সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার কে? এমন প্রশ্নের জবাবে কেবলমাত্র ডন ব্রাডম্যানের নামটিই সন্দেহাতীতভাবে উচ্চারিত হতে পারে। মাত্র ৫২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচের ক্যারিয়ারে রেকর্ড বইয়ের পাতা এলোমেলো করে দেয়া মানুষটিকে বলা হয় গ্রেটদের গ্রেট। আর হবেই না কেন? ৯৯.৯৪ গড়ে রান তোলা নিশ্চয়ই চাট্টিখানি কথা নয়। এই অতিমানবের গল্পই বলতে চলেছি আজ।
১৯০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে জন্ম নেন ব্রাডম্যান। পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ এই সদস্যের ছোটবেলা থেকেই ছিলো ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক। স্কুলে থাকাকালীন সময়েই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে নিজের জাত চেনাতে শুরু করেন। তবে ১৯ বছর বয়সে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেকের মাধ্যমেই শুরু হয় ব্রাডম্যানের মূল পথচলা। এর দুবছর পরেই ডাক পান জাতীয় দলে।
১৯২৮-এ ইংল্যান্ড দল যখন অস্ট্রেলিয়া সফরে আসে ব্রাডম্যানের বয়স তখন একুশ। প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের জার্সিতে ব্যাট হাতে নামেন। অভিষেক টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে করেন ১৯। অস্ট্রেলিয়া দল সেই ম্যাচ হারে ৬৭৫ রানের বিশাল ব্যবধানে! পরের ম্যাচে বাদ পরেন ব্রাডম্যান। সেই প্রথম ও শেষ বাদ পড়া। তৃতীয় টেস্টে ফিরেই করলেন সেঞ্চুরি। এরপরের ইতিহাস শুধু ব্রাডম্যানময়। সেই সিরিজে ৬৬.৬৮ গড়ে করেন ৪৬৮ রান। পরের সিরিজে হয়ে উঠেন আরো বিধ্বংসী। ৫ ম্যাচে ৭ ইনিংসে করেন ৯৭৪ রান! আজ অব্দি কোন সিরিজে এটাই ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান। ১৯৩০-৩১ এ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫ ইনিংসে ২০১.৫০ গড়ে করেন ৮০৫ রান। চলতে থাকে তাঁর রানের বন্যা।
সেঞ্চুরি করাটাকে রীতিমতো ছেলেখেলা বানিয়ে ফেলেছিলেন ব্রাডম্যান। মাত্র ৫২ ম্যাচে ৮০ ইনিংসের ক্যারিয়ারে সেঞ্চুরিই আছে ২৯টি, ডবল সেঞ্চুরির সংখ্যা ১২, ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ৩ বার আর অর্ধশতক আছে ১৪টি। প্রতি ১.৭৯ ম্যাচে ব্রাডম্যান একটি করে সেঞ্চুরি হাঁকাতেন। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও পরিসংখ্যান অন্তত তাই বলে।
হেলমেটবিহীন ব্যাট করা, পিচের অদ্ভুত আচরণ, ছোট প্রস্থের ব্যাটসহ বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে খেলতে হতো তখন। তাই স্বাভাবিকভাবেই সে যুগটাকে বলা হয় বোলারদের যুগ। কিন্তু সেই সময়েই ব্রাডম্যান রান তুলতেন ঝড়ের গতিতে। ১৯৩১ সালে এক ম্যাচে নেমে তো সেঞ্চুরি করে বসলেন মাত্র ২২ বলে! টেস্টে প্রথম দিনের প্রথম ইনিংসের প্রথম সেশনে সেঞ্চুরি করার রেকর্ড যে ছয়জনের আছে, ব্রাডম্যান তাঁর মধ্যে একজন। তাছাড়া পরপর ইনিংসে তাঁর সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব আছে মোট ছয়বার।
ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটেও ব্রাডম্যান দাপিয়েছেন স্বমহিমায়। ২৩৪ ম্যাচে ১১৭ সেঞ্চুরি আর ৬৯ হাফ সেঞ্চুরির সাহায্যে রান তুলেছেন ২৮০৬৭। সর্বোচ্চ রান ৪৫২*, সেখানে গড় ৯৫.১৪!
টেস্ট ক্রিকেটে দ্রুততম দুই, তিন, চার, পাঁচ এবং ছয় হাজার রান করার রেকর্ড ব্রাডম্যানের দখলে। এক ইনিংস বেশি লাগায় হাতছাড়া হয় দ্রুততম এক হাজার রানের রেকর্ড। জীবনের শেষ ইনিংসে ব্রাডম্যান যখন মাঠে নামেন তখন তাঁর রান ৬৯৯৬। মাত্র ৪ রান হলেই ছুঁয়ে ফেলবেন দ্রুততম সাত হাজার রান করার রেকর্ড, তাঁর গড় দাঁড়াবে ১০০! কিন্তু ক্রিকেটকে বলা হয় অনিশ্চয়তার খেলা। সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি হাঁকানো এই অস্ট্রেলিয়ান রান মেশিন সেদিন ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই শূন্য রানে বোল্ড হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। সেই বিখ্যাত শূন্য দাগ কেটে যায় ক্রিকেট ভক্তদের মাঝে। মাত্র ৪ রানের আক্ষেপ নিয়ে ব্রাডম্যান তাঁর ক্যারিয়ারের ইতি টানেন ৯৯.৯৪ গড়ে।
ক্রিকেটের বাইবেলখ্যাত ম্যাগাজিন উইজডেন একমাত্র ব্রাডম্যানকেই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়ের উপাধি দিয়েছে মোট দশবার। ১৯৯৭ সালে “সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত অস্ট্রেলিয়ান” হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করা হয়। স্থান পান সেদেশের ডাকটিকেট ও মুদ্রায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা(ICC) তাকে ভূষিত করেছে সম্মানসূচক “হল অব ফেইম” উপাধিতে।
ব্রাডম্যানকে নিয়ে আছে কিছু মজার গল্পও। ১৯৯০ সালে একজন সাংবাদিক ব্রাডম্যানকে প্রশ্ন করলেন, “এই সময়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেললে আপনার গড় কতো হতো?” ব্রাডম্যান উত্তর দিয়েছিলেন “৫০ বা ৬০ এর মতো।” সাংবাদিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো এতো কম কেনো? ব্রাডম্যানের হেসে জবাব দিয়েছিলেন, “বয়স যে এখন ৮২ হয়ে গেছে!”
১৯৮৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় কারাগারে নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে দেখা করতে যান তখন ম্যান্ডেলার প্রথম প্রশ্নই ছিলো, “ব্রাডম্যান কি বেঁচে আছেন?” অবশ্য তখনো বেঁচে ছিলেন ব্রাডম্যান। অস্ট্রেলিয়ার কেনসিংটন পার্কে ২০০১ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যদিও এই মৃত্যু স্রেফ একটি শব্দ।
- This author does not have any more posts.