মার্চ ১৯, ২০২৫

নিরাগ বাস্তবতা

সুইসাইডের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এবার কিছু হিসাব মিলানো বাকি; সঙ্গে খুঁজতে হবে কিছু উত্তর। মৃত্যুভয়কে জয় করতে পারলে পৃথিবীতে অনেক কাজই সহজ হয়ে যায়। আর তাই ভবঘুরের মতোই রাস্তায় রাস্তায় আজ পুরো তিনদিন পার হয়ে গেল নন্দিনীর। কী সহজেই সাজানো জীবনটা বদলে গেল না সেদিন? কখনও কি ভেবেছিল এ রকম কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হবে? শিশিরভেজা সকালের কোনো এক মুহূর্তে নন্দিনী বুঝেছিল হৃদস্পন্দনের তীব্রতা কতটা সুখের হয়। বাবা-মায়ের বাধ্য মেয়ে নন্দিনী সেদিন শিকল ছিঁড়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল। আর দিবে নাই বা কেন? এক বছরের সম্পর্কে জাভেদ প্রতি মুহূর্তে তাকে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। তারা তো একইসাথে বৃষ্টির শব্দ শুনত, কবিতায় হারিয়ে যেত, রোদের কাঁচা রঙকে আপন করে নিত। সুখের আবেশে থাকতে থাকতেই নন্দিনী প্রথম অন্ধকার দেখে সেই ভোরের ঠিক একমাস পর। অধিকাংশ মেয়ের কাছে দিনটা আশীর্বাদ, কিন্তু নন্দিনীর জীবনে তা এসেছিল শেষের শুরু হয়ে। প্রেগনেন্সি কিটের দিকে তাকিয়ে নন্দিনী যখন কোনো কূল খুঁজে পাচ্ছিল না, জাভেদ তখন অফিসের কাজে ব্যস্ত। আজও স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা, নন্দিনী কাঁদতে কাঁদতে জাভেদকে ফোন দিয়েছিল।

“জা-জাভেদ, আমার পজিটিভ এসেছে।“

ওইপাশ থেকে কিছুক্ষণের জন্য কোনো সাড়া আসে নি।

“কিছু বল জাভেদ। কী করব এখন!”

“তুমি শিওর নন্দিনী?”

“হ্যাঁ।“

দীর্ঘশ্বাসের পালা শেষে জাভেদ বলেছিল, ”আজ বিকেলে দেখা করো।“

সেদিন বিকেলে জাভেদ যখন বলেছিল, ”নন্দিনী, এটা তোমার জন্যও ভাল হবে না, আমার জন্যও না। তোমার এখন নিজেকে গড়ে তোলার সময়, বাচ্চা নেয়ার সামর্থ্য আমাদের কারোরই এখন নেই। আমি কেবল একটা চাকরিতে ঢুকেছি। মা-বাবাকে এসব জানানোর প্রশ্নই আসে না। তুমি তোমার মা-বাবাকে বলে এ্যাবোর্শনের ব্যবস্থা কর, “নন্দিনীর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছিল। তারপরের কথোপকথন তার কিছু খেয়াল নেই। সে নিজে থেকেই জাভেদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। জাভেদ হয়ত হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। সে নিজেও নন্দিনীর সাথে যোগাযোগের আর চেষ্টা করে নি। একমাস নন্দিনী ঘর থেকে বেরোয় নি। কী করবে বুঝতে পারছিল না, রাতে ঘুমোতে পারত না। সে নিজের ভিতরে পরিবর্তনগুলো টের পাচ্ছিল। যত দিন যাচ্ছিল তার আতঙ্ক তত বাড়ছিল। কোন মুখে বলবে মা-বাবাকে? ভাবতে ভাবতেই তিনমাস পার হয়ে যায়। অবশেষে নিজের সমস্ত সাহস দিয়ে সে মা-বাবাকে সবটা খুলে বলে। বাবা আফজাল হোসেন আর মা মোনালী রহমানের স্তব্ধ চেহারার দিকে তাকাতে পারছিল না, কিন্তু নন্দিনীর জন্য যে আরও বড় ধাক্কা অপেক্ষা করছিল। মোনালী রহমানের কথাগুলো ক্ষণে ক্ষণে কানে বাজে, “নিজের মেয়ে হলে কি এরকম করতে পারত? কীভাবে পারল এত নিচে নামতে?”

তীব্র হর্নের শব্দে নন্দিনী ভাবনার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এল। গাড়ির ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে রাগত স্বরে তাকে কিছু একটা বলল, নন্দিনী বুঝতে পারল না। কখন যে রাস্তায় পা দিয়ে দিয়েছে খেয়ালই করে নি। তিনদিন ধরে মানুষটাকে খুঁজছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কিনারা করতে পারে নি। ২১ বছর আগের পরিচয়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া কি সম্ভব? আগের নন্দিনীকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে হয়ত বলত সম্ভব না। কিন্তু জীবনের এই প্রান্তে এসে তার কাছে সবই সম্ভব মনে হচ্ছে। সন্ধ্যা নামবে একটু পরেই, পাখিদের সাথে সাথে মানুষেরাও কাজ শেষে বাড়ি ফেরার আয়োজনে মত্ত। আর নন্দিনী? অস্তিত্বটাই একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন যেন। কোন বাড়িতে ফিরবে সে? যাকে ভালবেসেছিল সে তো সমস্ত অহংকার চূর্ণ করে দিয়ে চলে গেল। আর যেখানে বড় হয়েছে, সে বাড়ি আসলে কোনোদিন তার ছিলই না।

নীলিমা বুটিক হাউজের সামনে এসে নন্দিনী দাঁড়িয়ে পড়ল। তিনদিনে এই নিয়ে ছয় নাম্বার বুটিক হাউজে খোঁজ নিচ্ছে। ধানমন্ডিসহ আশেপাশের এলাকার বুটিক হাউজের একটা লিস্ট করেছে সে। কাউন্টারে  ১৬-১৭ বছরের একটা মেয়ে বসে আছে। নন্দিনী কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ”আচ্ছা এখানে কি সীমা আক্তার নামে কেউ কাজ করতেন কখনো?”

মেয়েটা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। এই কয়দিনে এইরূপ দৃষ্টির সাথে সে পরিচিত হয়ে গেছে। মেয়েটি বলল, ”আপনি কে জানতে পারি?”

“আমি নন্দিনী। আমার আসলে উনাকে খুব দরকার। আপনি জানেন এই নামে কেউ ছিল কিনা?”

“আমি সীমা আক্তারের মেয়ে নীলিমা। মা তো একটু বাইরে গেছেন। আপনি আমাকে বলতে পারেন আর নাইলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারেন।“

হঠাৎ করেই নন্দিনীর সব শক্তি যেন এক নিমিষে শেষ হয়ে গেল। বুকের উপর কেউ যেন ভারী পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে।

“এই তো মা চলে এসেছেন।“

নন্দিনী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ”আচ্ছা নীলিমা, আমি আসছি।“

কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই ভালো, কিছু হিসাব না মিলেই মিলে যায়। ২১ বছর আগে তার নিজের মা হয়ত এরকম কোন একটা কারনেই তাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আজ এত বছর পর নন্দিনী সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। গর্ভপাত করার সাহস তার নেই, একটা প্রাণকে মেরে সে নিজে বেঁচে থাকতে পারবে না। মুদ্রার এপিঠে সেই সময়ের নবজাতককে নিজের করে নেয়া আফজাল সাহেবদের বাসা থেকে কান্নার রোল ভেসে আসে, ”আমরা তো ছিলাম রে মা, কেন হেরে গেলি?” মুদ্রার অন্য পিঠে নন্দিনী পেটে হাত দিয়ে দৃঢ় পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সাহস? সে মুদ্রার দুপিঠেই আছে। বাস্তবতা যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে নন্দিনীদের অস্বচ্ছ হারের অথবা জিতের আড়ালে কালো হয়ে ভেঙ্গে পড়া সমাজের সভ্য প্রোটোটাইপ হাস্যকর।

শিক্ষার্থী | Department of EEE, Rajshahi University of Engineering & Technology

Session: 2018-2019