fbpx

Hemidactylus garnotii – একটি মহিলাসর্বস্ব টিকটিকি

টিকটিকি বাংলাদেশে অতি পরিচিত প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। ঘরে যখন দিনে বা রাতে বিশ্রাম নেয়া হয় তখন মাঝেমধ্যেই ‘টিক’ ‘টিক’ ‘টিক’ শব্দ শোনা যায়। ‘কেউ কোন কথা বলার সময় টিকটিকির শব্দ শুনলে সে ঠিক বলছে’ -এরকম কথাও লোকমুখে প্রচলিত আছে। Hemidactylus গণভুক্ত প্রাণীদেরকে সাধারণত বাংলাদেশে আমরা টিকটিকি বা House Lizard বা Wall Lizard নামে চিনি। বাংলাদেশে এই গণের ৬টি প্রজাতি পাওয়া যায়, যার মধ্যে সবগুলো প্রজাতিকেই বসতবাড়ির আশেপাশে গাছ, দেয়াল, ঝোপঝাড় থেকে শুরু করে বন জঙ্গলেও পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে পাওয়া ৬টি প্রজাতির মধ্যে একটি প্রজাতি মহিলাসর্বস্ব অর্থাৎ এই প্রজাতির কোনো পুরুষ নেই। পৃথিবীতে অনেক নিম্নশ্রেণির প্রাণী আছে যাদের শুধুমাত্র পুরুষ বা শুধুমাত্র মহিলা/নারী সদস্য পাওয়া যায়। এরা বিভিন্ন ব্যতিক্রমী উপায়ে তাদের বংশধরদের এই পৃথিবীতে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে এধরনের ব্যতিক্রম খুব একটা দেখা যায় না। Hemidactylus garnotii হচ্ছে সেরকম একটি ব্যতিক্রমের জলজ্যান্ত উদাহরণ।  

ছবিঃ গারনতের টিকটিকি Hemidactylus garnotii

১৮৩৬ সালে André Marie Constant Duméril এবং Gabriel Bibron প্রথম Erpétologie Générale বইয়ের ৩ নম্বর ভলিউমে এই টিকটিকির কথা উল্লেখ করেন। দুইজনই ছিলেন ফ্রেঞ্চ প্রাণিবিদ এবং তারা এই প্রজাতিটির নামকরণ করেন ফ্রেঞ্চ প্রকৃতিবিদ Prosper Garnot-এর নামানুসারে। বাংলায় একে গারনতের টিকটিকি বা সাদা টিকটিকি বলা হয়। ইংরেজিতে Garnot’s House Gecko, Indo-Pacific House Gecko, Fox Gecko, Assam Greyish-brown Gecko ইত্যাদি নামে পরিচিত।

প্রাপ্তবয়স্ক Garnot’s House Gecko লম্বায় ৪-৫ সে.মি. এবং এর লেজ ৭ সে.মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। পিঠের বর্ণ ধূসর কালো থেকে বাদামি হয় এবং পেটের দিকে হলুদাভ থাকে। মাথা এবং নাক লম্বাটে হওয়ায় একে “Fox Gecko” বলে ডাকা হয়। নাক লম্বা হলেও ভোঁতা; কান উন্মুক্ত, ছোট ছিদ্রযুক্ত এবং গোলাকার। লেজ কিছুটা চ্যাপ্টা এবং তাতে এক সারি ছোট ছোট কাঁটাযুক্ত আঁইশ থাকে। আঙুলগুলো মুক্ত, সামান্য স্ফীত। আঙ্গুলে বাঁকানো ল্যামেলী থাকে। ল্যামেলী হল পাতলা পর্দাযুক্ত টিস্যুর আবরণ এবং এর সংখ্যা আঙুলভেদে বিভিন্ন হয়। পিঠ ও গলার দিকে ছোট ছোট গোলাকার আঁইশে আবৃত থাকে। পেটের দিকেও মাঝারি গড়নের চাপা আঁইশ থাকে।

কোনো পুরুষ না থাকায় এই টিকটিকি পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। পার্থেনোজেনেসিস বা অপুংজনি হল নিষেক ছাড়াই অনিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে সরাসরি অপত্য উদ্ভিদ বা প্রাণী সৃষ্টি হওয়ার প্রক্রিয়া।  সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় ডিম পারে এবং একবারে ৬টি ডিম দিতে পারে। পুরুষ সদস্য না থাকায় তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য কোনো ফেমোরাল পোর (পুরুষ সদস্যকে আকৃষ্ট করার জন্য হরমোন ক্ষরণকারী গ্রন্থি) থাকে না। অন্যান্য প্রজাতির ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪০ থেকে ৪৬ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং ডিপ্লয়েড হয়। ডিপ্লয়েড হল মূল বা হ্যাপ্লয়েড (n) ক্রোমোজোমের দুই সেট (2n) উপস্থিত থাকা। কিন্তু, গারনতের টিকটিকির ক্রোমোজোম সংখ্যা ৭০টি, ৬টি দ্বি-বাহু বিশিষ্ট এবং বাকি ৬৪টি একবাহু বিশিষ্ট এবং ট্রিপ্লয়েড। হ্যাপ্লয়েড সংখ্যক ক্রোমোজোমের তিন সেট (3n) উপস্থিত থাকাই হল ট্রিপ্লয়েড।

সাধারণত পোকামাকড়, মাকড়সা এবং অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণীদেরকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। উজ্জ্বল আলোর কাছাকাছি বসে থেকে এদেরকে আলোতে আকৃষ্ট পোকামাকড় ধরতে দেখা যায়। সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে থাকায় বাংলাদেশে এই টিকটিকিকে দুর্লভ বলে মনে করা হয়। কিন্তু গবেষকরা মনে করেন দেশে এই টিকটিকির পপুলেশন ভাল অবস্থায় আছে এবং এজন্য IUCN (International Union for Conservation of Nature) কর্তৃক এটিকে আশঙ্কামুক্ত (Least concern) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে এই প্রজাতির টিকটিকিসহ সকল বন্যপ্রাণীদেরকে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুসারে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব (সিলেট) ও দক্ষিণ-পূর্ব (পার্বত্য চট্টগ্রাম) এলাকায় এই টিকটিকি পাওয়া যায়। এছাড়া, বৈশ্বিকভাবে এই টিকটিকি উত্তর-পূর্ব ভারত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ প্রশান্ত মহসাগরীয় দ্বীপ, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ চীন, হংকং, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ফিজি ও পলিনেশিয়াতে পাওয়া যায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতির জন্য এটি Indo-Pacific House Gecko নামে পরিচিত। নিউজিল্যান্ড, হাওয়াই, ফ্লোরিডা, বাহামাসে এই টিকটিকিকে ইনভেসিভ প্রজাতি হিসেবে ধরা হয়। পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অতিপ্রজনন এবং বেশি অভিযোজন ক্ষমতার কারণে ঐসব এলাকার নিজস্ব প্রজাতির উপর এই টিকটিকির খারাপ প্রভাব থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

তথ্যসূত্রঃ

১।  Hasan, M.K., Khan, M.M.H. and Feeroz, M.M. 2014. Amphibians and Reptiles of Bangladesh - A Field Guide.
২। Rabbe, M. F., M. F. Jaman, M. M. Rahman and M. M. Alam. 2019. Some Behavioural Aspects on the Hemidactylus Species of Bangladesh.
৩। The Reptile Database, www.californiaherps.com এবং www.thainationalparks.com 
টিচার | প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগ

সেশনঃ ২০১২-২০১৩
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মো: ফজলে রাব্বী

সেশনঃ ২০১২-২০১৩ প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়