fbpx

ব্লাড (শেষ পর্ব)

১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

(৮)

-ইন্সপেক্টর রাকিব?

-জি স্যার।

-আরেকটা খুন। কারওয়ান বাজারে চলে আসুন। এক্ষুনি!

-কিন্তু স্যার আমার মেয়ের অবস্থা তো জানেন।

-উহু, কিছু শুনতে চাই না আর। এই মুহূর্তে আপনাকে লাগবে।

ডেপুটি ইন্সপেক্টর কামাল হোসেন বেশ কড়া মেজাজের মানুষ। রাকিব ফোন রেখে দিয়েই রক্তের ব্যাগ সিস্টার এর হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেল হাসপাতাল থেকে। বের হবার আগে শ্রাবণীর কাছে গিয়ে আরেকটা বার দেখার সময়ও পেল না।

রাকিব গাড়ি করে এগোতে থাকে আর তার বারবার শ্রাবণীর কথা মনে হতে থাকে। ওর মুখটা তার চোখে ভাসতে থাকে। মেয়ের এতটা কষ্টের সময়েও মেয়ের পাশ ছেড়ে তাকে চলে আসতে হয়েছে। যদি সে পারতো এসব কিছু ছেড়েছুড়ে মেয়ের পাশে গিয়ে বসে থাকতে! মেয়ের হাত নিজের হাতে নিয়ে তাকে যদি বলতে পারতো, এই তো বাবা আছি। ভয় কিসের? কিচ্ছু হবে না। তার মনে প্রায়ই প্রশ্ন জাগে তার ভেতর যে মেয়ের প্রতি কতটা ভালোবাসা আছে তা কি শ্রাবণী কখনো বুঝবে? সে তো দেখছে তার বাবা তাকে ফেলে রেখে তার সবচেয়ে কষ্টের সময়েও চলে যাচ্ছে। দেশের ঋণ শোধ করলেও মেয়ের কাছে যে ঋণী হয়ে গেল। মেয়ে কি কখনো মাফ করবে? হয়ত। ভাবতে ভাবতেই তার চোখে পানি চলে আসে। একজন ভাল ইন্সপেক্টর হতে পারলেও একজন ভাল বাবা আর হয়ে উঠা হলো না। জীবনের কাছে আমরা বেশ নিরুপায়।

হঠাৎ করে রাকিবের মনে পড়লো যে লোকটা তাকে রক্তের ব্যাগ ধরিয়ে দেয় তার ভেতরের কোন বিষয়টা তার চেনা। গন্ধ। যে গন্ধটা সে জামার ভেতরেও পেয়েছিল! সাথে সাথে রাকিব জোরে বলে উঠলো ড্রাইভার গাড়ি ঘুরাও। হাসপাতাল যাব। ফাস্ট।

(৯)

ফজলুর সাহেব থানায় বসে আছেন। তার মাঝে মোটেও চিন্তার রেখা নেই। বেশ আরাম করে মুখে পান নিয়ে চিবুচ্ছেন আর সাথে সাথে দাঁত এর ফাঁকে টুথপিক দিয়ে খুঁচিয়ে যাচ্ছেন। রাত্রি তখন সাড়ে বারো। সাধারণত এসময় তিনি কাজে থাকেন না। তবে আজকে থাকতে হচ্ছে। হঠাৎ করে টেলিফোন বেজে উঠল।

-ফজলুর সাহেব?

-জে স্যার, বলেন।

-এক্ষুনি একটা গাড়ি নিয়ে চলে আসেন আমার মেয়ে যে হাসপাতালে আছে সেটায়। আর কোন প্রশ্ন করবেন না। আমাদের হাতে সময় নেই।

-স্যার এহুনি আইয়া পড়তাসি। খুনি শালায় কি ধরা পড়সে স্যার?

-না। আপাতত আরো কিছু পুলিশের লোক লাগবে। এখুনি জোগাড় করে তাদেরকে হাসপাতালের আশেপাশের রাস্তাগুলোয় পাহারা দিতে বলবেন। আমি প্রতিটা লোকের তল্লাশি চাই। যারা যারা ঐ রাস্তা দিয়ে যাবে তাদের প্রত্যেকের। ইচ এন্ড এভরিওয়ান।

-স্যার, সব ব্যবস্থা হইয়া জাইব। ধইরা লন খুনি শালায় আইজকা শেষ।

ফজলুর সাহেবের কথা শেষ করার আগেই ফোন কেটে দেয় রাকিব।

রাকিব এক দৌড়ে হাসপাতালের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে লিফটে উঠে পড়ে। লিফট যত উপরে উঠতে থাকে ততই তার ভেতরে হৃৎস্পন্দন বাড়তে থাকে। এর আগে যতগুলি কেস সে সলভ করেছে কোনটাই এমন মানসিক বিকারগ্রস্ত খুনির বিপরীতে না। লিফট এসে থামতেই দ্রুত এগিয়ে যায় সে জায়গায় যেখানে সে বসে ছিল। নাহ। কোথাও সেই লোক নেই।

-সিস্টার, কিছুক্ষণ আগে ঠিক এই জায়গাটায় যে লোকটা বসে ছিল সে কোথায় গেছে দেখেছেন?

-কোন লোকের কথা বলছেন? আপনাদের আত্মীয় যিনি?

-আত্মীয় মানে?

-উনি তো বললেন আপনাদের আত্মীয় হন। সেজন্য রক্ত দিয়ে গেছেন। আপনি যাবার পর তো উনি আপনার মেয়ের রুমে তাকে দেখতেও গেলেন।

রাকিবের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে যেন। সে প্রায় পাগলের মত ছুটে যাচ্ছে মেয়ের কেবিনের দিকে। কপাল থেকে ঘাম ঝড়ছে। নাহ, মেয়েকে এভাবে ফেলে যাওয়াই উচিত হয় নি। তার হৃৎস্পন্দন আরও বেড়ে গেছে। তার হাত কাঁপছে রীতিমত। সে দরজার হাতলে হাত রাখল। আরেক হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে রিভলবার।

(১০)

-স্যার কামডা কি ঠিক হইতাসে?

-আপনার কি ভয় লাগছে ফজলুর সাহেব? ভয় লাগলে আপনি চলে যেতে পারেন। আমি একাই পারব।

-না না স্যার, কী জে কন! পুরাডা জীবন কত বদজাত ধইরা ধইরা খালাস করসি। এইডা তো বাইচ্চা পুলা। কিন্তু খালি আমরা দুইজন মিল্লাই আইসা পড়নটা কি ঠিক হইতাসে?

-বেশি জন নিয়ে আসলে সে টের পেয়ে যেত। আজকের সুযোগটা মিস করতে চাই না।

-কিন্তু শালার মাথাডা সমইস্যাটা কী? কবরের উপ্রে কী করতাসে এইসব? লগে জিন লাগে নাই তো আবার?

-চুপ করে থাকেন ফজলুর সাহেব। আমাদের পারফেক্ট মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

রবিন হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখছে তার বোনের কবর। তার চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। চারিদিকে নীরবতা। শুধু কিছু ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনা যাচ্ছে। সেই ডাকের মাঝে কিছু সময় পর পর শুনা যাচ্ছে রবিনের ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠার শব্দ। জানস বইন? আইজও একটারে মাইরা আইসি। কিন্তু আইজ রক্ত আর তোর লেইগা আনলাম না। রবিন বেশ বড় করে এক নিঃশ্বাস ফেলল। আয় দেখি তোর মাথায় হাত বুলায় দেই। রবিন তারপর উঠে গিয়ে কবরের এক পাশে সরে হাত বুলাতে লাগল। ক্যান আইজকা রক্ত তোর লেইগা আনি নাই জিগাবি না? না, তুই ক্যান জিগাবি? তোর তো আমার উপ্রে রাগ। রাগ তো থাকবই। আমি সময় থাকতে তোর লেইগা রক্ত আইনা দিতে পারলে আইজকা কি আর তুই এহানে হুইয়া থাকতি? তুই থাকতি আমার লগে মাটির উপ্রে। রবিন আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। তার চোখ বেয়ে জল পড়তেই থাকে।

যেন পুরো কবরস্থান কেঁদে উঠছে এক ভাইয়ের আর্তনাদের সাথে সাথে। বারবার সে মাথা ঠেকিয়ে আফসোস করে যাচ্ছে। কিন্তু সময়কে ফিরিয়ে আনে কার সাধ্য? জীবনের বিনিময়েও না, রক্তের বিনিময়েও না। তোর জইন্নে আবার রক্ত আনমু নে বইন। চিন্তা করিস না। রবিন হুট করে মাথায় যেন কিসের স্পর্শ পায়।

-হ্যান্ডস আপ, মিস্টার রবিন। আমি ইন্সপেক্টর রাকিব। কোন চালাকি করতে গেলেই গুলি। এমনিতেও এতগুলি খুন করার পর তোমাকে মরতেই হবে। তাই এটাই ভাল হয় চুপচাপ আত্মসমর্পণ কর। তোমার সাহস আছে বলতেই হয়। আমার নাকের ডগায় এসে পার পেয়ে গেলে। কিন্তু আর নাহ!

-আমারে মারবেন? আমারে? রবিন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। রাতের নীরবতা ভেদ করে সেই হাসি বিকট শুনায়।

-তোমার কি মনে হয়? এসব করে পার পাবে? তোমার কি মনে হয় আমরা জানি না সামনে থাকা কবরটা তোমার বোনের? আমরা জানি না যে প্রতিবার খুন করে তুমি এইখানেই আসো? রিয়া নাম, রাইট?

-আমার বইন দিয়া কী করবেন? নিজের মাইয়ার কাসে জান। তারে তো রুমের ভিত্রে গিয়া দেইখা আইসি। দেখতে ভালাই। রবিন আবার হাসিতে ফেটে পড়ে।

-আর না, তোর মত জানোয়ারকে সাথে করে নেয়ার কোন মানে নাই। এখনই শেষ করব। কিছু বলার থাকলে বল মরার আগে।

-শেষ হওন কী? শরীরের ভিত্রের মাংসের পচন ধইরা যাওন? রগে রগে ছুইটা চলা রক্ত থাইমা যাওন? শুধু এইগুলান-ই?
রাকিবের বেশ অদ্ভুত শুনায় কথাগুলি। সে স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকে।

-মনের পচন ধইরা গেলে মরণ আরও আগে আসে। এই কথা বলে রবিন মাটিতে কয়েক বার থু দেয়। আশেপাশের জাগো আপনে হাঁইটা চইলা যাইতে দেখতাসেন সব লাশ। ওইগুলার মন পইচা গেসে বহু আগে। আমার বইনরে কি ঐ কুত্তাগুলা রক্ত দিয়া বাঁচাইতে পারত না? দিসে? আমি খুনি হইলে অইগুলাও খুনি।

রাকিব কিছু বুঝে উঠার আগে রবিন পকেট থেকে এক ব্লেড বের করে নিজের হাতের রগ নিজেই কেটে ফেলে। রক্ত ফিনকি দিয়ে বইতে শুরু করে। রবিন চিৎকার করে উঠে। তবে সে চিৎকারের মাঝে শুধু কষ্ট নিহিত থাকে না। যেন প্রচণ্ড রকম হিংস্রতা গ্রাস করতে থাকে তাকে। নিজের রক্ত নিজের গায়ে মেখে হাসতে থাকে সে। রাকিবের পক্ষে আর সহ্য হয়না। রিভলবারে চাপ পড়ে। রবিনের দেহ রিয়ার কবরের উপরে ধুপ করে পড়ে যায়।

(১১)

-কীরে মা! মুখ দেখি পুরো শুকিয়ে গেছে। কেমন আছিস এখন?

-বাবা, তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলে কেন?

-আমার কাজটাই এমন মা। রাকিব মুখে কিছুটা কষ্ট নিয়েই এক হাসি এনে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

-বাবা, তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

-খুব পচা এক মানুষকে ধরতে। যাকে মেরে তোমার বাবা এখন দেশের হিরো। এই কথা বলে পাশে থাকা ডাক্তার মুচকি হাসি দিয়ে উঠে।

-আরেহ না, কী যে বলেন! আপনাকে ধন্যবাদ আমার মেয়ের এত দেখাশুনা করে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত তাকে সময় দেয়ার জন্য।

-এতো আমার দায়িত্ব ইন্সপেক্টর সাহেব। বাই দা ওয়ে সময় মত রক্ত পাওয়ায় বাঁচানো গেছে। ভাগ্যিস জোগাড় করতে পেরেছিলেন আপনি। নাহলে কিন্তু সিচুয়েশন আর আমার হাতে থাকতো না।

রাকিব রিমোট হাতে নেয়। “অবশেষে গত এক সপ্তাহের মাঝে জোড়া খুনের আসামি পুলিশের হাতে নিহত। দেখে নিন এই নরপশুর চেহারা। তাকে সবাই রবিন নামেই চিনে। শিমুলপাড়া আর কারওয়ানবাজারে খুন করার পর শেষমেষ এই মানুষরূপী পশু ধরাশায়ী। বিস্তারিত খবর জানতে পারবেন পরবর্তীতে।” খুব বড় এক নিঃশ্বাস ফেলে রাকিব টিভি অফ করে দেয়। তারপর মেয়ের দিকে তাকায়। তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মেয়ের হাসি দেখতে পায়। কী মিষ্টি করে হাসে!

রাকিব জানলায় এসে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার মাথায় পশু শব্দটা ঘুরপাক খেতে থাকে। সে খুব একটা সিগারেট খায় না। তবে আজ অনেকদিন পর হাতে সিগারেট নিয়ে একের পর এক টান দিতে থাকে। সে তার জীবনে অনেক খুনি দেখেছে। কিন্তু এই প্রথম একজনকে পশু বলতে তার দ্বিধা হচ্ছে। যতবার মেয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছে ততবারই নিজের গুলিতে বুক ছিন্নভিন্ন করে দেয়া পশুর প্রতি কৃতজ্ঞতা তৈরি হচ্ছে। সে কীভাবে পারল হত্যা করতে? বলা হয়, যুদ্ধ সবচেয়ে নিরীহ মানুষকেও হিংস্র করে তুলে। জীবনও তো এক ধরনের যুদ্ধ। এই যুদ্ধেও কি কোন এক পর্যায়ে নিরীহ সত্তার মাঝে পশুত্ব জেগে উঠতে পারে?

রাকিব পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে। এই কাগজটা সে গত রাত্রে যখন রবিনের সন্ধানে কেবিনে ঢুকে তখন শ্রাবণীর বিছানার পাশের টেবিলে পড়ে থাকতে দেখে। রাকিব কাগজটা মেলে ধরে চোখের সামনে।

“আপনের মাইয়ারে দেইখা আমার নিজের বইনের কথা মনে পইরা গেসে। তারেও এ্যাম্নেই কেবিনে শুইয়া থাকবার দেখসিলাম। আপনের আরও রক্ত লাগলে মালিবাগের ব্লক বি তে ২৩/৪ বাড়িত যাইয়েন। সেইহানে আরও কয়েক ব্যাগ রক্ত থুইয়া আইসি।”

লেখাগুলি পড়ে রাকিব চোখ মুছতে থাকে। কাগজের টুকরোটা সে সারাজীবন নিজের কাছে যত্ন করে রাখবে।

(শেষ)

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি (IUT)

সেশনঃ ২০১৮-২০১৯

হাসিন ইশরাক

সেশনঃ ২০১৮-২০১৯