fbpx

নভেম্বর ১০, ২০২৪

অপারেশন জ্যাকপট: মৃত্যু না কি বাংলাদেশ!

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায়। স্বাধীনতা প্রাপ্তি বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। একটি মানবশিশু জন্ম নিতে যতটুকু সময় লাগে, প্রায় ততটুকু সময় নিয়ে ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র চোখ মেলে তাকিয়েছিল, জেগে উঠেছিল ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, দেশপ্রেম, রক্ত, অশ্রু আর অপরিসীম আত্মত্যাগের ভেতর দিয়েই অর্জিত হয় চুড়ান্ত বিজয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় নৌ-কমান্ডো দ্বারা পরিচালিত ‘অপারেশন জ্যাকপট’ তেমনি একটি আত্মত্যাগের গল্প; গৌরবের এক মহান বিজয়গাঁথা যা সেই সময় যুদ্ধের মোড় অনেকাংশেই ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ত্বরান্বিত করেছিল পাকিস্তানের পতন।

অপারেশন জ্যাকপটের প্রেক্ষাপট চিত্রায়িত হচ্ছিল সুদূর দক্ষিণ ফ্রান্সের উপকূলীয় শহর তুলনে। ১৯৭১ সালের মার্চের শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে পূর্ব পাকিস্তানে যখন চলছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম, একই সময় সেখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন পাকিস্তানি সাবমেরিন ‘পিএনএস ম্যাংরো’র ১৩ জন বাঙালি অফিসারসহ মোট ৪৫ জন সাবমেরিনার। সেখানেই তারা আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত বর্বর গণহত্যার কথা জানতে পেরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। নিশ্চিত মৃত্যু বা আজীবন জেলে পচে মরার ঝুঁকি নিয়েও ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ ৮ জন বাঙালি অফিসার পালিয়ে আসেন সাবমেরিন থেকে। পাকিস্তান সরকার তাঁদেরকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে  এবং তাঁদের অবর্তমানে সামরিক আইনে বিচার করে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় । নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে ফ্রান্স, স্পেন, রোম, জেনেভা হয়ে ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল তাঁরা দিল্লিতে এসে পৌঁছান।

স্বাধীনতা যুদ্ধের কঠিনতম মুহূর্তে এরকম প্রশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ নৌসেনাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান বাড়তি সাহস এনে দেয় সবার মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী তাঁদের সাথে দেখা করে বুকে টেনে নেন । তিনি নৌ-কমান্ডো গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৭৫৭ সালে যেখানে অস্তমিত হয়েছিল  বাংলার স্বাধীনতার সূর্য, পলাশীর সেই স্মৃতিসৌধের পাশেই স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ৩০০ জন সেনা নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৩ মে শুরু হয় ক্যাম্প ‘সি-টু-পি’। “আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না”- এই বাক্যে শপথ নিয়ে দৈনিক ১৮ ঘণ্টার তিন মাসব্যাপী এই প্রশিক্ষণ নেন দেশপ্রেমে মাতোয়ারা একদল পাগলাটে যুবক।

jackpot map

ট্রেনিং এর দুটো অংশ ছিল। স্থলযুদ্ধ প্রশিক্ষণ যেমন: গ্রেনেড নিক্ষেপ, এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার, স্টেনগান রিভলবার চালানো, খালি হাতে যুদ্ধ ইত্যাদি  এবং  জলযুদ্ধ প্রশিক্ষণ। যেমন: আর জলযুদ্ধের ট্রেনিঙের মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের সাঁতার যেমন: বুকে ৫-৬ কেজি ওজনের পাথর বেধে সাঁতার, চিৎ সাঁতার, কোন মতে পানির উপরে নাক ভাসিয়ে একটানা অনেক্ষন সাঁতার, পানিতে সাঁতরিয়ে এবং ডুব সাঁতার দিয়ে লিমপেট মাইন ব্যবহার, স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার, জাহাজের কেবল ভাঙা ইত্যাদি। একটানা ৪৮ ঘণ্টা পানিতে থাকার অভ্যাস করতে হয় সব যোদ্ধাকে।   আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তাদের ট্রেনিং শেষ হয়।

প্রশিক্ষণ শেষে একই সাথে একই সময়ে দুই সমুদ্র বন্দর (চট্টগ্রাম ও মংলা) ও দুই নদীবন্দরে (নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর) আক্রমণের পরিকল্পনা সাজানো হয়। সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬০ সদস্যের একটি দল চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর, নৌ-কমান্ডো আমিনুর রহমান খসরুর নেতৃত্বে ২৬০ সদস্যের একটি দল (৬০ জন নৌ কমান্ডো ও ২০০ জন সি আন্ড সি কমান্ডো) মংলা সমুদ্র বন্দর, সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি দল চাঁদপুর নদী বন্দর এবং সাবমেরিনার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি দলকে নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরে আক্রমণের জন্য পাঠানো হয়। যাত্রা করার সময় প্রত্যেক কমান্ডোকে একজোড়া সাঁতারের ফিন, একটি ছুরি, একটি লিমপেট মাইন, সাঁতারের পোশাক, শুকনো খাবার দেয়া হয়েছিল। প্রতি তিনজনের একজনকে একটি স্টেনগান ও গ্রেনেড দেয়া হয়েছিল। কারো কারো কাছে কম্পাস ছিল। দলনেতার কাছে ছিল ট্রানজিস্টর রেডিও। এগুলো নিয়ে আগস্টের ৩-৯ তারিখের মাঝে তারা রওয়ানা হয়ে যান এবং ১২ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশে নির্ধারিত সেফ হাউজগুলোতে পৌঁছে যান।

অপারেশন জ্যাকপট কবে শুরু হবে তা টিম কমান্ডার ছাড়া কেউই জানত না। এ গোপনীয়তার কারণ ছিলো যদি কোন দল ইতোমধ্যে পাকসেনার নিকট ধরা পড়ে যায়, নির্যাতনের মুখেও যেন অপারেশন সম্পর্কিত কোন কার্যকরী তথ্য ফাঁস না হয়। পর্যাপ্ত ওয়্যারলেস ডিভাইস ও ছিলনা । তাই টিম কমান্ডারদের বলা হয়েছিল যে, দুটি বাংলা গানকে সতর্ক সংকেত হিসেবে ব্যবহার করা হবে। গান দুটি প্রচার করা হবে কলকাতা আকাশবাণীর পক্ষ থেকে। প্রথম সংকেত ছিল আরতি মুখোপাধ্যায় এর গাওয়া গান “আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি।”  এর অর্থ হল ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ করতে হবে বা আক্রমণের সময় কাছাকাছি। পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া “আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান” গানটি ছিলো দ্বিতীয় সংকেত যার অর্থ আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ কর। অর্থাৎ সুস্পষ্ট নির্দেশ আক্রমণ করতেই হবে।

jackpot 02

১৪ ই আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা দিবস পালন করবে তাই এই রকম একটা তারিখই আক্রমণের জন্য ধার্য করা হয়েছিল। সেই লক্ষ্যে ১৩ তারিখ আসে প্রথম সংকেত। কিন্তু  ১৪ তারিখ স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তানি সেনারা অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে পারে এই ভেবে আক্রমণের তারিখ এক দিন পেছানো হয়। ১৫ তারিখ আসে চূড়ান্ত সংকেত। দিনে দুবার করে বাজানো হয় গান দুইটি। যেন কোনভাবেই কেউ সংকেত মিস না করে। প্রথমবার সকাল ৬ টা থেকে ৬:৩০ এর মধ্যে এবং দ্বিতীয়বার রাত ১০:৩০ মিনিট থেকে ১১ টার মধ্যে। সংকেত পাওয়ার সাথে সাথেই সবাই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এবং ১০ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে ১৫ আগস্ট রাত ১২ টার পর চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে হামলা চালানো হয়। এ হামলায় পাকিস্তানের ৩ টি বড় অস্ত্রবহনকারী জাহাজ- এমভি আল আব্বাস, এমভি হরমুজ এবং ওরিয়েন্ট বার্জ নং ৬ ডুবে গিয়ে প্রায় ২৫,০০০ টনের মত অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিনষ্ট হয়। পাশাপাশি অন্য ৭ টি নৌযানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মংলা বন্দরে অপারেশন শুরু হয় ভোর ৪ টা ৩০ মিনিটে। নৌ-কমান্ডোগণ ৬ টি দলে বিভক্ত হয়ে ৬ টি জাহাজে মাইন লাগান। এগুলোর মধ্যে একটি করে সোমালীয়, মার্কিন, জাপানি ও পাকিস্তানী জাহাজ এবং দুইটি চীনা জাহাজ ছিল। এ অপারেশনে পশুর নদীতে মোট ৩০,০০০ টন গোলা-বারুদ ও যুদ্ধের সরঞ্জাম ডুবে যায়। এই অপারেশনে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা নিখোঁজ হন।  

চাঁদপুরে অপারেশনে মোট ৪ টি জাহাজ ও ৩ টি  স্টিমার-জাহাজসহ আরও কিছু নৌযান ডুবে যায়। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জে ৪ টি জাহাজ-বার্জ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন নৌ-কমান্ডোরা।

আগস্টে শুরু হওয়া এই অপারেশন চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তবে এরপর নৌ-কমান্ডোরা পূর্ব-পরিকল্পিত এবং একযোগে অভিযান পরিচালনা করেননি। তার বদলে, ছোট ছোট দল পাঠানো হতো কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানতে, এবং সুযোগ পেলেই কমান্ডোরা সেখানে আক্রমণ চালাতেন। কমান্ডো বাহিনীর ৮ জন শহিদ হন, ৩৪ জন আহত হন এবং ১৫ জন ধরা পড়েন। এ সময়ের মধ্যে ৪৫ টিরও বেশি নৌযান ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন নৌ-কমান্ডোরা।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অপারেশন জ্যাকপট ছিলো অপরিসীম গুরুত্ববহ। এই আক্রমণের ফলে অস্ত্র ও গোলাবারুদের সাথে সাথে হানাদার বাহিনীর মনোবলও ডুবে যায় নদীগর্ভে, বদলে গিয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের অনেক হিসেব। আন্তর্জাতিক মিডিয়া এই অপারেশনের খবর অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রচার করে। যা সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। এছাড়া অপারেশন জ্যাকপটের এই কমান্ডোরা আক্ষরিক অর্থেই গোড়াপত্তন করেছিলেন ‘বাংলাদেশ নৌবাহিনী’র যা আজও বাংলাদেশের শান্তিতে-সংগ্রামে-সমুদ্রে এক দুর্জয় কাণ্ডারি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সব বীরদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র-

১. উইকিপিডিয়া

২.https://roar.media/bangla/main/liberation-war/operation-jackpot-in-liberation-war

৩. https://youtu.be/­B0tGO5miW80

Humayun Kabir
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৮-১৯