fbpx

ব্লাড (দ্বিতীয় পর্ব)

১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

(৪)

পুলিশের গাড়ি সবে মাত্র মির্জাপুর কবরস্থানে এসে থেমেছে। সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। আশেপাশে মানুষ নেই বললেই চলে। শুধু একজন মধ্যবয়স্ক দাঁড়িয়ে। তার নাম সগির মিয়া। গাড়ি থেকে রাকিব আর ফজলুর সাহেব নামলেন। আধ ঘণ্টা আগে এই সগির মিয়াই তাদের ফোন দেয়। সগির মিয়ার সাথে ফোনালাপ থেকেই রাকিব জানতে পারে কবরস্থানে কোন এক অজ্ঞাত মানুষের জামা কুঁচকে পড়ে আছে। সেই সাথে বেশ কিছু জায়গায় রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।  

“স্যার, আমি আইসাই দেহি এহানে ওই কবরখানের কাসে কে জানি বইয়া আসে। তয় আইন্ধার এর লেইগা চেহারা দেখবার পারি নাই। আমি তো পয়লা পয়লা ডরায় গেসিলাম। মনে কইসে কোন জিনটিন নি! পরে দিয়া কাসে যাইয়া দেহি ফাক্কা, খালি এত্ত খান জায়গা জুইরা রক্ত!”, সগির মিয়া কপালের ঘাম মুছতে মুছতে রাকিবকে বলে।

“আচ্ছা, আপনি ঘাবড়াবেন না। আমরা এসে গেছি এখন আমাদের উপর ছেড়ে দেন। লাশ টাশ দেখসেন নাকি সগির ভাই আশেপাশে?”, রাকিব বেশ চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করে।

“স্যার, অহনো অত দেহি নাই। আমি তো রক্ত আর এই জামা দেইখাই পাগল হইয়া হায় আল্লাহ কইতে কইতে দৌড় মারসি!”

“ঠিক আছে সগির ভাই। আপনি আপাতত থানায় চলেন আমার সাথে। বেশ কিছু জিজ্ঞাসা আছে। আর ফজলুর সাহেব! আপনি এখানটা আরও ভাল করে দেখতে থাকেন। আর কবরটা কার সেটা খোঁজ লাগান।”

(৫)

বেলা এগারোটা। রাকিব থানায় বসে আছে। সামনে সগির মিয়া। তার হাতে রক্তাক্ত জামা।  জামাটা নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা করার আছে, ল্যাবে দিতে হবে। যতদূর শোনা যাচ্ছে আর কোন খুন হয়নি। তাহলে জামাটা কার? এত রক্ত কেন এতে? খুনির জামাই যদি হয় তবে এটা ফেলে গেল কেন এভাবে? আবার কবরগুলির উপরেও বা রক্ত কেন? খুনি কি কারো খুন করে কবরে মাটি চাপা দিয়ে গেছে? সেই মানুষের জামা এটা? কিন্তু আর তো কারো লাশ কিংবা নিখোঁজ হবার খবর পাওয়া যায় নি! তাহলে? উফফ। বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। রাকিব বুঝে উঠতে পারছে না এবারের খুনের ঘটনাগুলি এমন অদ্ভুত কেন ঠেকাচ্ছে। আগে তো কখনো এমন হয়নি।

গন্ধ। জামার ভেতরে রক্ত ছাড়াও অন্য এক গন্ধ লেগে আছে। গন্ধটা খুব অপরিচিত কিন্তু বোঝা যায় গন্ধটা যার জামা হাতে বসে আছে সেই সত্তার। প্রতিটা মানুষের কিছু বিষয় একান্তই নিজের থাকে। সে বিষয়গুলির মাঝে একটি- সে মানুষের সাথে মিশে থাকা নিজস্ব এক গন্ধ। সেই গন্ধ মানুষের অস্তিত্ব জানান দেয়। সে মানুষ কাছে না থাকলেও তার ব্যবহার করা সামগ্রীগুলির মাঝে মিশে থাকা গন্ধ বারবার তার কথা মনে পড়ায়। হয়ত সে দূরে তবুও কোন এক পিছুটান থেকেই যায় সেই গন্ধের রেশ ধরে। কিন্তু এই গন্ধ যার সে কে? খুনির-ই গন্ধ কি? রাকিবের ফোনে কল আসে। মুহূর্তেই ফোন রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে সে।

– ফজলুর সাহেব!

– জ্যা স্যার? আবারও খুন?

– নাহ, ফজলুর সাহেব। তবে আমাকে উঠতে হবে। বাসা থেকে কল এসেছে।

– কী হইসে স্যার? বড় কোন কিসু?

– আমার মেয়ে হুট করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে বুঝলেন? বোধহয় ডেঙ্গু!

– হায় হায়, তাড়াতাড়ি যান! ইদানিং তো ডেঙ্গু বেজায় ভয়ানক হইয়া দাড়াইসে।

– আপনি একটু এদিকটা দেখে নিয়েন। আমি যাচ্ছি। মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন। বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

(৬)

মিডফোর্ড হাসপাতাল। কেবিন নাম্বার ৪০৫। রাত সাড়ে এগারোটা। রাকিবের সামনে তার মেয়ে শ্রাবণী শুয়ে। তার শরীর প্রচণ্ড গরম হয়ে আছে। হাতে নল লাগানো। ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত লাগছে। শ্রাবণী চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। এবার সারা দেশে ডেঙ্গু বেশ ভালোভাবে প্রকোপ করেছে। হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে প্রহর গুনছে। আর সেই সাথে গুনছে রক্তের ব্যাগ! রাকিবকে বেশ দৌড়াদৌড়ি করে শ্রাবণীর জন্য রক্ত জোগাড় করতে হচ্ছে। তার স্ত্রী আবার এক কাজে ঢাকার বাইরে। সব কিছু একাই সামাল দিতে হচ্ছে তাই। তার উপর খুনের সংখ্যা বেড়েই চলছে। কী যে করবে সে! 

– আব্বু, আমি মাকে খুব মিস করছি।

– খুব বেশি করছিস নাকি?

– হ্যাঁ, আব্বু।

– কিন্তু কিছু যে করার নেই, মা! 

– রাতগুলি এমন হয় কেন আব্বু? সব মনে করিয়ে দিতে থাকে। আমি না সারাদিন বেশ ভুলে থাকতে পারি! নিজের মনের ভেতর আসতেই দেই না যে মা এখন নেই, জানো? কিন্তু রাতটা হলেই আর পেরে উঠি না। তখন নিজের মনের চারদিকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা দেয়ালগুলি যেন ভাঙতে থাকে। একে একে সেই দেয়াল ভাঙতে থাকে রাতের নীরবতা। খুব চেষ্টা করি সব অনুভূতিগুলো ফেলে দিয়ে ঘুমিয়ে যেতে। কিন্তু চোখ বন্ধ করতেও ভয় করে। পলক ফেললেই যে মাকে দেখি! কী করবো বাবা বলো?

– জানি না রে, মা!

– বাবা জানো? আমি এই রাতের নীরবতার মাঝেও মা-র হাসি শুনতে পাই। মা যেন একদম ঠিক আমার পাশে শুয়ে হাসছে! আর আমি তার বুকে জরিয়ে রেখেছি নিজেকে। তুমি কি মা-র হাসি শুনতে পাও?

রাকিব তার মেয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তারপর শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, “পাই, বেশ শুনতে পাই।”

– আমার খুব খারাপ লাগছে বাবা।

– খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে রে মা?

কোন উত্তর পাওয়া যায় না। আমতা আমতা করে কিছু বলে শ্রাবণী। তার চোখ খোলা রাখতে পারে না আর সে। প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। রাকিব ধড়ফড়িয়ে উঠে ডাক্তারের খোঁজে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে। রাত বেশ হয়েছে। ডাক্তার পাবে কিনা সে কে জানে! তবে দেরি করা চলবে না। আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে রাকিব বেড়িয়ে পড়ে। তার মেয়ের যেন কিছু না হয়।

(৭)

শ্রাবণী তার সামনে ঝুলতে থাকা রক্তের ব্যাগ এর দিকে তাকায়। কত রক্ত টলমল করছে সেই ব্যাগে। কত সহজে বাঁধাহীন ভাবে সেই রক্ত সরু সূচ বেয়ে ঢুকে পড়ছে তার শরীরের শিরায় শিরায়। আচ্ছা রক্তের লাল রঙ এত গাঢ় কেন? খুব চোখে লাগছে। মাথা ধরেছে অনেক। মা তুমি পাশে নেই কেন? তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি কত কষ্ট পাচ্ছি? একবার কি এসে হাত টা ধরে পাশে থাকা যায় না? একটু সময়ের জন্য কি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারো না তুমি? আমার হাতে অসহ্য যন্ত্রণা করছে। ইচ্ছা করছে সব খুলে রেখে চলে আসি তোমার কাছে। বেঁচে থাকার জন্য কি আসলেও রক্তের খুব প্রয়োজন? এত দাম কেন এর! কেমন স্বাদ এই রক্তের? তোমার মনে পড়ে ছোটবেলায় একবার আমার পায়ে কাঁচ ঢুকেছিল? কত রক্ত যে পড়ল সেবার। তুমি তো চিৎকার করে উঠেছিলে। তোমার মেয়ের জন্য হুলস্থুল এক অবস্থা করে ফেলেছিলে বাসায়। কিন্তু আজকে তুমি কেন আসছ না মা? আমি বোধ হয় আর পারব না। শ্রাবণী শুনতে পেল বাবার গলা।

– ডাক্তার, আপনি প্লিজ কিছু করেন।

– সরি মিস্টার রাকিব, আমার হাতে কিছুই করার নেই।

– কিন্তু এত রাতে আমি কীভাবে এত রক্ত জোগাড় করব?

– সেটা আপনার ব্যাপার, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক!

রাকিব তার হাতের ঘড়ি দেখে। ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বাজে। এই সময়ে তিন ব্যাগ রক্ত কোথা থেকে জোগাড় করবে সে? সে নিজের রক্ত দিতে চাইলেও পারবে না। ধূমপান করার পাশাপাশি তার নিজের কিছু অসুখের কারণে তার রক্ত মেয়েকে দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু রিস্ক দেখা যাবে। রাকিব ধপ করে সামনে থাকা চেয়ারে বসে পড়ল। হাসপাতাল ভর্তি মানুষ কিন্তু তার পাশে যেন কেউ নেই। সে যেন এতজনের মাঝে থেকেও এই শহরে একা! খুব একা। তার কপালে ঘাম এসে গেছে। কী করবে সে এখন?

হঠাৎ নিজের কাঁধে একজনের হাতের স্পর্শ অনুভব করে সে। সে ফিরে তাকায়। নাহ! চিনতে পারছে না মানুষটাকে। আগে কখনো দেখেনি। কিন্তু সেই মানুষ এর মাঝে কিছু একটা আছে যেটা রাকিবের চেনা। কী অদ্ভুত! তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

– রক্ত লাগবে স্যার?

– আপনি কে?

– আমি কে সেটা এখন আসল বিষয় না স্যার। রক্ত দিচ্ছি মেয়েকে বাঁচান।

এই কথা বলে এক মৃদু হাসি দিয়ে রবিন এক ব্যাগ টাটকা তাজা রক্ত রাকিবের হাতে তুলে দিল।

(চলবে)

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি (IUT)

সেশনঃ ২০১৮-২০১৯

হাসিন ইশরাক

সেশনঃ ২০১৮-২০১৯