fbpx

দ্য বায়োস্কোপ

(১)

বিকাল সাড়ে তিনটায় মহাখালী ঢাকা ব্যাংক হেড অফিসের সামনে উবার থেকে নামলো এনাম। সিনিয়র অফিসার পদের জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছে ও। ফিটফাট হয়ে বোর্ডের সামনে হাজির হতে চায় বলে বাসের বদলে উবারে আসা।

ধীর পায়ে রাস্তা থেকে ফুটপাতে উঠলো এনাম। ওর সিরিয়াল তেরো – সাড়ে চারটার আগে ডাক পড়বে বলে মনে হয় না। আগে গিয়ে লাভ কী? প্রার্থীদের মধ্যে ওর পরিচিত কেউ নেই। ইন্টারভিউতে কী কী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, তা জানার উপায় নেই।

বিল্ডিং-এ ঢোকার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ঘটনাটা ঘটলো। এনামের বাম কাঁধে ‘থপ’ করে কিছু একটা পড়লো। প্রথমে ওর মনে হলো দাঁত ব্রাশ করে কেউ পেস্ট ফেলেছে। উপর দিকে তাকাতেই ভুল ভাঙলো – একটা দাঁড়কাক মলত্যাগ করেছে!

এনামের মনে হলো, ওর শার্টের নীল রঙ ঘটনার জন্য কিছুটা দায়ী। কোথায় যেন ও পড়েছিলো, লাল আর নীল রঙের ‘টয়লেট’ পাখিদের পছন্দ।

বাসায় গিয়ে শার্ট পাল্টে আসার সময় নেই – আরামবাগ এখন যেন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। আশেপাশের কোন দোকান থেকে শার্ট কেনা যেতো, কিন্তু পকেটে মাত্র নয়শ’ টাকা আছে।

কয়েক কদম হেঁটে ‘আল্লাহর দান স্টোর’ থেকে ওয়েট টিস্যু কিনলো এনাম। সাথে ফ্রি পাওয়া গেলো পুরানো খবরের কাগজের একটা পৃষ্ঠা। প্রথমে কাগজ, তারপর ওয়েট টিস্যু ব্যবহারে শার্টটা চলনসই হলো। আশা করা যায় ওর ইন্টারভিউ শুরুর আগেই শার্টটা শুকিয়ে যাবে।

মোবাইলে কথা বলতে বলতে এনামের সমবয়সী একটা ছেলে রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই কিছু কথা এনামের কানে এলো: ‘⋯ না, ইন্টারভিউটা অত ভালো হয়নি। জিজ্ঞাসা করলো, ব্যাংক শব্দটা কোথা থেকে এলো? পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলো, কয় ত্রিশে পঁয়ত্রিশ? এটা একটা প্রশ্ন হলো? বুঝেই উঠতে পারলাম না ব্যাটা কী জানতে চায়। ⋯ ’

এনাম ওর মোবাইল হাতে নিলো, Google-এ টাইপ করলো ‘etymology of bank’। সার্চ রেজাল্ট মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলো।

পরের প্রশ্নের উত্তরের জন্য Google করে লাভ হবে না। কয় ত্রিশে পঁয়ত্রিশ? চিন্তায় মগ্ন হলো সে। উত্তরটা কী হতে পারে?

এনামের ডাক পড়লো চারটা পঞ্চাশে। ইন্টারভিউ বোর্ডে চারজন সদস্য থাকলেও কথা বললেন শুধু একজন।

‘আপনার নাম?’

‘এনাম কবির।’

‘এনামুল কবির?’

‘না, স্যার। এনাম কবির।’

‘এ নাম কবির। তার মানে, এই নাম একজন কবির। কিন্তু, নামটা কী?’ কথাটা বলেই হো হো করে হাসতে শুরু করলেন প্রশ্নকর্তা। বাকি তিনজন সদস্যও যোগ দিলেন হাসিতে।

কী বলবে খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইলো এনাম।

‘আপনি তো অ্যাকাউন্টিং-এ মাস্টার্স করেছেন দেখছি। রেজাল্ট কবে হলো?’

‘মাস ছয়েক আগে, স্যার।’

‘আপনার অনার্স সিজিপিএ ৩.২১, মাস্টার্সের জিপিএ ৩.১৯। নট ভেরি ইমপ্রেসিভ। ব্যাংকিং সম্পর্কে ধারণা আছে?’

‘জ্বী, স্যার।’

‘ব্যাংক শব্দটা কোথা থেকে এসেছে?’

বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিড়লো! একটু চিন্তা করার ভান করে এনাম বললো, ‘ব্যাংক শব্দটার অরিজিন হচ্ছে ইতালিয়ান শব্দ বাংকো, যার অর্থ বেঞ্চ। আজ থেকে কয়েকশ’ বছর আগে ইতালির ব্যবসায়ীরা একটা বেঞ্চের পাশে টাকা লেনদেন করতো। বেঞ্চের উপরে টাকা রাখা হতো। এই বাংকো বা বেঞ্চ থেকেই ব্যাংক শব্দটা তৈরি হয়েছে।’

‘ভেরি গুড। এবার বলুন তো, কয় ত্রিশে পঁয়ত্রিশ?’

চাকুরিটা আর ঠেকায় কে! ঠোঁট নেড়ে একটু হিসেব করার ভান করলো এনাম। তারপর বললো, ‘এক সমস্ত ছয়ের এক ত্রিশে পঁয়ত্রিশ, স্যার।’

‘এক সমস্ত ছয়ের এক মানে কী?’ হঠাৎ করে অন্য একজন সদস্য জানতে চাইলেন। ‘Can you say it in English?’

‘One and one-sixth, স্যার।’

‘ব্রিলিয়্যান্ট,’ এক সাথে বলে উঠলেন চারজন সদস্য। ইন্টারভিউয়ের বাকি সময়টা তারা পার করলেন এনামের সাথে গল্প-গুজব করে।

জগতের সকল দাঁড়কাক সুখী হোক, মনে মনে বললো এনাম।

(২)

ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে মিতালি, একটু পরে ওর ভাইভা। ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হতে চলেছে।

পাশেই কয়েকজন ছাত্র-ছাত্র্রীর জটলা। একটু আগে মিতালি ওদের সাথেই ছিলো। ভাইভাতে কী কী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, কোন্ প্রশ্নের সঠিক উত্তর কী – এসব আলোচনা করেছে।

পরের সিরিয়ালটাই ওর, তাই একটু একা দাঁড়িয়ে মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে।

গত তিন-চার মাস ধরে একের পর এক ঝড় যাচ্ছে মিতালির জীবনে। ফাইনাল পরীক্ষা শুরুর এক মাস আগে ওর বাবা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। মিতালিকেই ছুটোছুটি করতে হলো। ওর একমাত্র ভাই বিয়ের পর থেকেই দূরের মানুষ হয়ে গেছে – আলাদা থাকে এবং কোন খোঁজখবর নেয় না। মায়ের ব্যাকপেইন থাকায় মিতালিকে বাইরের কাজ একাই সামলাতে হয়।

তিন সপ্তাহ ভুগে বাবা মারা গেলেন। পরীক্ষার তখন মাত্র এক সপ্তাহ বাকি।

শোক করার বিলাসিতা মিতালির ছিল না। থার্ড ইয়ার শেষে ওর সিজিপিএ দাঁড়িয়েছে ৩.১০। ফোর্থ ইয়ারের পরীক্ষা খারাপ হলে সিজিপিএ তিনের নিচে নেমে যেতে পারে। তখন ভালো কোথাও চাকুরির আবেদন করা যাবে না। তাই বুকে পাথর বেঁধে পড়াশুনা চালিয়ে গেল মিতালি।

পরীক্ষার মাঝে দিন দশেক সর্দি-কাশি-জ্বরে ভুগলো ও, দু’টো পরীক্ষা খারাপ হয়ে গেল। প্রশ্ন কঠিন হওয়াতে খারাপ হলো আরও দু’টো পরীক্ষা।

আজকের ভাইভা ভালো হলে সিজিপিএ তিনের নিচে হয়তো নামবে না। তাই অনেক পড়াশুনা করেই এসেছে ও।

আগের সিরিয়ালের মেয়েটা ভাইভা বোর্ড থেকে বের হয়ে আসতেই মনে মনে আল্লাহর নাম নিয়ে ভিতরে ঢুকলো ও।

চারজন শিক্ষক বসে আছেন লম্বা টেবিলের দুই পাশে। এদের একজনকে মিতালি চিনে না, ইনি নিশ্চয়ই এক্সটার্নাল।

হাত তুলে সালাম দিলো ও। অনুমতি পেয়ে বসলো, অ্যাটেনডেন্স শিটে সাইন করলো। প্রশ্ন শুরু করলেন এক্সটার্নাল স্যার।

‘তোমার নাম?’

‘মিতালি মাহমুদ।’

‘হলে থাকো?’

‘না, স্যার। সিদ্ধেশ্বরী।’

‘থার্ড ইয়ারের সিজিপিএ কত?’

‘থ্রি পয়েন্ট ওয়ান জিরো।’

‘এই অবস্থা কেন? পড়াশুনা করো না?’

‘করি, স্যার।’

‘ফোর্থ ইয়ারে ঠিক মতো ক্লাস করেছো?’

‘জ্বী, স্যার।’

‘ফোর্থ ইয়ারের সবগুলো কোর্সের নাম বলো তো – কোর্স নাম্বারসহ পুরো নাম বলবে।’

এটা একটা কমন প্রশ্ন। মিতালি ভালো করে এর উত্তর শিখে এসেছে। খুবই যত্নের সাথে এক এক করে সে সবগুলো কোর্সের কোর্স নাম্বার আর নাম বলে গেল। ঝামেলাটা বাধলো তালিকার শেষ প্রান্তে এসে।

‘⋯ কোর্স নাম্বার 413 – ভাইভা ভোসি।’

‘ভাইভা ভোসি?’ বলে হা হা করে হাসতে শুরু করলেন এক্সটার্নাল স্যার। অন্য একজন স্যারও যোগ দিলেন হাসিতে। মিতালি ফ্যাকাসে মুখে বসে রইলো।

‘তুমি ভাইভা ভস্ কথাটির এই অদ্ভুত উচ্চারণ কোথা থেকে শিখলা?’ হাসি থামিয়ে জানতে চাইলেন এক্সটার্নাল স্যার।

মিতালিকে viva voce-এর উচ্চারণ শিখিয়েছেন ওর বাবা। তিনি ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। মিতালির খুব রাগ হচ্ছে, মনে হচ্ছে ওর মৃত বাবাকে নিয়ে স্যারেরা হাসাহাসি করছেন।

উচ্চারণটা কার কাছে শিখেছে, তা বলতে গেল না মিতালি। মৃত বাবার আরও অপমান ওর সহ্য হবে না। তবে, একদম চুপ করেও থাকতে পারলো না।

‘স্যার, আমি যতদূর জানি, ব্রিটিশ আর আমেরিকান ইংলিশে উচ্চারণটা ভাইভা ভোসি – ’ কথাটা বলে ফেলার পর মিতালি খেয়াল করলো বারেক স্যার (যিনি পরীক্ষা কমিটির সভাপতি এবং উচ্চারণটা শুনে হাসেননি) ইশারায় ওকে কথা বলতে না করেছেন। ব্যাপারটা বুঝতে ও দেরি করে ফেলেছে।

এক্সটার্নাল স্যারের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। মিতালি ভাবলো, আমার কথা বলার ভঙ্গিতে কি ভিতরের রাগটা প্রকাশ পেয়েছে? বারেক স্যার কি এই কারণেই কথা বলতে নিষেধ করেছেন?

‘ও.কে. মিতালি,’ বারেক স্যার নির্বিকার কন্ঠে বললেন। ‘তেরোটা কোর্সের নাম মনে রাখতে পেরেছো। ভেরি গুড। যাও, পরের জনকে পাঠিয়ে দাও।’

স্যারেরা কেন আর কোন প্রশ্ন করলেন না? ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বের হয়ে এলো মিতালি।

কয়েকজন ক্লাসমেট এগিয়ে আসতে গিয়েও ওর চোখ-মুখ দেখে থেমে গেল।

বান্ধবী দিনাকে সামনে পেয়ে মিতালি বললো, ‘ভালো লাগছে না, চলে যাই। আমি মুভি দেখতে যাব না, তোরা যা। পরে কথা হবে।’

দ্রুত পায়ে হেঁটে ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হলো সে।

(৩)

রমনা পার্কে ঘণ্টাখানেক উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাঘুরি করলো মিতালি। একটা বেঞ্চে বসে কাঁদলো কিছুক্ষণ। ভাইভার তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে থাকতে বৃথাই চেষ্টা করলো।

স্যারেরা কি ওকে ভাইভাতে অনেক কম নম্বর দিবে? বারেক স্যার নিশ্চয়ই তেমন কিছু করবেন না। কিন্তু, স্যার একা কতটুকু বাঁচাতে পারবেন। চারজনের নম্বরের গড় করা হবে তো।

আচ্ছা, বারেক স্যার কেন ওকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দিলেন? ওর কথা বলার ভঙ্গি কি এতোটাই দৃষ্টিকটু হয়ে গিয়েছিলো?

বাবা কি ওকে ভুল শিখিয়েছেন? উচ্চারণটা কি আসলেই ভাইভা ভোসি? একবার Google করতে গিয়েও করলো না মিতালি। বাবার ভুল হয়ে থাকলে সহ্য করতে পারবে না ও।

এখন আর কান্না পাচ্ছে না মিতালির। তবে, বেঞ্চ থেকে উঠতেও ইচ্ছে করছে না। বসে বসে উথাল পাতাল ভাবতে লাগলো সে।

‘আর ইউ ও.কে.?’

চমকে উঠে তাকালো মিতালি। অপরিচিত একটা ছেলে। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল।

‘এক্সকিউজ মি?’ বিরক্তির সাথে বললো মিতালি। একটু ভয় লাগছে ওর। মতলব কী ছেলেটার?

‘দয়া করে বিরক্ত হবেন না। ভয়েরও কিছু নেই, আমার কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেই। তাছাড়া, সময়টা বিকেল, পার্কে অনেক লোক। চাইলেও আমি আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবো না।’

‘তাহলে কী চান?’ জানতে চাইলো মিতালি।

‘আপনাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে আপনার মনের অবস্থা কী –’

‘আপনি কি মনোবিজ্ঞানী?’

‘না, হিসাববিজ্ঞানী। তবে, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে মনোবিজ্ঞানী হবার দরকার নেই। আমি বুঝতে পারছি, ভাইভা নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তায় আছেন।’

অবাক হলো মিতালি। ছেলেটা কি যাদু জানে?

‘ভাইভার কথা আপনি কীভাবে জানলেন?’

‘আপনি একটু পর পর বিড়বিড় করে বলছিলেন ভাইভা ভোসি।’

ওহ গড, আমার এই অবস্থা – মনে মনে বললো মিতালি।

‘ঘটনাটা কী? বলা যাবে?’ ছেলেটা বললো।

‘আমার সমস্যার কথা আপনাকে কেন বলতে যাবো?’

‘কারও সাথে শেয়ার করলে মন হাল্কা হয়।’

‘শেয়ার করতে চাইলে পরিচিত কারও সাথে করবো। আপনার সাথে কেন?’

‘ঠিক আছে, পরিচিত কাউকে ফোন দিন। আমি দূরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি, যাতে শুনতে না পাই।’

‘দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন? আপনি আপনার কাজে যান।’

‘আপনি স্বাভাবিক হওয়ার আগে আমি এখান থেকে যাচ্ছি না। আমার ভয় হচ্ছে আপনি উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলবেন।’

ওহ গড, আমার এই অবস্থা! আবার ভাবলো মিতালি।

‘আপনি তাহলে ত্রাণকর্তা?’ বললো সে।

‘না, আমি একটা সাধারণ ছেলে। যে কোন সাধারণ ছেলে এমনই করবে। বলুন তো, কোন ইয়ারের ভাইভা?’

প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে পুরো ঘটনাই বলে ফেললো মিতালি।

‘ভাইভা ভোসি উচ্চারণটাই ঠিক,’ বললো ছেলেটা।

‘আপনি আমাকে খুশি করার জন্য বলছেন।’

‘মোটেই না। এই যে দেখুন।’ মোবাইলে Google করে ওকে ব্রিটিশ আর আমেরিকান উচ্চারণ শোনালো ছেলেটা। দুইবারই শোনা গেল ভাই-ভা-ভো-সি।

‘দেখলেন তো, আপনার বাবা আপনাকে ভুল শেখাননি।’

মিতালি আবার কাঁদতে শুরু করলো। তবে, ওর মনে আনন্দের একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছে। বাবার জন্য গর্ব হচ্ছে।

কান্না থামিয়ে চোখ মুছলো সে। বললো, ‘আপনি বোধ হয় বিরক্ত হচ্ছেন।’

‘মোটেই না। আমি খুব ভালো মেজাজে আছি। আপনি উত্তর জেনেও ভাইভাতে খারাপ করেছেন, আর আমি উত্তর না জেনেও ভাল করেছি।’

‘আপনার কিসের ভাইভা ছিলো?’

‘চাকুরির ইন্টারভিউ। বাই দ্য ওয়ে, আমি এনাম।’

‘আমার নাম মিতালি।’

এনামের কাছে ইন্টারভিউয়ের পুরো ঘটনা শুনে মিতালি বললো, ‘আপনার আকাশে সূর্য উঠলো, আমার আকাশে অস্ত গেল।’

‘এভাবে বলছেন কেন? আপনি কাল বারেক স্যারের সাথে দেখা করুন। তাকে বোঝান আপনি কেন রিঅ্যাক্ট করেছেন।’

‘আমিও এটা ভাবছিলাম,’ বললো মিতালি।

‘চলুন, আপনাকে একটা মজার জিনিস দেখাই।’

‘কোথায় যেতে হবে?’ জানতে চাইলো মিতালি।

‘পার্কের ঐপাশে।’

দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো। মিতালি একটু পর পর এনামের চুলের দিকে তাকাচ্ছে।

‘এ রকম কালো চুল কখনও দেখেছেন?’ এনাম জানতে চাইলো।

‘তা দেখিনি। কিন্তু আপনি যে নিজের প্রশংসা নিজেই শুরু করলেন!’

‘মোটেই তা নয়। আমি আসলে নিজের সমালোচনা করছি।’

‘তার মানে?’ মিতালির জিজ্ঞাসা।

‘কালো চুল তিন ধরনের: soft black, raven black আর jet black – এদের মধ্যে jet black হচ্ছে সবচেয়ে কালো। আমার ‍চুল jet black-এর চেয়েও কালো। এতই কালো যে, আলো প্রায় সবটাই চুষে নেয়। আলো প্রতিফলিত হয় না। এই মুহূর্তে আপনার চুলে সূর্যের আলো খেলা করছে, আমার চুলে খেলা করছে না।’

‘আপনি কি পদার্থবিজ্ঞানী?’

‘না, হিসাববিজ্ঞানী।’

‘আমার ‍চুল কি তাহলে soft black?’ জানতে চাইলো মিতালি।

‘না, soft black মানে তো হাল্কা কালো। আপনার চুল raven black; raven মানে জানেন তো?’

‘জানি, দাঁড়কাক। আমি তাহলে দাঁড়কাক?’

হাসলো এনাম। বললো, ‘আজ আমার ভাগ্যে যা ঘটলো, আপনাকে দাঁড়কাক বললে সেটা হবে কমপ্লিমেন্ট। আমি বলতে চেয়েছি, আপনার চুল দাঁড়কাকের মতো নীলচে কালো।’

‘খুশি হবো কিনা ‍বুঝতে পারছি না।’

‘আপনি উইকিপিডিয়াতে Black hair টপিকটা পড়লে দেখবেন, raven black চুলের উদাহরণ হিসেবে দিপিকা পাডুকোনের ছবি দেয়া আছে।’

‘এবার খুশি খুশি লাগছে,’ একটু হেসে বললো মিতালি।

(৪)

কিছুটা সামনে একজন ষাটোর্ধ্ব মানুষ দাঁড়িয়ে ডুগডুগি বাজাচ্ছেন। পরনে খয়েরি জামা, মাথায় লাল-সাদা চেকের গামছা। তার সামনে একটা বড় বাক্স, ফোল্ডিং টেবিলের উপর বসানো।

‘উনি কি ডুগডুগি বাজিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করছেন?’ মিতালির কণ্ঠে বিস্ময়।

‘না,’ হেসে বললো এনাম। ‘ওখানেই যাচ্ছি আমরা। উনি বায়োস্কোপ দেখান।’

মিতালির মনটা খুশিতে ভরে গেল। বললো, ‘আমার মায়ের কাছে বায়োস্কোপের কথা অনেক শুনেছি। মা যখন ছোট, দশ-বারো বছর বয়স, তখন তাদের বাড়িতে বায়োস্কোপ-ওয়ালা গিয়েছিলো। মা ঐ একবারই বায়োস্কোপ দেখেছিলেন। আজও তার কথা ভুলতে পারেননি। আমার কখনও বায়োস্কোপ দেখা হয়নি।’

‘আমিও আগে দেখিনি। আজই কিছুক্ষণ আগে একবার দেখেছি। আপনার সাথে আরেকবার দেখবো।’

কাছে গিয়ে বায়োস্কোপের লাল-সবুজ বাক্সটা খুঁটিয়ে দেখলো মিতালি। এর উপরের দিকে মাঝামাঝি জায়গায় হলুদ কাগজে গোলাপি অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘বায়োস্কোপ’। লেখাটির বাম পাশে সাদা রঙে লেখা ‘আ: জলিল মন্ডল, 01794912186, থানা: বাগমারা, রাজশাহী’। বাক্সটিতে ছয়টি বড় ছিদ্র – চারটি সামনের দিকে, দুইটি দুই পাশে। মিতালি বুঝতে পারলো, এগুলোর যে কোন একটিতে চোখ রেখে বায়োস্কোপ দেখতে হবে। ছয়জন দর্শক একসাথে বায়োস্কোপ দেখতে পারবে। এ মুহূর্তে ছিদ্রগুলো ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করা।

মিতালি আর এনামকে দেখে বায়োস্কোপ-ওয়ালা ডুগডুগি বাজানো বন্ধ করলেন। প্রদর্শনীর মূল্য জনপ্রতি বিশ টাকা। একজন টোকাই কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে তার টাকাও দিয়ে দিলো এনাম। তিনটা ছিদ্রের ঢাকনা সরিয়ে দিলেন লোকটা।

বায়োস্কোপ প্রদর্শনী শুরু হলো। ডান হাতে করতাল জাতীয় একজোড়া বাদ্য বাজাচ্ছেন লোকটা। একই সাথে বাম হাতে বাক্সটার উপরে বসানো একটা হাতল ধীরে ধীরে ঘোরাচ্ছেন। তিনজন দর্শকের চোখের সামনে একের পর এক নানা ধরনের ছবি এসে আবার দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে। বাজনার তালে তালে সুর করে ছবিগুলোর বর্ণনা দিচ্ছেন লোকটা।

বায়োস্কোপ দেখা শেষ করে উচ্ছল মিতালি এনামকে বললো, ‘আপনার কল্যাণে একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা হলো। থ্যাংক ইউ।’

‘ইউ আর ওয়েলকাম।’

‘আমার আজ মুভি দেখতে যাওয়ার কথা ছিলো। তার বদলে দেখলাম বায়োস্কোপ – একে কি মুভির বাবা বলবো, না দাদা?’

‘পরদাদা বা গ্রেট-গ্র্যান্ডফাদার বলা যায়,’ হেসে বললো এনাম।

মিতালিও হাসলো। বললো, ‘আমি এবার বাসায় যাই। অনেক দেরি হয়ে গেছে। মায়ের ব্যাকপেইন, সেই অবস্থায় সারাদিন একা আছেন।’

‘আমাদের কি আবার দেখা হবে?’ এনাম জিজ্ঞাসা করলো।

‘আপনি যদি চান, দেখা হবে।’

(৫)

পরদিন সকালে বারেক স্যারের সাথে দেখা করতে ডিপার্টমেন্টে গেল মিতালি। কিন্তু, স্যার এলেন না। স্যারকে কল করতে সাহস পেলো না ও। ভাবলো, কাল আবার আসবো।

রাতে এনাম কল করে প্রায় ঘণ্টাখানেক কথা বললো।

পরদিন সকাল দশটায় বারেক স্যারের দেখা পাওয়া গেল। গম্ভীর গলায় ওকে বসতে বললেন স্যার। মন দিয়ে ওর কথা শুনলেন। উত্তরে তিনি যা বললেন, তার জন্য মিতালি প্রস্তুত ছিলো না।

‘তুমি ভাইভা দিয়ে বের হবার পর আমি নেট ব্রাউজ করে এক্সটার্নাল স্যারকে দেখিয়েছি, ভাইভা ভোসি উচ্চারণটাই ঠিক। তিনি অনেক সিনিয়র টিচার এবং বড় মনের মানুষ। তোমার ঠিক উচ্চারণে হেসেছেন বলে তিনি তাঁর তরফ থেকে তোমাকে স্যরি বলতে বলেছেন।

‘তুমি নম্বর নিয়ে দুশ্চিন্তা করছো! অথচ তোমার উচ্চারণ যে ঠিক, সেটা জানার আগেই তিনি তোমাকে ভাল নম্বর দিয়েছেন। কোন্ যুক্তিতে দিয়েছেন তা আমাকে ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন, “বারেক, মেয়েটাকে একটাই প্রশ্ন করা হয়েছে এবং সে সেটা পেরেছে। খারাপ নম্বর দেয়ার কোন যুক্তি নেই। উচ্চারণের জন্য তো আমরা নম্বর কাটি না।” এরকম একজন স্যারের সাথে তুমি কেমন আচরণ করেছো!

‘স্যার ভুল জানতেই পারেন। অনেক লোকই শব্দটা ভুল উচ্চারণ করে। তোমার উচ্চারণ তাঁর কাছে অদ্ভুত মনে হতেই পারে – সেক্ষেত্রে হাসি আসাটাও স্বাভাবিক। তুমি ভদ্রভাবে স্যারের ভুলটা ধরিয়ে দিতে পারতে। কিন্তু, তোমার আচরণে মনে হয়েছে তিনি তোমার ব্যক্তিগত শত্রু। কোনও খারাপ শব্দ তুমি ব্যবহার করোনি, কিন্তু তোমার চোখে রাগ আর বিদ্বেষ প্রকাশ পাচ্ছিলো –’

‘স্যার, এক্সটার্নাল স্যারের নম্বরটা দিবেন? আমি ক্ষমা চাইবো।’ কাঁদতে কাঁদতে বললো মিতালি।

‘আচ্ছা, আমিই তোমার পক্ষ থেকে তাঁর সাথে কথা বলবো। আফটার অল, তিনি ছিলেন আমার গেস্ট। তবে, তোমার ভালোর জন্য একটা কথা বলি। তোমার বাবা মারা গেছেন, নিশ্চয়ই তোমার মন খারাপ। এই অবস্থায়ও যুক্তি-বুদ্ধি হারালে চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করো, ও.কে.?’

‘জ্বী, স্যার।’

স্যারের রুম থেকে বের হয়ে এনামকে কল করলো মিতালি। সব শুনে এনাম বললো, ‘আপনার মনটা নিশ্চয়ই অনেক হাল্কা হয়েছে এখন?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে একটু সেলেব্রেট করি আমরা? দুপুরে একসাথে খাই?’

‘মা দুপুরে একসাথে খেতে বলেছেন। আমরা বিকেলে বের হই?’

‘ঠিক আছে। চারটায়, বেইলি রোডের ক্যাফে অপিয়াসে?’

‘ও.কে.।’

সাড়ে তিনটায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে তৈরি করছে মিতালি, এমন সময় এনামের কল এলো।

‘আমি বাসা থেকে বেরোলাম। আগেভাগে না গেলে টেবিল ⋯ একটু লাইনে থাকুন তো –’

মিতালি অন্য প্রান্তের সব কথা শুনতে পাচ্ছে: ‘আপনারা?’ ‘আপনি এনাম কবির?’ ‘হ্যাঁ, কিন্তু –’ ‘আপনাকে একটু থানায় যেতে হবে।’ ‘কী ব্যাপার?’ ‘সেটা থানায় গেলেই জানবেন।’

এনাম মিতালিকে বললো, ‘শুনেছেন বোধ হয় –’

‘আপনি শিওর যে এরা পুলিশ? অনেক সময় পুলিশ পরিচয়ে –’

‘পুলিশের ইউনিফর্ম, পুলিশের গাড়ি – অন্য কিছু মনে হচ্ছে না। ও.কে. মিতালি, আপনার সাথে পরে কথা হবে। বাই।’

মিতালি ওর ছোটমামাকে কল দিলো। তিনি একজন ক্রিমিনাল লইয়ার, পুলিশের সাথে ভালো যোগাযোগ আছে। এনামের বাসা আরামবাগে, তাই মতিঝিল থানায় ফোন করে খোঁজখবর নিলেন তিনি। মিতালিকে জানালেন, গতকাল আনুমানিক মাঝরাতে এনামের বড় ভাই আরিফ মারা গেছেন। পুলিশ নিশ্চিত নয় এটা হত্যা না আত্মহত্যা। এনামের ভাবী আজ মতিঝিল থানায় ওর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওকে থানায় নেয়া হয়েছে। অ্যারেস্ট করা হবে কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

‘মামা, ওকে কি মারধর করা হবে?’

‘পুলিশ থানায় নিয়েই মারধর শুরু করে দেয় না। ওর ভাবী যদি পুলিশকে টাকা দিয়ে বলে পিটিয়ে পা ভেঙে দেন, তাহলে আলাদা কথা। তবে, আমি পুলিশকে বলেছি এনাম আমার ভাগ্নীর বন্ধু, একটু যেন খেয়াল রাখে।’

‘থ্যাংক ইউ, মামা।’

‘এবার বল্ তো মা, এই এনাম ছেলেটার জন্য তুই এত উতলা কেন?’

‘উতলা কোথায়? একটু হেল্প করার চেষ্টা করছি, এই যা। তুমি থানায় বলে দাও, আমি গেলে যেন এনামের সাথে দেখা করতে দেয়।’

‘আচ্ছা, বলে দিচ্ছি। থানায় গেলে এসআই ফিরোজের খোঁজ করিস।’

একটা প্রশ্ন মিতালির মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এনামের ভাই গতকাল রাতে মারা গেল, অথচ এনাম আজ একদম স্বাভাবিক!

চিন্তিত মুখে ‍মতিঝিল থানায় যাবার জন্য বের হলো মিতালি।

(৬)

এসআই ফিরোজ অনেক ভালো ব্যবহার করলেন মিতালির সাথে। জানালেন, ওর মামা অ্যাডভোকেট কামাল তাকে একটা কাজে অনেক হেল্প করেছেন।

‘এনামকে কি অ্যারেস্ট করা হয়েছে?’ মিতালি জানতে চাইলো।

‘না না, পাশের রুমে বসিয়ে রেখেছি। আরিফের মৃত্যুটা আত্মহত্যা না খুন, সেটাই তো পরিষ্কার নয়।’

‘ঘটনাটা একটু বলবেন?’

‘গতকাল বিকালে আরিফ তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে ডেমরা গেছেন। রাত সাড়ে এগারোটায় তার মোবাইল থেকে তার স্ত্রী নীলার মোবাইলে মেসেজ এসেছে, “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।” নীলা সকালে ঘুম থেকে উঠে মেসেজটা পড়েছেন। দশটার দিকে থানায় এসে তিনি ঘটনা জানালেন। আরিফের মোবাইল ট্র্যাক করে আমরা দুপুর একটার দিকে লাশ উদ্ধার করেছি।

‘ডেমরার একটা জংলা এলাকায় লাশটা পড়ে ছিলো। মাথার ডান পাশে পিস্তলের গুলি খেয়ে আরিফের মৃত্যু হয়েছে। রাত পৌনে বারোটায় স্থানীয় একজন চায়ের দোকানদার গুলির শব্দ শুনেছেন। পিস্তলটা পাওয়া গেছে আরিফের ডান হাতে। মোবাইলটা সাইলেন্ট করা অবস্থায় রাখা ছিলো প্যান্টের বাম পকেটে।

‘লাশ পাওয়ার পর নীলা এনামের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করলেন। তার মতে, আরিফের সুইসাইড করার কোন কারণ ছিলো না। এনামের সাথে নাকি সম্পত্তি নিয়ে আরিফের গণ্ডগোল ছিলো।’

‘নীলা ভাবীর কোন মোটিভ নেই?’ জানতে চাইলো মিতালি।

‘আরিফের মৃত্যুতে নীলার চেয়ে এনামের লাভ বেশি। নীলা পাবেন আরিফের সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ, বাকিটা পাবেন এনাম। তাছাড়া, একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যুর পরও এনাম স্বাভাবিক ছিলেন। আমাদের কাছে খবরটা শুনে কান্নাকাটি শুরু করলেন। তিনি নাকি আগে জানতেন না। সেটা সত্যি কিনা যাচাই করতে হবে। আরিফের বিজনেস পার্টনার কাদের গতকাল কখন কী করেছে, তাও জানতে হবে। চিন্তা করবেন না, এনাম যাতে বিনা দোষে ফেঁসে না যায় সেটা আমি দেখবো।’

‘ওর সাথে দেখা করা যাবে?’

‘অবশ্যই। পাশের রুমে চলে যান। আমি হাতের কাজ শেষ করে আসছি। তাকে আরও কিছু প্রশ্ন করা বাকি।’

এনাম গালে হাত দিয়ে আনমনে বসে আছে। মিতালির উপস্থিতি টের পেলো না। অনেক কান্নাকাটি করেছে বোঝা যায়। চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা আর হতাশার ছাপ।

‘আর ইউ ও.কে.?’

চমকে উঠে তাকালো এনাম। মিতালিকে দেখে খুশি হলো। পরক্ষণেই নিজের অবস্থার কথা চিন্তা করে বিব্রত বোধ করলো। ম্লান মুখে বললো, ‘খুনির সঙ্গে দেখা করতে এলেন?’

‘আপনাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে আপনি খুন করেননি।’

‘আপনি কি অপরাধবিজ্ঞানী?’

‘না, সমাজবিজ্ঞানী। আপনি বোধহয় আপনার ভাইয়ের খবরটা জানতেন না?’ পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললো মিতালি।

‘না, থানায় এসে শুনলাম।’

‘এটাই পুলিশের সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাই-ভাবীর সাথে আপনি একই বাসায় থাকেন। ভাবী সকাল থেকে ভাইয়ার খোঁজ করছেন। পুলিশ মনে করছে আপনি জেনেও নির্বিকার।’

‘গতকাল রাত নয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত আপনার সাথে আমার কথা হলো। তারপর আমি একটা মুভি দেখতে শুরু করলাম। ভাইয়া যে আদৌ বাসায় আসেননি, তা আমি জানি না। সকালে ভাবী তার মোবাইলে ভাইয়ার মেসেজ পড়ে থানায় চলে গেলেন, আমাকে কিছু বলেননি। আমি ভেবেছি ভাইয়া আমার আগে ঘুম থেকে উঠে বের হয়ে গেছেন। বিনা দরকারে তো ভাইয়াকে কল দেয়া হয় না। তাছাড়া, ভাবীর সাথে আমার কথাবার্তা বন্ধ –’

‘এটা তো জানতাম না!’

‘ভাইয়ার বিজনেস পার্টনার কাদেরের সাথে ভাবীর অনৈতিক সম্পর্ক আছে বলে আমার ধারণা। একদিন বেইলি রোডের Boomers-এ তাদেরকে আমি ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকতে দেখেছি। আমাকে দেখে ভাবীর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সেদিন থেকে তার সাথে আমি কথা বলি না।’

‘আপনার ভাইকে জানিয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ। তবে, ভাইয়া আগেই জানতেন। ডিভোর্সের চিন্তা-ভাবনা করছিলেন।’

‘এটাই খুনের কারণ নয় তো?’ মিতালি বললো।

‘চাইলেই তো ভাবী ডিভোর্স দিতে পারতেন। খুন করাতে যাবেন কেন? আমার ধারণা, মোটিভটা আর্থিক। কাদের ভাই হয়তো বিজনেস থেকে টাকা সরিয়েছেন, ভাইয়া টের পেয়ে গেছেন।’

‘আমার মনে হয়, ভাবী আপনার নামে মামলা করেছেন যাতে পুলিশ আপনার কথা বিশ্বাস না করে। তাতে কাদেরের সুবিধা।’

‘কাদেরের গতকালের গতিবিধি চেক করা দরকার,’ বললো এনাম। ‘তবে, তার চেয়ে বেশি দরকার হলো ভাইয়ার সাথে তার জয়েন্ট বিজনেসের হিসাবের খাতা চেক করা।’

‘দাঁড়ান, আমি ছোটমামাকে একটা কল দেই।’

মিনিট পাঁচেক ধরে ছোটমামার সাথে কথা বললো মিতালি। মামাকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলো, তাঁর পরামর্শ মন দিয়ে শুনলো।

‘মামা বললেন, আপনার প্রথম কাজ হলো থানায় কাদের আর ভাবীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা। এতে সুবিধা হলো, হিসাবের ‍খাতা বা অন্যান্য জিনিসপত্র কাদের দেখাতে না চাইলে সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু করানো যাবে।’

‘ভালো আইডিয়া,’ বললো এনাম।

এসআই ফিরোজকে অনুরোধ করতেই তিনি মামলা রেকর্ড করার ব্যবস্থা নিলেন। তারপর আনুষঙ্গিক কিছু কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।

‘আপনার তো বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই?’ এনামকে জিজ্ঞাসা করলো মিতালি।

‘নাহ্। এসআই ফিরোজ আমাকে এই রুমেই অপেক্ষা করতে বলেছেন। তিনি আমাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।’

‘আমি যাই, আপনার জন্য কিছু নাস্তা নিয়ে আসি।’

‘আমার ক্ষুধা নেই,’ এনাম বললো।

‘প্রায় ছয়টা বাজে। দুপুরের পরে নিশ্চয়ই আর কিছু খাননি। স্যুপ নিয়ে আসি। আপনার শরীর-মনের যে অবস্থা, স্যুপই ভালো হবে।’

‘আপনি কি পুষ্টিবিজ্ঞানী?’

‘না, সমাজবিজ্ঞানী।’

ঘণ্টাখানেক পরে এসআই ফিরোজ এসে এনামকে বললেন, ‘আপনাদের বাসার কাজের বুয়া জানিয়েছে, দুপুর পর্যন্ত সে নিজেও কিছু জানতো না। নীলা বাসায় কিছু বলেনি, কান্নাকাটিও করেনি। আরও বললো, নীলার সাথে আপনার কথাবার্তা বন্ধ। আপাতত আপনাকে অ্যারেস্ট করা হলো না। পোস্ট-মর্টেম শেষ হয়েছে। আপনার ভাইয়ের দাফনের ব্যবস্থা করুন। কাল বেলা এগারোটায় কাদের আর নীলাকে থানায় আসতে বলেছি। আপনারাও আসুন।’

‘হিসাবের খাতাটা দেখা দরকার,’ বললো এনাম।

‘হিসাবের খাতা আর বিল্ডিং-এর সিসিটিভি ফুটেজ অলরেডি আমাদের হাতে,’ বললেন এসআই ফিরোজ। ‘কাল সব ভাল করে চেক করা হবে। আপনারাও চাইলে দেখতে পারবেন।’

(৭)

পরদিন সকাল দশটার আগেই থানায় চলে গেল এনাম। মিতালি পৌঁছালো সোয়া দশটায়। এসআই ফিরোজের সাথে দেখা করে ওরা বিজনেস ফার্মের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাইলো।

‘আমাদের একজন এএসআই সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পনেরো মিনিটের একটা ভিডিও তৈরি করেছে,’ বললেন ফিরোজ। ‘সেটা দেখে আমি সংশ্লিষ্ট সবার গত পরশুর আসা-যাওয়ার একটা টাইমলাইন বানিয়েছি। এটা আগে পড়ে দেখুন।’

এনাম আর মিতালি পড়তে শুরু করলো:

০৯:০১১ম কর্মচারী বিল্ডিং-এ ঢুকলেন।
০৯:১১২য় কর্মচারী।
০৯:১৩৩য় কর্মচারী।
১০:০৭আরিফ এলেন।
১০:১৫কাদের এলেন।
১২:১০রনি নামের একজন লোক এলেন। হাতে ৪/৫ টা খাবারের প্যাকেট।
১২:২০২য় ও ৩য় কর্মচারী চলে গেলেন।
১২:২৩১ম কর্মচারী চলে গেলেন।
০১:২৯আরেকজন লোক এলেন। নাম বজলু।
০৩:০০বজলু বের হলেন। সিকিউরিটি গার্ডের সাথে কথা শুরু করলেন। পরক্ষণেই আরিফ একটা ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে বের হলেন। ট্রলিতে একটা বড় কিউব আকৃতির বক্স। একটা প্রাইভেট কার (উবার, আরিফের কল করা) অপেক্ষা করছিলো। ড্রাইভারের সাহায্য নিয়ে বক্সটা গাড়িতে তুলে আরিফ চলে গেলেন। বজলু গার্ডের সাথে কথা শেষ করে ট্রলিটা নিয়ে ভিতরে গেলেন।
০৩:০১বজলু চলে গেলেন।
১১:৩০কারেন্ট চলে যাওয়ায় সিসিটিভি বন্ধ হয়ে গেল। কাদের বলেছেন, ঐ সময় তিনি আর রনি বের হয়েছেন।

এনাম আর মিতালি ভিডিওটা দেখলো। কোয়ালিটি ভাল নয়। টাইমলাইনের সাথে ভিডিওর কোন অসামঞ্জস্য চোখে পড়লো না।

এনাম ভাবলো, কর্মচারীদেরকে কেন তাড়াতাড়ি ছুটি দেয়া হলো? রনি আর বজলু কেন এলো? আরিফ ভাইয়া বড় বক্সে করে কী নিয়ে গেলেন?

এসআই ফিরোজ জানালেন, প্রশ্নগুলো তার মনেও এসেছে – কাদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

এনামের অনুরোধে বিজনেস ফার্মের হিসাবের বড় খাতাটি এগিয়ে দিলেন ফিরোজ। বললেন, ‘এটা কিন্তু এভিডেন্স। খাতায় কোন কাটাছেঁড়া করা যাবে না, দাগ দেয়া যাবে না।’

‘আপনার সামনেই খাতাটা চেক করবো। আপনি এই রুম থেকে বের হলে খাতাটা লক করে যাবেন।’

মনোযোগ দিয়ে খাতার হিসাব-নিকাশ দেখতে শুরু করলো এনাম। এদিকে মিতালি ভিডিওটা আবার খুঁটিয়ে দেখছে।

একজন কনস্টেবল এসে এসআই ফিরোজকে জানালো, কাদের আর নীলা এসেছে।

‘ওয়েট করতে বলো,’ বললেন ফিরোজ। তারপর এনাম আর মিতালিকে বললেন ‘আপনাদের চেক করা শেষ হোক।’

সাড়ে এগারোটার দিকে এনাম বললো, ‘শুধু মূল বিষয়গুলো দেখেছি। এত অল্প সময়ে বিস্তারিত চেক করা সম্ভব না।’

‘কিছু পেলেন?’ ফিরোজ জানতে চাইলেন।

‘একটা ব্যাপারে খটকা লাগলো। তিন বছর আগে বিজনেস শুরু হয়েছে। প্রাথমিক মূলধন ছিলো দুই কোটি টাকা। প্রথম বছর শেষে সব খরচ আর নিজেদের বেতন বাদ দিয়ে লাভ হলো এক কোটি টাকা, যার ফলে মূলধন বেড়ে দাঁড়ালো তিন কোটি টাকা। দ্বিতীয় বছর শেষে মূলধন আরও দুই কোটি টাকা বেড়ে হলো পাঁচ কোটি টাকা। সেই হিসেবে তৃতীয় বছর শেষে লাভ হওয়ার কথা প্রায় তিন কোটি। কিন্তু, হিসাবে দেখা যাচ্ছে লাভ হয়েছে এক কোটিরও কম। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।’

‘নানা কারণেই তো লাভ কম হতে পারে,’ বললেন ফিরোজ।

‘তা পারে। সরেজমিনে চেক করতে পারলে ভালো হতো। হতে পারে, কাজির গরু কাদেরের গোয়ালে আছে, কিতাবে নেই।’

‘ব্যাপারটা পরে দেখা যাবে,’ বললেন ফিরোজ। ‘এখন কাদের আর নীলাকে আসতে বলি। আপনারাও চাইলে থাকতে পারেন।’

(৮)

সব প্রশ্নের জন্য কাদের যেন তৈরি ছিলেন।

তিনি জানালেন, একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আরিফের সাথে তার কথা কাটাকাটি খুব বাজে পর্যায়ে চলে যাচ্ছিলো বলে কর্মচারীদেরকে তিনি ছুটি দিয়েছিলেন।

তিনি বললেন, ‘আমার বন্ধু রনিকে আসতে বলেছি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য। আর, আরিফের বন্ধু বজলুকে আসতে বলেছি যাতে ওকে বোঝাতে চেষ্টা করে।’

‘বড় বক্সে করে আরিফ কী নিয়ে গেলেন?’ জানতে চাইলেন এসআই ফিরোজ।

‘বলতে পারবো না। ওকে বজলু জিজ্ঞাসা করেছিলো। ও বলেছিলো, কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র।’

মিতালি এসব কিছুই শুনছিলো না। ও হিসাবের খাতার পাতাগুলি একটা একটা করে উল্টাচ্ছিলো। হিসাবের কিছুই ও বোঝে না। কিন্তু, কোনও পৃষ্ঠায় আরিফ ভাই যদি কিছু লিখে থাকেন!

খাতার অর্ধেক ব্যবহৃত হয়েছে। শুধুই হিসাব। বাকি পৃষ্ঠাগুলি একদম সাদা। সরাসরি বা সাংকেতিক ভাষায় কোন লেখা চোখে পড়লো না।

আবার পৃষ্ঠাগুলি একটা একটা করে উল্টাতে শুরু করলো মিতালি।

এনাম এতক্ষণ কোন কথা বলেনি। হঠাৎ সে এসআই ফিরোজকে বললো, ‘বিল্ডিং থেকে বের হওয়ার সময় সিসিটিভিতে আরিফ ভাইয়ার মুখ দেখা যায়নি। কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যায় ইনি সত্যিই আরিফ ভাইয়া কিনা?’

‘সিকিউরিটি গার্ডও তো বলেছে আরিফ তিনটায় বের হয়েছেন,’ বললেন ফিরোজ।

‘বজলু তো ঐ সময়ে সিকিউরিটি গার্ডের সাথে কথা বলছিলো,’ বললো এনাম। ‘তাকে ব্যস্ত রেখেছে।’

‘আরিফ তাহলে কোথায় ছিলো?’ কাদের হঠাৎ আলোচনায় যোগ দিলো।

‘হতে পারে বক্সটার মধ্যে,’ বললো এনাম।

‘আরিফ তো ঐ সময়ে বেঁচে ছিলো,’ বললেন ফিরোজ। ‘পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী, তার মৃত্যু হয়েছে রাত এগারোটা থেকে একটার মধ্যে।’

‘হয়তো অজ্ঞান করে বক্সে ঢোকানো হয়েছে,’ বললো এনাম।

‘কল্পনা করে কত কিছু বলে যাচ্ছেন এই ভদ্রলোক,’ বিদ্রূপের সাথে বললেন কাদের।

মিতালি হঠাৎ লক্ষ্য করলো, হিসাবের খাতার যেই পাতায় হিসাব শেষ হয়েছে, তার পরের পাতায় একটা ছোট ছিদ্র। এর অবস্থান পাতাটির ডান প্রান্তের কাছাকাছি, মাঝামাঝির চেয়ে নিচে। সম্ভবত একটা আলপিন দিয়ে ছিদ্রটা করা হয়েছে।

পাতা উল্টাতেই দেখা গেলো, পরের পাতায়ও একটি ছিদ্র। আগের ছিদ্রটির সামান্য নিচে ডানদিকে এর অবস্থান। এভাবে পরপর অনেকগুলি পাতার প্রত্যেকটিতে একটি করে ছিদ্র। প্রত্যেকটি ছিদ্রের অবস্থান আলাদা। তবে, পাশাপাশি দুই পাতার ছিদ্র দু’টির অবস্থান কাছাকাছি।

মিতালির হঠাৎ মনে হলো, ছিদ্রগুলি ব্যবহার করে কিছু একটা লেখা হয়েছে। উত্তেজনায় ওর দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো।

খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো মিতালি। মনে মনে সবগুলো‍ বিন্দুকে জোড়া দেয়ার চেষ্টা করছে। বোঝা গেল, মেসেজটা খাতার বাম থেকে ডানে না লিখে নিচ থেকে উপরে লেখা হয়েছে।

খাতাটা ডানদিকে একটু ঘুরিয়ে নিলো মিতালি। খাতার নিচের দিকটা এখন ওর বামপাশে, উপরের দিকটা ডান পাশে। আবার খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো ও।

‘হিসাবের খাতায় একটা মেসেজ লেখা আছে,’ হঠাৎ বলে উঠলো মিতালি।

চমকে উঠে চুপ হয়ে গেল সবাই। খাতার ছিদ্রগুলি সবাইকে দেখালো সে।

‘এবার আপনাদেরকে আরিফ ভাইয়ার বায়োস্কোপ দেখাই,’ বলতে বলতে খাতা হাতে উঠে দাঁড়ালো মিতালি। খাতার দুই মলাট আর ছিদ্রবিহীন পাতাগুলো বাম হাতে ধরে রাখলো সে। ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর সঞ্চালনে ছিদ্র করা পাতাগুলো দ্রুতগতিতে এক এক করে উল্টে যেতে লাগলো।

‘কী দেখলেন?’ পাতা সঞ্চালন শেষ করে এসআই ফিরোজকে জিজ্ঞাসা করলো মিতালি।

‘মনে হলো যেন একটা বিন্দুই ছুটোছুটি করছে,’ বললেন ফিরোজ।

‘অনেকটা কার্টুনের মতো,’ যোগ করলো এনাম।

‘ঠিক বলেছেন। তবে, বিন্দুর গতিপথ খেয়াল করতে হবে। আবার দেখাচ্ছি।’

দ্বিতীয়বার ‘বায়োস্কোপ’ দেখালো মিতালি।

‘এবার প্রথম অংশটা পড়তে পেরেছি। মনে হলো “বান” লেখা আছে।’ বললেন ফিরোজ।

‘আমার মনে হয়েছে “বনি” লেখা,’ বললো এনাম। কাদের আর নীলা ফ্যাকাসে মুখে চুপ করে রইলো।

‘ভালো করে চেক করলে দেখবেন প্রথমে লেখা রয়েছে “রনি”।’ মিতালি উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বললো।

‘বাকি অংশে কী লেখা আছে বলুন তো।’ ফিরোজ কৌতুহল চেপে রাখতে পারছেন না।

‘লেখা রয়েছে, “রনি-কাদের খুনি।” নিজেই দেখুন।’ খাতাটা ফিরোজের দিকে এগিয়ে দিলো মিতালি। তারপর এনামের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো।

‘রনি তো আমার সাথে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত অফিসে ছিলো,’ বললো কাদের। ‘সে কীভাবে ডেমরাতে আরিফকে খুন করলো?’

‘রনি আপনার অফিসে ছিলো তার প্রমাণ কী? আপনাকে আর রনিকে ধোলাই দিলেই সব বের হয়ে যাবে।’ এসআই ফিরোজের আচরণ দ্রুতই বদলে গেছে।

‘আমি তাহলে যাই,’ বললেন নীলা।

‘নট সো ফাস্ট,’ বললেন ফিরোজ। ‘হিসাবের খাতায় নাম না থাক, আপনি আর বজলুও জড়িত বলে আমার ধারণা।’

(৯)

[সেদিন যা ঘটেছিলো]

সাড়ে বারোটায় আরিফের অফিসে ঢুকেই ওর দিকে পিস্তল তাক করলো রনি। টেবিল থেকে আরিফের মোবাইল আর কলম নিয়ে পকেটে ঢোকালো। বজলু আসবে ঘণ্টাখানেক পরে, তার আগ পর্যন্ত আরিফকে পাহারা দিতে হবে। কারও সাথে যেন সে যোগাযোগ করতে না পারে।

আরিফ বুঝতে পারলো, আজ ওর জীবনের শেষ দিন। রনিকে দিয়ে কাদের ওকে খুন করাবে।

নীলা কতটুকু জানে? আরিফ নিশ্চিত হতে পারছে না। ব্যভিচার এক কথা, খুন আরেক কথা।  

কাদের হয়তো খুন করে পার পেয়ে যাবে। সে খুবই চতুর।

হিসাবের খাতাটা সামনে পড়ে আছে। কলম বা পেন্সিল থাকলে খাতার কোনও এক জায়গায় লিখে রাখা যেতো, রনি আর কাদের খুনি। এনাম অ্যাকাউন্টিং-এ মাস্টার্স করা। আরিফের মৃত্যুর পর অবশ্যই খাতাটা চেক করবে।

হঠাৎ আলপিনের প্যাকেটটা আরিফের চোখে পড়লো। তাইতো! আলপিন দিয়েই তো খাতার কোনও এক পৃষ্ঠায় মেসেজটা লেখা যায়।

না, লিখে লাভ হবে না। এনাম বা পুলিশকে খাতাটা দেয়ার আগে কাদের ভাল করে চেক করবে। কোনও কিছু লেখা থাকলে সেই অংশটা ছিঁড়ে ফেলবে।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে মেসেজ লেখার উপায় পেয়ে গেল আরিফ। মুশকিল হলো, সূক্ষ্মভাবে চেক না করলে হয়তো এটা কারও চোখে পড়বে না। তবুও লিখবো, ভাবলো আরিফ। খুনি ধরা পড়ার একটা সম্ভাবনা থাকুক।

রনি বসে আছে দরজার কাছে একটা চেয়ারে। এদিকে খুব একটা মনোযোগ নেই। তারপরও একটা ফাইলের স্তূপ অল্প অল্প করে সামনে ঠেলে কিছুটা আড়াল সৃষ্টি করলো আরিফ।

হিসাবের খাতাটা খুলে মনোযোগ দিয়ে দেখার ভান করলো সে। একটা আলপিন হাতে নিয়ে মেসেজটা লেখার কাজে হাত দিলো। যেই পাতায় হিসাব শেষ হয়েছে, তার পরের পাতা থেকে শুরু করে প্রত্যেক পাতায় একটি করে ছিদ্র করে যাচ্ছে আরিফ। যত্নের সাথে সঠিক অবস্থান নির্ধারণ করে প্রতিটা ছিদ্র করতে হচ্ছে।

পাঁচ মিনিটের চেষ্টায় ‘র’ লেখা শেষ হলো। ছিদ্রগুলি যদি এক পাতায় করা হতো, তাহলে সহজেই ‘র’-টা চোখে পড়তো। এখন এনাম বা পুলিশকে কসরত করতে হবে।

আধা ঘণ্টায় পুরো মেসেজটা লেখার কাজ শেষ করতে পারলো সে।

দেড়টায় সিডেটিভ নিয়ে বজলু এলো। আরিফকে অজ্ঞান করে ওর পরনের পোশাক আর জুতো খুলে রেখে ওকে বক্সে ঢোকানো হলো। রনি আর আরিফের শরীরের গড়ন প্রায় এক। আরিফের পোশাক পরে নিজের পোশাক বক্সে ঢোকালো রনি।

আরিফের মোবাইল ব্যবহার করে উবার কল করা হলো। বক্সটা ট্রলিতে তুলে দু’জন নিচে নেমে গেল। বজলু দারোয়ানকে ব্যস্ত রাখলো। রনি ড্রাইভারের সাহায্য নিয়ে বক্সটা গাড়িতে তুলে চলে গেল।

ডেমরা পৌঁছে উবার বিদায় করলো রনি। একটা ভ্যানে করে বক্সটা জংলা এলাকায় নিয়ে এসে ভ্যান বিদায় করলো।

সন্ধ্যায় আরিফকে বক্স থেকে বের করে আবার সিডেটিভ দিলো রনি। পোশাক পাল্টে নিজের পোশাক পরলো সে, আরিফকেও তার নিজের পোশাক পরালো।

খালি বক্সটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুটা পথ হেঁটে একটা নালার কাছে পৌঁছালো রনি। বক্সে কয়েকটা পাথর ঢুকিয়ে ফেলে দিলো নালার মধ্যে। দ্রুত ডুবে গেল সেটা।

আরিফের মোবাইল থেকে সাড়ে এগারোটায় নীলাকে ‘সুইসাইড নোট’ পাঠালো রনি। এটা দেখিয়ে পুলিশের সাহায্য নিবে নীলা। তবে, এনামের বিরুদ্ধে মামলাও করা হবে। পুলিশ মনে করবে আত্মহত্যা বা এনামের হাতে খুন। ওদের চারজনকে সন্দেহ করবে না।

মোবাইলটা সাইলেন্ট করে আরিফের প্যান্টের বাম পকেটে ঢুকিয়ে দিলো রনি। রুমাল দিয়ে পিস্তল থেকে নিজের হাতের ছাপ মুছে পিস্তলটা আরিফের ডান হাতে ধরিয়ে দিলো।

আরিফের মাথার ডানপাশে পিস্তল ঠেকিয়ে ওকে দিয়েই ট্রিগার টানালো রনি। কাজ সেরে দ্রুত চলে গেল সে।

(১০)

[কিছুদিন পরের কথা]

বিকেল পাঁচটায় কলিং বেল বাজতেই দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগোলো মিতালি। এনাম আসার কথা। মিতালির মায়ের সাথে পরিচিত হতে চায় সে।

দরজা খুলে অবাক হলো ও। এনামের সাথে বায়োস্কোপ-ওয়ালা!

‘ভাবলাম, তোমার মা বায়োস্কোপ দেখলে খুশি হবেন,’ বললো এনাম।

‘অবশ্যই। আসুন আপনারা।’

মা এখনও বেডরুমে। তাঁকে ডাকার আগে বায়োস্কোপটা সেট করা হলো। মায়ের ব্যাকপেইন আছে বলে বাক্সটা একটু উঁচু করে বসানো হলো, যাতে ঝুঁকে দেখতে না হয়।

মিতালি মাকে ডাকতে যাচ্ছিলো। এনাম প্রস্তাব করলো, আগে ডুগডুগি বাজানো হোক।

ঘরের সব দরজা-জানালা খোলা, তারপরও ডুগডুগির শব্দে কানে তালা লেগে গেল। মা বের হয়ে এসে কাণ্ড-কারখানা দেখে হতবাক! পরক্ষণেই বায়োস্কোপের কথা শুনে আনন্দে আত্মহারা হলেন তিনি। বিপুল উৎসাহ নিয়ে বায়োস্কোপ দেখতে বসলেন।

‘তুমিও বসো,’ মিতালিকে বললো এনাম। ‘আজকের ছবিগুলো কিন্তু আলাদা।’

মা-মেয়ে একসাথে বায়োস্কোপ নিয়ে মেতে গেল।

প্রদর্শনী শেষ হতেই দু’জনকে ধন্যবাদ জানিয়ে মা বললেন, ‘রহিম-রূপবান, ক্ষুদিরামের ফাঁসি – এই ছবিগুলোই আমি ছোটবেলায় বায়োস্কোপে দেখেছিলাম!’   

‘আমার ঘরে এই ছবিগুলা অনেক দিন ধইরা পইড়া ছিলো,’ বললেন বায়োস্কোপ-ওয়ালা। ‘আজকাল এগুলা কেউ দেখতে চায় না। এনাম ভাই বললেন, তাই খোঁজ কইরা নিয়া আসলাম।’

মায়ের ব্যাকপেইন যেন হাওয়া হয়ে গেছে। মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য ছুটোছুটি করলেন তিনি। তাঁর চোখে-মুখে একটা কিশোরী মেয়ের উচ্ছলতা।

‘মাকে এতো খুশি কখনও দেখিনি!’ বললো মিতালি। ‘আপনি নিশ্চয়ই মনোবিজ্ঞানী!’

একটু হেসে এনাম বললো, ‘না, হিসাববিজ্ঞানী।’

(শেষ)

১. বিলুপ্ত-প্রায় ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন বলে একজন সত্যিকারের বায়োস্কোপ-ওয়ালার প্রকৃত নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর গল্পে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪

জাফর আহমেদ খান

প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪