থাৎ শত্রুপক্ষ; এ দিক থেকে দেখলে জেডকার জীবন ধ্বসে পড়বে বলে মনে হচ্ছিলো। পরবর্তী দশ দিনে উভয় সৈন্যদল যখন মুখোমুখি হতে প্রস্তুত, কেউই জানে না স্বাধীনতা ঘোষণার ফল কী হবে এবং এটা কতটা রক্তক্ষয়ী হবে, সে মুহূর্তে জেডকা অনুভব করলো সে তার স্বামীকে কতটা ভালোবাসে! সারাক্ষণ সে শুধু ঈশ্বরকে ডাকছিলো, যাকে মনে হচ্ছিলো অনেক দূরে কিন্তু সেই ঈশ্বরই ছিলো জেডকার একমাত্র আশা। সে যেন তার স্বামীকে ফিরে পেতে পারে সেজন্য সেইন্টদের কাছে সে যে কোন কিছু বিসর্জন দেয়ার অঙ্গীকার করলো।

শেষ পর্যন্ত তাই হলো। জেডকার স্বামী ফিরে এলো, বাচ্চারা আবার স্কুলে যেতে শুরু করলো যেখানে তারা স্লোভেন ভাষা শিখলো। আর যুদ্ধের ঝুঁকি প্রতিবেশী প্রজাতন্ত্র ক্রোয়েশিয়ায় স্থানান্তর হলো।

এরপর তিন বছর পার হলো। ক্রোয়েশিয়ার সাথে যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধ বসনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো এবং খবর এলো যে সার্বরা সেখানে নৃশংস হত্যা শুরু করে দিয়েছে। কিছু উন্মাদ লোকের নির্বুদ্ধিতার কারণে একটি পুরো জাতিকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা অন্যায় বলে জেডকার কাছে মনে হলো। এ সময় তার জীবন এমন অর্থপূর্ণ হয়ে উঠলো যেটা সে কখনো আশা করেনি। সে তার জনগণকে গর্ব ও সাহসের সাথে রক্ষা করতে পত্রপত্রিকায় লিখলো, টেলিভিশনে গেলো, কনফারেন্স-এর আয়োজন করলো। এগুলো কোন কিছুই কোন ফল দেয়নি, এমন কি আজ পর্যন্ত বিদেশীরা মনে করে ঐ সব দিনের নৃশংসতার জন্য সার্বরাই দায়ী। কিন্তু জেডকা জানে সে তার কর্তব্য পালন করেছে; একটা কঠিন সময়ে সে তার জাতিগত ভাইবোনকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারতো না। এ কাজে তার স্লোভেন স্বামীর, তার সন্তানদের এবং অন্যান্য লোকজনের সমর্থনও ছিলো যারা উভয়পক্ষের গুজবকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কাজে লাগায়নি।

এক সন্ধ্যায় জেডকা মহান স্লোভেন কবি প্রিজেরেন এর ভাষ্কর্যের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। এ সময় তার মাথায় কবির জীবন নিয়ে ভাবনা শুরু হলো। কবির বয়স যখন চৌত্রিশ বছর তখন গির্জায় জুলিয়া প্রিমিক নামক এক কিশোরীকে দেখে তার গভীর প্রেমে পড়ে যান। প্রাচীন কালের চারণ কবিদের মতো তিনি ঐ কিশোরীকে নিয়ে কবিতা লিখতে থাকেন এই স্বপ্ন নিয়ে যে, তাকে একদিন বিয়ে করবেন।

দেখা গেলো জুলিয়া উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, এবং গির্জায় দর্শন পাওয়া ছাড়া প্রিজেরেন কখনোই তার কাছে যাওয়ার সুযোগ পান না। কিন্তু এ বাঁধাই তাঁকে সবচেয়ে সুন্দর কবিতাগুলো লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিলো এবং তাঁর নাম কিংবদন্তীতুল্য হয়েছিলো। ল্যুবল্জানা’র ছোট্ট স্কয়ারটাতে কবির ভাষ্কর্যটার দিকে তাকালে দেখা যায় এক দৃষ্টিতে কোন কিছুর দিকে কবি তাকিয়ে রয়েছেন। কেউ ঐ স্থির দৃষ্টি অনুসরণ করলে দেখতে পাবে কবির দৃষ্টি স্কয়ারের অন্য পাশে একটা বাড়িতে পাথরে খোঁদাই করা একটা নারী মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঐ বাড়িটাতেই জুলিয়া থাকতো। তাই বলা যায়, মৃত্যুর পরও প্রিজেরেন অনন্তকাল ধরে তার অসম্ভব ভালোবাসার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

কী হতো যদি তিনি আর একটু লড়াই করতেন? কবির কথা ভেবে জেডকা একটু বিষণ্ন হলো।

এমন সময় জেডকার হৃদস্পন্দন হঠাৎ-ই বেড়ে গেলো। খুব সম্ভবতঃ এটা কোন অঘটনের পূর্বাভাস, হয়তো তার কোন বাচ্চা বাসায় কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। সে দ্রুত বাসায় ফিরে দেখলো তার বাচ্চা পপকর্ন খাচ্ছে আর টিভি দেখছে।  

যাই হোক, তার বিষাদ ভাবটা কাটলো না। জেডকা শুয়ে পড়লো এবং প্রায় বারো ঘন্টা ঘুমালো; যখন তার ঘুম ভাঙলো তার উঠতে মন চাইলো না। কেন জানি প্রিজেরেনের গল্প তার মাঝে তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিককে ফিরিয়ে নিয়ে এলো যে কখনোই তার সাথে আর যোগাযোগ করেনি।

জেডকা নিজেকেই প্রশ্ন করলো: আমি কি যথেষ্ট লড়াই করেছিলাম? আমি যেমনটা আশা করতাম সেটা না চেয়ে আমার কি রক্ষিতা হিসেবে নিজের অবস্থানটা মেনে নেয়া উচিত হয়েছিলো? আমি আমার দেশের জনসাধারণের জন্য যে শক্তি নিয়ে লড়েছি আমার প্রথম ভালোবাসার জন্য কি সে শক্তি নিয়ে লড়েছিলাম?

তেমনটা লড়েছিলো বলে নিজেকে প্রবোধ দিলেও জেডকার বিষাদ দূর হলো না। যা তার কাছে একসময় স্বর্গ মনে হতো – নদীর ধারে বাড়ি, তার ভালোবাসার স্বামী, টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা তার সন্তান – সব কিছুই ক্রমান্বয়ে নরক বলে মনে হতে লাগলো।

আজকের এই দিনে, অনেক মহাজাগতিক ভ্রমণের পর এবং অনেক বিবর্তিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে জেডকা বোঝে যে এগুলো সব অর্থহীন। তার অসম্ভব ভালোবাসা ছিলো শুধুই একটা অজুহাত, এটা ছিলো যাপিত জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তির অজুহাত, যে যাপিত জীবন ছিলো তার পরম আকাঙ্ক্ষিত জীবন থেকে যোজন যোজন দূরে।

কিন্তু বারো মাস আগে পরিস্থিতি ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে পাগলের মতো তার সুদূর প্রেমিকের খোঁজ শুরু করলো, আন্তর্জাতিক ফোন কলে সে তার ভাগ্য পরীক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু তার প্রেমিক আর আগের শহরে ছিলো না এবং তাকে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। সে এক্সপ্রেস মেইলে চিঠির পর চিঠি পাঠালো, কিন্তু সবগুলোই ফেরত আসলো। সে তার প্রেমিকের সব পরিচিত বন্ধুকে ফোন দিলো কিন্তু কেউই বলতে পারলো না তার কী ঘটেছে।

কী ঘটছে সে ব্যাপারে তার স্বামী কিছুই জানতো না, আর এটা তাকে আরো ক্রোধান্বিত করে তুললো। তার স্বামীর অন্ততঃ কিছু সন্দেহ করা উচিত ছিলো, একটা আবেগের বিস্ফোরণ ঘটানো উচিত ছিলো, অভিযোগ করতে পারতো, তাকে রাস্তায় বের করে দেয়ার হুমকি দিতে পারতো। তার মনে হতে লাগলো আন্তর্জাতিক টেলিফোন অপারেটর, পোস্টম্যান ও তার বান্ধবী – সবাইকে তার প্রেমিক হাত করেছে অভিন্ন খবর দিতে। সে তার বিয়ের গয়না বিক্রি করে দিয়ে একটা বিমানের টিকেট কাটলো মহাসাগর পাড়ি দিতে। শেষ পর্যন্ত যখন কেউ একজন তাকে বোঝাতে সক্ষম হলো যে আমেরিকা অনেক বড় একটা জায়গা এবং সে কোথায় কী খুঁজছে সেটা ঠিক করে না গেলে সেখানে যাওয়ার কোন অর্থ হয় না; তখনই কেবল সে থামলো।

এক সন্ধ্যায় মনোকষ্টে সে শুয়ে ছিলো যেন এমন কষ্ট সে কখনোই পায়নি, এমন কি ল্যুবল্জানা’র প্রতিদিনের বিশ্রী জীবনে যখন ফিরে যেতো তখনও না। সে সেই রাত আর পরের দুই দিন তার রুমেই কাটালো। তৃতীয় দিনে তার সদয় ও দায়িত্বশীল স্বামী একজন ডাক্তার ডেকে আনলো। সে কি সত্যিই জানে না যে জেডকা অন্য এক পুরুষের স্পর্শ পেতে চাচ্ছে, ব্যাভিচার করতে চাচ্ছে, সম্মানজনক স্ত্রী’র জায়গায় একজন গোপন রক্ষিতার জীবন চাচ্ছে, এই ল্যুবল্জানা, এই ঘর, এই সন্তানদের চিরদিনের মতো ছেড়ে যেতে চাচ্ছে?

ডাক্তার আসলে জেডকা হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো আচরণ করতে লাগলো এবং দরজা বন্ধ করে রাখলো যতক্ষণ পর্যন্ত না ডাক্তার চলে গেলো। এক সপ্তাহ পর তার বিছানা ছেড়ে উঠে যাওয়ার আর কোন শক্তি রইলো না এবং বিছানাতেই প্রাকৃতিক কাজ সারতে লাগলো। সে আর কিছুই ভাবতে পারছিলো না; তার মাথার পুরোটাই ঐ লোকটার ছোট ছোট স্মৃতিতে পূর্ণ হয়েছিলো এবং সে বিশ্বাস করতে শুরু করলো তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক তারও ব্যর্থ খোঁজ করছে।

তার অসহ্য-উদাসীনতাপূর্ণ নিঃস্বার্থ স্বামী তার বিছানার চাদর পাল্টে দিতো, তার চুল আঁচড়ে দিতো আর বলতো সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। তার বাচ্চারা আর তার শোবার ঘরে আসতো না যেদিন পর্যন্ত না সে একজনকে অকারণে চড় দিয়ে বসে। পরে অবশ্য সে হাঁটু গেড়ে, চুমু খেয়ে ক্ষমা চায় এবং তার হতাশা ও অনুশোচনা দেখাতে রাতের পোশাক ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে।

আরো এক সপ্তাহ পর – যে সপ্তাহে সে তার খাবারে থুতু ছিটালো, কয়েকবার বাস্তবে যাতায়াত করলো, সারা রাত জেগে ও সারা দিন ঘুমিয়ে কাটালো – দু’ জন লোক দরজায় নক না করেই তার রুমে ঢুকলো। একজন তাকে ধরে রাখলো আর একজন তাকে একটা ইনজেকশন দিলো; এরপর সে জেগে উঠলো এই ভিলেট-এ।

“বিষণ্নতা,” সে শুনলো ডাক্তার তার স্বামীকে বলছে, “কখনো কখনো খুব সামান্য ব্যাপার থেকেও তৈরি হয়, যেমন, শরীরে রাসায়নিক পদার্থ সেরোটোনিন-এর অভাবের কারণে।”

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০