fbpx

ডিসেম্বর ৭, ২০২৪

দ্য ওল্ড ট্রিক্‌স্‌

(১)

চারতলার বাসা থেকে বের হয়ে লিফটের বদলে সিঁড়ি দিয়ে পাঁচতলায় উঠলো আভাস। অ্যাপার্টমেন্ট 5A-এর কলিংবেল বাজাতেই মিসেস আনোয়ারা আজিম দরজা খুললেন। ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তিনি।

আইন বিভাগের ছাত্র আভাস, দিনকয়েক আগে ওর ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মা আর ছোটভাইকে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট 4B-তে থাকে।

মিসেস আনোয়ারার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাসখানেক আগে তার স্বামী অ্যাডভোকেট আজিম মারা গেছেন। তাদের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের নাম সাগর, বয়স চৌদ্দ, ক্লাস এইটে পড়ে। মেয়ে নীলার বয়স এগারো, ক্লাস ফাইভের ছাত্রী।

বুয়াকে নাস্তা দিতে বলে আভাসের মুখোমুখি বসলেন আনোয়ারা।

‘এখন কিছু খাবো না, আন্টি,’ বললো আভাস। ‘সকালের নাস্তা আমি একটু দেরিতে খাই।’

‘চা খাও?’

‘ঠিক আছে। শুধু একটা টি-ব্যাগ, দুধ-চিনি ছাড়া।’

বুয়াকে চা দিতে বলে আভাসের দিকে ফিরলেন আনোয়ারা। কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না। মনস্থির করার চেষ্টা করছেন।

আভাস ভেবেছিলো, ও আইনের ছাত্র বলে বৈষয়িক ব্যাপার নিয়ে আন্টি ওর সাথে আলাপ করবেন। কিন্তু, এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অন্য কিছু।

‘সাগর-নীলা কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলো আভাস।

‘ঘুমাচ্ছে। আজ তো শনিবার, স্কুল বন্ধ।’

‘আজিম আর আমি সংসার শুরু করেছিলাম রাজশাহীতে,’ মনস্থির করে বলতে শুরু করলেন আনোয়ারা। ‘আমাদের দু’জনের বাড়িই রাজশাহী, তুমি জানো বোধ হয়। বিয়ের বছরখানেক পর, সাগরের জন্মের দু’বছর আগে, রাজশাহীর একটা ক্লিনিকে আমাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। এতদিন আমরা জানতাম, ডেলিভারির একটু আগে ছেলেটা মারা গেছে। কিন্তু, গত পরশু রাতে অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা মেসেজ পেলাম –’

মোবাইলে মেসেজটা বের করে এগিয়ে দিলেন আনোয়ারা। বাংলায় লেখা: “আমি জানি আপনার ১ম বাচ্চা বেচে আছে।”

‘বেঁচে’ লিখতে গিয়ে বানান ভুল করে ‘বেচে’ লেখা হয়েছে। এতে হয়তো কিছুটা সত্য প্রকাশ পেয়েছে, ভাবলো আভাস।

‘আপনি কোনও মেসেজ বা কল দিয়েছেন?’ জিজ্ঞেস করলো আভাস।

‘হুট করে একটা অপরিচিত নাম্বারে কোনও মেসেজ পাঠাতে চাই না। কথা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু নাম্বারটা বন্ধ। Unknown নামে সেইভ করা আছে, তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো।’

আভাস কল করলো। নাম্বারটা এখনও বন্ধ।

‘যদি সত্যিই বেঁচে থাকে, তাহলে ওর বয়স এখন ষোল,’ বললেন আনোয়ারা। হাত দিয়ে চোখের জল মুছলেন তিনি। তারপর যোগ করলেন, ‘যত টাকা লাগুক, আমি ওকে খুঁজে বের করতে চাই।’

‘মেসেজটা তো ভুয়া হতে পারে। হয়তো কেউ আপনার সাথে ট্রিক করছে। সবাই জানে আপনার অনেক টাকা। আপনি তো মৃত বাচ্চাটার ডিএনএ টেস্টের ব্যবস্থা করতে পারেন।’

‘গতকাল এটা নিয়ে মামুনের সাথে কথা হচ্ছিলো। জানো বোধ হয়, মামুন আমার একমাত্র ভাই, ক্যানাডা থাকে। দেশে থাকতে ওকালতি করতো। ও বললো, বাচ্চাটা যেহেতু সরকারী গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে, কবর খুঁড়ে ডিএনএ টেস্ট করাতে পুলিশের অনুমতি লাগবে। বেনামি মেসেজের উপর ভরসা করে লোক জানাজানি করার মানে হয় না।’

‘তা ঠিক,’ বললো আভাস। ‘আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’

‘তুমি তো এখন ফ্রি আছো। কয়েকটা দিন এই কাজে সময় দিতে পারবে? রাজশাহীতে গিয়ে একটু খোঁজখবর নাও? আমি অবশ্যই পে করবো।’

‘ওখানে আপনার আত্মীয়-স্বজন আছে না? তাদের কাউকে –’

‘এই কাজে দরকার তীক্ষ্ন বুদ্ধি। তোমার বিকল্প খুঁজে পাচ্ছি না। রাজশাহীতে গেলে তোমার সমস্যা হবে না। আমার বাবার বাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে, কেয়ারটেকার আর তার ওয়াইফ দেখাশোনা করে। তোমার সব খরচের টাকা তো দেয়া হবেই – খরচ বাদে তোমাকে কত দিতে হবে বলো।’

‘টাকা দিতে হবে না, আন্টি। আপনারা আমাদের অনেক দিনের প্রতিবেশী –’

‘এটা ভিন্ন ব্যাপার। আমি প্রফেশনালি কাজটা করাতে চাই।’

আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো, সপ্তাহ দুয়েক খোঁজখবর নিবে আভাস। খরচ বাদে ওকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়া হবে। যদি বাচ্চাটার খোঁজ বের করতে পারে, বোনাস হিসেবে ওকে এক লাখ টাকা দেয়া হবে। যদি কোনও খোঁজ না পায়, মৃত বাচ্চাটার ডিএনএ টেস্টের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(২)

পরদিন সকাল নয়টার বাস ধরলো আভাস। রাজশাহীর ‘ঢাকা বাস স্ট্যান্ড’-এ পৌঁছালো দুপুর আড়াইটায়।

সাহেব বাজারে মিসেস আনোয়ারার পৈত্রিক বাড়িটা খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না। রিকশা বিদায় করে কলিংবেল বাজাতেই কেয়ারটেকার কাসেম এসে গেট খুললো।

লাল সিরামিক ইটের দোতলা বাড়ি, নাম ‘মুনফ্লাওয়ার’। এই নাম কে রেখেছিলো? তার কি জানা ছিলো এই ফুল বিষাক্ত?

ষাটোর্ধ্ব কাসেম আর তার পঞ্চাশোর্ধ্ব স্ত্রী – দুজনই সরল-সোজা মানুষ। আভাস তাদেরকে মামা আর মামী বলে সম্বোধন করায় তারা খুশি হলো। তাদের এক ছেলে আর এক মেয়ে। দুজনই বিয়ে করে আলাদা থাকে।

কাসেম জানালো, সবচেয়ে ভালো গেস্টরুমটাই আভাসকে দেয়া হয়েছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পিছনের বাগানটা দেখা যায়।

গোসল সেরে সাড়ে তিনটায় খেতে বসলো আভাস। নানা রকমের ভর্তা-ভাজি, মুরগী, রুই মাছ – আইটেমের শেষ নেই। রান্নাও চমৎকার।

খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ ঘুমালো সে। সন্ধ্যা ছয়টায় উঠে শুধু এক কাপ চা খেলো। আগেই জানিয়ে দিয়েছে রাত নয়টার আগে কিছু খাবে না।

আনোয়ারা আন্টি ফোন করে ওর খোঁজখবর নিলেন। জানালেন, অপরিচিত নাম্বারটি এখনও বন্ধ। অন্য কোনও মেসেজ সেখান থেকে পাওয়া যায়নি।

আন্টি মেসেজটা পেয়েছেন তিন দিন আগে। আর কোনও যোগাযোগ কেন মেসেজদাতা করছে না?

আভাস যদিও নাম্বারটি ওর মোবাইলে ‘Unknown’ নামে সেইভ করে নিয়েছে, কিন্তু হঠাৎ করে কোনও কল করতে চায় না ও। লোকটি ভড়কে যেতে পারে।

ভেবেচিন্তে ও সিদ্ধান্ত নিলো, আন্টির মোবাইল থেকে মেসেজদাতাকে একটা মেসেজ দেয়ার সময় হয়েছে। ও বাংলায় একটি মেসেজ লিখলো: “আপনার কাছে কোনও তথ্য থাকলে রাজশাহীতে আমার প্রতিনিধি আভাসের সাথে যোগাযোগ করুন (01915164882)।”

কীসের তথ্য চাওয়া হচ্ছে, তা ইচ্ছে করেই উল্লেখ করেনি সে। মেসেজটা ‘Unknown’ লোকটা দেখার আগে অন্য কেউ দেখতে পারে।

আন্টিকে মেসেজটা পাঠিয়ে ফোন করলো আভাস। বললো, ‘অপরিচিত ঐ নাম্বারে আপনার মোবাইল থেকে মেসেজটা পাঠানো দরকার।’

‘ও.কে., আমি এখনই পাঠাচ্ছি।’

সোয়া সাতটায় নতুন একটা নাম্বার থেকে কল এলো।

‘হ্যালো।’

ঐ পাশে নীরবতা।

‘হ্যালো, কে বলছেন?’ আভাসের কণ্ঠে অধীরতা।

ঐ পাশ তবুও নীরব।

‘আপনি কি মেসেজটা পেয়েছেন? এটা কি আপনার অন্য নাম্বার?’ জানতে চাইলো আভাস।

ঐ পাশ থেকে কলটা কেটে দেয়া হলো। আভাস কলব্যাক করে দেখলো নাম্বারটি বন্ধ।

‘Unknown 2’ নামে নতুন নাম্বারটি সেইভ করলো আভাস। আগের অপরিচিত নাম্বারটির নাম পাল্টে ‘Unknown 1’ বানালো, যাতে কোনও ভুল না হয়।

দু’টো নাম্বার কি একই লোকের? কথা বলে না কেন? কোনও কারণে ভয় পাচ্ছে?

(৩)

সকালে ঘুম থেকে উঠে অভ্যাসবশে মোবাইল চেক করলো আভাস। দেখলো, ‘Unknown 1’ থেকে রাত বারোটায় মেসেজ পাঠানো হয়েছে: “ঢাকার ছেলে ঢাকা চলে যান। নইলে আপনার বিপদ হবে।”

একটু ধাঁধাঁয় পড়লো আভাস। যে খবর দিলো বাচ্চাটা বেঁচে আছে, সে-ই কেন এখন ভয় দেখিয়ে ওকে তাড়াতে চাইছে? কী কারণে লোকটা মত পাল্টালো?

ঘাবড়ে যাবার ছেলে ও নয়। তবে, সাবধান থাকতে হবে।

শেভ, গোসল আর নাস্তা সেরে নয়টায় বাসা থেকে বের হলো আভাস। গন্তব্য ‘জোবায়দা হসপিটাল’।

গেট থেকে বেরিয়ে ডানে বায়ে তাকালো সে। বামদিকে বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার ওপাশে একটা লোক বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আভাসকে দেখে লোকটা একটু সচকিত হলো – ওর তাই মনে হলো।  

ওকে যেহেতু হুমকি দেয়া হয়েছে, কেউ না কেউ ওর গতিবিধি লক্ষ্য করবে এটাই স্বাভাবিক। আশেপাশে সন্দেহজনক আর কাউকে চোখে পড়ছে না।

বাইক-ওয়ালাই Unknown 1 বা তার সহযোগী, ভাবলো সে।

জোবায়দা হসপিটাল ডানদিকে, কিন্তু আভাস বামদিকে হাঁটতে শুরু করলো। ধীর পায়ে হাঁটছে, যেন ঘুরতে বেরিয়েছে।

লোকটা এখন রাস্তার ঠিক উল্টোপাশে। হঠাৎ লোকটাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আভাস দ্রুত রাস্তা পার হয়ে তার কাছে চলে গেল। পুরানো কৌশল।

‘আপনাকে পরিচিত মনে হচ্ছে,’ অমায়িক কন্ঠে বললো আভাস। ‘আপনার নাম কি সোহেল?’

লোকটার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। অশিক্ষিত মনে হচ্ছে না। পকেটে অস্ত্র থাকলেও বের করার সময় পাবে না, ভাবলো আভাস।

‘না,’ বললো লোকটা। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।

‘স্যরি, চিনতে ভুল হয়েছে। আপনাদের শহরে বেড়াতে এসেছি। ঘুরতে বের হয়ে প্রথমেই আপনার সাথে দেখা। আসুন দুজনে একটা সেলফি তুলি –’

চট করে মোবাইলে দুজনের একটা ছবি তুলে ফেললো আভাস।

‘আপনার নাম কী, ভাইয়া?’ জিজ্ঞেস করলো সে।

‘শরিয়ত।’

ভুয়া নাম, ভাবলো আভাস।

‘ও.কে. বাই,’ বললো সে।

ধীর পায়ে জোবায়দা হসপিটালের উল্টোদিকেই যাচ্ছে আভাস, তবে, এখন রাস্তার ডান পাশ দিয়ে হাঁটছে। পিছন ফিরে তাকাচ্ছে না। লোকটা এখনও বাইকে স্টার্ট দেয়নি, সময় নিচ্ছে। ধীর পায়ে কেউ হাঁটলে তাকে বাইকে চড়ে ফলো করা কঠিন।

মোড়ে গিয়ে ডানদিকের রাস্তাটা ধরলো আভাস। বাইকে স্টার্ট দেয়ার শব্দ শুনলো সে, তবে ঘুরে তাকালো না। লোকটার দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়েই প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করলো সে। বামদিকের প্রথম গলিটাতে ঢুকে দৌড়ের গতি না কমিয়ে প্রথম সুযোগেই ডানদিকের একটা গলিতে ঢুকে পড়লো। পরক্ষণেই ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলো।

একটা ছোট রেস্টুরেন্ট দেখতে পেয়ে ভিতরে ঢুকলো সে। দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে একটা চায়ের অর্ডার দিলো।

মনে মনে হাসলো আভাস। ইংরেজীতে অনুসরণকারীকে বলে ‘টেইল’। তার মানে, ওর একটা ‘লেজ’ গজিয়েছিলো।

অপরাধ জগতের লোকেরা পুলিশের গোয়েন্দাকে বলে ‘টিকটিকি’। নামটা আভাসের কাছে যৌক্তিক মনে হয় না। যে অনুসরণ করে, তাকে কেন টিকটিকি বলা হয়? যাকে অনুসরণ করা হচ্ছে, তাকে টিকটিকি বলা উচিৎ। ও নিজে একটা টিকটিকির মতোই ঝামেলা এড়াতে ‘লেজ’ ফেলে পালিয়েছে।

যারা বাচ্চাটি চুরির সাথে জড়িত (যদি সত্যিই চুরি হয়ে থাকে), তারা জানে আভাস জোবায়দা হসপিটালে খোঁজখবর নিতে যাবে – কারণ, ওখানেই বাচ্চাটি হয়েছে। তারপরও, ওদেরকে যতটা সম্ভব অন্ধকারে রাখতে চায় সে, কখন কী করবে তা জানতে দিতে চায় না।

 (৪)

আভাসের ধারণার চেয়ে জোবায়দা হসপিটাল বড়। প্রথমে ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, হসপিটালের মেডিকেল রেকর্ডস রুমে খোঁজখবর নিবে – ডেলিভারির আগেই বাচ্চাটি মারা গেছে কিনা। পরে ওর মনে হলো, বাচ্চাটির বাবা ছিলেন একজন লইয়ার, কাগজপত্রের কোন অসংগতি থাকলে তিনি ধরে ফেলতেন।

ষোল বছর আগে যেসব নার্স আর আয়া গাইনি বিভাগে কাজ করতো, তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। এত আগের কথা অন্যদের মনে না থাকলেও যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের ঠিকই মনে থাকবে।

হসপিটালের দোতলায় HR (হিউম্যান রিসোর্সেস) বিভাগে ঢুকলো আভাস। দুই টেবিল ঘুরে পৌঁছালো হেডক্লার্ক কেরামত আলির টেবিলে। মাঝবয়সী লোকটির দিকে তাকিয়েই বুঝলো, এর কাছ থেকে কাজ আদায় করতে হলে কেরামতি দেখাতে হবে।

‘আমাকে পাঠিয়েছেন আমার মামা পুলিশের এসপি দেলোয়ার,’ নিজের পরিচয় দিয়ে বললো আভাস। এসপি দেলোয়ার যদিও ওর দূর সম্পর্কের মামা, তিনি ওকে চিনেন কিনা সন্দেহ। ‘পুলিশের এসপি’ কথাটিতে ‘পুলিশ’ শব্দটি দু’বার রয়েছে। তবে, ভুলটা ওর ইচ্ছাকৃত।

‘ষোল বছর আগে আমার এক আন্টির ছেলে হয়েছিলো আপনাদের হসপিটালে,’ বললো আভাস। ‘তখন একজন নার্স আর একজন আয়া অনেক কষ্ট করেছিলো। আন্টি তাদেরকে বখশিশ দিবেন বলেছিলেন, কিন্তু দেয়া হয়নি। হঠাৎ করে আন্টি ঢাকা চলে গেছেন। তাদের মনে নিশ্চয়ই কষ্ট রয়ে গেছে। সামনে সেই ছেলের S.S.C. পরীক্ষা। বুঝতেই পারছেন –’

‘নার্স আর আয়ার নাম মনে আছে?’

‘এখানেই তো মুশকিল। আন্টির মনে নেই, তবে নাম শুনলেই মনে পড়বে।’

প্রথমে পাওয়ার, তারপর ইমোশন – কৌশলটিতে কাজ হলো। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে খুঁজে পাঁচজন নার্স আর তিনজন আয়ার নাম আর মোবাইল নম্বর দিলেন কেরামত আলি। জানালেন, এদের মধ্যে একজন নার্স আর একজন আয়া এখন আর এখানে চাকুরি করে না। লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আভাস গাইনি ওয়ার্ডের দিকে এগোলো।

ছয়জন নার্স-আয়ার প্রত্যেকের সাথে আলাদাভাবে দেখা করে কথা বললো আভাস। এদের মধ্যে একজন নার্স আর একজন আয়াকে সন্দেহের তালিকায় ফেললো সে। এরা হলো নার্স নাসিমা আর আয়া আলেয়া।  

মিসেস আনোয়ারাকে চিনতে পেরেছে নাসিমা। কিন্তু, জোর দিয়ে বলেছে বাচ্চাটা ডেলিভারির আগেই মারা গেছে। একটু বেশিই জোর দিয়েছে সে, ভাবলো আভাস। আর, আলেয়া জানিয়েছে আনোয়ারার কথা মনে নেই, কিন্তু হাবভাবে বোঝা গেছে মিথ্যা বলছে। এই দুইজনের সাথে পরে মোবাইলে কথা বলতে হবে।

চলে যাবার জন্য নিচতলায় নামলো আভাস। হঠাৎ একটা আইডিয়া এলো ওর মাথায়। নাসিমার সাথে আবার দেখা করলো সে।

‘আপনাকে আগে বলা হয়নি,’ বললো সে। ‘আমাকে এই ভাইয়া আপনার কাছে পাঠিয়েছে –’ অনুসরণকারী লোকটার সাথে তোলা সেলফি নাসিমাকে দেখালো সে।

নাসিমা একটু অবাক হলো। বললো, ‘উনি তো সকালে বললেন এক রকম, এখন দেখি আরেক রকম –’

লোকটার সাথে নাসিমার যোগাযোগ আছে!  

‘আমি তাকে কল দিচ্ছি,’ বললো আভাস। মোবাইলে কল দেয়ার ভান করলো সে। তারপর বললো, ‘স্যরি, আমার মোবাইলে তো টাকা নেই।’

‘আমি কল দিচ্ছি,’ বললো নাসিমা। একটু দূরে গিয়ে মোবাইলে কথা বলতে শুরু করলো সে, ‘শরিয়ত ভাই, আপনার সাথে এই ছেলের ছবি দেখলাম?’ আর কিছু না বলে ওপাশের কথা শুনে গেল সে।

লোকটা তাহলে তার আসল নামই বলেছিলো!

‘আমার সাথে চালবাজি করেন?’ মোবাইলে কথা শেষ করে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো নাসিমা। ‘আপনি যান, আর কখনও আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবেন না।’

দ্রুত ওখান থেকে সরে পড়লো আভাস। আলেয়াকে খুঁজে না পেয়ে কল দিলো সে।

‘হ্যালো,’ বললো আলেয়া।

‘আমি আভাস। কিছুক্ষণ আগে আপনার সাথে –’

‘শরিয়ত ভাই আপনার সাথে আর কোন কথা কইতে না করছে।’ কলটা কেটে দিলো আলেয়া।

বাসায় ফিরতে তিনটা বেজে গেল। খাওয়া শেষে কাসেম আর তার স্ত্রীকে শরিয়তের ছবি দেখালো সে, কিন্তু তারা লোকটির পরিচয় বলতে পারলো না।

শেষ বিকেলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অলস সময় কাটাতে চাইলো আভাস। কিন্তু, শরিয়ত, নাসিমা আর আলেয়ার চিন্তা মাথা থেকে যাচ্ছে না। অথচ, সামনে তাকালে ফুলের বাগান, ডানে তাকালে সূর্যাস্ত!

এরা তিনজন কি একই দলে? ‘Unknown 1’ কি এদের মধ্যে কেউ?

‘Unknown 2’ এর কথা হঠাৎ মনে পড়লো আভাসের। কল দিয়ে দেখলো এখনও মোবাইল বন্ধ। এই লোক কেন কল দিয়ে কথা বললো না?

(৫)

সন্ধ্যায় আলেয়াকে কয়েকবার কল করলো আভাস, প্রতিবারই নাম্বারটা ব্যস্ত পাওয়া গেল। সে কি ওর নাম্বারটা ব্লক করে দিয়েছে?

আজ আর নয়, ভাবলো আভাস।

সোয়া সাতটায় ওর মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো। Unknown 2-এর কল!

‘হ্যালো,’ আভাসের কণ্ঠে আগ্রহ।  

ওপাশ থেকে কলটা কেটে দেয়া হলো, যেন ওর কন্ঠ শুনতেই কলটা দেয়া হয়েছে। পরক্ষণেই একটা মেসেজ পেলো সে:

“কাটছে না তো মনের খরা,
চাই যে প্রেমের বৃষ্টি।
আভাস দিলাম, দাওনি ধরা –
দেখতে কি নই মিষ্টি?”

ঘটনা তাহলে এই, ভাবলো আভাস। একজন সিক্রেট অ্যাডমায়ারার!

মেয়েটা কে? নাকি কোনও ছেলে তামাশা করছে? একবার কল দিতে গেয়েও দিলো না আভাস। এখন নয়।

ডিপার্টমেন্টের মেয়েদের মধ্যে অনেকেই আভাসকে পছন্দ করে। ও যে খুব হ্যানসাম তা নয়। কিন্তু, খুব কম ছেলেই বুদ্ধি আর সাহসে ওর সমকক্ষ।

পাঁচজন মেয়ে আকারে ইঙ্গিতে ওকে পছন্দের কথা জানিয়েছে – দু’জন ওর ব্যাচের, বাকি তিনজন থার্ড ইয়ারের।

কিন্তু, এরা কেউ তো ছড়া-কবিতা লেখে না, ভাবলো আভাস। তাহলে কি কবিতাটা বই বা ইন্টারনেট থেকে নেয়া? সম্ভাবনা কম, কারণ ওর নাম এখানে সুকৌশলে ব্যবহার করা হয়েছে।

পাঁচজন মেয়ের মধ্যে তিনজন আভাসের পছন্দের তালিকায় রয়েছে: ওর ব্যাচের রাইসা, থার্ড ইয়ারের কবিতা আর শিউলি। এদের মধ্যে কবিতা রূপে সেরা। কিন্তু, নাম কবিতা হলেও একে দিয়ে কবিতা হবে না।

রাইসা আর শিউলি রূপে পিছিয়ে থাকলেও গুনে এগিয়ে। এরা দু’জন গোপনে কাব্য-চর্চা করে শুনলে আভাস অবাক হবে না। তবে, কবিতাটা শিউলি লিখেছে তার সম্ভাবনা বেশি, ভাবলো ও।   

রাত নয়টায় অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে কল এলো আভাসের মোবাইলে।

‘হ্যালো।’

‘আমি আলেয়া। আপনে এই নাম্বারে কল দেন।’ কলটা কেটে দিলো সে।

আভাসের হার্টবিট বেড়ে গেছে। নিশ্চয়ই শরিয়তের ভয়ে আলেয়া অন্য নাম্বার থেকে কল দিয়েছে। দ্রুত কলব্যাক করলো সে।

‘আনোয়ারা আপারে মেসেজটা আমিই দিছিলাম,’ বললো আলেয়া। ‘আর কোনও যোগাযোগ করতে পারি নাই।’

‘কেন পারেন নাই?’ জানতে চাইলো আভাস।

‘শরিয়ত ভাই সিমটা নিয়া নিছে। এখন কাজের কথা কন। একজন তো বাচ্চার খবর দিলে বিশ হাজার টাকা দেবে বলছে –’

‘কোন্ লোক?’

‘এইটা তো কওয়া যাইবো না। আপনেরা কী করবেন কন।’

‘বাচ্চাটা কোথায় আছে?’

‘মনে করছেন জানি না? টাকার কথা কন, নাইলে ফোন রাখলাম।’

‘সামনা-সামনি কথা বলি? কোথায় আসতে হবে বলেন।’

‘বার বার দেখা করা যাইবো না। আগে ফোনে কথা ফাইনাল করেন।’

‘কত টাকা চান আপনি?’ আভাসের প্রশ্ন।

‘পঞ্চাশ হাজার।’

মিসেস আনোয়ারার কাছে এটা কোনও টাকাই নয়। তবে, দরদাম না করলে আলেয়া ভাবতে পারে আরও টাকা বের করা যাবে।

‘ঐ লোক তো বিশ বলেছে। আমার কাছে এত চান কেন? ত্রিশ হাজার দেই?’

‘না, কম দিলে হইবো না। পঞ্চাশ হাজার দিলে আর কখনও কিছু চামু না।’

একটু খটকা লাগলো আভাসের। আর কখনও কিছু চাইবে না! এর মানে কী?

অন্য কোন্ লোক বাচ্চার খবর চায়?

‘ঠিক আছে,’ বললো সে। ‘পঞ্চাশ হাজারই পাবেন। কখন কোথায় টাকাটা নিয়ে যাবো বলুন।’

‘কাইল রাত আটটায়। টিকাপাড়া বটতলার মোড়। বটগাছটার নিচেই আমি থাকুম।’

‘এবার বলুন তো, অন্য কোন্ লোক বাচ্চার খবর চায়?’ আভাসের প্রশ্ন।

‘টাকা পাওয়ার পরে কমু।’

‘শরিয়ত?’

‘আরে সে তো দিলারা আপার ভাই। আমি রাখলাম।’

‘এটা কি আপনার নাম্বার?’

‘না। একটা দোকান থেইকা ফোন দিছি। আমারে ফোন দিয়েন না। কাইল সময় মতো চইলা আইসেন।’

আনোয়ারা আন্টিকে ফোন দিলো আভাস।

‘আপনি কি আমার পাশাপাশি অন্য কাউকে বাচ্চাটা খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছেন?’

‘না তো! আর কাউকে দায়িত্ব দিলে তো তোমাকে বলতাম। কেন?’

‘শিওর হলাম। বলার মত কিছু হলে পরে বলবো।’

‘ও.কে.।’

কথা শেষ করে আভাসের মনে হলো দিলারার কথা তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। কে এই ‘দিলারা আপা’? কাল জানা যাবে।  

(৬)

পরদিন সকালে নাস্তা শেষ করে আভাস কাসেমকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘মামা, দিলারা নামের কাউকে চিনেন?’

কিছুক্ষণ চিন্তা করলো কাসেম। তারপর বললো, ‘আমার তো একজন দিলারার কথাই মনে আছে। বজ্জাত মহিলা। আনোয়ারা আপার ঘর ভাঙছে।’

‘মানে?’ আভাসের যেন আরও দু’টো কান গজালো।

‘আপার তো প্রথমে এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে বিয়া হইছিলো, নাম রাশেদ। মানুষটা খারাপ আছিলো না, কিন্তু বিয়ার বছর খানেক পর এই দিলারার খপ্পরে পড়লো। আপা তারে তালাক দিয়া উকিল সাহেবরে বিয়া করলো। দিলারা বিয়া করলো রাশেদরে।’

‘আনোয়ারা আন্টির সাথে দিলারার নিশ্চয়ই অনেক গন্ডগোল হয়েছিলো?’

‘তা হইবো না! একদিন দিলারার সাথে দেখা কইরা আপা তারে কয়েকটা চড়-থাপ্পড় দিছিলো।’

দিলারা কি পুরানো শত্রুতা আজও ভোলেনি?

আনোয়ারা আন্টিকে কল দিলো আভাস। প্রথম বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই আনোয়ারা বললেন, ‘আমার প্রথম বিয়ের সাথে তোমার কাজের সম্পর্ক কী?’

দিলারার কথা জানিয়ে আভাস বললো, ‘ইনি তো আমার কাজে বাধা দিচ্ছেন।’

‘কেন?’

‘তা তো জানি না। ডিভোর্সের কতদিন পর আপনি আবার বিয়ে করেছেন?’

‘তিন মাসেরও বেশি পরে।’

বাচ্চাটা তো তাহলে রাশেদের নয়, ভাবলো আভাস। দিলারা তাহলে কী চায়?

রাত সাড়ে সাতটায় টিকাপাড়া বটতলার মোড়ে পৌঁছালো আভাস। নির্জন এলাকা। হাতে সময় আছে বলে কিছুটা এগিয়ে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসলো।

দু’কাপ চা খেয়ে সাতটা পঞ্চাশে বটগাছটির দিকে এগোতে শুরু করলো সে।

আভাসের চোখের সামনে ঘটনাটি ঘটলো। বটগাছের আড়াল থেকে উদভ্রান্তের মতো ছুটে বের হলো আলেয়া। রাস্তায় উঠেই একটা ছুটন্ত পিকআপের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে গেল সে। পিকআপটি পালালো। দৌড়ে আলেয়ার দিকে এগোলো আভাস।

বাইকে স্টার্ট দেয়ার শব্দ শোনা গেল। বটগাছের আড়াল থেকে ডানদিকের রাস্তাটা ধরে চলে গেল সেটা। শব্দ শুনে আভাস বুঝতে পারলো, এটা শরিয়তের বাইক নয়।

মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে আলেয়া, প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে হাসপাতালে নেয়া পর্যন্ত টিকবে না।

আশেপাশে কোন রিকশা বা গাড়ি চোখে পড়ছে না। চায়ের দোকানদারকে ছুটে আসতে দেখে আভাস চিৎকার করে অ্যাম্বুলেন্স কল করতে বললো।

‘আজাদরে দেইখা ভয় পাইছি,’ দুর্বল কন্ঠে বললো আলেয়া।

‘কে সে?’

‘উকিল সাহেবের ভাই … বিশ হাজার দিতে চাইছে … আমার টাকা দিবেন তো?’

‘অবশ্যই,’ বললো আভাস। ‘কার হাতে দিবো টাকাটা?’

‘আমার ছেলেরে, হেলাল নাম … মোবাইলে আছে …’

হাত বাড়িয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা আলেয়ার মোবাইলটা তুলে নিলো আভাস। বললো, ‘বাচ্চাটা কোথায়?’

‘রংপুর –’

নিস্তেজ হয়ে গেল আলেয়া।

আভাস আর চায়ের দোকানদার মিলে তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার বললেন, ‘স্যরি।’

বাসায় ফিরে আলেয়ার মোবাইলটা চেক করলো আভাস। কিন্তু, আজাদের মোবাইল নাম্বার ছাড়া কাজে লাগার মতো আর কোন তথ্য পেলো না।  

(৭)

পরদিন সকালে জোবায়দা হসপিটালে গিয়ে নাসিমার সাথে দেখা করলো আভাস। কিন্তু, তার বক্তব্যে কোনও পরিবর্তন ঘটানো গেল না।

‘আমি কিন্তু জানি, রংপুরে এক লোকের কাছে বাচ্চাটা বড় হচ্ছে,’ বললো আভাস। ‘আগামী বছর ছেলেটা এসএসসি দিবে।’

নাসিমার চোখে একটু ভয় দেখা গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে সে বললো, ‘আপনি যদি জানেনই, তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?’

‘বিস্তারিত ঠিকানার জন্য,’ বললো আভাস।

‘আমি যা জানি, আপনাকে বলেছি।’

‘তাহলে পুলিশে খবর দেই? পুলিশ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু বের করে ফেলতে পারবে।’

‘ইচ্ছে হলে খবর দেন। দেখবেন তাতে কার লাভ, কার ক্ষতি?’

এবার টাকা অফার করলো আভাস। বললো, ‘পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়া হবে, আপনি শুধু ঠিকানাটা দিন। আনোয়ারা আন্টি তো ঢাকায় থাকেন। ছেলেটা রংপুর থেকে ঢাকা গেলে শরিয়ত ভাই জানবে না।’

রেগে গেল নাসিমা। বললো, ‘আপনার ধারণা শরিয়ত ভাইয়ের ভয়ে আমি এসব করছি? সে তো দূরের কথা, পুলিশ আর আর্মি দিয়া মার খাওয়ান, লাখ টাকা দেন – আমি বেঈমানি করবো না।’

‘কার সাথে বেঈমানি?’

‘যে আমার উপকার করছে, আমার স্বামীরে বাঁচাইছে –’

‘কে সে?’

সতর্ক হয়ে গেল নাসিমা। বললো, ‘আপনার কী দরকার?’

কোন কাজ হবে না বুঝতে পেরে চলে এলো আভাস। দিনটা সে পার করলো দিলারা, রাশেদ আর আজাদ সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে। তিনজনকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেলো সে। কোনও অসুবিধায় পড়তে হয়নি, কারণ তিনজনের কেউ ওর চেহারা চিনে না।

শরিয়তকে প্রথম দিনের পরে আর দেখেনি সে।

বিকেলে আলেয়ার মোবাইল থেকে নাম্বার নিয়ে হেলালকে কল করলো আভাস। জানালো, ‘তোমার মায়ের মোবাইল আর পাওনা পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে আমি আসছি।’

রিকশায় যাওয়ার পথে হঠাৎ আভাসের মনে হলো, আলেয়ার মোবাইলটা আবার চেক করা দরকার। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ রংপুরের একটা ঠিকানা পাওয়া গেল। আলেয়া নিজেকে নিজে এসএমএস করেছে:

দেলোয়ার আহমেদ
৬৭, হারাগাছ লেন
বাবুপাড়া
রংপুর।

ঠিকানাটা নিজের মোবাইলে সেইভ করে আলেয়ার মোবাইল থেকে ডিলিট করে দিলো আভাস। বাচ্চাটার সাথে সম্পর্কিত আর কোন কিছু মোবাইলে পাওয়া গেল না। হেলালকে টাকা আর মোবাইলটা দিয়ে বাসায় ফিরলো সে।   

রাত আটটায় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় ফুলবাগানটা দেখার সময় Unknown 2-এর দ্বিতীয় মেসেজটা পেলো আভাস: “কবিতাটা কি পাওনি?”

দু’দিনেও কোন উত্তর না দেয়ায় Unknown 2 চিন্তায় পড়েছে, ভাবলো আভাস।

সেদিন রাত বারোটার বাসে রংপুর রওয়ানা হলো আভাস। কাসেম আর তার স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেল, কারণ ওর ধারণা রাজশাহীতে আর আসতে হবে না।

(৮)

পরদিন সকালে বাস থেকে নেমে তাজহাট রোডে তরুছায়া গেস্টহাউজ-এ উঠলো আভাস। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে নয়টায় বের হলো বাবুপাড়ার উদ্দেশ্যে।

৬৭, হারাগাছ লেন খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না। হলুদরঙা দোতলা বাড়িটার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো আভাস। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।

রাস্তা পার হয়ে একটু এগিয়ে একটা স্টেশনারি দোকানের সামনে দাঁড়ালো সে। দরকার নেই, তবু একটা কলম কিনলো। আলাপ শুরু করলো দোকানির সাথে।

‘ঐ হলুদ বাড়িটা দেলোয়ার সাহেবের না?’

‘হ্যাঁ। আপনি?’

‘আমি কিছুদিন এই এলাকায় ছিলাম। দেলোয়ার সাহেবের একটা ছেলে আছে না, কী যেন নাম?’

‘হ্যাঁ, রুদ্র।’

‘অনেকদিন তো দেখি না। কোন্ ক্লাসে পড়ে এখন?’

‘মেট্রিক পাশ করলো এবার। এখনও কলেজে ভর্তি হয়নি।’

‘ওর তো কোনও ভাই-বোন নেই, তাই না?’

‘না। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।’

বাড়িটি থেকে একটা ছেলেকে বের হতে দেখা গেল। দোকানিকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেল আভাস। ইঞ্জিনিয়ার রাশেদের সাথে ছেলেটির চেহারার দারুন মিল!

রহস্যের জট খুলে গেছে।

‘তুমি রুদ্র না?’ হাসিমুখে বললো সে।

‘হ্যাঁ। কিন্তু, আপনি?’

‘আমাকে চিনবে না। আমার নাম আভাস। তোমাকে ছোটবেলায় দেখেছি। কত বড় হয়ে গেছো! এসো একটা সেলফি তুলি।’

দ্রুত ছেলেটার সাথে কয়েকটা সেলফি তুললো আভাস। পনেরো সেকেন্ডের একটা ভিডিও করলো। কয়েকটা সিংগেল ছবিও তুললো।

রুদ্রকে ধন্যবাদ জানিয়ে গেস্টহাউজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো সে। পথে একটা সিম কার্ড কিনলো।

বিকেলে রংপুর থেকে বাসে করে সৈয়দপুর গেল আভাস। সেখান থেকে প্লেনে ঢাকা পৌঁছালো রাত আটটায়।

এয়ারপোর্ট থেকে উবারে বাসায় যাওয়ার পথে নতুন সিমটি ব্যবহার করে অ্যাডভোকেট আজিমের ভাই আজাদকে একটা মেসেজ পাঠালো আভাস:

“আপনি আলেয়াকে ধাক্কা মেরে পিক-আপের নিচে ফেলে দিয়েছেন। সে মারা যাওয়ার আগে আপনার নাম বলে গেছে। আমার কাছে তার বক্তব্যের রেকর্ড আছে। এটা সত্যি যে, আলেয়া টাকার লোভে আপনাকে মিথ্যা বলেছিলো। বলেছিলো যে, বাচ্চাটা বেঁচে আছে। তাই বলে আপনি তাকে মেরে ফেলবেন? আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আলেয়ার ছেলে হেলালকে এক লাখ টাকা দিবেন। নইলে রেকর্ডটা পুলিশকে দেয়া হবে।”

মেসেজটা পাঠিয়েই সিমটা খুলে রাখলো আভাস। আজাদের সাথে কোনও যোগাযোগ শুরু করতে চায় না সে। হেলালকে টাকা দিক বা না দিক, লোকটা টেনশনে থাকবে। সেটাই ওর মূল উদ্দেশ্য।

এরপর আভাস ওর রেগুলার নাম্বার থেকে Unknown 2-কে একটা মেসেজ পাঠালো:

“দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ বইতে বলেছেন, আদর্শ জগত থেকে বাস্তব জগত আলাদা, আবার বাস্তব জগত থেকে কবিদের কল্পনার জগত আলাদা। তাই, প্লেটো আদর্শ জগতের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেখানে কবিদের ঠাঁই নেই।”

পনেরো মিনিটের মধ্যে উত্তর পেলো সে:

“প্লেটোর আদর্শ জগত হলো তাঁর কল্পনার ফসল। সেই হিসেবে, ‘রিপাবলিক’ বইটি একটি গদ্যকবিতা। অর্থাৎ, প্লেটো একটা কবিতা লিখেছেন, যে কবিতায় কবিতাকে নির্বাসন দেয়া হয়েছে। অনেকে যেমন দেয়ালে পোস্টার লাগায়, যেখানে লেখা থাকে ‘দেয়ালে পোস্টার লাগাবেন না’।

আমি জানতাম না, আপনি কবিতা এত অপছন্দ করেন। আমার প্রাত্যহিক জীবনের একটা বড় অংশই যেহেতু আপনার অপছন্দ, আমাদের কোনও ভবিষ্যত নেই। আমি আমার অফার ফিরিয়ে নিচ্ছি।”

(৯)

আভাস কলিংবেল বাজাতেই মিসেস আনোয়ারা দরজা খুললেন। ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তিনি।

‘কী খবর?’ উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলেন তিনি। আভাসের মুখোমুখি বসলেন।

‘খবর একই সাথে ভালো এবং খারাপ।’

‘তার মানে?’

‘আপনার ছেলে বেঁচে আছে। ওর নাম রুদ্র। তবে, ওর বর্তমান পরিচয় গোপন রাখা আপনার জন্য খুবই জরুরী।’

আনোয়ারা বোকার মত তাকিয়ে রইলেন।

‘আপনি তো আমাকে সব কথা বলেননি। প্রথম স্বামীকে ছেড়ে আসার মাসখানেক পরেই আপনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। আমার ধারণা, আপনার ডিভোর্সটা ব্যাকডেটে করা, যাতে তিন মাস অপেক্ষা করার নিয়মটা কাগজে কলমে ঠিক থাকে। আজিম আংকেল জানতেন না আপনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন।’

‘তুমি কেন ধরে নিচ্ছো সে জানতো না? আমি প্রেগন্যান্ট জানার পরেও তো সে আমাকে বিয়ে করে থাকতে পারে।’

‘একজন ঝানু লইয়ার কখনই এটা করবে না। আপনি প্রেগন্যান্ট থাকার ফলে ডেলিভারির আগ পর্যন্ত প্রথম স্বামীর সাথে আপনার ডিভোর্স কার্যকরী হয়নি। সেই অবস্থায় আপনি আবার বিয়ে করায় দ্বিতীয় বিয়েটা অবৈধ। এর মানে বুঝতে পারছেন? আপনাদের দুই সন্তান সাগর আর নীলাও অবৈধ।’

‘মাই গড!’

‘একটা সুবিধার দিক হলো, কোর্টে কেউ এসব প্রমাণ করতে পারবে না, যতক্ষণ আপনার প্রথম সন্তানকে না পাবে। এই কারণেই, আজিম আংকেল যখন টের পেলেন বাচ্চাটা রাশেদের, আপনাকে না জানিয়ে বাচ্চাটা এক নি:সন্তান দম্পতিকে দিয়েছেন। নার্স নাসিমা আর আয়া আলেয়া এ কাজে তাকে সাহায্য করেছেন।’

আনোয়ারার চোখে বিস্ময় ও বেদনা।

‘আপনাকে নিশ্চয়ই পুরো অজ্ঞান করে সিজার করা হয়েছিলো?’ জিজ্ঞেস করলো আভাস।

‘হ্যাঁ। কিন্তু, একটা মরা বাচ্চা নিশ্চয়ই দরকার হয়েছিলো? কোথায় পেলো?’

‘আমার ধারণা, কোনও মরা বাচ্চা ব্যবহার করা হয়নি। একজন বুদ্ধিমান লোক এ কাজ করবে না, কারণ ডিএনএ টেস্ট করলেই ধরা পড়বে বাচ্চাটা আপনাদের নয়। আমার ধারণা, কবরটা ফাঁকা।’

‘কেউ যদি চেক করে দেখে কবরটা ফাঁকা? প্রমাণ হয়ে যাবে না আসল বাচ্চা বেঁচে আছে?’

‘মোটেই না। উল্টো দাবি করা যাবে কেউ লাশটা সরিয়েছে।’

‘আজিম কি বাচ্চাটা হওয়ার পর আমাকে আবার বিয়ে করতে পারতো না?’ বিষণ্ন কণ্ঠে বললেন আনোয়ারা।

‘তাহলে সমাজ আর আইনের চোখে আপনারা ব্যভিচারী হতেন। সবার হাসির পাত্র হতেন।’

‘আমি তো বাচ্চাটা নষ্ট করতে চাইনি –’

চুপ করে রইলো আভাস। পেটের সন্তান আর পছন্দের মানুষ – দুই দিক ঠিক রাখতে গিয়ে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে!

‘আপনার দেবর আজাদ তো রুদ্রের খোঁজ বের করতে পাগল হয়ে গেছে,’ বললো আভাস। ‘সাগর আর নীলাকে অবৈধ প্রমাণ করতে চায়।’

‘তার লাভ কী?’

‘অবৈধ সন্তান তো বাবার সম্পত্তি পায় না। আংকেলের একমাত্র ভাই হিসেবে সব সম্পত্তির মালিক হবে আজাদ।’

‘মাই গড। সে যদি এখন রুদ্রের খোঁজ বের করে ফেলে?’  

‘আমি ছাড়া তার খোঁজ জানে শুধু নাসিমা। আর একজন জানতো, আলেয়া, সে মারা গেছে। নাসিমার কাছ থেকে খোঁজ বের করবে, এমন সাধ্য কারও নাই। আজিম আংকেল তার অনেক উপকার করেছেন বলে সে এই কাজে সাহায্য করেছে। মরে গেলেও বেঈমানি করবে না।’

‘দিলারার ভূমিকাটা কী?’

‘রুদ্র রাশেদের বৈধ সন্তান। তার পরিচয় প্রকাশ পেলে সে রাশেদের সম্পত্তির অংশ পাবে। তাই দিলারা আর তার ভাই শরিয়ত নাসিমাকে সাহায্য করেছে। আলেয়া টাকার লোভ করতো, কিন্তু মিথ্যা বলতে পারতো না। নাসিমা কিছু টের পেলেই শরিয়তের সাহায্য নিতো। আপনাকে আলেয়া মেসেজ দেয়ার পর শরিয়ত তার সিম নিয়ে নিয়েছিলো –’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন আনোয়ারা। হঠাৎ বললেন, ‘রুদ্রকে এক নজর দেখতে ইচ্ছে করছে।’

‘আমার কাছে ওর ভিডিও আর ছবি আছে।’

‘আগে বলোনি কেন?’

ছেলের ছবি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন আনোয়ারা।

(১০)

পরদিন সকালে শিউলিকে কল দিলো আভাস।

‘হ্যালো,’ মেয়েটির কণ্ঠে নির্লিপ্ততা।

‘তোমার সাথে দেখা করা দরকার।’

‘কেন?’

‘কবিতা নিয়ে আলোচনা করবো।’

‘আপনি তো কবিতা পছন্দ করেন না,’ বললো শিউলি।

হাসিতে ফেটে পড়লো আভাস।

‘আমার মেসেজটা ছিল একটা ট্রিক,’ বললো সে। ‘তুমি কীভাবে জানো, আমি কবিতা পছন্দ করি না? এখন বোঝা গেল, ছড়াটা তুমিই লিখেছো।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো শিউলি। তারপর হেসে বললো, ‘ভালোই ট্রিক্‌স্‌ শিখেছেন।’

(শেষ)

IMG 6678

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪