fbpx

দ্য থ্রি-কার্ড মন্টি

(১)

দুইটায় বাকীউল্লাহ স্যারের ফিজিক্স ক্লাস ছিলো। সোয়া দুইটায় জানা গেল ক্লাসটা হবে না। সব ছাত্র একসাথে চিৎকার করে উঠলো, ‘বাকীর নাম ফাঁকি।’

সিঁড়ি দিয়ে নামছে অর্ণব, চেহারায় বিরক্তি। মাস ছয়েক পর H.S.C. পরীক্ষা – এখনও বাকী স্যার সমানে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যদি একটার সময় জানাতেন ক্লাসটা হবে না, তাহলে সোয়া ঘণ্টা অনর্থক অপেক্ষা করতে  হতো না।

গেট দিয়ে বের হয়ে অভ্যাসের বশে মাথা তুলে কলেজের সাইনবোর্ডটা দেখলো অর্ণব। কোনও এক কালে বোর্ডটাতে লেখা ছিলো ‘পলাশপুর সরকারী কলেজ’। এখন ‘প’ আর ‘ক’ অক্ষর দু’টো মুছে যাওয়ায় লেখাটা দাঁড়িয়েছে ‘লাশপুর সরকারী লেজ’।

রাস্তার ওপাশে রাফিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।

‘কিরে, কমার্সের ক্লাসও হচ্ছে না?’ রাস্তা পার হয়ে জিজ্ঞেস করলো অর্ণব।

‘হচ্ছে,’ বললো রাফি। ‘তবে, হুদা স্যারের ক্লাস করাও যা, না করাও তা। বেহুদা কে বসে থাকে? চল্ যাই।’

বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলো রাফি।

‘রিকশা ‍নিবি না?’ অর্ণবের জিজ্ঞাসা।

‘আজকে গরম কম। চল্ হেঁটেই যাই।’

বটতলার মোড়ে জুয়ার আসর বসেছে। একটা খালি কার্ডবোর্ড বক্সকে টেবিল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘টেবিল’-এর দু’পাশে দু’জন দাঁড়িয়ে তিন তাসের খেলা খেলছে।

একজনকে অর্ণব চেনে। ছেলেটার নাম মিজু, ওর চেয়ে বছর পাঁচেক বড়। ওদের কলেজের ড্রপ-আউট।

অন্য ছেলেটা অর্ণব আর রাফির সমবয়সী। ওদের মতোই কলেজের ইউনিফর্ম পরে আছে – বাদামী প্যান্ট আর সাদা শার্ট। ছেলেটার গলা বকের মতো লম্বা। অর্ণব মনে মনে তার নাম দিলো ‘বগা’।

থ্রি-কার্ড খেলা বলতে অর্ণব এতদিন বুঝতো ‘থ্রি-কার্ড পোকার’ – যেই খেলায় প্রত্যেক খেলোয়াড় তিনটা করে তাস পায়। খেলাটি ও দু’একবার খেললেও ‘pair’-এর চেয়ে ভালো তাস কখনও পায়নি।

তবে, এখানে ‘থ্রি-কার্ড পোকার’ খেলা হচ্ছে না।

বায়ান্ন তাসের বদলে মাত্র তিনটা তাস দিয়ে খেলা হচ্ছে – স্পেডের টেক্কা, ক্লাবের টেক্কা আর হার্টের কুইন। তিনটা তাসই কিছুটা বাঁকানো হয়েছে, যাতে উপুড় করে রাখলে মাঝের দিকটা একটু উঁচু হয়ে থাকে। এর ফলে টেবিল থেকে তাসগুলো সহজে তোলা যাচ্ছে।

মিজু হচ্ছে ‘ডিলার’। জুয়ার আসরটা সে-ই বসিয়েছে। হার্টের কুইনটা হচ্ছে মানি কার্ড। প্রত্যেক দানের শুরুতে তিনটা তাস টেবিলে পাশাপাশি উপুড় করে রেখে মিজু দ্রুতগতিতে সেগুলোর জায়গা অদলবদল করছে। মুখে বলছে:

‘হৃদয়ের রানীকে খুঁজে পেলে পাবেন পাঁচশ’ টাকা পুরস্কার।’

‘বগা’ তিনটা তাস থেকে একটা বেছে নিচ্ছে। হার্টের কুইন বেছে নিতে পারলে তার পাঁচশ’ টাকা লাভ হচ্ছে, না পারলে পাঁচশ’ টাকা লস্ হচ্ছে।

অর্ণব প্রথমে ভাবলো, ‘বগা’-র হার প্রায় নিশ্চিত। কারণ: তিনটা চয়েসের মধ্যে একটা চয়েস সঠিক। অনেকবার খেলাটা খেললে ‘বগা’ প্রতি তিনবারে গড়ে একবার জিতবে এবং পাঁচশ’ টাকা পাবে। কিন্তু, বাকি দুইবার হেরে এক হাজার টাকা মিজুকে দিবে। তার মানে, তিন বারে তার গড়ে পাঁচশ’ টাকা লস্ হবে।

কিন্তু, ‘বগা’-কে অতটা হারতে দেখা যাচ্ছে না। বরং, তার জয়ের পাল্লাই ভারি।

মনোযোগ দিয়ে মিজুর শাফল দেখে অর্ণব বুঝতে পারলো ‘বগা’-র সাফল্যের কারণ কী।

প্রতিবার মিজু বাম হাতের বুড়ো আঙুল আর মধ্যমা দিয়ে একটা টেক্কা ধরছে। একই হাতের বুড়ো আঙুল আর অনামিকার সাহায্যে কুইনটা ধরছে। উপুড় করে ধরলে কুইনটা নিচে থাকছে। ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর মধ্যমার সাহায্যে ধরছে অন্য টেক্কা।

সবার আগে কুইনটাকে টেবিলে ফেলা হচ্ছে। এরপর টেক্কা দু’টো কুইনের দু’পাশে ফেলে দ্রুতগতিতে কয়েকবার তিনটা তাসের জায়গা অদলবদল করা হচ্ছে। সজাগ দৃষ্টি রাখলে অনেক শাফলের পরেও বোঝা যাচ্ছে কুইনটা কোথায়। বগা ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারছে না, তাই মাঝে মাঝে হারছে।

‘খেলবি নাকি?’ রাফি জিজ্ঞেস করলো।

‘নাহ্,’ বললো অর্ণব।

‘কেন? দুই-চার হাজার টাকা তো তোর ভাষায় “চিকেন ফিড”। তোদের তো টাকার অভাব নেই। কয়েক দান খেলবি?’

‘ন্-নাহ্।’

রাফি আবার বলাতে রাজি হলো অর্ণব।                  

‘আমি খেলবো,’ মিজুকে বললো সে।

‘একসাথে তো দুইজন খেলা যায় না,’ অর্ণবকে বললো মিজু। তারপর বগার দিকে ফিরে বললো, ‘তুমি একটু ব্রেক নাও, ছোট ভাই। পরে আবার খেলবা। চইলা যাইও না।’

(২)

কিছু বুঝে উঠার আগেই পর পর দশ দান হেরে গেল অর্ণব! পাঁচ হাজার টাকা লস্!

প্রত্যেক দানে সে মিজুর শাফলের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। কিন্তু, কোনও কাজ হয়নি।

অর্ণব হঠাৎ বুঝতে পারলো, মিজু কোনও একটা কারসাজি করছে, যা ও ধরতে পারছে না।

কৌশল পরিবর্তন করলো অর্ণব। আগের মতোই মিজুর শাফলের দিকে মনোযোগ দিলো সে। তবে, যে তাসটাকে কুইন বলে মনে হলো, সেটা বাছাই না করে অন্য দু’টো তাস থেকে একটা বাছাই করলো।

মিজু সত্যিই কারসাজি করলে এই কৌশলে অর্ণবের জেতার সম্ভাবনা ৫০%।

নতুন কৌশলে চার দান খেললো সে। দুই দান জিতলো আর দুই দান হারলো।

হঠাৎ অর্ণবের মাথায় একটা নতুন আইডিয়া এলো। এতক্ষণ ও ধরে নিয়েছে মিজু বাম হাত থেকে কুইনটাকে প্রথমে টেবিলে রাখে, কারণ উপুড় করে দু’টো তাস ধরলে কুইনটা নিচে থাকে। তাছাড়া, বগা যখন খেলছিলো, তখন কুইনটা প্রথমে টেবিলে রাখা হচ্ছে ধরে নিলে হিসেব মিলে যাচ্ছিলো।

এখন যেহেতু হিসেব মিলছে না, তাই ধরে নেয়া উচিত হাতের কারসাজিতে কুইনের বদলে টেক্কাটাকে প্রথমে টেবিলে রাখা হচ্ছে। অর্ণবের ধারণা, তর্জনির সাহায্যে খুব দ্রুত কাজটা করা হচ্ছে বলে কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো এই কারণেই তাস দু’টো ধরার সময় মধ্যমা আর অনামিকা ব্যবহার করা হচ্ছে, তর্জনিকে ফ্রি রাখা হচ্ছে।

পরের দুই দানে নতুন হিসাব ব্যবহার করলো অর্ণব। দু’টো দানই জিতলো সে। এখনও চার হাজার টাকা লসে আছে ও।

হঠাৎ বগা ‘পুলিশ’ বলে চিৎকার করে উঠলো। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ডানে তাকালো অর্ণব। রাফিও ঘুরে দেখলো। কোনও পুলিশ চোখে পড়লো না।

এদিকে ‘পুলিশ’ কথাটা শুনেই তাস তিনটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে মিজু। কার্ডবোর্ড বক্সটা ফোল্ড করার চেষ্টা করছে।

‘খেলা বন্ধ করছেন কেন?’ রাফির কণ্ঠে রাগ। ‘কোনও পুলিশ তো দেখা যাচ্ছে না। অর্ণব জিততে শুরু করেছে বলে কেটে পড়তে চান?’

‘জুয়া খেলে ধরা পড়লে পুলিশ কী করে জানো?’ পাল্টা প্রশ্ন মিজুর।

আবার ‘পুলিশ’ বলে চিৎকার করে দৌড়ে পালাতে শুরু করলো বগা। মিজু দৌড়াতে শুরু করার আগেই তাকে ধরে ফেললো রাফি।

‘অর্ণব, ধর্ ব্যাটাকে।’ রাফি একা মিজুকে ধরে রাখতে পারছে না।

‘বাদ দে,’ বললো অর্ণব। ‘এসব গণ্ডগোল আমার ভালো লাগে না।’

রাফির হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলো মিজু। কার্ডবোর্ড বক্সটা ফেলেই পালাচ্ছে সে। রাফি তার পিছু ধাওয়া করলো, অর্ণবের নিষেধ শুনলো না।

বামে ঘুরে দু’জনই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে বাসার পথ ধরলো অর্ণব।

(৩)

Google করে জানা গেল খেলাটার নাম ‘থ্রি-কার্ড মন্টি’।

চার হাজার টাকা হেরেও নিজেকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে অর্ণবের। কারসাজি ধরতে না পারায় প্রথমদিকে খেলাতে ওর জয়ের সম্ভাবনা ছিলো ০%। দ্বিতীয় কৌশলে ওর জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে হলো ৫০%। সম্পূর্ণ কারসাজি ধরতে পারায় সবশেষে ওর জয়ের সম্ভাবনা হয়ে গেল ১০০%।

মিজু খেলা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলো। সন্দেহ নেই, বগা ছিলো তার সহযোগী।

সাড়ে চারটা বাজে। অর্ণবের ক্ষুধা লেগেছে। কলেজ-ক্যান্টিনের হাল্কা লাঞ্চ কতক্ষণ পেটে থাকে? মা ঘুমাচ্ছে। কাজের বুয়া ছাদে গেছে কাপড়-চোপড় আনতে, ঘণ্টাখানেক হাওয়া খেয়ে নামবে। ড্রাই কেকের প্যাকেট খুললো অর্ণব।

ঘর্মাক্ত কলেবরে রাফি এসে হাজির হলো, উদ্ভ্রান্ত চেহারা। ওর এই অবস্থা দেখে অবাক হলো অর্ণব। সোফায় বসে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেলো রাফি।

‘দোস্ত, আমি মিজুকে মেরে ফেলেছি,’ বললো সে।

‘কী বলছিস!’ অর্ণবের মনে হলো ও ভুল শুনেছে।

জানা গেল, ঘটনা সত্যিই গুরুতর। নাজিরের পুল পানির ট্যাংকের কাছে মিজুকে আবার ধরে ফেলে রাফি। মিজু পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে। রাফি একটা আধলা ইট হাতে তুলে নেয়। মিজু ওর গলা লক্ষ্য করে ছুরি চালায়। আঘাতটা এড়িয়ে রাফি তার কপালে ইট দিয়ে বাড়ি মারে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিস্তেজ হয়ে যায় মিজু।  

দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে আসছিলো রাফি। হঠাৎ বগা হাজির হয়। মিজুর নাড়ি চেক করে চিৎকার করে বলে, ‘তুই মিজু ভাইকে মেরে ফেলেছিস।’ মিজুর ছুরিটা কুড়িয়ে নিয়ে রাফিকে ধাওয়া করে সে, তবে ধরতে পারেনি।

‘দোস্ত, পুলিশ আসার আগেই আমাকে এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে,’ বললো রাফি।

‘বোকার মতো চিন্তা বাদ দে,’ বললো অর্ণব। ‘তোর উচিত নিজেই পুলিশে খবর দেয়া। তোকে কেউ খুনি হিসেবে দেখবে না। মিজুর হাতে ছুরি ছিলো।’

‘পুলিশের কাছে যেতে বলিস না। পুলিশ ছুঁলে উনিশ ঘা। আমার লাখ খানেক টাকা দরকার, কিছুদিন পালিয়ে থাকবো। মা’র কাছে চেয়েছিলাম, মাত্র বিশ হাজার দিতে পারলো। তুই বাকি টাকাটা ম্যানেজ করে দে, আমি পরে শোধ করে দিবো।’

‘টাকা লাগলে দেয়া যাবে। আগে দেখা দরকার মিজু সত্যিই মারা গেছে কিনা। একটু দাঁড়া, আমি রেডি হয়ে আসি।’

পাঁচটার দিকে নাজিরের পুল এলাকায় পৌঁছালো ওরা দু’জন। পকেট থেকে একটা ছুরি বের করলো রাফি।

‘কী রে, ছুরি দিয়ে কী করবি?’ জিজ্ঞেস করলো অর্ণব।

‘তোর “বগা” এখনও আশপাশে থাকতে পারে।’

‘এ রকম ছুরি তো আমাদের বাসায়ও আছে। তুই কি আমাদের কিচেন থেকে ছুরিটা নিয়েছিস? আমি যখন রেডি হতে গেছি?’

‘আরে নাহ,’ বললো রাফি। ‘ছুরিটা আমাদের।’

পানির ট্যাংকের কাছে এসে অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকালো রাফি। মিজুর কোনও চিহ্ন নেই।

‘নিশ্চয়ই বগা লাশ নিয়ে গেছে,’ বললো সে।

‘বগা কেন লাশ নিয়ে যাবে? ওর তো পুলিশে খবর দেয়ার কথা! হয়তো জ্ঞান ফিরে পেয়ে চলে গেছে মিজু। কিন্তু, ইটটা কোথায়? যেটা দিয়ে মিজুকে বাড়ি মেরেছিস?’

অনেক খুঁজেও ইটটা পাওয়া গেল না।

অর্ণবের হঠাৎ মনে হলো পুরো ব্যাপারটা রাফির সাজানো। কলেজে ভর্তি হবার পর ছেলেটার সাথে ওর পরিচয় ও বন্ধুত্ব। এক বছরে একটা ছেলে সম্পর্কে কতটুকু জানা যায়?

বগার মতো রাফিও মিজুর সহযোগী নয় তো? কলেজ থেকে হেঁটে বাসায় যাওয়ার আইডিয়াটা রাফির। ওকে জুয়া খেলার উৎসাহটাও সে-ই দিয়েছে। এখন আবার মিজুকে খুন করার কথা বলে টাকা চায়!

‘তুই কি পুরো ঘটনা বানিয়ে বলেছিস? টাকা পাওয়ার জন্য?’

রেগে গেল রাফি। বললো, ‘তাহলেও তো একটা ইট এখানে রেখে যেতাম, তাই না?’  

‘হয়তো ভেবেছিস আমি এখানে চেক করতে আসবো না।’

রাগে কোনও কিছুই বলতে পারছে না রাফি। অবশেষে বললো, ‘তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তুই যা।’

কথা না বাড়িয়ে বাসার পথ ধরলো অর্ণব।

(৪)

সন্ধ্যা সাতটায় মিজুর ছুরিবিদ্ধ লাশ খুঁজে পেলো পুলিশ। পানির ট্যাংক থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে একটা খালি প্লটে পড়ে আছে লাশটা।

পুলিশে খবর দিয়েছে নাজিরের পুল এলাকার এক চায়ের দোকানদার। তাকে লাশের কথা জানিয়েছে এক পাতাকুড়ানি বুড়ি।

এস.আই. হান্নান তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন।

ঘটনাস্থলেই গ্লাভস পরা হাতে লাশটি ভালো করে পরীক্ষা করলেন তিনি। পেটে বিঁধে রয়েছে একটা কিচেন নাইফ, কালচে হাতল। দেখে মনে হচ্ছে হাতলটা পরিষ্কার করা হয়েছে। কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট রয়েছে বলে মনে হয় না। তারপরও ছুরিটা একটা জিপলক ব্যাগে ভরলেন তিনি।

শার্ট আর প্যান্টের পকেট চেক করে কোনও মোবাইল বা টাকাপয়সা পাওয়া গেল না। তবে, ভিকটিমের এন.আই.ডি. পাওয়া গেল। জানা গেল, ছেলেটার নাম মিজু আহমেদ, বয়স চব্বিশ।

লাশের কপালে দু’টো আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। একটা মাঝামাঝি জায়গায়, আরেকটা ডানপাশে। দু’টোই ইট বা এ জাতীয় কোনও কিছুর আঘাতে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

এস.আই. হান্নানের নির্দেশে পুরো প্লট খুঁজলো দু’জন কনস্টেবল। একটা লালচে আধলা ইট পাওয়া গেল, হাল্কা দাগ লেগে আছে, রক্তের দাগ বলেই মনে হচ্ছে।

কপালের ক্ষতচিহ্ন দু’টি আবার পরীক্ষা করলেন হান্নান। মাঝের ক্ষতটির আশেপাশে সূক্ষ্ম লালচে কণা লেগে আছে। ক্ষতটি এই ইটের আঘাতেই হয়েছে বলে মনে হলো তার। পোস্ট মর্টেম করলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। ইটখানা অন্য একটা জিপলক ব্যাগে ভরলেন তিনি। 

ডানদিকের ক্ষতটির চারপাশে বাদামি কণা লেগে আছে। এই ক্ষতটি লালচে ইটের আঘাতে হয়নি।

পুরো প্লট আবার তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। কোনও বাদামি রঙের ইট বা অন্য কিছু পাওয়া গেল না।

রাতেই মিজুর বাসা আর আশেপাশের এলাকায় খোঁজখবর নিলেন হান্নান। জানতে পারলেন, মিজু প্রায়ই নানা এলাকায় তিন তাসের আসর বসাতো। তার সহকারীর নাম হেলাল। সে পলাশপুর সরকারী কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।

সন্দেহভাজন হিসেবে হেলালকে তার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হলো। তার কাছে একটা ছুরি পাওয়া গেল। সে জানালো, ছুরিটা মিজুর।

হেলালের মায়ের সাথে কথা বলে এবং বাসার কিচেনটা চেক করে হান্নানের মনে হলো, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরিটা এখান থেকে নেয়া হয়নি।

থানায় হান্নানের কঠিন জেরার মুখে হেলাল স্বীকার করলো, মিজুর জুয়ার আসরে সে সহযোগিতা করতো। তবে, খুনের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করলো সে। অর্ণবের জুয়া খেলা আর রাফির পরবর্তী কার্যকলাপ বিস্তারিত জানা গেল তার কাছ থেকে।

‘রাফি মিজু ভাইকে খুন করেছে,’ বললো হেলাল। ‘আমি নিজের চোখে দেখেছি।’

‘কোথায় খুন করেছে?’

‘নাজিরের পুলের একটা খালি প্লটে।’

‘থানায় খবর দাওনি কেন?’ এসআই হান্নানের জিজ্ঞাসা।

হেলাল জানালো, মিজুর ছুরিটা তুলে নিয়ে রাফিকে সে ধাওয়া করেছে। অনেক দূর ধাওয়া করেও ধরতে পারেনি। এরপর সে আর ফিরে যায়নি, কারণ লাশের কাছে ওকে দেখলে লোকজন মনে করতে পারে ও-ই খুনি। পুলিশেও খবর দেয়নি, কারণ জুয়া খেলায় ওর সংশ্লিষ্টতা পুলিশ জেনে ফেলবে।

‘অর্ণব আর রাফিকে কতদিন ধরে চেনো?’ হান্নান জানতে চাইলেন।

‘চেহারা পরিচিত হলেও নাম জানতাম না। গতকাল জুয়া খেলার সময় ওদের কথাবার্তা শুনে নাম জেনেছি।’

পরদিন সকালে হেলালকে সাথে নিয়ে কলেজের গেটে অপেক্ষা করলো পুলিশ। অর্ণব রিকশা থেকে নামতেই হেলালের ইশারা পেয়ে তাকে গ্রেফতার করা হলো।

রাফিকে পাওয়া গেল না। অর্ণবের কাছ থেকে রাফির মোবাইল নাম্বার নিয়ে কল দিলেন হান্নান। নাম্বারটা বন্ধ। ছেলেটার বাসায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গতকাল সন্ধ্যা থেকে সে লাপাত্তা। মায়ের কাছ থেকে বিশ হাজার টাকা নিয়ে গেছে।

রাফির ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র জব্দ করা হলো ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করার জন্য।  

অর্ণবের বাসায় গিয়ে তার মা আর কাজের বুয়ার সাথে কথা বললেন হান্নান। জানতে পারলেন, কালচে হাতলের একটা কিচেন নাইফ পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো এটাই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি, ভাবলেন তিনি।

(৫)

বেলা বারোটায় হান্নান অর্ণবকে জেরা করতে শুরু করলেন।

‘তুমি গতকাল মিজুর সাথে জুয়া খেলেছো?’

‘থ্রি-কার্ড মন্টিকে জুয়া না বলে লটারি বলা যায়।’

‘থ্রি-কার্ড মন্টি আবার কী?’

‘তিন তাসের খেলা, যেটা গতকাল খেললাম। আপনারা এটাকে কী বলেন?’

‘তিন তাসের খেলা,’ বলে হাসলেন হান্নান।

‘তিন তাসের পোকারকে তাহলে কী বলেন?’

‘থ্রি-কার্ড।’ আবার হাসলেন হান্নান। এবার অর্ণবও যোগ দিলো হাসিতে।

‘কত টাকা হেরেছো?’ হান্নানের জিজ্ঞাসা।

‘চার হাজার টাকা।’

‘নিশ্চয়ই মিজুর উপর অনেক রাগ হয়েছে?’

‘অনেক না, অল্প রাগ হয়েছে।’

‘তাহলে খুন করলে কেন?’

‘আমি খুন করিনি। অ্যারেস্ট হবার পর জানতে পেরেছি সে খুন হয়েছে।’

‘তোমাদের বাসার কিচেন নাইফ খুনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।’

ভ্যাবাচ্যাকা খেলো অর্ণব। ভাবলো, রাফি তাহলে ছুরিটা আমাদের বাসা থেকে নিয়েছে! মিথ্যে কেন বললো সে? আমি রাগ করবো বলে?

‘যদি ছুরিটা আমাদের হয়েও থাকে, সেটাতে আমার হাতের ছাপ নেই।’

‘কেন, গ্লাভস পরে নিয়েছো?’                  

‘ছুরিটা আমি কখনও ধরিনি। আপনার কী মনে হয়? আমি গ্লাভস পরেছি, যাতে ধরা না পড়ি – কিন্তু, নিজের বাসার ছুরি ব্যবহার করেছি, যাতে ধরা পড়ি?’

হান্নান কিছু বললেন না। ছেলেটার কথায় যুক্তি আছে।

‘আপনি শিওর আমাদের ছুরিতেই খুন হয়েছে?’ অর্ণবের জিজ্ঞাসা।

‘তোমাদের ছুরিটাই লাশের গায়ে পাওয়া গেছে।’

হান্নান একটু কায়দা করে অর্ণবের প্রশ্নটার উত্তর দিয়েছেন। আসলে তিনি এখনও জানেন না কোন্ অস্ত্রের আঘাতে মিজুর মৃত্যু হয়েছে – লালচে ইট, বাদামি ইট, না কিচেন নাইফ। একে বলা যায় রিয়েল লাইফের থ্রি-কার্ড মন্টি, ভাবলেন তিনি।

পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট পেলে জানা যাবে কোন্ blow-টা death blow ছিলো। এটা জানা জরুরী। কারণ, ডেথ ব্লো-টা যার, সে-ই খুনি।

‘এখনও স্বীকার করবে না, ছুরিটা তুমিই ব্যবহার করেছো?’ হান্নানের কণ্ঠে বিরক্তি।

রাফিকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে নিজে ফেঁসে যেতে হবে, ভাবলো অর্ণব। গতকালের পুরো ঘটনা খুলে বললো সে।

‘রাফিকে না পেলে তোমার কথার সত্যতা যাচাই করা মুশকিল,’ বললেন হান্নান। ‘ও পালিয়ে কোথায় গিয়েছে, জানো?’

‘আমি জানি না।’

‘বাসায় না বললেও বন্ধুকে তো বলে যাওয়ার কথা।’

‘আমাকে কিছু বলেনি। টাকা ধার চেয়েছিলো, দেয়া হয়নি।’

‘তোমাদের বাসার ছুরিটা রাফি নিয়েছে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন।’

‘রাফি যে মিজু ভাইকে ধাওয়া করেছে, এটা নিশ্চয়ই অনেকে দেখেছে?’

‘তুমি, রাফি আর হেলাল – তোমরা তিনজনই কলেজ ইউনিফর্ম পরে ছিলে। দূর থেকে বোঝা মুশকিল কে ধাওয়া করলো, কে করলো না।’

‘আপনি কি আমাদের তিনজনকেই সন্দেহ করেন?’

‘সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? তোমাদের তিনজনেরই মোটিভ আছে। তুমি চার হাজার টাকা হেরেছো, রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। রাফি তোমার অতি উৎসাহী বন্ধু, সেও নিশ্চয়ই রেগেছে মিজুর উপর। হেলালের সাথেও মিজুর ঝগড়া হয়ে থাকতে পারে টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে।’

তিনজনের মধ্যে একজন খুনি – এটাও রিয়েল লাইফের থ্রি-কার্ড মন্টি, ভাবলেন হান্নান।

(৬)

দুপুরে জানা গেল, আধলা ইটে রাফির বুড়ো আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। ছুরিতে কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই। এই দু’টি অস্ত্রের আঘাতে মিজুর মৃত্যু হয়নি। কপালের ডানদিকের আঘাতটাই ছিলো ডেথ ব্লো।

তার মানে, বাদামি ইট হলো আসল অস্ত্র, যা এখনও উদ্ধার করা যায়নি। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল হান্নানের।

এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যগুলি মনে মনে যাচাই করতে শুরু করলেন তিনি।

হেলাল আর অর্ণবের বক্তব্য অনুযায়ী, মিজুকে প্রথম আঘাত করেছে রাফি। নিশ্চয়ই সেটা লালচে ইট দিয়ে। কারণ, প্রথমেই বাদামি ইটের আঘাতে মিজুর মৃত্যু হলে দ্বিতীয় ইটের আঘাত দরকার হতো না। আবার, রাফি ছুরিটা প্রথমে ব্যবহার করলে হেলাল নিশ্চয়ই বলতো।

হেলাল বলেছে, রাফির আঘাতের পর সে নাড়ি চেক করে দেখেছে মিজু মারা গেছে। তার কথা সত্যি হলে রাফি মিজুকে লালচে ইট দিয়ে আঘাত করার পর বাদামি ইট দিয়েও আঘাত করেছে। কিন্তু, দু’টো আঘাতের মাঝে কেউ ইট বদল করে?

রাফি যদি দু’টো ইট দিয়ে আঘাত করেও থাকে, একটা ইট লুকিয়ে আরেকটা কেন সে ঘটনাস্থলেই রাখবে?

নিশ্চয়ই হেলাল মিথ্যা বলেছে!

তাহলে অর্ণব সত্য বলেছে। রাফি পানির ট্যাংকের কাছে মিজুকে আঘাত করেছে, খালি প্লটে নয়।  

ধীরে ধীরে হান্নানের মনে বিচ্ছিন্ন তথ্যগুলোর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দাঁড়িয়ে গেল:

“পানির ট্যাংকের কাছে রাফি মিজুকে ধরে ফেললো। লালচে ইট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করলো। হেলাল এসে মিজুর নাড়ি চেক করে খুনের মিথ্যা অভিযোগে রাফিকে ধাওয়া করলো। এদিকে মিজু জ্ঞান ফিরে পেলো। হেলাল ফিরে আসার পর দু’জনে খালি প্লটে গিয়ে বসলো। টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দু’জনের বাদানুবাদ হলো। একটা বাদামি ইট দিয়ে মিজুর কপালে আঘাত করলো হেলাল। মিজু মারা গেল। বাদামি ইট দূরে কোথাও ফেলে দিলো হেলাল। এরপর রাফির ব্যবহার করা লালচে ইট নিয়ে এসে লাশের কাছাকাছি ‘লুকিয়ে’ রাখলো। রুমাল বা এরকম কিছু ব্যবহার করলো, যাতে লালচে ইটে নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট না পড়ে।

অর্ণবের সাথে এসে রাফি মিজুর লাশ খুঁজে পেলো না। অর্ণব চলে যাবার পর আরও খুঁজে লাশটা পেলো রাফি। অর্ণবকে ঝামেলায় ফেলতে কিচেন নাইফটা লাশের গায়ে বিঁধিয়ে দিলো।”

চেষ্টা করেও আর কোনও যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারলেন না হান্নান। মুশকিল হলো, হেলাল সাংঘাতিক ধুরন্ধর। তাকে দিয়ে দোষ স্বীকার করানো এত সহজ হবে না।  

ভেবে-চিন্তে একটা উপায় বের করলেন হান্নান। হেলালকে আবার জেরা করার জন্য নিয়ে আসা হলো। দু’জন এ.এস.আই.-কে সাক্ষী হিসেবে পাশে রাখলেন হান্নান।

‘তুমি নিজের চোখে দেখেছো রাফি মিজুকে ইট দিয়ে আঘাত করেছে?’ হেলালকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘জী, স্যার।’

‘একবার আঘাত করলে তো সাধারণত কেউ মারা যায় না। রাফি কয়বার আঘাত করেছিলো মিজুকে?’

‘দুইবার।’

‘আস্ত ইট দিয়ে, না আধলা ইট?’

‘আধলা ইট।’

‘প্রথমবার আঘাত করার পর আধলাটা ভেঙে যায়নি?’

‘না, স্যার।’

‘আধলাটা তাহলে মজবুত ছিলো? রাফি দুইবার আঘাত করতে পেরেছে?’

‘জী, স্যার।’

হেলালকে প্রচণ্ড ধমক দিলেন হান্নান। তারপর ব্যাখ্যা করলেন আসল ঘটনা।

হেলালের স্বীকারোক্তি পেতে কষ্ট হলো না। ঘটনা সম্পর্কে হান্নানের অনুমানই ঠিক।

মিজুর সাথে হেলালের বাদানুবাদের কারণটাও জানা গেলো। হেলাল ‘পুলিশ’ বলে চিৎকার করে খেলা বন্ধ করেছিলো ঠিকই, কিন্তু দেরি করে ফেলেছিলো। দুই দান আগেই মিজু খেলা বন্ধের ইশারা দিয়েছিলো, যা সে লক্ষ্য করেনি। খালি প্লটে বসে টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করার সময় শেষ দুই দানের এক হাজার টাকা লস্ মিজু শেয়ার করতে চায়নি।

(৭)

জীবনে আর জুয়া খেলবে না, এই শপথ করিয়ে অর্ণবকে ছেড়ে দেয়া হলো।

থানা থেকে বের হয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে সে। হঠাৎ তার মনে হলো, পালিয়ে গিয়ে থাকলে রাফি কেন কাউকে কিছু বলে গেল না!

ওকেও হেলাল মেরে ফেলেনি তো?

এমন তো হতে পারে: “রাফি যখন মিজুর লাশ খুঁজে পেয়েছে, তখন হেলাল আশেপাশেই ছিলো। রাফিকে মেরে লাশটা লুকিয়ে ফেলেছে সে, যাতে সবাই মনে করে রাফি মিজুকে খুন করে পালিয়েছে। মিজুর লাশে কিচেন নাইফটা হেলালই বিঁধিয়েছে।”

ওর কি পুলিশকে বলা উচিৎ? যদি জানা যায় রাফি সত্যিই আর নেই, নিজেকে অর্ণব ক্ষমা করতে পারবে না। কারণ, রাফিকে মিজুর লাশের খোঁজে ও-ই নিয়ে গিয়েছিলো।

রাফির মা আশা করে আছে ছেলে একদিন ফিরে আসবে – সেই আশা এক মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে!

অর্ণব ফাঁকা দৃষ্টিতে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।

(শেষ)

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪

জাফর আহমেদ খান

প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪