fbpx

ভালোবাসার ভিত্তি

(১)

গোধূলি নিলার ভীষণ প্রিয়। সূর্যটা যেন তার সমস্ত মহিমা ত্যাগ করে চাঁদকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে যায়। তার বাড়ির পশ্চিম দিকটা বেশ খোলামেলা। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার আগে নিলা এখানে এসে বসে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না।

“নদীর পাড় তো এখান থেকে বেশি দূরে না। এই সময়টায় একবার ঘুরে আসলেই তো পারিস রে মা।”

নিলা হেসে বলল, “আপনি আমার সাথে যাবেন মা?”

রুবিনা বানু, নিলার  শাশুড়ি। বয়সের ভারে অনেকখানি নুইয়ে গেছেন। ছেলের মৃত্যুশোক তার শরীর যেন আরও ভেঙ্গে দিয়েছে। একবছর হতে চলল নিলার স্বামী রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। বিয়ের তিন বছরের মাথায় সে বিধবা হয়। প্রেমের বিয়ে ছিল না ঠিকই, তবে স্বামী-সংসারের প্রতি তীব্র মায়া জন্মেছিল। সেটি সাজানো শুরু করতে করতেই সবটা শেষ হয়ে গেল। তার বিয়ের আগেই শ্বশুর মারা গিয়েছিলেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর শাশুড়িকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতেই থাকে নিলা। সে নিজের বাড়িতে ফিরে যায়নি। বড়ভাই পরিবার নিয়ে সেখানে থাকেন। সবাই, এমনকি রুবিনা বানু নিজে অনেক করে বললেও সে যায়নি। ভাইয়ের সংসারে বোঝা হতে চায়নি নিলা। কেউ মুখ ফুটে বলবে না হয়ত, তবে এটাই বাস্তবতা। নিলা স্বাবলম্বী, সরকারি ব্যাংকে চাকুরি করে। যে সময়টুকু বাইরে থাকে সেই সময়টুকু তাদের পূর্বপরিচিতা রহিমা খালা ঘরের কাজ সামলায়, রুবিনা বানুকে দেখে রাখে। অফিস থেকে ফিরে এই জানালার ধারে বসে থাকার সময় প্রায়ই শাশুড়ি তাকে ওদিক থেকে ঘুরে আসতে বলে। নিলা তখন এই প্রশ্ন করে মজা পায়। সে জানে রুবিনা বানু ঘর থেকে বের হবে না।

“কেন, আমি না গেলে বুঝি তুই যেতে পারবি না। পা আছে, শখ আছে ঘুরে আসবি। আমি আর গিয়ে কী করব, হাঁটতেও তো ইচ্ছা করে না।”

নিলা হেসে বলল, “একা যেতে মন চায় না মা। আমার এখান থেকে দেখতেই বেশ লাগে।”

বিয়ের পর মুহিনের সাথে প্রায়ই সূর্যাস্ত দেখতে যেত, নৌকায় করে ঘুরত, লালচে পাড় ধরে হাতে হাত রেখে হাঁটত।

রুবিনা বানু নিলার পাশে এসে বসেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিলার হাতটা ধরে বললেন, “নিলা মা, তুই তোর ভাইয়ের কাছে চলে যা। ভাল দেখে একটা বিয়ে করে নে। জীবনের কতখানি সময় পড়ে আছে দেখ। কেন এভাবে নষ্ট করছিস। আমি রহিমার সাথে বেশ থাকব।”

নিলা হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

“আপনার কি আমার সাথে থাকতে ভাল লাগে না মা? কেন বারবার এগুলো বলেন?”

“এই দেখ, আমি কি সে কথা বলেছি একবারও? তুই যে আমার জন্য এভাবে আছিস, আমি তো তোকে সুখী দেখতে চাই। আমি আর আছি কতদিনই বা। তুই তো আমার মেয়ে রে।”

নিলা কিছু বলল না। চোখের কোণে পানি নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

(২)

“নিলা?”

ডাক শুনে পিছনে ঘুরে দেখল আদিব ভাই তার দিকে এগিয়ে আসছে। আদিব ভাই নিলার কলিগ। ভীষণ অমায়িক, পরোপকারী একজন মানুষ। নিলা দাঁড়িয়ে পড়ল।

“বাসায় যাচ্ছ তো?”

“জী ভাই।”

“কোন সমস্যা না থাকলে তোমাকে পৌঁছে দেই আমি? আমিও তো ওইদিকেই যাই। একসাথে কিছুক্ষণ গল্প হবে।”

নিলা হেসে বলল, “আমি যেতে পারব ভাই, কোনো সমস্যা নাই। আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না।”

“আরে কষ্ট কেন বলছ। বললাম না আমি ওইদিকেই যাব। ইট উড বি মাই প্লেজার।”

নিলা রাজি হল। দুজনে হাঁটা আরম্ভ করল। টুকিটাকি গল্প করে নিলার ভালই লাগছিল। আদিব ভাইয়ের সেন্স অব হিউমার দারুণ। কথাও বলেন দায়িত্ব নিয়ে।

“বুঝলে নিলা, আজকাল মানুষ দ্বিমুখী নীতিতে এত বেশি অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে যে তফাতটাই বোঝা দায় হয়েছে। সমাজের মানদণ্ড ঠিক কোথায় আমি ভেবে পাই না।”

নিলা কিছু বলে না। তার শুনতে ভাল লাগছিল।

“তুমিও কিছু বল। সব কথা তো আমিই বলছি।”, আদিব ভাই হাসতে হাসতে বললেন।

“আপনি খুব গুছিয়ে কথা বলেন আদিব ভাই। আমি এরকম পারি না।”

“কী যে বল নিলা!” কিছুক্ষণ চুপ থেকে উনি বললেন, “তোমাকে একটা প্রশ্ন করব?”

নিলা তাকিয়ে মাথা নাড়ল। আদিব ভাই বললেন, “তোমার কাছে ভালবাসার ভিত্তি কোথায়?”

নিলা ভেতর থেকে চমকে উঠল। বলল, “আদিব ভাই, প্রশ্নটা ভীষণ ভারী। এর উত্তর আমি অন্য কোনদিন দিব। আজ যে বাড়ির কাছে চলে এসেছি।”

“তাই তো। দেখ হাঁটতে হাঁটতেই চলে আসলাম। দূরত্ব তো অবশ্য বেশি নয়। ভালই হল বল, হাঁটা হল।”

এরপর থেকে প্রায়ই তারা একসাথে ফিরতে লাগল। নিলা বুঝতে পারছিল আদিব ভাই শুধু তাকে একজন কলিগের চোখে দেখছেন না। নিলার ভেতরে এই ব্যাপারটা নিয়ে কী কাজ করছে সে বুঝতে পারে না।

রাতে খাওয়ার টেবিলে রুবিনা বানু জিজ্ঞাসা করলেন, “ছেলেটা তোর কলিগ নাকি রে?”

নিলা চোখ না তুলে বলল, “কার কথা বলছেন?”

শাশুড়ি মুচকি হেসে বললেন, “বুঝছিস না কার কথা বলছি? ওই যে শ্যামলা করে ছেলেটা তোকে যে বাড়িতে রেখে যায়। দেখতে বেশ ভদ্র।”

নিলা আস্তে করে বলল, “মা আমি এই বিষয়ে কোন কথা বলতে চাই না। আপনি দয়া করে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না।”

রুবিনা বানু আলতো করে হেসে খাওয়ায় মন দিলেন। নিলা তাকে ছেড়ে চলে গেলে তিনি কীভাবে থাকবেন জানেন না। জীবনের এই প্রান্তে স্বামী-সন্তান হারিয়ে কারো সাথে এভাবে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে যাবেন ভাবেন নি। তবুও তিনি চান নিলা নতুনভাবে জীবনটাকে শুরু করুক।

(৩)

সেদিন আকাশ মেঘলা ছিল। আদিব ভাইয়ের সাথে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে উনি যখন গোলাপ ফুলগুলো বের করে নিলাকে বললেন, “নিলা, তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমায় ভুলভাবে নিও না, আমার তোমাকে খুব ভাললাগে। আমি তোমার সম্পর্কে সব জেনেই প্রাউডলি তোমাকে আপন করে নিতে চাই। আমার কি সেই সৌভাগ্য হবে?” কিছুক্ষণের জন্য নিলার পৃথিবী থমকে গেছিল। নিজেকে সামলে নিতে সে বেশি সময় নেয় নি। সে বলেছিল

“আপনার মনে আছে আপনি আমাকে একদিন প্রশ্ন করেছিলেন আমার কাছে ভালবাসার ভিত্তি কোথায়। আজ আমি তার উত্তর দিব। আমার কাছে সেটা নারী-পুরুষের প্রেমে নয়। মাঝে মাঝে কিছু ভালোবাসা এমন স্বাদ নিয়ে আসে যে তার মত সুখ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। আপনার এই প্রপোজাল সেটা বুঝতে আরও সাহায্য করেছে। আপনি খুব ভাল মানুষ আদিব ভাই। আপনার ফুলগুলো আমি নিলাম। কিন্তু এর বেশি কিছু সম্ভব না।”

আদিব ভাই চুপ করে গিয়েছিলেন, কোন কথা বলেন নি।

নিলা ফুলগুলো নিয়ে যখন বাড়ি ফিরল, তার ভেতরটা খুব হাল্কা লাগছিল। দরজার সামনে রুবিনা বানু দাঁড়িয়ে আছে, তাকে বোঝার চেষ্টা করছে। নিলা জানে তার শাশুড়ি সব দেখেছে উপর থেকে। নিলা হাসল। কেউ কোন কথা বলল না। ফুলগুলো ফুলদানিতে রেখে সে ঘরে চলে গেল।

জানালার ধারে নিলা বসে আছে। রুবিনা বানু তার পাশে এসে বসলেন। তিনি শাড়ি পাল্টে এসেছেন। নিলা অবাক হয়ে তাকাতেই বললেন, “আজ তোর গোধূলি দেখে আসি। আমার সাথে একটু হাঁটবি মা?”

নিলা মাথা নেড়ে জামা পাল্টাতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিল। এই একা বুড়িটাকে যে সে ভীষণ ভালবাসে।

শিক্ষার্থী | Department of EEE, Rajshahi University of Engineering & Technology

Session: 2018-2019

মালিহা আনাম

Session: 2018-2019