জুন ২০, ২০২৫

ছোটবেলার চৌহদ্দি

গ্রামে পড়াশোনা করা মানুষগুলোর কাছে প্রাথমিক বিদ্যালয় এক একটা স্মৃতির আঁতুড় ঘর। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে না পারলেও প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করায় বোধহয় সবারই এই গণ্ডিতে আসার সৌভাগ্য হয়। যদিও আজকাল গ্রামেও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সে যাই হোক, বলছিলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা। ঘুমের অতলান্ত সাগরে ডুবে গতরাতে হঠাৎ করেই ফিরে গিয়েছিলাম নিজের ফেলে আসা প্রাথমিকে।

তখন ২০০১/২০০২ সাল। প্রথম ভর্তি হই এই বিদ্যাপীঠে। একপাশে চার কক্ষের একখানা পাকা ঘর থাকলেও আধা পাকা টিন শেডের ঘরখানি থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনে আমার প্রথম যাত্রা শুরু। আমার প্রথম পাঠগ্রহণ যে কক্ষে হয় সেটা শ্রেণিকক্ষ নয় বরং বৃহৎ হলঘর। যার সম্মুখ প্রান্তে দু’পাশে সারি সারি বেঞ্চিতে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া বাচ্চাদের ক্লাস চলতো আর পিছনে পাকা মেঝের উপরে চাটাইয়ে বসে চলতো প্রাক-প্রাথমিকিয়ানদের দুষ্টামি। দিদিমনি, আপামনি শব্দগুলো অনেকদিন না শুনলেও তখন এই শব্দটাই দিনে হাজার বার শুনতে হতো। আমাদের সময় শিক্ষিকাদের এমন সব আদুরে নাম ছিল; আজও তা আছে কিনা জানিনা। তবে ‘ম্যাডাম’ ডাকের চেয়ে এটা যে ঢের শ্রুতিমধুর লাগে তা তখন না বুঝলেও বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ঠিকই বুঝেছিলাম। আমাদের বিদ্যালয়ে দুইটা টয়লেট থাকলেও অনিবার্য কারণহেতু একটা টয়লেট পাঁচটি বছরই তালাবদ্ধ থাকতে দেখেছি। তবে রটনা ছিল, এই টয়লেটে কেউ একজন মারা গিয়েছিল। কোনো গরমের বন্ধ শুরু হওয়ার আগের দিন আটকা পড়ে আর বেরোতে না পেরে নাকি সে মারা গিয়েছিল । তবে এই গণ্ডি পার হওয়ার পর জানতে পেরেছিলাম গল্পটা একটা শহুরে স্কুলের। তবুও আমাদেরকে কেন এমন গল্প শুনে কৌতুহলী চোখে পাঁচটা বছর চেয়ে থাকতে হয়েছে তা বোধোদয় হয়না। তবে মনে আছে এই তালাবদ্ধ টয়লেটের দরজার ফাঁক দিয়ে আমাদের কল্পিত আটকে পড়া আত্মাকে প্রায়শই ঢিল ছুড়তাম আমরা। আনন্দও পেতাম খুব। স্কুলে একটা ছোট বাগান ছিল; ফুলের বাগান। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি শ্রেণির জন্য আলাদা আলাদা প্লট বরাদ্দ ছিল ফুলের গাছ রোপনের জন্য। সম্ভবত প্রতি বৃহস্পতিবার যার যার ফুলের বাগানের পরিচর্যা করতে হতো। অসম্ভব মজা পেতাম, যখন বড় ক্লাসের বাগানের চেয়ে নিজেদের অংশে ফুল বেশি ফুটতো। উপরের ক্লাসে উঠবার সাথে সাথে বাগানের অংশেরও পরিবর্তন ঘটতো। আমাদের লাগানো গাছগুলোর অংশীদার হতো আমাদের অনুজরা আর আমরা পেতাম আমাদের অগ্রজদের স্থান। তবে এই পরম্পরা কত বছর চলেছে তা ঠিক জানা নেই। স্কুলের একটা পাকা মেঝের কাঠের ঘরে বাচ্চু ভাই নামে এক জনৈক থাকতেন বলে মনে আছে। উনার ঘরের পুরোটাই কাগজের আবরণে লেপা ছিল। বইপত্রও ছিল কিছু। উনি কী করতেন, কেন থাকতেন সেসব প্রশ্ন ঘুরপাক খেলেও জনশ্রুতি ছাড়া কোনো সদুত্তর জোটেনি কখনোই। স্কুলের পিছনে সুবৃহৎ পুকুর ছিল। পুকুর সংলগ্ন আম গাছও ছিল দু একখানা। তবে সেই আমগাছের ভাগ্যে নিজের ফলগুলোর পরিপক্ব রূপ দেখার সুযোগ হতে দেইনি আমরাই। স্কুল প্রাঙ্গণটা ছোট হলেও সেটার সীমানায় বেশ বড় একটা মাঠ ছিল। সেটা উচ্চবিদ্যালয়ের এখতিয়ারে পড়লেও আমরা নিজের মনে করেই রাজত্ব কায়েম করতাম টিফিন কিংবা ছুটির সময়। স্কুলে তখনও সরকার থেকে বর্গাকৃতির এক সুস্বাদু বিস্কুট আসতো। যেটার স্বাদ আজও মুখে লেখে আছে। এই বিস্কুট বণ্টনে আপামনি, দিদিমনিরা বেশ সুকৌশলী ছিলেন। ক্লাসের ফাঁকেই মনিটর প্রজ্ঞাপন  জারি করে যেতো। যারা বেশি পরিমাণে প্রাঙ্গনের আগাছা উঠাবে তাকে বিস্কুট দেওয়া হবে। তবে বেশি কমের এই হিসাবটা কোন দাঁড়িপাল্লায় মাপা হতো সেটা বুঝতাম না। অনেক সময় অন্যের ঝুড়ির ময়লা ফেলে আমিই তুলতাম দেখিয়ে দেখিয়ে। এই পন্থা যে শুধু আমার স্বাতন্ত্রের পরিচয় বহন করে সেটা ভাবার অবকাশ নেই। এটা বহুল ব্যবহৃত এবং প্রমাণিতও বটে।

vsc

বৃহস্পতিবার অর্ধেক ক্লাস হতো। বাকি সময়টা গান, কবিতা-ছড়া আবৃত্তির আসর বসতো হল ঘরে। হা করে তাকিয়ে শুনতাম অন্যদের মেধার চর্চা। আর তখন থেকে নিজের অসারতার প্রমাণ পেয়েছি সুস্পষ্টভাবে। কিছুতেই অংশগ্রহণ করতে পারতাম না। তবে শ্রোতা হিসেবে যে যশ কুড়িয়েছি সেটাও কম নয়! স্কুলের প্রথম পরীক্ষার কথা আজও মনে আছে। সাদা কাগজের উপর লুকোচুরির খেলা! সব ফাঁকা ফাঁকা! উপরে প্রশ্ন, নিচে ফাঁকা দাগকাটা। বাক্য আছে তবে শব্দের পর্যাপ্ততা নেই। প্রশ্নপত্র ধরে সামনে পিছনে তাকাই আর কতগুলি ভয়ার্ত চোখের চাহনি দেখে নিজেও খানিকটা ভয় পেয়ে বসি। গ্রামের স্কুল। না ছিল কোনো প্রহরী, না ছিল কোনো সীমানা প্রাচীর। কক্ষের বাইরে সব অভিভাবক জানালা দিয়ে ভিতরে চেয়ে আছে। নিজেদের তখন খাঁচায় বন্দি চিড়িয়াখানায় নতুন আগত জন্তুর মতোই মনে হচ্ছিল। পরীক্ষায় কত পেয়েছিলাম মনে নেই, তবে ফেল করিনি এটা মনে আছে। আমাদের সময় একটা পরীক্ষার নাম ছিল চারু ও কারুকলা। বিষয়টা ব্যবহারিক এর মতই ছিল। বাড়ি থেকে মাটি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে নিয়ে যেতে হতো। পরীক্ষার দিনে সবার হাতে হাতে বিভিন্ন রকম মাটির জিনিস দেখে বোঝার উপায় ছিলনা এটা পরীক্ষা নাকি কোনো আড়ংয়ের মেলা। তবে এই পরীক্ষাটা আমার খুব প্রিয় ছিল। নিজেকে কিছুই করতে হতো না। বাড়ির মানুষজনই এগুলো করে দিতো এবং সেটা মনে হয় সর্বজনীন ছিল। তাই এই পরীক্ষায় আমাদের অবদান প্রত্যক্ষ অপেক্ষা পরোক্ষ ভাবেই নেওয়াই শ্রেয়। স্কুলে মাঝে মাঝে পরিদর্শক আসতো উপজেলা পরিষদ থেকে কিন্তু তাদের পোশাক দেখে ষোলো আনা শহুরে বাবুয়ানা গোছেরই ঠেকতো। ঐ বাবুরা আসার মানেই ছিল আমাদের পায়ে শিকল। প্রতিটা আপামনি, দিদিমনিদের ক্লাসে পাঠানো হতো যেন আমরা এক পা-ও ক্লাসরুমের বাইরে না ফেলি। আর আগেরদিন থেকেই বলা হতো আমাদের ভালো ভাবে পরিপাটি হয়ে স্কুলে আসতে। এই পরিপাটি নিয়েই স্মরণীয় কিন্তু করুণ এক অভিজ্ঞতা আছে আমার। একবার শখ করেই নতুন জামা-প্যান্ট পরে স্কুলে গেলাম। বর্ষার দিন। বাইরে গিয়ে পাকামি করতে গিয়ে নিজেই আছাড় খেলাম জলকাদায়। জলকাদাও খুব আদর করে জেকে ধরলো জামার প্রতিটা রন্ধ্রে! ধোয়ার পরও ময়লা গেলো না বরং লেপে গেলো পুরোটা জামায়। যতটা না ব্যথা পেয়েছিলাম তার থেকে এই ময়লার উপর রাগ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে যাই। আর কোনোদিন নতুন জামাকাপড়ে স্কুলে যাইনি। আজও যতোবার সার্ফএক্সেল এর বিজ্ঞাপন দেখি নিজের ঐদিনকার কথাটা বেশ মনে পড়ে। একটা উদ্ভট নেশা ছিল তখন সামনের বেঞ্চে বসার। ভাল ছাত্র কখনোই ছিলাম না; তারপরও কী মজা পেতাম সেটা আজও অজানা। তবে মজার ব্যাপার হলো এই সামনের বেঞ্চের উপর এমন লোলুপ দৃষ্টি যে আমার একার ছিল মোটেও তেমন নয়। বাড়ি কাছে হওয়ায় খুব ভোরেই পুরনো খাতা হাতে ছুটতাম স্কুল পানে। কখনো ক্লাস রুমের ভেঙে যাওয়া টিনের বেড়া উলটিয়ে আবার কখনো জানালার ভিতর দিয়ে কীভাবে যেন ঢুকতাম ক্লাসে আর জায়গা রেখে আসতাম নিজের প্রিয় সিটের উপর খাতা রেখে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বাসে সিট রাখা দেখে আমার ঐ বাচ্চাকালের সিট রাখাই মনে পড়তো। তবে মনে আছে, এই উপায় সবসময় কাজে দেয়নি। ক্লাসরুম পরিবর্তনের সাথে একসময় ইটকাঠের চারদেয়ালে ক্লাস করতে হতো। তখন পদ্ধতির পরিবর্তন আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে প্রয়োজনের খাতিরেই। স্কুল ছুটির সময় যে যার পুরনো খাতা রেখে চলে যেতাম। আর এভাবেই নতুন জায়গায় নতুন রূপে আমাদের জায়গা রাখার ধারাটাও সগৌরবে অটুট থাকলো। স্কুলে একটা মজার অথচ পীড়াদায়ক নিয়ম ছিল ‘নামলেখা’। ক্লাসের পরিস্থিতি পিনপয়েন্ট নিরবতায় ঢেকে দিতে কোন ব্যাটা এই নিয়ম আবিষ্কার করেছিল সেটা ভাবতাম তখন। মনিটরের হাতে এই নিয়ম অর্পিত হতো অলিখিত নিয়মেই! বিশেষ কিছু সময়ের জন্য এটার প্রযোজ্যতা ছিল। সেই সময়ে কেউ কথা বললেই নাম চড়ে পড়তো মনিটরের লিস্টে। আর এই নির্ধারিত সময় শেষে শ্রেণি শিক্ষক ক্লাসে এসে লিস্ট ধরে এই অপরাধীদের বেত্রাঘাত চালাতেন বীরদর্পে! “কথা বললেও মাইর খাওয়া লাগে!”, মাঝে মাঝে ভাবতাম বটে। তবে পরে মেনে নিতাম ওটা আমার অপরাধই ছিল। নিয়মের বেড়াজালে এই রুদ্ধ মুখগুলি আজও রুদ্ধ! শুধু জায়গা পালটিয়ে আজ সগৌরবে আসীন হয়ে আছে জবাবদিহিতাহীন শাসন ব্যবস্থা। যেমনটা শ্রেণি শিক্ষককেও সেদিন কেউ প্রশ্ন করতে পারতাম না যে কথা বলার অপরাধটা কী? আজ একইভাবে এই স্বেচ্ছাচারীদেরকেও প্রশ্ন করার এখতিয়ার নেই। যাহোক, স্কুলের পুরনো বিল্ডিং নেই, পুরনো টিনের চালাও নেই। ভৌতিক টয়লেটও ধরিত্রীর ভোগে গেছে বহুত আগে। এখন ফুলের বাগানটিও দেখিনা আমার সেই স্কুলে। পুকুরখানি এখন শুধু গল্প হয়ে টিকে আছে আমাদের কাছে। এখন হয়তো জায়গা রাখার নিয়মটাও নেই সংগত কারণেই। হয়তো ছেলেমেয়েদেরকে আর প্রাঙ্গণের ময়লা নিজ হাতে পরিষ্কার করতে হয় না। অনেক সুশৃঙ্খল আর পরিপাটি হয়েছে ইট বালুর বদৌলতে। বৃষ্টির সময় বৃহৎ হলঘরের দরজাগুলোতে দাঁড়িয়ে আর হয়ত ছেলেমেয়েদের বৃষ্টিতে ভিজতে হয় না। গ্রামের স্কুলগুলোতেও আজকাল দেখি শহুরে জুজুতে ধরেছে। এক দশকেই ভোল পাল্টিয়েছে। এখন আর চকবোর্ড কী সেটাই হয়তো জানেনা অনেক বাচ্চারাই। বইয়ে পড়ে হয়তো। চকের গুড়ি মাখিয়ে মজাও হয়তো করেনা। গ্রামেও নবশিক্ষিত বাপ মায়েদের কমপ্লেক্সিটি বেড়েছে। বাচ্চাদের এসব দুষ্টুমি হয়তো বাঁদরামি হিসেবে গণ্য হয়। সেই ভয়ে হোক আর পড়াশুনার চাপে হোক অনেক কিছুই একদশকেই হারিয়ে গেছে সেটা বেশ বুঝতে পারি আশেপাশে দেখেই। চতুর্থ বিপ্লবের যুগ চলছে। তাই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তবে ঘুমঘোরে এসে ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া ছোট্টকালের ঐ ছোট্ট গণ্ডি যেন বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থেই বিবর্তনে শামিল হয় এটাই শুধু চাওয়া।


jagannath pal
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, চুয়েট
Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp