fbpx

দ্য লিভিং ঈগল

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য পেয়েছেন নানা খেতাব। অনেকেই সাহসিকতার অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু অনেক যোদ্ধাই রয়েছেন যারা মনেপ্রাণে ‘বাংলাদেশ’ চেয়েছেন কিন্তু হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনীতে যুক্ত হতে পারেন নি। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত অনেক বাঙালি অফিসার ও সৈনিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আগেই আটক হন, অনেকেই আবার শহিদ হন। এমনই এক অদম্য সাহসী যোদ্ধার নাম সাইফুল আজম। যার খ্যাতি ‘দ্য লিভিং ঈগল’ হিসেবে।

certificate

সাইফুল আজম পৃথিবীর ইতিহাসে এক দুঃসাহসী বৈমানিকের নাম। পৃথিবীর সকল বৈমানিকের আদর্শ। তার রেকর্ডের ঝুলিটি অনেক ভারী। ২০০১ সালে আমেরিকা যে ২২ জনকে লিভিং ঈগল ঘোষণা করে তার মধ্যে তিনি অন্যতম। সাইফুল আজম ৮টি ভিন্ন দেশের ৮ বাহিনীর বিমান পরিচালনা করেছেন তার দক্ষ হাতে। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, চীন, রাশিয়া, ইরাক, জর্ডান ও বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর অসংখ্য যুদ্ধবিমান চালানোর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই বৈমানিক সর্বোচ্চ সংখ্যক ইসরাইলের বিমান ভূপাতিত করার রেকর্ডটি ধরে রেখেছেন এখনো। পৃথিবীর চারটি দেশের (জর্ডান, ইরাক, পাকিস্তান, বাংলাদেশ) বিমান বাহিনীতে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার এবং তিনটি দেশের সামরিক খেতাব অর্জন করার রেকর্ডটিও তার। আকাশপথে সম্মুখসমরে সাইফুল আজম এক দুঃসাহসী ও দক্ষ বৈমানিকের নাম। দুটো ভিন্ন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে (ভারত ও ইসরাইল) যুদ্ধ জয়ের কৃতিত্ব রয়েছে তার ।

সাইফুল আজম ১৯৪৭ সালে পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। দুই বছরের শিক্ষা সম্পন্নের পর জিডি পাইলট হিসেবে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। ‘সেসনা টি-৩৭’ দিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হলেও তার দক্ষতা ছিল অত্যাধুনিক সব যুদ্ধবিমান চালনার। তিনি ‘এফ-৮৬ স্যাবরজেট’ দিয়ে বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘লুক এয়ারফোর্স বেইস’ থেকে।

এরপর ১৯৬৩ সালে দেশে ফিরে কিছুদিন ঢাকাস্থ বিমানঘাঁটিতে অবস্থান শেষে নিয়োগ পান মৌরিপুর (মাশরুর) বিমানঘাঁটিতে টি-৩৩ বিমানের প্রশিক্ষক হিসেবে। তার অধীনেই বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ‘১৭ নং স্কোয়াড্রন’-এ যুক্ত হয়ে ‘এফ-৮৬ স্যাবরজেট’ নিয়ে অনন্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন এবং ভারতীয় অফিসার বিজয় মায়াদেব-এর ‘ফোল্যান্ড নেট’ বিমানটি ভূপাতিত করেন। মুখোমুখি যুদ্ধে এমন অত্যাধুনিক বিমান পর্যদুস্ত করা ছিল ইতিহাসের এক বিরল ঘটনা যার জন্য তিনি ‘সিতারা-ই-জুরাত’ পদক লাভ করেন।

saiful azom 01

সাইফুল আজম আরব-ইসরাইল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অনন্য নজির স্থাপন করেন। ছয়দিনব্যাপী এ যুদ্ধের সময় ইসরাইল ছিল এক অজেয় ও ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ। আরব শক্তির চার দেশের (মিশর, ইরাক, জর্ডান ও সিরিয়া) সম্মিলিত শক্তি ইসরাইলের শক্তির তুলনায় নগণ্য। মিশর ও সিরিয়ার ওপর বিমান হামলা করে প্রায় সবকিছু ধ্বংস করে দেয় ইসরাইল। ইসরাইলের একের পর এক আক্রমণে আরব শক্তি চরম হতাশ ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় অ্যারোস্পেইস ডগফাইট অর্থাৎ আকাশে সম্মুখযুদ্ধে অবিস্মরণীয় সাফল্য এনে দেন সাইফুল আজম।

জর্ডানের হয়ে চারটি হকার হান্টারের নেতৃত্ব দিয়ে ইসরাইলের বিমান হামলা ঠেকাতে উড়াল দেন সাইফুল আজম। উদ্দেশ্য জর্ডানের মাফরুক ঘাঁটি রক্ষা। ইসরাইলের ‘ডাসল্ট সুপার মিস্টেরে’ বিমানের তুলনায় হকার হান্টার দুর্বল। ইসরাইল এ প্রতিরোধের কথা চিন্তাই করে নি। সাইফুল আজম আকাশে অসীম সাহসের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তার নির্ভুল নিশানায় আঘাত করে ইসরাইলের চারটির মধ্যে একটিকে ভূপাতিত এবং আরেকটি অকেজো করে দেন। এই যুদ্ধে মাফরুক ঘাঁটির কিছুটা ক্ষতি হলেও ইসরাইল তার স্বার্থসিদ্ধ করতে পারেনি। আরবশক্তিতে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়। আজমের এ সাফল্যে তার ডাক পড়ে ইরাক বিমান বাহিনীতে; ইরাকের দুই বিমানঘাঁটি ‘এইচথ্রি’ এবং ‘আল ওয়ালিদ’ রক্ষার।

৫ জুনের যুদ্ধে জর্ডানের মাফরুক ঘাঁটি রক্ষার মত ৭ জুন ইরাকের ‘এইচথ্রি’ ঘাঁটি রক্ষার অভিযানে নামেন আজম। এবার ইরাকিদের প্রতিপক্ষ ইসরাইলের চারটি ‘ভেটোর বোম্বার’ এবং দুটি ‘মিরেজ থ্রিজি’। ইসরাইলি ক্যাপটেন লিওনের গুলিতে নিহত হন আজমের উইংম্যান সহ দুই ইরাকি। পরক্ষণেই আজম তার দক্ষ হাতের নির্ভুল নিশানার ভেলকি দেখান। গিডিওনের মিরেজ থ্রিজিকে ভূপাতিত করেন মুহূর্তের মধ্যেই। আজমের হকার হান্টার ‘ভেটোর বোম্বার’ গুলোকেও তাড়া করে এবং সফলতার সাথে একটিকে ধ্বংস করে। এখানেও ব্যর্থ হয় ইসরাইল। ভূপাতিত বিমানের দুই বৈমানিক যুদ্ধবন্দি হিসেবে ধরা দেন। দুই যুদ্ধবন্দির বিনিময়ে ইরাক ও জর্ডানের সহস্রাধিক সৈন্যকে মুক্ত করা হয়। আরব-ইসরাইল যুদ্ধে প্রথম ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে সম্মুখ সমরে তিনটি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করার অনন্য রেকর্ড তৈরি করেন আজম। তাঁর বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ জর্ডান ‘হুসাম-ই-ইস্তিকালাল’ এবং ইরাক ‘নাত-আল সুজাহ’ সম্মাননায় ভূষিত করে।

পাকিস্তান বিমান বাহিনীতেও তাঁর সম্মান ছিল অনেক। সাধারণত ‘ফাইটার স্কোয়াড্রেন’ এর নেতৃত্বে থাকেন একজন ‘উইং কমান্ডার’। কিন্তু তুলনামূলক জুনিয়র র‍্যাংকে থেকেই (ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট) ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান ও ১৯৬৭ সালে জর্ডান ফাইটার স্কোয়াড্রেনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৯ সালে ‘শেনিয়াং এফ-৬’ জঙ্গী বিমানের ফ্লাইট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৭১ সাল। দেশপ্রেমিক অকুতোভয় এ বৈমানিক যুদ্ধের আভাস পেয়েই প্রস্তুত হতে থাকেন যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। তিনি পাকিস্তান এয়ারলাইন্স ও বিমান বাহিনীতে কর্মরত বাঙ্গালিদের নিয়ে করাচি থেকে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের জেটবিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মার্চের ৬ তারিখে স্ত্রী-সন্তানদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। কিন্তু পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার পূর্বেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভয়ের কারণ ছিল। তারা জানত দুঃসাহসী বৈমানিকের দেশপ্রীতির কথা। তাই একাত্তরের শুরু থেকেই তাকে গ্রাউন্ডেড (উড্ডয়নে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা) করে রাখা হয়। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের ‘টি-৩৩’ বিমান ছিনতাই এর পরিকল্পনায়ও ছিলেন তার প্রশিক্ষক সাইফুল আজম। মতিউর রহমান শহিদ হবার পর আজমকে রিমান্ডে নিয়ে টানা ২১ দিন জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করা হয়। তার মৃত্যুদণ্ড হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও সামরিক সম্মাননা প্রাপ্ত হওয়ায় এবং তিনি ইরাক ও জর্ডানের নাগরিক হবার সুবাদে পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান ও জর্ডানের বাদশাহর অনুরোধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। কিন্তু তাকে সমগ্র যুদ্ধকালীন সময়ে বন্দি হিসেবে রাখা হয় যেন তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিতে না পারেন। তিনি যোগ দিলে হয়তবা বিমান হামলায় রচিত হতো আরও অনেক ইতিহাস। দুঃসাহসী বিমান হামলাগুলোর তালিকায় যুক্ত হত তার এক বা একাধিক নির্ভুল লক্ষ্যভেদের গল্প।

saiful azom 02 1

স্বাধীনতার পর তিনি মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং আত্মনিয়োগ করেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বিমান বাহিনীতে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন । পরবর্তীতে তিনি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

তিনি গত ১৪ই জুন ২০২০ তারিখে ইন্তেকাল করেন। ‘সাইফুল আজম’ এমনই একটি নাম, যা বাংলাদেশিরা আজীবন পুরো বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে বলতে পারবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। ইতিহাসের এই স্বল্প আলোচিত অকুতোভয় যোদ্ধার প্রতি রইল অপরিসীম শ্রদ্ধা।

তথ্যসুত্র-

১. উইকিপিডিয়া

২.https://roar.media/­bangla/main/­bangladesh/­saiful-azam-a-great-f­ighter-pilot-of-bang­ladesh/

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৫-২০১৬

সায়েম শাফিন

সেশনঃ ২০১৫-২০১৬