fbpx

নৈরাত্রি (পর্ব ১)

সমস্ত ঘরে অন্ধকার ছেয়ে আছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে খুব। ঝুমঝুম শব্দ বুকের মাঝে আঘাত করে চলেছে যেন। নিতিস সেন তার হাতের সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটিকে ফেলে দিতে যে কয়েক ছটাক আলো ছিল তার ঘরে তাও ফুরিয়ে যায়। তার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। ইস! কেউ যদি এক কাপ চা এনে দিত। কিন্তু সেটুক সৌভাগ্য থেকেও যে সে বঞ্চিত। কতদিন হয়ে গেছে ইলাকে সে দেখে না। শেষ কবে ইলার সাথে এই ঘরে বসে গল্প করতে করতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে তাও মনে নেই।

আকাশ মাঝে মাঝেই হুংকার দিয়ে উঠছে। একেকটা বজ্রপাত যেন ধরণীর রাগ হয়ে তার উপর আছড়ে পরছে। কিন্তু কেন ধরণীর তার উপর এত রাগ? নিতিস সেন পেশায় ব্যাংকার। ব্যাংকে চাকরি করে জীবনের অনেকখানি পথ অতিক্রম করে এখন বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। । কখনো ঘুষ এর ধারের কাছেও নিজেকে ঘেষতে দেয় নি। এই সৎ থাকা কি কখনো ভুল হতে পারে? আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় নিতিস। মোবাইলের আলো ফেলে। কপালে ঘাম জমে আছে, চুলগুলিও এলোমেলো হয়ে কপালের উপরে এসে পড়েছে। গালে কীসের যেন দাগ, চোখগুলি কোটরের ভেতর ঢুকে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়ে আছে। আলো জ্বালার পর হঠাৎ করে গরম যেন আরও বেশি লাগছে। সমস্ত শরীর থেকেই ঝরঝর করে ঘাম ঝরতে আরম্ভ করেছে। নিতিস মোবাইলের লাইট অফ করে।

রাত নয়টা বাজছে। অপু আর খেয়াকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আরেকবার ফোন কি দিবে সে? সে জানে এখন এদের কারোরই আর তার সাথে যোগাযোগ এর সুযোগ নেই। কোর্ট কি একজন বাবার অধিকার কাড়তে পারে? ইলাই হয়ত দিচ্ছে না তাদের কথা বলতে। কিন্তু তাদেরও তো কথা বলার ইচ্ছা করে। তারা কি একটাবারের জন্য পারে না মাকে রাজি করিয়ে ফোন দিতে? কিছু প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় কখনই মিলবে না। কখনই না। নিজের মনে এই কথাগুলি বলতে বলতেই নিতিস সেন হেঁটে যেতে থাকে অপুর ঘরের দিকে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। মোবাইল জ্বালাতে কেন জানি ইচ্ছা করছে না তার। অন্ধকারটাই থাকুক জীবনে। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেন বাড়ি লেগে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। চোখ থেকে চশমা খুলে পড়ে। কিছুক্ষণ অন্ধকারেই হাতড়ে যখন চশমা খুঁজে পায় না তখন নিজের মনেই খিলখিল করে হেসে উঠে নিতিস সেন।

বাইরে বৃষ্টি বেড়েছে। ঝড় তুফান শুরু হয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়। বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছে তার। কিন্তু রান্নাঘরে গিয়ে খাবার খুঁজবে সে ইচ্ছে নেই আর। অবশ্য বুয়ার বানানো খাবার খেতেও মন চাচ্ছে না। ইলার হাতের রান্না যদি খেতে পারতো! প্রায় দুই মাস হয়ে গেল। হুট করে বাসার দরজায় ধাক্কা লাগার মতন শব্দ হয়। কে এসেছে ইলা? নিতিস জোরে জোরে চিৎকার করে উঠে। ইলা! এই ইলা নাকি? তুমি এসেছ শেষমেশ? আমি এক্ষুনি দরজা খুলছি। একটু দাঁড়াও। হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে সে। কেউ নেই। না, তার বিশ্বাস হয় না। সে মোবাইল এর আলো জ্বালে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিচে গিয়ে দেখতে থাকে। বার বার ডাকতে থাকে ইলার নাম ধরে। কিন্তু আর কোন সাড়া পাওয়া যায় না। শুধু একাধারে বৃষ্টির শব্দই বাজতে থাকে কানে। সেই শব্দ যেন শুন্যতা আরও বাড়িয়ে দেয়। সে অবশ্য নিজেও জানে ইলা আসে নি। মাঝে মধ্যেই  ঝড় বাদলার দিনে এমন হয়। তবুও কেন সে আজ এমন করছে সে জানে না। ইলা তুমি তাহলে আসলে না? কেন তুমি আসবে না? আমি কি আর কেউ না?  

ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যায় একসময়। অনেক খুঁজে একটি মোমবাতি জোগাড় করে সে। মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই আলোতে নিজের ঘরে এসে বসে। আচ্ছা আজকের তারিখ কত? এখন কি জুন মাস? কিছুই তার মাথায় আসছে না। ইলার জন্মদিন যেন কবে? এই বছরের শুরুতে কত প্ল্যান করে বসেছিল সে! অপু আর খেয়ার সাথে কত আলোচনা। কীভাবে কীভাবে জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিবে, ইলার পছন্দের কোন দোকান থেকে কেক কিনে আনবে, কী কী উপহার দিবে। এগুলি ভেবে সে হাসতে থাকে। মন ভীষণ খারাপ। তবুও নিজের উপর হাসি পাচ্ছে। কেন হাসি পাচ্ছে সে জানে না। সে হুট করে কলম খুঁজতে আরম্ভ করে।

পড়ার টেবিলের উপর থেকে শুরু করে ড্রেসিং টেবিল, বিছানার আশেপাশে সব জায়গায় খুঁজে। কোথায় কলম আছে কে জানে! যেকোনো কিছু খুঁজে না পেলেই ইলাকে ডেকে সেটা খুঁজে দিতে বলার অভ্যাসটা এখনো যায় নি। নিজ থেকে কখনো সে কিছু খুঁজে বের করতে পারে নি।

না, কোথাও কোন কলম না পেয়ে শেষমেশ পেন্সিল হাতে নিয়ে লিখতে বসে সে। তার সামনে যে এক টুকরা খসড়া কাগজ পরে আছে সেটাই হাতে নেয়। বেশ কিছু সময় খচখচ করে তারপর লিখতে শুরু করে,” আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।” আবার দরজায় শব্দ হয়। সে হন্তদন্ত হয়ে দৌড় দেয়।

                                                                                           *****

বেলা দশটা বেজে গেছে প্রায়। ইন্সপেক্টর রাকিব থানায় তার চেয়ারে বসে আছে। সাব ইন্সপেক্টর ফজলুর সাহেব তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। উনার এক হাতে চায়ের কাপ আরেক হাতে পিরিচ। উনি কাপ থেকে চা ঐ পিরিচে ঢেলে কিছুক্ষণ পর পর সুড়ুৎ করে শব্দ করে খেয়ে যাচ্ছেন। তার সামনে খবরের কাগজ খোলা। খবরের কাগজের দিকে মন নেই। কারণ এক লোক এসেছে জিডি করতে। এসব কাজের জন্য থানায় তার নিচে আরো একজন অফিসার আছে। কিন্তু আজকে সে না আসার কারণে রাকিবকেই এগুলি সামাল দিতে হচ্ছে। এই ছোটখাটো কাজগুলি যদি এখনো তাকেই করতে হয়! বেশ অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাই তাকে কথা বলতে হচ্ছে লোকটির সঙ্গে।

তো আপনার নাম কী বললেন?

মুবিন। মুবিন রহমান।

নিখোঁজ ব্যক্তি আপনার কে হন?

জি, আমার প্রতিবেশী।

সে কী! উনি কি অবিবাহিত? পরিবারে কি কেউ নেই?

জি, মানে আছে আবার নেই। মানে স্যার উনার পরিবারের কেউ আসলে উনার সাথে থাকেন না এখন। 

পুরো ঘটনা খুলে বলুন। এভাবে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিসসা শুনতে ভাল্লাগছে না।

জি, উনার নাম নিতিস সেন। উনি সরকারি একটা চাকরি করতেন। প্রায় দুই মাস হইল উনার চাকরি নাই। বোধ হয় এই কারণেই পোলা মাইয়া নিয়া বউ বাপের বাড়ি চইলা গেছে। তারপর থেকে তিনি একলা। বাসার থেকে বেরই হন না বলতে গেলে।

বের হন না মানে? বাজার সাজার করার প্রয়োজন হয় না নাকি?

না মানে একটা বুয়া রাখসেন। ঐ বুয়াই কাজ টাজ কইরা দেয়।

তো নিখোঁজ যে হলেন বুঝলেন কীভাবে?

আজকে সকালে দেখলাম উনার বাসার দরজা খোলা। কিন্তু উনি ভিতরে নাই। পুরা বাসা খুঁইজাও পাইলাম না উনারে।

আরে কী অদ্ভুত মশাই! মানে এই অল্প সময়েই চলে এলেন? উনি হয়ত বাইরে হাঁটতে বেড়িয়েছেন। দরজা আটকাতে ভুলে গেছেন। হয়ত এখনি গিয়ে দেখবেন উনি নিজের ঘরে।

না মানে আপনি বুঝছেন না আসলে। মানে উনি একেবারেই ঘর থেকে বের হন না। গত দুই মাসে তার চেহারাও দেখি নাই।

সে যাই হোক ২৪ ঘণ্টা পার হোক তারপর দেখা যাবে। আমাকে কল দিবেন।

জি আচ্ছা। আমি উঠি।

মুবিন বাবু চলে যাবার পরেই ফজলুর সাহেব আয়েস করে চায়ের পিরিচে শেষ চুমুক দিয়ে কাপ আর পিরিচ টেবিলে রাখলেন। তারপর বলতে আরম্ভ করলেন।

বুজসেন স্যার? মাইনসের এহন কাইম কাজের এত্ত অভাব। কিসু একটা হইতে না হইতেই মাতা গরম কইরা আইয়া পরে।

হুম।

স্যার আপ্নের লেইগা পান সিগারেট কিসু আইনা দিমু? চা নিয়া আসি?

জি না। আপাতত চুপ থাকেন।

                                                                                                 *****

কী নিতিসবাবু? বেশ শীতল এক কণ্ঠ ভেসে আসে।    

খুল আমাকে, কোথায় এনে বন্দি করসস? শালা হারামজাদা! খুল।

সুসস, চুপ করে থাক, একদম চুপ। মাত্রই তো তুমি চোখ খুললে। এখনো আতিথেয়তার অনেকটুকুই যে বাকি। খুবই ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলতে থাকে সে কণ্ঠ। 

আমার হাত পা খুল, খুল বলছি!

গালি দিচ্ছ দাও, তবে এতো ঘামছ যে, টিস্যু লাগবে?

আমারে এখানে ক্যান আনসস? ক্যান আনসস এখানে? নিতিস চোখগুলি দেখতে পায় বক্তার, জ্বলজ্বল করছে তার দিকে চেয়ে।  

তোমরা অতিথিদের সাথে কী করো বলো তো?

বলব না আমি, কিচ্ছু বলব না, কী করবি?

বেশ সাহস দেখছি। তা সাহস যদি এতই থাকত এতদিনে সুইসাইডটা করেই ফেলতে। তাই না বলো? প্রণব জোরে জোরে হাসতে শুরু করে কথাটা শেষ করে। 

প্রণব চেয়ার থেকে উঠল। হুইস্কির বোতল থেকে একটু হুইস্কি ঢেলে নিল গ্লাসে। সঙ্গে দুইটা বরফ। পুরো ঘরের মাঝে শুধু একটি বাতি জ্বলছে। হলুদ আভা বিলিয়ে যাচ্ছে। ঘরের পুরোটা জুড়ে আলো না ছড়ালেও বেশ খানিকটা দেখা যায়। সারা ঘরে সব পুরনো আসবাবপত্র। ধুলোবালি আর ভ্যাপসা গরম। ভালো করে তাকালে দেখা যায় পুরো ঘরে কোথাও কোন দরজা নেই, একদম ডান দিক দিয়ে এক সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। দেয়ালে টাঙানো এক ঘড়িতে তিনটা বেজে আছে। ঘড়ি বন্ধ হয়ে আছে দেখলেই বুঝা যায়। এতক্ষণ ঘরে শুধু ধুলোবালির ভেসে বেড়ানো আর পুরানো আসবাব থেকে আসা গন্ধই পাওয়া যাচ্ছিল। এখন সে সাথে ঘামের গন্ধও এসে জুড়েছে। নিতিস ঝরঝর করে ঘামছে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ। হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে প্রণব বলতে শুরু করে।

মাংস পছন্দ কোনটা? গরু নাকি খাসি?

নিতিস চুপ করে থাকে। 

আচ্ছা, আজকে মাংস দিয়েই আপ্যায়ন করব। আমি নিজে রান্না করেছি।

আমারে যাইতে দে।

আহহা, তা তো কোন এক সময় যাবেই। একটু খেয়ে নাও। 

প্রণব এক বাটি রান্না করা মাংস এনে নিতিসের সামনে রাখে। তারপর তার হাত খুলে দেয়। নিতিস অনুভব করতে পারে তার শরীর বেশ অবশের মতন হয়ে আছে। ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে কিনা কে জানে!

সে পানি চায়। পানি এনে দিলে ঘটঘট করে পানিটা শেষ করে। বেশ খিদাও পেয়েছে। সে মাংসের টুকরা হাতে নেয়। কেমন যেন গন্ধ করছে। প্রচণ্ড খিদায় মানুষ পচা বাসি খাবারও খেয়ে ফেলে অনায়াসে। সেখানে এই গন্ধ খুবই তুচ্ছ কিনা! নিতিস খেতে শুরু করে। পেটে ব্যথা করছে চিনচিন করে। অনেকক্ষণ ধরে কিছু খায়নি দেখে গ্যাস্ট্রিক এর পেইন বোধ হয়।

মৃত্যুর যন্ত্রণা পাওয়াও সৌভাগ্যের বিষয় বুঝলা? কিন্তু এক চান্সে পেয়ে গেলে তৃপ্তি কই বলো?   

মানে? নিতিসের আতঙ্কগ্রস্ত গলা শুনতে পাওয়া যায়।          

মৃত্যুর যন্ত্রণা পেতে হয় ধীরে ধীরে। শরীরকে বুঝতে হয় কীভাবে শরীরের প্রতিটা অঙ্গ শরীরকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তুমি সেটা কখনো করতে পারবে না। তাই আমি নিয়ে এসেছি তোমাকে হেল্প করতে। 

প্রণব হাতে করে এক সেলাই মেশিন আর ছুড়ি এনে সামনের টেবিলে রাখে।

***

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি (IUT)

সেশনঃ ২০১৮-২০১৯

হাসিন ইশরাক

সেশনঃ ২০১৮-২০১৯